- বইয়ের নামঃ সোনালী
- লেখকের নামঃ নিমাই ভট্টাচার্য
- প্রকাশনাঃ দে’জ পাবলিশিং (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. খোকন থমকে দাঁড়িয়ে বলল
খোকন ওকে দেখেই থমকে দাঁড়িয়ে বলল, কী আশ্চর্য! তুই শাড়ি পরেছিস!
সোনালী ওকে প্রণাম করে সুটকেশটা হাতে নিয়ে বলল, তুমি কি ভেবেছ আমি চিরকালই ছোট থাকব?
খোকন ড্রইংরুম পার হয়ে ভিতরের দিকে যেতে যেতে বলল, না, না, তুই মস্ত বড় হয়েছিস।
সোনালী সঙ্গে সঙ্গে খোকনের মার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, আমি বড় হইনি বড়মা?
খোকনের মা হাসতে হাসতে বললেন, হয়েছিস বৈকি!
শুনলে তো খোকনদা?
এখন আমি এসে গেছি। এখন আর বড়মা বা জ্যাঠামণিকে তেল দিয়ে লাভ নেই। এখন আমাকেই তেল দে।
সোনালী ঘরের একপাশে সুটকেশটা রেখে রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে নির্বিকার হয়ে বলল, আমি কাউকে তেল দিই না।
বাজে ফড়ফড় না করে চা দে।
সোনালী রান্নাঘরে চলে যেতেই খোকন বলল, দেখো মা, যত দিন যাচ্ছে সোনালীকে দেখতে তত সুন্দর হচ্ছে।
ওকে দেখে তো কেউ ভাবতেই পারে না ও আমাদের মেয়ে না।
খোকন হেসে বলল, তুমি ওকে যা সাজিয়ে-গুজিয়ে রাখো…।
বাজে বকিস না। ওকে দেখতেই ভালো। একটা সাধারণ শাড়ি-ব্লাউজ পরলেও ওকে দেখতে ভালো লাগে।
খোকন মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, তুমি যাই বলল মা, তুমি ওকে আদর দিয়ে দিয়েই…
তুই বাড়িতে এসেই আমার পিছনে লাগবি না।
সোনালী চা নিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতেই বলল, তোমার স্বভাব আর কোনোদিন বদলাবে না খোকনদা।
ঠাকুমা-দিদিমার মতন কথা বলবি তো এক থাপ্পড় খাবি।
আমাকে থাপ্পড় মারলে তুমিও বড়মার কাছে থাপ্পড় খাবে।
খোকন চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল, সত্যি, বাবা-মা তোকে আদর দিয়ে দিয়ে এমন মাথায় চড়িয়েছেন যে এরপর তোকে সামলানোই দায় হবে।
খোকনের মা জিজ্ঞাসা করলেন, হারে, তোর কলেজ খুলবে কবে?
কলেজ পনেরোই জুলাই খুলবে। তবে আমাকে দিন পনেরো পরেই ফিরে যেতে হবে। খোকন হাসতে হাসতে বলল, ছুটির মধ্যেই আমাদের টিউটোরিয়াল হবে।
খোকনের মা আর কিছু না বললেও সোনালী বলল, মাত্র পনেরো দিনের জন্য এত খরচা করে এলে কেন?
তোকে শায়েস্তা করতে।
যতদিন বড়মা জ্যাঠামণি আছেন, ততদিন আমার জন্য তোমাকে কিছুই করতে হবে না।
দ্যাখ সোনালী, আমি এ বাড়ির একমাত্র ছেলে।
আমি এ বাড়ির একমাত্র মেয়ে।
খোকনের মা হাসতে হাসতে বললেন, তুই ওর সঙ্গে পেরে উঠবি না। সোনালী এখন মাঝে মাঝে আমাকে আর তোর বাবাকেও শাসন করে।
সোনালী ঘর থেকে বেরিয়ে কয়েক মিনিট পরে এসেই বলল, নাও খোকনদা, এবার চান করতে যাও।
আগে আরেক কাপ চা দে।
আর চা খেতে হবে না।
কবিরাজি না করে যা বলছি শোনো।
বড়মার সামনে এই ধরনের কথা বলে?
