মণিকার কাঁধের উপরে ডান হাতটা রাখল সুকান্ত।
কাঁধের ওপরে সুকান্তর হাতের স্পর্শ পেয়ে ফিরে তাকাল মণিকা।
চোখের মণি দুটোতে যেন এক অস্বাভাবিক দীপ্তি।
চাপা কণ্ঠে সুকান্ত ডাকে, মণি?
সুকান্তর স্বরের অস্বাভাবিকতা অকস্মাৎ মণিকার শ্রবণেন্দ্রিয়ে প্রবেশ করে তাকে সচকিত করে তুলল। তখনও তাকিয়ে মণিকা সুকান্তের মুখের দিকে।
সম্মুখের ফায়ার-প্লেসের অগ্নির রক্তাভ আলোর আভায় সুকান্তর গৌর মুখখানা যেন রাঙা টকটক করছে।
কি হয়েছে সু? শরীর অসুস্থ বোধ করছ না তো? উদ্বিগ্ন-ব্যাকুল কণ্ঠে প্রশ্ন করে মণিকা উঠে দাঁড়ায়।
না। বসো।
কই দেখি কপালটা? আরও একটু এগিয়ে এসে মণি হাতটা দিয়ে সুকান্তর কপাল স্পর্শ করতে উদ্যত হতেই মুহূর্তে দু বাহু দিয়ে সুকান্ত মণিকাকে নিজের বুকের ওপরে টেনে নিয়ে চাপা উত্তেজিত কণ্ঠে বলে, মণি! মণি!
এবং পরক্ষণেই সুকান্তর উত্তপ্ত ওষ্ঠ মণিকার কপাল ও কপোলে মুহুর্মুহুঃ চুম্বনে চুম্বনে আচ্ছন্ন করে দেয়।
মণিকা ঘটনার আকস্মিকতায় এমন বিহ্বল হয়ে যায় যে বাধা দেবারও প্রথমটায় অবকাশ পায় না।
থরথর করে গভীর উত্তেজনায় সর্বাঙ্গ কাঁপছে সুকান্তর। দেহের সমস্ত শিরায় শিরায় যেন একটা তরল অগ্নির জ্বালা। রোমকূপে-কূপে একটা উত্তপ্ত কামনার প্রদাহ। ভুয়ো বালির বাঁধ কামনার বন্যাস্রোতে ভেঙে গুঁড়িয়ে গিয়েছে। সে আগুনের তাপে মণিকার শরীর যেন ঝলসে যায়।
না! না! না! কোনো বাধাই মানব না! কোনো যুক্তি কোনো নিষেধ শুনব না! তুমি—তুমি আমার! আমার!
জোর করে ছাড়াতে চেষ্টা করে নিজেকে মণিকা সুকান্তর কঠিন বাহুবন্ধন হতে কিন্তু সুকান্ত আরও নিবিড় করে তার দুটি বাহুর বেষ্টনী, না মণি, না!
সুকান্ত! প্রায় একটা ধাক্কা দিয়েই নিজেকে এবারে মুক্ত করে নেয় মণিকা।
শোন মণি, এ নিষ্ঠুর খেলার অবসান হোক। সুকান্ত তখনও কাঁপছে উত্তেজনার আধিক্যে, আজ জানতে চাই তুমি আমার হবে কিনা?
আমি কারও নই। তোমাদের কারোরই হতে পারি না।
কারোরই হতে পার না! এত অহঙ্কার তোমার! তুমি কি ভেবেছ এমনি করে দিনের পর দিন আমাদের তিনজনকে তুমি বাঁদর-নাচ নাচিয়ে বেড়াবে! হিংস্র কামনামত্ত আদিম পশুপুরুষ সভ্যতার খোলস ফেলে নখর বিস্তার করেছে।
কি বলছ তুমি!
ঠিকই বলছি। তুমি জান তিনজনই আমরা তোমায় চাই। আমরা তিনজনই তোমাকে কামনা করি, তাই কি তুমি এইভাবে খেলছ আমাদের নিয়ে?
খেলছি তোমাদের নিয়ে?
