বুঝতে কষ্ট হয় না চেয়ারের পায়াটার দিকে তাকিয়ে যে, পায়ার সঙ্গে তামার পাতটা বরাবর জড়ানো ছিল না।
শিউশরণের নজর পড়ে কিরীটীর দিকে।
কি দেখছ অমন করে, রায়?
একটা সরু তামার পাত—
তামার পাত! বিস্মিত শিউশরণ পাল্টা প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ। বলতে বলতে কিরীটী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ঘরের এদিক-ওদিক আবার তাকায়।
চোখের শ্যেন অনুসন্ধানী দৃষ্টিটা একসময় ঘুরতে ঘুরতে দরজার পাশেই দেওয়ালের গায়ে যেখানে আলোর সুইচটা তার উপরে গিয়ে নিবদ্ধ হল।
পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল কিরীটী সইটার সামনে দেওয়ালের কাছে।
সাধারণ প্ল্যাস্টিকের সুইচ।
সুইচের উপরের অংশটা কোনো একসময় ভেঙে গিয়েছিল বোধ হয়। খানিকটা অংশ নেই। অথচ আশ্চর্য, জানা গিয়েছে পরশু এ ঘরের আলোটা নাকি খারাপ হয়ে গিয়েছিল, মিস্ত্রীও এসেছিল, তবু ভাঙা সুইচটা বদলানো হয়নি বোঝাই যাচ্ছে।
অন্যমনস্ক ভাবেই কিরীটী সুইচটা টিপল কিন্তু দেখা গেল ঘরের বালটা জ্বলছে না। আবার এগিয়ে গেল কিরীটী ঝুলন্ত বালবটার কাছে এবং তাকিয়ে রইল ঝুলন্ত বালবটার দিকে।
শিউশরণ অবাক হয়ে কিরীটীকে প্রশ্ন করে, কি হল?
সুটকেসটা মাটিতে নামিয়ে রেখে, ঐ চৌকিটা এনে ঐ বালবটা খোল তো শিউশরণ!
কেন হে? হঠাৎ বালবটার কি আবার প্রয়োজন হল?
খোল না বালবটা! যা বলি কর!
শিউশরণ আর কথা বাড়ায় না। কিরীটীর নির্দেশমত চৌকিটা এনে তার উপরে দাঁড়িয়ে বালবটা খুলে কিরীটীর হাতে দিল।
বালবটা হাতে করে একবার ঘুরিয়ে দেখেই গম্ভীর কণ্ঠে আত্মগত ভাবেই যেন কিরীটী মৃদুভাবে বলে, ফিউজ হয়ে গিয়েছে!
কি বললে?
কিছু না!
বলতে বলতে কিরীটী আবার এগিয়ে যায় দেওয়ালের গায়ে সুইচটার সামনে।
সুইচটা নিয়ে আবার নাড়াচাড়া শুরু করে। এবারে হঠাৎ কিরীটীর দৃষ্টিকে আকর্ষণ করে, একটা সরু তারের অংশ সুইচের তলা দিয়ে বেরিয়ে আছে।
এবং সঙ্গে সঙ্গে একটা বৈদ্যুতিক ক্রিয়া ঘটে যায় তার মস্তিষ্কের গ্রে-সেলগুলিতে কম্পন তুলে। চোখের তারা দুটো চচক্ করে ওঠে। ও নিম্নকণ্ঠে বলে, so this is that!
কি হল হে?
পেয়েছি—
কি পেলে?
তামার পাত ও ফিউজ বালবের রহস্য।
হেঁয়ালি গাঁথছ কেন বল তো?
