তার কোনো ঠিক নেই, প্রতিরাত্রেই গত সাতদিন ধরে তাস খেলেছি আমরা—কখনও বারান্দায়, কখনও রণেনের ঘরে। তবে গতকাল রাত্রে সুকান্তই তার ঘরে খেলতে বললে, তাই–
হুঁ। রাত সাড়ে এগারোটায়খেলা শেষ হবার পর অতুলবাবুকে তাঁর ঘরে ঢুকতে দেখেছিলেন?
দেখেছি এবং তাকে দরজা বন্ধ করতেও শুনেছি। তাই তো আজ সকালে তার ঘরের দরজা খোলা দেখে আমি আশ্চর্যই হয়েছিলাম!
এমন তো হতে পারে কোনো এক সময় হয়ত রাত্রে ঘর থেকে বের হয়েছিলেন? কথাটা বলে শিউশরণ।
তা হতে পারে। কিরীটী বলে।
রাত্রে একবার অতুল উঠতই। তবে উঠলেও শোয়ার আগে আবার সে দরজা বন্ধ করেই দিত বরাবর। কখনও তার দরজা দিতে ভুল হত না-বললে মণিকা।
মিস গাঙ্গুলী, আপনি বলেছিলেন গতরাত্রে খেলা শেষ হবার পর অতুলবাবু আপনার সামনেই ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তাঁর দরজা বন্ধ করবার সঙ্গে সঙ্গেই কি আপনি শুতে যান?
হ্যাঁ। আমার আগেই অতুল শুতে যায়।
রণেনবাবু?
রণেন আমাদের আগেই ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েছিল।
আচ্ছা মিস গাঙ্গুলী, রাত্রে শোবার পর কোনোপ্রকার শব্দ বা অস্বাভাবিক কোনো কিছু শুনতে পেয়েছিলেন?
না।
বিছানায় শুয়েই ঘুমিয়ে পড়েননি নিশ্চয়ই?
না।
ঘুম আসছিল না বলে অনেক রাত পর্যন্ত, তা প্রায় গোটা দুই হবে জেগে বই পড়েছি। ওই সময়ের মধ্যেও কোনো শব্দ বা কিছু–
সেরকম কিছু না, তবে বারান্দায় পায়ের শব্দ পেয়েছি। ভাবছিলাম হয়ত কেউ বাথরুমে যাচ্ছে রাত্রে।
ঘরে আপনার দিদিমা ও সুবালাদি ছিলেন, বলছিলেন না? আপনি যখন ঘরে শুতে যান তখন কি তাঁরা ঘুমিয়ে ছিলেন, না জেগে ছিলেন?
দুজনেই ঘুমিয়ে ছিল।
সকালে আপনার ঘুম ভাঙে কটায়?
ভোর ছটায়। দিদিমা উঠে যাবার কিছু পরেই।
এবার একটু ইতস্তত করে কিরীটী বলে, মণিকা দেবী, অতুলবাবুর এই ধরনের আকস্মিক রহস্যজনক মৃত্যুতে আপনি যে অত্যন্ত শ হয়েছেন বুঝতে পারছি। এবং এও নিশ্চয়ই আপনার মত একজন শিক্ষিত মহিলা বুঝতে পারছেন—আমাদের পক্ষে এ রহস্যের মীমাংসায় পৌঁছাতে হলে কতকগুলো delicate প্রশ্নের সম্মুখীন আমাদের হতেই হবে। সেক্ষেত্রে আপনাদের প্রত্যেকেই বিশেষ করে আপনি যদি আমাদের সর্বতোভাবে না সাহায্য করেন, তাহলে—
বলুন কি জানতে চান?
কিছু মনে করবেন না, আপনাদের চারজনের মধ্যে দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠতা, কথায় বলে দশ পা একত্রে গেলেই নাকি বন্ধুত্ব হয়, তা এক্ষেত্রে আপনারা চারজন নিশ্চয়ই একে অন্যের খুব নিকটতম সংসর্গেই এসেছিলেন এবং আপনাদের চারজনের মধ্যে একা আপনিই নারী। পুরুষ ও নারীর এই বয়সের ঘনিষ্ঠতার মধ্যে সাধারণত যে সম্পর্কের সম্ভাবনাটা দেখা দেওয়া খুব স্বাভাবিক বুঝতে পারছেন আশা করি, কি আমি বলতে চাই মিস গাঙ্গুলী?
