***
কিন্তু দিল্লীতে ফিরে মণিকা কয়েকদিন পরে একখানা চিঠি পেল সুকান্তর।
মণি,
জানি না সে রাত্রের আমার পশুবৎ আচরণকে তুমি এ জীবনে ক্ষমা করতে পারবে কিনা। তবু জেনো সে রাত্রের যে সুকান্তকে তুমি দেখেছিলে তার সন্ধান আর তুমি কোনো দিনও পাবে না। এবং আমার সেদিনকার আচরণের জন্য দায়ী তোমার প্রতি আমার তিল তিল করে গড়ে ওঠা সুতীব্র আকাঙক্ষাই। আমার সে আকাঙক্ষাকে তুমি ঘৃণা করো না। প্রত্যেক মানুষের মনের মধ্যেই থাকে চিরন্তন আদিম একটা বৃত্তি যাকে এ যুগের লোকেরা বলবে কু, আর থাকে আজকের দিনের তথাকথিত সভ্যতার আচরণে ক্লিষ্ট ভীরু একটা বৃত্তি যাকে তোমরা সগৌরবে বলে থাক সু। কিন্তু জান, এই কু বা সু কোনোটাই মিথ্যা নয় বরং প্রথমটাই আমার মতে নির্ভেজাল সত্য পরিচয়, যুগে যুগে মানুষে আজও যা নিঃশেষ করে ফেলতে পারিনি আমরা সভ্যতা ও তথাকথিত শিক্ষার কষ্টিপাথরে ঘষেও। সে যা চায় তা প্রাণ খুলে অতি বড় দুঃসাহসের সঙ্গেই চায়। চাইতে গিয়ে সরমে পিছিয়ে আসে না। কিন্তু যাক সে কথা। কারণ এ যুগে কুকেও কেউ ক্ষমার চক্ষে দেখবে না। সত্য ও নির্ভীক হলেও তার মনুষ্যসমাজে মর্যাদা নেই। মনে মনে যাই আমি স্বীকার করি না কেন, আমিও বোধ হয় সু-এরই বশ। সেই বৃত্তিতেই ক্ষমা চাইছি। আশা করি সে রাত্রের স্মৃতিকে তুমি মনে মনে পোষণ করে রাখবে না অন্তজ্বালায় ও ঘৃণায়।
ইতি
অনুতপ্ত সুকান্ত
চিঠিটা পেয়ে সেদিন মণি তোমার মনে কি ভাব হয়েছিল ভোলনি নিশ্চয়ই! কারণ মুখে, তুমি যতই বড়াই করো না কেন সুকান্তর সে রাত্রের অকুণ্ঠ সতেজ পুরুষ-আহ্বান তোমারও দেহে কামনার তীব্র দাহন জ্বেলেছিল। তুমি কাগজ-কলম নিয়ে লিখতে গিয়েছিলে:
সু—আমার সুকান্ত
ভুল আমারই। স্বীকার করতে আজ আর আমার কোনো লজ্জা নেই। আমার এ নারীমন আমার অজ্ঞাতে যে একটিমাত্র বিশেষ পুরুষের জন্য লালায়িত হয়ে উঠেছিল তাকে তুমিই সবল বাহুতে নাড়া দিয়ে ক্ষণিকের জন্য হলেও জাগিয়ে তুলেছিলে। সে রাত্রের আমার প্রত্যাখ্যানকে অস্বীকার করে জোর করে যদি তুমি আমায় অধিকার করতে, সাধ্য ছিল না আমার তোমাকে না ধরা দিই। কেন নিলে না জোর করে কেন?