হেঁয়ালি নয় শিউশরণ, সাধারণ সাংকেতিক নিয়ম।
তারপর হঠাৎ আবার কি মনে পড়ায় কথাটা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গেই যেন এগিয়ে গিয়ে ক্ষণপূর্বে রাখা মাটি হতে বইটা হাতে তুলে নিল।
বইটা কিন্তু সাইকোলজি বা সেকসোলজি সংক্রান্ত নয়। শরৎচন্দ্রের একখানা বহুখ্যাত উপন্যাস। চরিত্রহীন।
বইটা হাতে করে অন্যমনস্ক ভাবে বইয়ের পাতাগুলো ওলটাতে লাগল কিরীটী।
অনেক হাতে ঘুরেছে। অনেক হাতের ছাপ বইটার সর্বত্র।
পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে হঠাৎ বইয়ের একটা পাতার মার্জিনে লাল কালিতে বাংলায় লেখা একটি টিপ্পনী নজরে পড়তেই কিরীটীর চোখের দৃষ্টি সজাগ হয়ে ওঠে। মন হয়ে ওঠে সচেতন।
সুন্দর মুক্তার মত ছোট ছোট হরফে গোল গোল লেখা।
কিরণময়ী, দুঃখ করো না। উপীন্দ্র নপুংসক।
ক্ষণকাল স্থির একাগ্র দৃষ্টিতে লাইনটার দিকে তাকিয়ে থাকে কিরীটী। তারপর আবার একসময় বইটার বাকি পাতাগুলো বেশ একটু মনোযোগ সহকারেই উলুটে চলে। কিন্তু আর কোথায়ও কোন টিপ্পনী ওর চোখে পড়ে না।
কি ভেবে কিরীটী চরিত্রহীন বইখানা হাতে নিয়েই পুনরায় সুটকেসটার কাছে এগিয়ে এল। এক এক করে এবারে সুটকেস হতে জামাকাপড়গুলো বের করে পাশে নামিয়ে রাখতে লাগল।
শুধু কাপড়জামা ও বই-ই নয়, নিত্য প্রয়োজনীয় টুকিটাকি অনেক কিছুই সুটকেস হতে বের হয়। এবং শেষ পর্যন্ত একেবারে তলায় পাওয়া গেল বইয়ের আকারে একটা মরোক্কো লেদারে বাঁধানো সুদৃশ্য খাতা।
সাগ্রহে কিরীটী খাতাটা তুলে নিয়ে মলাটটা ওল্টালো।
প্রথম পাতাতেই লেখা: ছিন্নপাতার দল।
তবে নিচে লেখা: অতুল।
মনের মধ্যে একটা কৌতূহল উঁকি দেয়। কিরীটী খাতার পৃষ্ঠাগুলো উলুটে চলে সাগ্রহ উত্তেজনায়। অতুলের ডায়েরী।
কোথাও তারিখ বড় একটা নেই। অসংলগ্ন স্মৃতির পৃষ্ঠাগুলো যেন এলোমেলো ভাবে ছড়িয়ে আছে।
লেখা কখনও ইংরাজীতে, কখনও বাংলায়।
দু-একটা পৃষ্ঠা এদিক-ওদিক থেকে পড়ে কিরীটী।
তারপর একসময় ডায়েরীটা জামার পকেটে ভরে নেয়।
.
আরও কিছুক্ষণ পরে।
কিরীটীর নির্দেশক্রমেই শিউশরণ সকলকে ডেকে আপাতত তার বিনানুমতিতে যেন কাশী কেউ না ত্যাগ করে নির্দেশ দিয়ে ও মৃতদেহের উপরে পাহারার ব্যবস্থা করে সকলে বিদায় নিয়ে ঐ বাড়ি হতে বের হয়ে এল।
৭. সেইদিনই দ্বিপ্রহরে
সেইদিনই দ্বিপ্রহরে।
আহারাদির পর শিউশরণ একটা জরুরী তদন্তে বাইরে বের হয়েছে। সুব্রত একটা নভেল নিয়ে শয্যায় আশ্রয় নিয়েছে।
কিরীটী একটা আরামকেদারার ওপরে একটা বা চুরুট ধরিয়ে ঐদিন সকালে তদন্তের সময় মৃত অতুলের সুটকেসে প্রাপ্ত ডায়েরীটা নিয়ে গভীর মনোযোগের সঙ্গে ডায়েরীর পাতাগুলো উল্টে চলেছে।
এক জায়গায় লেখা:
মাঝে মাঝে ভাবি মণি কি ধাতুতে গড়া! সত্যিই কি ওর মনের মধ্যে কোন নারীমন আছে? না দেহেই শুধু ও নারী! মনের দিক দিয়ে ও নপুংসক! এই দীর্ঘ পরিচয়ের মধ্যে আমাদের তিন পুরুষ বন্ধুর কেউই কি ওর মনে কোন আঁচড়ই কাটতে পারিনি!
.
আবার এক পাতায় লেখা:
বাবা মা এত করে বলছেন বিবাহের জন্য। কিন্তু কেমন করে তাঁদের বলব বিবাহ করলে আমি সুখী হতে পারব না। সমস্ত মন আমার আচ্ছন্ন করে রয়েছে সে। অথচ নিজের মনে নিজেই যখন বিশ্লেষণ করি অবাক হয়ে যাই। কি আছে ওর? রূপ তো নয়ই। ওর মত মেয়েরও বাংলাদেশে অভাব নেই। আচ্ছা ও কি কোন জাদু জানে! নচেৎ এমন করে আমাদের প্রত্যেককে ও আকর্ষণ করে কেন?