না।
এঁদের তিন বন্ধুর মধ্যে সব চাইতে কাকে বেশী ভাল বলে আপনার মনে হত সুবালা দেবী?
অতুলবাবুকেই।
অতঃপর ক্ষণকাল আপন মনে কিরীটী কি যেন ভাবে। তারপর সুবালার দিকে তাকিয়ে বলে, আচ্ছা আপনি যেতে পারেন সুবালা দেবী।
সুবালা ঘর হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেল।
কিরীটী ঘরের মধ্যে নিঃশব্দে পায়চারি করতে শুরু করে।
সুব্রত ও শিউশরণ কেই কোনো কথা বলে না।
মণিকা দেবীকে আর একবার ডাক তো শিউশরণ?
হঠাৎ যেন কি একটা কথা মনে পড়ায় কিরীটী শিউশরণকে কথাটা বললে।
শিউশরণ কিরীটীর নির্দেশমতই মণিকাকে ডাকতে গেল।
মিনিট খানেকের মধ্যেই শিউশরণের সঙ্গে মণিকা এসে ঘরে ঢুকল।
আসুন মণিকা দেবী। আপনাকে আবার কষ্ট দিচ্ছি বলে দুঃখিত। কিরীটী বললে।
মণিকা কিরীটীর কথার কোনো জবাব দিল না। নিঃশব্দে দাঁড়িয়েই থাকে।
আচ্ছা মণিকা দেবী, এইবারের ছুটির মত আর কখনও আগে আপনারা সকলে এই বাড়িতে কি একত্রে এসে কাটিয়েছেন?
কিরীটীর প্রশ্নে মণিকা চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর মৃদুকণ্ঠে জবাব দেয়, হ্যাঁ।
কতদিন আগে?
তিন বছর আগে।
কতদিন সেবারে আপনারা এখানে ছিলেন?
এক মাস প্রায় হবে।
অনেকদিন সেবারে ছিলেন তো?
হ্যাঁ। আমার সেবারে টাইফয়েড হয়, তাই বাধ্য হয়েই বাকী কথাটা আর শেষ করে না মণিকা।
হুঁ। আচ্ছা তিনজনেই মানে তিন বন্ধুই আপনার সেবা করতেন সমান ভাবে, না? প্রশ্ন করে আবার কিরীটী।
তা করত। তবে বেশীর ভাগ সময় অতুল ও সুবালাদিই আমার ঘরে থাকত।
আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, মনে যদি অবিশ্যি কিছু না করেন?
বলুন?
বলছিলাম আপনার সুবালাদিকে কি রকম মনে হয়? প্রশ্নটা করে কিরীটী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মণিকার দিকে তাকিয়ে থাকে।
হঠাৎ যেন চমকে মণিকা কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল।
এ-কথা জিজ্ঞাসা করছেন কেন! হিন্দুঘরের ব্রতচারিণী বিধবা সুবালাদি—
কিরীটীর ওষ্ঠপ্রান্তে মৃদু হাসির একটা বঙ্কিম রেখা জেগে উঠেই মিলিয়ে যায়। আপনি নারী হয়ে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, অন্য এক নারী সম্পর্কে আমার প্রশ্নটা ঠিক–
না, সেরকম কিছু থাকলে অন্তত আমার দিদিমার নজর এড়াত না, মিঃ রায়। দৃঢ়কণ্ঠে জবাব দেয় মণিকা কিন্তু তথাপি কিরীটীর মনের সংশয়টা যেন যায় না। অদৃশ্য একটা কাঁটার মতই একটা সংশয় যেন কিরীটীকে বিঁধতে থাকে।
আচ্ছা আপনি যেতে পারেন।
মণিকা চলে গেল।
.