খোকন হেসে বলে, আচ্ছা আর বলব না। তুই এক কাপ চা খাওয়া।
সোনালী রান্নাঘরের দিকে পা বাড়িয়েই পিছন ফিরে বলল, বড়মা, তুমি জ্যাঠামণিকে টেলিফোন করবে না? জ্যাঠামণি হয়ত ভাবছেন, খোকনদা এখনও আসেনি।
হ্যাঁ করছি।
.
খোকন বাথরুম থেকে বেরুতেই ওর মা ডাকলেন, খোকন খেতে আয়।
খোকন টেবিলে এসে বসতেই সনালী খেতে দিল।
তুমি খাবে না মা?
তুই খেয়ে নে। আমি আর সোনালী পরে বসব।
পরে বসবে কেন? এখনই বসো।
সোনালী মুখ টিপে হাসতে হাসতে বলল, তোমার মাছ বেছে দিতে দিতে বড়মার খেতে অসুবিধে হয়। তুমি নামেও খোকন কাজেও খোকন।
দ্যাখ সোনালী, আমি এ বাড়ির একমাত্র ছোট ছেলে।
তুমি কখনও এ বাড়ির একমাত্র বড় ছেলে, আবার কখনও একমাত্র ছোট ছেলে।
খোকনের মা হেসে উঠলেও খোকন ওর কথার কোনো জবাব না দিয়ে আলু-পটলের তরকারি মাখা ভাত মুখে দিয়েই বলল, তরকারিটা লাভলি হয়েছে।
খোকনের মা বললেন, সব রান্নাই সোনালীর।
ইস! কি নুন হয়েছে।
খোকনের মা হেসে উঠলেও সোনালী গম্ভীর হয়ে বলল না জেনে প্রশংসা করলে অন্যায় হয় না।
গ্রামের বুড়িদের মতন বেশ তো প্যাঁচ মেরে কথা বলতে শিখেছিস?
সোনালী হেসে বলে, যাই বলো বড়মা, খোকনদা না থাকলে বাড়িতে লোজন আছে বলেই মনে হয় না।
খোকন জিজ্ঞেস করল, তুই একলা একলা ঝগড়া করতে পারিস না?
তুমি পারো বুঝি?
আমি কি ঝগড়া করতে জানি নাকি?
খাওয়া-দাওয়ার পর কিছুক্ষণ ছেলের সঙ্গে গল্প করে খোকনের মা শুতে গেলেন। খোকন নিজের ঘরে শুয়ে শুয়ে ডাকল, সোনালী একগ্লাস জল দিয়ে যা।
সোনালী এক গেলাস জল নিয়ে ঘরে ঢুকতেই খোকন ইশারায় ওকে কাছে ডেকে বলল, দেশলাইটা আন ভো।
সোনালী এক গাল হাসি হেসে দুটো আঙুল ঠোঁটের উপর চেপে ধরে একটা টান দিয়ে বলল, ধরেছ?
বাজে বকিস না। তাড়াতাড়ি আন।
অত ধমকালে আনব না।
আচ্ছা প্লীজ আন।
সোনালী দেশলাই আনতেই খোকন সিগারেট ধরিয়ে টানতে শুরু করল।
বেশ পাকা ওস্তাদ হয়ে গেছ দেখছি।
আস্তে। মা শুনতে পাবে।
অ্যাসট্টে লাগবে না?
হ্যাঁ হ্যাঁ, প্লীজ নিয়ে আয়।
সোনালী আঁচল দিয়ে ঢেকে অ্যাসট্রে এনে জিজ্ঞেস করল, রোজ কটা খাও?
এক প্যাকেটের বেশি না।
সোনালী চোখ দুটো বড় বড় করে বলল, এক প্যাকেট!
খোকন মৌজ করে টান দিতে দিতে বলল, আমি তো তবু কম খাই।
এক প্যাকেট কম হলো?