হ্যাঁ, খেলছ। কিন্তু এ চলবে না। এতদিন ওদের আমি সুযোগ দিয়েছি। তারা avail যখন করেনি—আমি আর অপেক্ষা করব না। হয় তুমি আমার হবে, না হয় আমাদের সামনে থেকে তোমায় চিরদিনের মত সরে যেতে হবে।
অতুল, রণেন তোমার বন্ধু মণিকার স্বর যেন ভেঙ্গে পড়তে চায়।
বন্ধু! হ্যাঁ, বন্ধু বলেই তো এতদিন চুপ করে ছিলাম। আর যদি তারা আমার পথে দাঁড়ায় জেনো তাদের হত্যা করতেও আমি পশ্চাৎপদ হব না। কতকগুলো ক্লীব জড় পদার্থ! কণ্ঠস্বরে ঘৃণা ও আক্রোশ যেন মূর্ত হয়ে ওঠে।
সুকান্ত তুমি কি পাগল হয়ে গেলে?
পাগল! না হলেও পাগল হতে বেশি দেরি হবে না আর তোমাদের এই আদর্শের ন্যাকামি নিয়ে আর কিছুদিন থাকলে। বন্ধুত্ব! মনে মনে অহোরাত্র কামনার হিংসায় জর্জরিত হয়ে বাইরে বন্ধুত্বের ভান করব আমরা আর তুমি কেবল মিষ্টি হাসি ও দুটো চোখের ইঙ্গিত দিয়ে আমাদের শান্ত রাখবার চেষ্টা করবে! নিশ্চয়ই তুমি ভাবছ, তোমার ঐ যৌবনের রঙের ঝাপ্টা এই তিনটে বোকার চোখে দিয়ে–
সুকান্তর কথাটা শেষ হল না। মণিকার ডান হাতটা চকিতে একটি চপেটাঘাত করল সুকান্তর গালে।
থমকে থেমে গেল সুকান্ত।
Get out! এই মুহূর্তে আমার ঘর থেকে বের হয়ে যাও!
প্রজ্বলিত অগ্নির মধ্যে একটা জলের ঝাপটা দিলে যেমন সহসা সেটা নিস্তেজ হয়ে যায়, সুকান্তরও মণিকার একটিমাত্র চপেটাঘাতের চকিত বিহ্বলতায় তার ক্ষণপূর্বের সমস্ত প্রদাহ ও কামনার জ্বালা দপ্ করেই নিভে যায়।
নিঃশব্দে সুকান্ত ঘর থেকে বের হয়ে গেল। এবং শুধু ঘর থেকেই নয়, ঘণ্টাখানেক বাদে নিজের ঘর হতে সুটকেসটা নিয়ে একেবারে হোটেল ছেড়েই চলে গেল।
বাকি রাতটুকু পথে পথে কাটিয়ে পরের দিনই সে দার্জিলিং ত্যাগ করে কলকাতায় ফিরে গেল।
পরের দিন সকালে রণেন ও অতুল ফিরে এল। সুকান্তের খোঁজ করতে মণিকা বললে, সে তোকই ফেরেনি রাত্রে!
দুই বন্ধু আশ্চর্য হয়ে তখুনি খোঁজাখুঁজি শুরু করে। কিন্তু সারাটা শহরেও তার দেখা মিলল না। সকলে তখন ব্যাকুল উৎকণ্ঠায় গিয়ে পুলিসে সংবাদ দেয়।
চতুর্থ দিনে অতুল সুকান্তর একটা টেলিগ্রাম পায়, আমি হঠাৎ কলকাতায় চলে এসেছি। ভালই আছি।
বুঝতে ঠিক পারে না অতুল আর রণেন, সুকান্তর ঐ ধরনের বিচিত্র ব্যাপারটা। তবে ওরা জানত সুকান্ত বরাবরই একটু বেশীমাত্রায় খেয়ালী, কারণে অকারণে হঠাৎ চঞ্চল হয়ে ওঠে।
পরে বন্ধুদের সঙ্গে সুকান্তর যখন দেখা হল, বলেছিল হাসতে হাসতে, হঠাৎ কি খেয়াল হল চলে এলাম। হঠাৎ যেন মধ্যরাত্রে সেদিন হোটেলে ফেরবার পথে মনে হল ফগে ভর্তি দার্জিলিং শহরটা বিশ্রী। যত শীঘ্র সম্ভব শহরটা পরিবর্জন করাই ভাল। অতএব কালবিলম্ব আরনা করে কাউকে কিছু না বলে সুটকেসটা হাতে ঝুলিয়ে রাত্রে বের হয়ে পড়লাম।