তুমি আমার অনেক আদর-ভালবাস-চুমু নাও। ইতি–
শুধু তোমারই শিখা
নিছক নববিবাহিতার প্রেমপত্র। পড়তে ভালই লাগত। মনে মনে দুজনের জন্যই সমবেদনা অনুভব কবেন শৈলেনদা কিন্তু পাটনার কোন ঠিকানায় এ চিঠি ফেরত পাঠাবেন?
চা-সিগারেট খেয়ে কিছুক্ষণ কাটাবার পর শৈলেনদা এবার অমল ব্যানার্জীর চিঠিটা খোলেন।…
আমার প্রিয়তম অমল রাজা! সত্যি বলছি, সব যেন স্বপ্নের মধ্যে ঘটে গেল। আমি এখনও সে স্বপ্নের নেশায় বিভোর হয়ে আছি। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে আমার কোন দিদির বিয়ে হয়নি। আমার দুই জামাইবাবু খুব ভাল হয়েছেন বলে মা সব সময় বাবাকে বলতেন, খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া ছেলে-মেয়ে কখনই ভাল হয় না। আমার দিদিরাও সব সময় মার মত সমর্থন করেছে। তাই বাবা যখন আমার বিয়ের জন্য চারদিকে খোঁজখবর করেও পছন্দমত পাত্র পাচ্ছিলেন না, তখনও মা বাবাকে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিতে দেননি। এমন সময় হঠাৎ ছোট কাকা তোমার বিজ্ঞাপনটি বাবাকে পাঠালেন। বাবা কোন মন্তব্য না করে ছোট কাকার চিঠি আর বিজ্ঞাপনটি মাকে দিলেন। সবকিছু কয়েকবার পড়ার পর মা বললেন, এত উচ্চশিক্ষিত ছেলে, তার উপর বিদেশে থাকে। একটা চিঠি লিখে তো দেখ।
ব্যস! পনেরো দিনের মধ্যে তোমার-আমার বিয়ে হয়ে গেল! এখন তোমার মত জামাই পেয়ে বাবা-মার গর্ব দেখে কে!
যাই হোক হানিমুনের দিনগুলির প্রতিটি মুহূর্তের স্মৃতি আমি সারাজীবন রোমন্থন করব। সত্যি, তোমার ভালবাসায় আমিও এমন পাগল হয়ে উঠেছিলাম যে সে কথা মনে করলেও লজ্জায় মুখ লাল হয়ে উঠছে? অবার ভাবি, পাগলামি করেছি তো বেশ করেছি। তোমার সঙ্গে নিশ্চয়ই পাগলামি করব। তাছাড়া তুমিই তো আমাকে পাগল করে তুলেছিলে।
তুমি কলকাতার কাজ শেষ করে তাড়াতাড়ি চলে এসো। এখানে দুতিন দিন না থাকলে এত জিনিসপত্তর ঠিকঠাক করবে কে? তাছাড়া তুমি তো দিল্লী হয়ে বোম্বে যাবে। বোম্বেতে কী তোমার কোন কাজ আছে? ওখানে কোন কাজ না থাকলে বোম্বের বদলে দিল্লী থেকেই তো আমরা সোজা নিউইয়র্ক যেতে পারি। নিউইয়র্ক যাবার পথে আমরা দুটি দিন কি লণ্ডন আর প্যারিসে কাটাব না?
তুমি তাড়াতাড়ি এসো। তোমাকে ছাড়া আর এক মুহূর্তেও আমার ভাল লাগে না। তাছাড়া রাত্তিরে তোমার অভাব এত অনুভব করি যে কিছুতেই স্থির হয়ে ঘুমুতে পারি না। আমার অনেক আদর ও প্রণাম নাও।
–তোমার আদরের কৃষ্ণা
তৃতীয় চিঠিটার দুচার লাইন পড়েই শৈলেনদা সামনের টেবিলের দিকে তাকিয়ে বললেন, হ্যাঁগো মানিকদা, এ তো ভারী মজার ব্যাপার দেখছি।
মানিকবাবু এই সেক্সেনের ইনচার্জ। উনি একটু মুখ তুলে বললেন, কী আবার মজার ব্যাপার হল?
শৈলেনদা হাসতে হাসতে বললেন, একই ঠিকানা থেকে তিনটে চিঠি ফেরত এসেছে। আর তিনটে চিঠিই সদ্য বিবাহিতা তিনটি মেয়ের লেখা।
একই লোককে লেখা?