হোস্টেলের সব ছেলেরাই দুই-তিন প্যাকেট খায়।
অত সিগারেট খেলে তো টি বি হয়ে যাবে।
ওসব বাজে কথা ছেড়ে দে।
বেশি সিগারেট খাওয়া খারাপ না?
সে রকম ধরতে গেলে তো সব নেশাই খারাপ।
তবে?
তবে আবার কি?
তাহলে জেনে-শুনে নেশা করছ কেন?
আজকালকার যুগে সবাই কিছু না কিছু নেশা করে।
সবাই মোটেও করে না।
সবাই মানে অধিকাংশ লোকই…
জানো খোকনদা, সিগারেটের গন্ধটা আমার দারুণ লাগে!
ভালো লাগে?
খুউব।
খোকন হাসে।
সোনালী একটু থেমে বলে, তবে যে যাই বলুক, কলেজের ছেলেরা একটু-আধটু সিগারেট খেলে বড্ড ক্যাবলা ক্যাবলা লাগে।
খোকন ওর কথা শুনে একটু জোরেই হাসে।
হাসছ কেন।
তোর কথা শুনে।
আমি কি এমন হাসির কথা বললাম?
খোকন ওর কথার জবাব না দিয়ে পর পর দু-তিনটে টান দিয়ে সিগারেটটা অ্যাসট্রেতে ফেলে দেয়।
আচ্ছা খোকনদা, আমি কি সত্যিই বেশ বড় হয়ে গেছি? নিজের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে সোনালী প্রশ্ন করে।
খোকন ওর দিকে একবার ভালো করে দেখে বলল, তা একটু হয়েছিস। তুমি বড়দিনের ছুটিতে যা দেখেছিলে আমি তার থেকে বড় হয়েছি?
নিশ্চয়ই হয়েছিস।
দেখে বুঝা যায়?
শাড়ি পরে তোকে একটু বড় লাগছে।
তুমিও যেন হঠাৎ বড় হয়ে গেছ।
তাই নাকি?
সত্যি বলছি।
খোকন হাসে।
সোনালী হেসে বলে, সামনের বার হয়তো দেখব তুমি দাড়ি কামাতে শুরু করেছ।
খোকন একবার নিজের মুখে হাত বুলিয়ে বললে, সামনের বার না হলেও বছর খানেকের মধ্যে শুরু করতেই হবে।
ভালো কথা খোকনদা, মীরাদির বিয়ে হয়ে গেল।
প্রদীপ আমাকেও একটা কার্ড পাঠিয়েছিল। তোরা গিয়েছিলি?
জ্যাঠামণির অফিসে মিটিং ছিল বলে যেতে পারেননি। আমি আর বড়মা গিয়েছিলাম।
জামাইবাবু কেমন হলো রে?
খুব সুন্দর।
আজকালের মধ্যেই একবার প্রদীপদের বাড়ি যেতে হবে।
প্রদীপদা বোধহয় আজ বিকেলে আসবে।
ও এসেছিল নাকি?
দু-তিন দিন আগে এসেছিলেন।
ও জানে আমি আজ আসছি?
প্রদীপদা বসে থাকতে থাকতেই তোমার চিঠিটা এলো।
তাই নাকি?
হ্যাঁ।
আর কেউ আমার খোঁজ নিতে এসেছিল?
একদিন মানসদা এসেছিলেন।
মানস? খোকন একটু বিস্মিত হয়েই জিজ্ঞাসা করল।
মানসদা এসেছিল শুনে তুমি চমকে উঠলে কেন?
ও হতভাগা লিখেছিল বিলেত যাচ্ছে।
এবার সোনালী চমকে ওঠে, তাই নাকি?
স্টেশনে নেমেই মাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আমার কোনো বন্ধু-বান্ধব এসেছিল কিনা, মা বলল না কেউ তো আসেনি।
বড়মা অত খেয়াল করেননি।
তোর মতন একটা প্রাইভেট সেক্রেটারি না থাকলে আমি যে কী মুশকিলেই পড়তাম।
সোনালী হেসে বলল, জ্যাঠামণিও ঠিক একই কথা বলেন।
মা রেগে যায় না?