মণিকা ঘর থেকে চলে যাবার পর কিরীটী নিঃশব্দে আপন মনেই কিছুক্ষণ ধূমপান করে। তারপর অর্ধদগ্ধ চুবরাটের ছাইটা ঝাড়তে ঝাড়তে শিউশরণের দিকে ফিরে তাকিয়ে বলে, শিউ, চল আর একবার অতুলবাবুর ঘরটা দেখে আসা যাক।
চল। কিরীটী যখন পাকেচক্রে একবার এই ব্যাপারে এসে মাথা দিয়েছে, মীমাংসায় একটা পৌঁছনো যাবেই। তাই কিরীটীর উপরেই সব ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে ছিল শিউশরণ।
সকলে পুনর্বার যে ঘরে মৃতদেহ ছিল সেই ঘরে এসে প্রবেশ করল। চাদরে আবৃত মৃতদেহটা তেমনি রয়েছে চেয়ারের উপরে উপবিষ্ট। কিরীটী তার অভ্যস্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ঘরটার চতুর্দিকে তাকাতে লাগল আর একবার। ঘরের পূর্ব কোণে একটা জলচৌকির উপরে একটা মাঝারি আকারের চামড়ার সুটকেস। এগিয়ে গিয়ে কিরীটী সুটকেসটার সামনে দাঁড়াল।
সুটকেসের উপরে অতুলের নাম ও পদবীর আদ্যক্ষর ইংরাজীতে লেখা। নীচু হয়ে কিরীটী সুটকেসটা খোলবার চেষ্টা করতেই ডালা খুলে গেল। বোঝা গেল সুটকেসে চাবি দেওয়া ছিল না। তালাটা খোলাই ছিল। ডালাটা সুটকেসের তুলল কিরীটী। কতকগুলো জামাকাপড়, খানকতক ইংরাজী বই।
একটা একটা করে কিরীটী বইগুলো তুলে দেখতে লাগল। একান্ত শিথিল ভাবেই কিরীটী সুটকেস হতে ইংরাজী বইগুলো একটা একটা করে তুলে দেখতে শুরু করে।
বইগুলো বিখ্যাত বিদেশী গ্রন্থকার কর্তৃক রচিত নামকরা সব সাইকোলজি ও সেকসোলজি সংক্রান্ত।
বইগুলো অন্যমনস্কভাবে উলটে দেখতে দেখতে আচমকা কিরীটীর মনের চিন্তা-আবর্তে এসে উদিত হয় একটা কথা এবং সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় কিরীটী সুটকেসের পাশে হাতের বইগুলো নামিয়ে রেখে পুনবার এগিয়ে যায় চেয়ারের ওপরে উপবিষ্ট ও চাদরে আবৃত মৃতদেহের সন্নিকটে এবং নীচু হয়ে চেয়ারের পায়ার কাছেই ভূপতিত বইটা হাত বাড়িয়ে তুলে নিতে গিয়ে সহসা চেয়ারের পায়ার দিকে দৃষ্টি পড়ে।
শিউশরণ তখন তার নোটবুকে ক্ষণপূর্বে শোনা জবানবন্দির কতকগুলো পয়েন্টস্ টুকে নিতে ব্যস্ত। কিরীটীর প্রতি তার নজরটা ছিল না।
যে চেয়ারটার উপরে মৃতদেহ উপবিষ্ট ছিল তারই একটা পায়ার সঙ্গে ও দেখতে পেল জড়ানো সরু একটা তামার পাত।
চেয়ারটা যদিও তৈরী ষ্টীলের এবং রঙটা তার অনেকটা তামাটে, সেই কারণেই সেই তামাটে বর্ণের সরু স্টীলের পায়ার সঙ্গে জড়ানো সরু একটা তামার পাত চট করে সহজে কারও দৃষ্টিতে না পড়বারই কথা। সেই কারণেও বটে এবং প্রথম দিকে মৃতদেহ ও তৎসংশ্লিষ্ট অন্যান্য ব্যাপারে কিরীটীর মন বেশী নিবিষ্ট ছিল বলেই ব্যাপারটা ওর নজর এড়িয়ে গিয়েছে প্রথম দিকে।
কৌতূহলভরে কিরীটী হাত দিয়ে চেয়ারের পায়া থেকে সরু তামার পাতটা খুলে নেবার চেষ্টা করল। এবং খুব বেশী শক্ত করে জড়ানো না থাকায় অল্প আয়াসেই সেটা খুলে নিল।
তামার পাতটা হাতে নিয়ে কিরীটী পরীক্ষা করে।
তার মস্তিষ্কের গ্রে-সেলগুলো বিশেষ ভাবেই সক্রিয় হয়ে ওঠে। পুরাতন একটা তামার পাত!