দুটি চিঠিই অমল নামের দুজনকে লেখা আর
পাশ থেকে বলাই ঘোষাল জিজ্ঞেস করলেন, একই ঠিকানায় একই নামের দুজনকে লেখা মানে?
শৈলেনদা বললেন, শুধু উপাধি আলাদা।
মানিকবাবু জিজ্ঞেস করলেন, থার্ড চিঠিটা কাকে লেখা?
অন্য নামের এক ভদ্রলোককে। কিন্তু তিনিও অন্য দুজনের মত বিয়ে করে কিছুদিন বউয়ের সঙ্গে ঘর করার পর কিছুদিনের জন্য কলকাতা এসেছেন।
তা কি করে হয়?
তাইতো আমার অদ্ভুত লাগছে।
দেখি তো চিঠিগুলো।
মানিকবাবু খুব মন দিয়ে তিনটে চিঠি দুতিনবার পড়লেন। কি যেন ভাবলেন। তারপর বললেন, বুঝলে শৈলেন, ব্যাপারটা আমার ভাল লাগছে না।
শৈলেনদা সঙ্গে সঙ্গে ওকে সমর্থন করে বললেন আমারও ব্যাপারটা ভাল লাগছে না।
মানিকবাবু বললেন, এ চিঠিগুলো ফেরত যাবে না।
অনেক বছর আগেকার কথা। তবু শৈলেনদার সবকিছু স্পষ্ট মনে আছে। সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, কেঁচো খুঁড়তে খুঁড়তে সাপ বেরিয়ে পড়ল।
আমি প্রশ্ন করি, তার মানে?
বেশীদিন না, দিন দশেকের মধ্যেই সব জানা গেল ও কেষ্টবাবু ধরা পড়লেন। কথাটা বলেই উনি একটু হাসলেন।
আমি জিজ্ঞেস করি, কী জানা গেল?
কেষ্টবাবুর কীর্তি-কাহিনী।
কেষ্টবাবু মানে?
ওরে বাপু, কলির কেষ্ট! হঠাং শৈলেনদার মুখ থেকে হাসির চিহ্ন উবে গেল। দুদিকের চোয়াল শক্ত হল। ওর চোখের দিকে তাকাতেও আমার ভয় হল। একটু পরে বললেন, ও হারামজাদা এক একটা শহরে এক একটা নাম-ধাম পরিচয় দিয়ে ভাল ভাল মেয়েদের বিয়ে করত।…
বলেন কী?
হ্যাঁ ভাই, তবে আর বলছি কি! কোথাও পরিচয় দিত আমেরিকায় থাকে ও ইউনিভার্সিটিতে পড়ায়, কোথাও বলত, বিলিতি কোম্পানির এরিয়া ম্যানেজার, কোথাও আবার অন্যকিছু বলত।
কী সর্বনাশ।
কটা মেয়ের সর্বনাশ করেছিল জানো?
কটা?
পাঁচটা।
ইস!
শৈলেনদা ঠোঁটের কোণে একটু হাসির রেখা ফুটিয়ে বললেন, ঐ জানোয়ারটা যেদিন পুলিশের হাতে ধরা পড়ল, তার পরদিনই ওর আরও একটা বিয়ে হবার কথা ছিল। ওটাহলেই হাফ ডজন হয়ে যেত।
মেয়েটি খুব জোর বেঁচে গেছে।
কিন্তু ঐ পাঁচটা মেয়ের কথা ভাবতে গেলেই আমার মাথা ঘুরে ওঠে! একজন তো আত্মহত্যাই করেছিল।
তাই নাকি?
তবে কী? এ আঘাত সবাই সইতে পারে?
ঐ অপর্ণা কী পাঁচজনের একজন?
হ্যাঁ।
৬. এ সংসারে আমরা সবাই
এ সংসারে আমরা সবাই মনে করি, সবকিছু জানি। সাধারণতঃ মানুষ–মানুষ এতই অহংকারী হয় যে, সে কিছুতেই স্বীকার করবে না, খুব সামান্য বিষয়েই তার জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা আছে, অধিকাংশ বিষয়েই সে অন্ধকারে। অহংকার আমারও ছিল। খবরের কাগজের রিপোর্টর বলে নিজেকে প্রায় সবজান্তাই মনে করতাম।