না। বড়মা বলেন, আমি তোমার প্রাইভেট সেক্রেটারি হবো কোন্ দুঃখে?
সত্যি, মা যদি এম-এস সি পাস করে রিসার্চ বা প্রফেসারী করতেন, তাহলে অনেক উন্নতি করতেন।
বড়মা আমাকে পড়াতে পড়াতে কি বলেন জানো?
কি?
বলেন তোর জ্যাঠামণিকে বলে আয় আমার মতন মাস্টার রাখতে হলে মাসে মাসে আড়াই শ টাকা লাগবে।
বাবা কি বলেন?
জ্যাঠামণি গম্ভীর হয়ে বলেন, বিয়ের সময় লাখ টাকা নগদ না দিলে স্বামীর ঘরে এসে এসব খেসারত দিতে হয়।
খোকন আবার একটা সিগারেট ধরাতেই সোনালী বলল, তুমি আবার সিগারেট খাচ্ছ?
দেখতে পাচ্ছিস না?
এই তো, একটু আগে খেলে।
একটু আগে মানে ঘণ্টা খানেকের উপর হয়ে গেছে।
হলেই বা!
গল্প-গুজব করতে গেলেই একটু বেশি সিগারেট খাওয়া হয়। কলেজ ছুটির দিনে তো হোস্টেলের ঘরে ঘরে দার্জিলিং-এর মতন মেঘ জমে যায়।
হোস্টেলে খুব মজা হয়, তাই না খোকনদা?
অতগুলো রাজার বাঁদর এক জায়গায় থাকলে মজা তো হবেই।
হোস্টেলে তোমাদের দেখাশুনার জন্য কোন প্রফেসর থাকেন না?
থাকেন।
খোকন সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে বলল, মাঝে মাঝে তাকে আমরা এমন টাইট দিই যে তিনি আর এক সপ্তাহ আমাদের ধারে কাছে আসেন না!
প্রফেসরকে তোমরা কী টাইট দেবে?
কত রকম টাইট দিই, তার কি ঠিক-ঠিকানা আছে।
যেমন?
খোকন মুখ টিপে টিপে হাসতে হাসতে সিগারেট খায় কিন্তু কোন কথা বলে না।
সোনালী অধৈর্য হয়ে ওঠে। বলে, বলো না খোকনদা, প্লীজ। হোস্টেলের গল্প শুনতে আমার খুব ইচ্ছে করে।
না তোকে বলব না।
কেন?
তুই কখন যে মাকে বলে দিবি, তার কি ঠিক আছে!
না, না, বলব না।
ঠিক বলছিস?
সত্যি বলছি, কাউকে বলব না।
তুই জ্যাঠামণি আর বড়মার যা ভক্ত, তোকে হোস্টেলের কথা বলতে সত্যি ভয় হয়।
মা কালীর নামে বলছি কাউকে কিছু বলব না।
খোকন সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে বলল, রোজ সকাল-সন্ধেয় হোস্টেল সুপারিন্টেন্ডেন্ট একবার আমাদের দেখতে আসেন।
কি দেখতে আসেন?
সব ছেলেরা ঘরে আছে কিনা বা পড়তে বসেছে কিনা। তাছাড়া বাইরের কোন ছেলে আছে। কিনা তাও চেক করেন।
হোস্টেলে বাইরের ছেলে থাকতে পারে?
বাইরের মানে কলেজেরই বন্ধু-বান্ধব। অনেক সময় নাইট শোতে সিনেমা দেখে বাড়িতে না ফিরে হোস্টেলেই কারুর কাছে থেকে যায়।
বুঝেছি।
হতভাগা বোজ ভোর ছটায় এসে আমাদের উৎপাত করে। একদিন সবাই মিলে ঠিক হল আমরা সবাই দরজা খুলে ন্যাংটো হয়ে শুয়ে থাকব।
শুনেই সোনালী দাঁত দিয়ে জিভ কাটল। লজ্জা আর বিস্ময়মাখা দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে বলল, এ রাম!