কিন্তু না! না—এসব কি লিখেছে মণিকা! তাড়াতাড়ি চিঠির কাগজ ছিঁড়ে ফেলে কুটিকুটি করে সেটা উড়িয়ে দেয়। তারপর লেখে :
সুকান্ত,
ভুল দোষ ত্রুটি নিয়েই মানুষ। যা হয়ে গেছে তার জন্য মনে কিছু করো না। আমরা পরস্পরের বন্ধু। এর মধ্যে কাউকে কারও ক্ষমার প্রশ্ন আসতেই পারে না। সে সব কথা আমি ভুলে গিয়েছি। ভালবাসা নিও–
তোমাদের মণি।
সংক্ষেপে মণিকা কিরীটীকে নিজেকে যথাসম্ভব বাঁচিয়ে দার্জিলিংয়ের সে রাত্রের সুকান্ত-কাহিনী বলে যায়। কিন্তু আসল কথাটি চাতুর্যের সঙ্গে কাহিনীর মধ্যে গোপন করে গেলেও মণিকার গলার স্বরে এবং বিবৃতির সময় তার চোখমুখের ভাবে কিরীটীর তীক্ষ্ণ সজাগ অনুভূতির অগোচর কিছুই থাকে না।
এতক্ষণে যেন অন্ধকারে ক্ষীণ :স্টা আলোকের রশ্মি দেখতে পায় কিরীটী। বুঝতে পারে এখন সুস্পষ্ট ভাবেই যেটা এখানে প্রবেশের পূর্বমুহূর্তে ক্ষীণ কুয়াশার মতই অস্পষ্ট ছিল, তার চিরাচরিত অনুমানের ভিত্তির ওপরে রণেন চৌধূরীর মুখে অতুলের মৃত্যুসসংবাদ পেয়ে সেটা একেবারে মিথ্যা নয় এবং এই মৃত্যু-রহস্যের মূলে হয়ত তার অনেকখানি ছড়িয়ে আছে।
ডাক পড়ল মণিকা দেবীর পর প্রথমে দিদিমার।
দিদিমা পেটের গোলমালের জন্য কয়েক বৎসর ধরে আফিম খান। তিনি অতুলের মৃত্যুর ব্যাপারে বিশেষ কোনো আলোকসম্পাতই করতে পারলেন না। তাছাড়া দিদিমা কানেও একটু খাটো। তাঁকে প্রশ্ন করার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি কেঁদে ফেললেন এবং বললেন, এরকমটি যে হবে তা আমি জানতাম দারোগাবাবু। তিনটে পুরুষ আর ও এক মেয়ে।
কিরীটী সচকিত হয়ে ওঠে, কেন দিদিমা? আপনি কি ওদের মধ্যে তেমন কিছু কখনও দেখেছেন?
তেমন পাত্রীই আমার নাতনী নয়। মেয়ে আমার খুব ভাল। আর ওরা তিনজনও বড় ভাল, কিন্তু কথায় বলে বয়েসের মেয়ে-পুরুষ! ঘি আর আগুন! যত সাবধানেই রাখ অনর্থ ঘটতে কতক্ষণ!
কিরীটী বোঝে দিদিমাকে আর বেশী ঘাঁটিয়ে লাভ হবে না।
কিরীটীর ইঙ্গিতে শিউশরণ দিদিমাকে বিদায় দেয়।
৬. সর্বশেষে ডাক পড়ল সুবালাদির
সর্বশেষে ডাক পড়ল সুবালাদির। সুবালা।
পদশব্দে মুখ তুলে তাকিয়েই কিরীটী কয়েকটা মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে রইল।
কিরীটীরই ভাষায়–
স্তব্ধ নির্বাক হয়ে গিয়েছিলাম যেন প্রথমটায়। একটা জ্বলন্ত আগুনের রক্তাভ শিখা যেন আমার সামনে এসে দাঁড়াল হঠাৎ।
এত রূপ মানুষের দেহে কখনও সম্ভব কি!
শুভ্র পরিধেয় শ্বেতবস্ত্রে সে রূপ যেন আরও স্পষ্ট আরও প্রখর হয়ে উঠেছিল।
বিস্ময় ও আকস্মিকতায় কয়েকটা মুহূর্ত কেটে গেলে আবার ভাল করে ভদ্রমহিলার মুখের দিকে তাকালাম এবং তখুনি আমার মনে হল সে রূপ বা দেহশ্রীর মধ্যে এতটুকু স্নিগ্ধতা নেই। জ্বলন্ত উগ্র উষ্ণ। তৃষ্ণা মেটে না, চোখ যেন ঝলসে যায়।
আরও একটা জিনিস যেটা আমার চোখে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল, তার ছোট কপাল, বঙ্কিম জ্ব-যুগল ও ঈষৎ চাপা নাসিকার মধ্যে যেন একটা উগ্র দাম্ভিকতা অত্যন্ত সুস্পষ্ট। দৃঢ়বদ্ধ চাপা ওষ্ঠ ও সরু চিবুক নিদারুণ একটা অবজ্ঞায় যেন কুটিল কঠিন।