সে রকম কাজ হলে দিই, তবে ছোটখাটো ব্যাপারে আমার মিস্ত্রীরাই কাজ করবার যা করে।
এ ঘরের ইলেকট্রিক আলোটা পরশু রাত্রে খারাপ হয়েছিল আপনি জানতেন?
না, আজ সকালেই প্রথম মণির মুখে একটু আগে শুনলাম।
মিস্ত্রী কাল কাজ করতে এসেছিল দুপুরে তাও কি জানতেন না?
না। বললাম তো একটু আগে আপনাকে শরীর খারাপ ছিল বলে সারাদিন ঘর থেকে বের হইনি।
এখানে আসবার পর খুব ইদানীং আপনাদের তিন বন্ধুর মধ্যে মণিকা দেবী সম্পর্কে কোনোরূপ আলোচনা বা বচসা কিছু হয়েছিল কি?
কি mean করছেন আপনি?
নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন মিঃ হালদার, কি আমি বলতে চাইছি
আপনার ও প্রশ্নের জবাব দেবার মত আমার কিছু নেই।
মণিকা দেবীকে ডাকা হল। এবারে তার জবানবন্দি।
সুন্দরী শিক্ষিতা, দিল্লীতে অধ্যাপিকার কাজ করে, আকস্মিক দুর্ঘটনায় সমস্ত মুখের ওপরে যেন একটা নিরতিশয় বেদনার ছায়া ফেলেছে। দীর্ঘ নয় বৎসরের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব মণিকার অতুল, রণেন ও সুকান্তর সঙ্গে। দুর্ঘটনার আকস্মিকতায় যেন ও ভারী মুষড়ে পড়েছে।
বসুন মণিকা দেবী। কিরীটীই বলে।
আমি এবারে ওদের পুজোর ছুটিটা এখানে কাশীতে কাটাবার জন্য নিমন্ত্রণ করে এনেছিলাম মিঃ রায়। আবেগে কণ্ঠস্বর যেন রুদ্ধ হয়ে আসে, চোখের কোল দুটি ছলছল করে, এমনি একটা দুর্ঘটনা ঘটবে যদি স্বপ্নেও জানতাম! সত্যি, ভাবতেও পারছি না—অতুল, অতুল নেই আর!
অন্যদিকে মুখটা ফেরায় মণিকা বোধ করি উগত অশ্রুকে সকলের দৃষ্টি হতে আড়াল করবার জন্যই।
আপনার লজ্জা ও দুঃখ আমি বুঝতে পারছি মিস গাঙ্গুলী, কিন্তু কি করবেন বলুন?
বোধ হয় সান্ত্বনা দেবারই চেষ্টা করে কিরীটী, আকস্মিক দুর্ঘটনার ওপরে তো আমাদের কারোরই কোনো হাত নেই, দৈব!
কিরীটী কিছুক্ষণ সময় দেয় মণিকাকে কিছুটা সামলে নেওয়ার জন্য।
কিরীটী আবার শুরু করে, এই নিষ্ঠুর হত্যার—-
কিরীটীর কথা শেষ হল না, চমকে অশ্রুসিক্ত চোখে ফিরে তাকায় চকিতে মণিকা প্রশ্নকারী কিরীটীর মুখের দিকে। অর্ধস্ফুট বিস্মিত কণ্ঠে শুধায়, হত্যা!
হ্যাঁ, মণিকা দেবী। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গেই বলতে আমি বাধ্য হচ্ছি, অতুলবাবুর মৃত্যুটা স্বাভাবিক নয়—নিষ্ঠুর হত্যা।
না–না! আর্ত চাপা কণ্ঠে প্রতিবাদ জানায় মণিকা, You dont really mean it!
সত্যিই হত্যা মণিকা দেবী! অতুলবাবুকে হত্যা করাই হয়েছে!
অতুল—
হ্যাঁ। এবং হত্যা বলেই এই ব্যাপারের একটা মীমাংসা হওয়া একান্তই প্রয়োজন, নয় কি?
মণিকা চুপ। মণিকার মনের অবগহনে তখন যেন একটা প্রচণ্ড ঝড়ের আলোড়ন চলেছে। অতুল নিহত! কিন্তু কেন? কেন সে নিহত হল? নিরীহ অতুল! কে তাকে হত্যা করলে? এ কি ভয়াবহ নিষ্ঠুর কথা!