অত রাম রাম করলে শুনতে হবে না।
আচ্ছা, আচ্ছা, বলল।
মৌজ করে সিগারেটে টান দিয়ে খোকন বলল, পরের দিন ভোরবেলায় হোস্টেলের দেড়শ ছেলেকে তৈলঙ্গস্বামী হয়ে শুয়ে থাকতে দেখে…
তোমাদের লজ্জা করল না?
হোস্টেলে থাকলে লজ্জা ঘেন্না ভয় বলে কিছু থাকে না।
একটু চুপ করে থাকার পর সোনালী জিজ্ঞাসা করল, পরে উনি কিছু বললেন না?
আমরা কি কচি বাচ্চা?
তবুও এই রকম একটা কাণ্ডর পর কিছুই বললেন না?
শুনেছিলাম সবাইকে ফাইন করা হবে কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভয়ে আর কিছু করেননি।
তাহলে হোস্টেলে বেশ ভালোই আছ।
এমনি বেশ মজায় থাকি তবে খাওয়া-দাওয়ার বড় কষ্ট।
কেন?
কি বিচ্ছিরি রান্না, তুই ভাবতে পারবি না।
তাই নাকি?
হ্যাঁরে। গলা দিয়ে নামতে চায় না।
এক গাদা টাকা নিচ্ছে অথচ…
শালারা চুরি করে।
তাহলে তোমরা কি করে খাও?
কি আর করব বল? বাধ্য হয়ে খিদের জ্বালায় সবাই খেয়ে নেয়।
বড়মা তাহলে ঠিকই বলেন।
মা কি বলে?
কালও বাজার করতে গিয়ে তোমার খাওয়া-দাওয়ার কষ্টের কথা বলছিলেন।
আজ আমি যা খেলাম, হোস্টেলে এর সিকি ভাগও খাই না।
আজকের রান্নাগুলো তোমার ভালো লেগেছে?
আমি ভাবতেই পারিনি তুই এত ভালো রান্না শিখেছিস।
আজকাল বড়মাকে আমি বিশেষ রান্নাঘরে ঢুকতে দিই না।
সব তুই করিস?
বড়মা বেশিক্ষণ রান্নাঘরে থাকলেই শরীর খারাপ হয়। হঠাৎ এক একদিন এমন মাথা ধরে যে বিছানা থেকে উঠতে পারেন না।
মা যে কিছুতেই ঠিক মতন ওষুধ খাবে না।
তুমিও ঠিক জ্যাঠামণির মতন কথা বলছ।
খোকন আর শুয়ে থাকে না উঠে পড়ে। বলে, যাই, এবার একটু মার কাছে শুই।
সোনালী হেসে বলল, তুমি কলেজে পড়লেও এখনো সত্যিকার খোনই থেকে গেছ।
খোকন ঘর থেকে বেরুতে বেরুতে বলল, আমি কি বুড়ো হয়ে গেছি যে মার কাছে শুতে পারি না?
আমি কি তাই বলেছি? কিন্তু…
সোনালীকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই খোকন একটু চাপা গলায় বলল, মার পাশে শোবার দিন তো ফুরিয়ে আসছে।
কেন?
কেন আবার? এর পর বউয়ের পাশে…
এ রাম! কি অসভ্য!
খোকন সোনালীর একটা হাত চেপে ধরে বলে, এতে অসভ্যতার কি আছে? আমি যেমন বউয়ের পাশে পোবো তুইও তেমন স্বামীর…
সোনালী অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বলল, আঃ খোকনদা, কী অসভ্যতা হচ্ছে।
খোকন সোনালীর হাতটা ছেড়ে দিয়ে বলল, বিয়ে করা কি অন্যায়?
অন্যায় হবে কেন?
তবে বিয়ে করার কথা বলতেই তুই আমাকে অসভ্য বললি কেন?
যখন বিয়ে করবে তখন এসব কথা বোলো। সোনালী একটু হেসে বলল, এখন বিয়ে করতে চাইলেও তোমাকে বিয়ে দেওয়া হবে না।
তুই কি আমার বিয়ে দেবার মালিক?