তিনজনই আমার অত্যন্ত প্রিয়। মৃদুকণ্ঠে মণিকা জবাব দেয়।
তাহলেও হাতের পাঁচটা আঙুল তো সমান হয় না মণিকা দেবী।
না। কিন্তু এক্ষেত্রে বোধ হয় কারও প্রতি কোনো আকর্ষণের তারতম্য ছিল না আমার।
মনকে আপনার খুব ভাল করে প্রশ্ন করে দেখুন। এত সহজে জবাব দেবার চেষ্টা করবেন না।
ঠিকই বলছি। মণিকার স্বর দৃঢ়।
আচ্ছা, এদের মধ্যে কেউ কোনোদিন আপনার কাছে কোনো excuse me for my language—মানে propose করেন নি?
এবার একটু থেমে ইতস্তত করে মণিকা জবাব দেয়, করেছিল। তিনজনই।
পরে সংক্ষেপে সংকোচের সঙ্গে মণিকার ঘটনাটা বিবৃত করে।
এছাড়া আর কোনো ঘটনা? অনুগ্রহ করে লজ্জা বা দ্বিধা না করে খুলে বলুন।
মণিকা দিন দুই আগেকার সারনাথের ঘটনাটাও বিবৃত করে।
আর কোনোদিনের কোনো ঘটনা?
সুকান্ত–কথাটা বলতে গিয়েও ইতস্তত করে যেন মণিকা।
বলুন, থামবেন না, বলুন। উদগ্রীব-ব্যাকুল কণ্ঠে মিনতি জানায় কিরীটী মণিকাকে।
গত বছর পুজোর ছুটিতে আমরা দার্জিলিং যাই। সেখানে এক রাত্রে সুকান্ত আমার ঘরে এসে ঢোকে—হঠাৎ–
তারপর?
.
মণিকার দার্জিলিং-বিবৃতি।
দার্জিলিংয়ের সে রাত্রের স্মৃতি। রাত্রে হোটেলের ঘরে ফায়ারপ্লেসের সামনে চুপচাপ বসে মণিকা। গায়ে একটা কম্বল জড়ানো। পুজো সেবার ছিল অক্টোবরের শেষে। শীতও সেবারে দার্জিলিংয়ে বেশ কড়া পড়েছিল। অতুলের এক প্রফেসর বন্ধুর বাড়ি কার্ট রোডে, তারাও সস্ত্রীক দার্জিলিং এসেছে, নিমন্ত্রণ করেছিল ওদের চারজনকেই কিন্তু ইনফ্লুয়েঞ্জার মত হওয়ায় মণিকা যেতে পারেনি। সুকান্ত, অতুল ও রণেন গিয়েছে নিমন্ত্রণে।
রাত বোধ করি বারোটা হবে। হঠাৎ দরজার গায়ে মৃদু ন পড়ল।
কে?
আমি। দরজাটা খোল মণি।
মণিকা উঠে দরজাটা খুলে দিল, এ কি! সুকান্ত তুমি একা! ওরা কই?
ওরা তাসের আড্ডায় বসেছে। হয়ত আজ রাত্রে ফিরবেই না। মিঃ ও মিসেস চামেরিয়ার তাসের প্রচণ্ড নেশা। তুমি একা, তাই চলে এলাম।
বেশ করেছ, বস। মণিকা চেয়ারটায় গিয়ে বসল।
গায়ের গ্রেট কোটটা খুলে খাটের বাজুর ওপরে রেখে দিল সুকান্ত। পাশের একটা চেয়ার খালি থাকা সত্ত্বেও কিন্তু সুকান্ত বসছে না।
দেওয়ালের গায়ে অগ্নির রক্তাভ শিখাগুলো যেন আনন্দে নৃত্য করছে। বাইরে আজ প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। সমস্ত দার্জিলিং শহরটা শীতে যেন কুঁকড়ে রয়েছে।
বসো সু। আবার মৃদু আহ্বান জানায় মণিকা।
তথাপি সুকান্ত কিন্তু বসল না। চেয়ারে উপবিষ্ট মণিকার পাশে এসে দাঁড়াল, মণি?
বসো। মণিকা আবার জানায় সুকান্তকে।