মিস গাঙ্গুলী?
অ্যাঁ! চমকে তাকায় মণিকা কিরীটীর ডাকে তার মুখের দিকে।
এ ঘরের ইলেকট্রিক আলোটা যে খারাপ হয়ে গিয়েছিল, সে সংবাদ আপনি কখন মিস্ত্রীকে পাঠিয়েছিলেন?
আমি! আমি সংবাদ পাঠিয়েছিলাম? কই না তো! বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকায় মণিকা কিরীটীর মুখের দিকে।
আপনি সংবাদ দেননি?
না। চিরদিন অত্যন্ত ভোলা মন আমার। বরং কাল দুপুরে ইলেকট্রিক মিস্ত্রী আসবার পর, অতুল যে তার ঘরের আলোটা খারাপ হয়ে যাওয়ার কথা বলেছিল, হঠাৎ সে কথাটা মনে পড়ায় বিশেষ লজ্জিতই হয়েছিলাম।
আপনি তাহলে ইলেকট্রিক মিস্ত্রীকে খবর দেননি?
না।
যে মিস্ত্রী আলো সারাতে এসেছিল সে কি আপনাদের পূর্বপরিচিত?
না।
হুঁ। লোকটার বয়স কত হবে বলে আপনার মনে হয়?
একটু বেশী বলেই মনে হয়েছিল। জাতিতে বোধ হয় বেহারী।
আপনার সঙ্গে লোকটার কি কথা হয়?
তার সঙ্গে আমার কোনো কথাই হয়নি বলতে গেলে। বংশী লোকটাকে নিয়ে এসেছিল—আমি শুধু ঘরটা দেখিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে চলে এসেছিলাম।
লোকটা যখন ঘরে কাজ করে আপনি তখন ঘরে ছিলেন না?
না। কতক্ষণ যে কাজ করেছে এবং কখন যে কাজ করে চলে গিয়েছে তাও জানি না।
আশ্চর্য! লোকটা কাজ করে পয়সা নিয়ে যায়নি?
হ্যাঁ, সুবালাদিই নাকি দিদিমার কাছ থেকে চেয়ে তিন টাকা দিয়ে দিয়েছিল।
হুঁ। কিরীটী কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে কি যেন ভাবে। অতঃপর বলে, আচ্ছা অতুলবাবু যে দুটোর সময় চিঠি ফেলতে বাইরে বের হয়েছেন বলে আপনার ধারণা, তখন যে তিনি স্টেশনে গিয়েছিলেন তা জানেন?
স্টেশনে! কই না তো! স্টেশনে সে যাবে কেন?
গিয়েছিলেন তিনি। আচ্ছা কোনো চিঠি গতকাল তাঁর নামে এসেছিল জানেন?
হ্যাঁ, একটা চিঠি এসেছিল বটে।
কার চিঠি সেটা জানেন?
না। বংশী এনে আমার হাতে দেয়, আমি চিঠিটা তার হাতে দিয়ে দিই।
বাড়িতে ফিরে তিনি ঘরে যাননি?
যতদূর মনে পড়ছে, না। সে যখন ফিরে আসে, আমরা, মানে আমি ও রণেন বাইরের বারান্দায় বসে চা ও ডালমুট ভাজা খাচ্ছিলাম। অতুল ডালমুট বড় ভালবাসত,How nice ডালমুট, বলতে বলতে সে বারান্দাতেই একটা মোড়ায় বসে চা ও ডালমুট খেতে শুরু করে। তারপরই বোধহয় পৌনে ছটা বা ছটা নাগাদ আমরা গঙ্গায় নৌকোয় ঘুরতে বের হই। যতদূর মনে পড়ছে সে ঐ সময়টা বাইরেই বারান্দায় ছিল, ঘরে যায়নি।
রাত্রে বাসায় ফিরে?
বাসায় ফিরে কিছুক্ষণ আমরা সকলে তিনতলার ছাদে গল্প করে নীচে গিয়ে খাওয়া-দাওয়া সেরে সুকান্তর ঘরে গিয়ে তাস খেলি।
সুকান্তর ঘরে বসেই কি বরাবর তাস খেলতেন আপনারা রাত্রে?