মালিক না হলেও আমার মতামতেরও অনেক দাম আছে।
তাই নাকি?
নিশ্চয়ই।
খোকন আর দাঁড়ায় না। সোনালীও উঠলো। বলল, আমি কিন্তু একটু পরেই চা করব।
.
খোকন মাকে জড়িয়ে শুতেই উনি বললেন, তুই এলি আর আমার দুপুরবেলার বিশ্রামের বারোটা বাজল।
তুমি ঘুমোও না।
এমন করে জড়িয়ে থাকলে কেউ ঘুমোত পারে?
অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছ। আর ঘুমোতে হবে না।
কেন, কটা বাজে?
চারটে।
এর মধ্যেই চারটে বেজে গেল?
সময় কি তোমার জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে?
এই তোর বকবকানি শুরু হলো।
সত্যি মা, তোমার কাছে এলেই বকবক করতে ইচ্ছে করে।
মাকে জ্বালাতন না করে কি তোর শান্তি আছে?
মার কথা শুনে খোকন হাসে।
এতক্ষণ তুই কি করছিলি?
সোনালীকে হোস্টেলের গল্প বলছিলাম।
ছুটির মধ্যে তোদের কি সত্যি টিউটোরিয়াল হবে?
আরে দূর। কে ছুটির মধ্যে টিউটোরিয়াল করবে?
তবে যে বলছিলি দিন পনেরো পরেই যেতেই হবে?
ও সোনালীকে ক্ষ্যাপাবার জন্য বলছিলাম।
তুই আসবি বলে ও আজ কটায় উঠেছে জানিস?
কটায়?
পাঁচটারও আগে।
খোকন শুনে হাসে।
ওর মা বললেন, সকাল আটটা থেকে ও আমাকে স্টেশনে যাবার জন্য তাড়া দিতে শুরু করল।
আচ্ছা মা, সোনালীদের বাড়ির কি খবর?
বিহারীর দোকানটা মোটামুটি ভালোই চলছে আর সন্তোষকে তো তোর বাবা ওঁদেরই অফিসে ঢুকিয়ে দিয়েছেন।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। তুই জানিস না?
না।
সোনালী ওদের বাড়ি যায়?
প্রত্যেক মাসেই যায় তবে রাত্তিরে থাকে না।
কেন?
ও আর আজকাল আমাদের ছেড়ে থাকতে পারে না।
খোকন আবার হাসে।
ওর মা বলেন, তাছাড়া ও না থাকলে আমাদেরও খুব খারাপ লাগে।
তা তো লাগবেই।
বিশেষ করে তোর বাবার তো এক মিনিট ওকে না হলে চলবে না।
তাই নাকি?
ওর মা হেসে বললেন, সোনালী যেদিন ওর বাবা-মার কাছে যায় সেদিন তোর বাবাকে দেখতে হয়।
কেন? কি করেন?
অফিস থেকে বাড়ি ফিরে মিনিটে মিনিটে আমাকে শোনাবেন, হতভাগী মেয়েটা না থাকলে বাড়িটা এত ফাঁকা ফাঁকা লাগে যে।
খোকন হেসে বলে, আচ্ছা।
তারপর আটটা বাজতে না বাজতেই নিজে গাড়ি নিয়ে ছুটবেন।…
খোকন একটু জোরেই হাসে।
এখনই হাসছিল? আসলে উনি সোনালীকেই আনতে যান কিন্তু ওখানে গিয়ে বলবেন, কাল ভোরবেলায় চলে আসিস।
সোনালী থাকে?
ও হতভাগীও জানে, জ্যাঠামণি ওকে আনতেই গেছে। ও জ্যাঠামণির গাড়ি চেপে চলে আসে।
সোনালী ট্রেতে করে তিন কাপ চা নিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলে, জানো খোকনদা, বাড়িতে এসে দেখি বড়মা আমার জন্য রান্না করছেন।
খোকনের মা নিজের দুর্বলতা ঢাকার জন্য কোনমতে গম্ভীর হয়ে বললেন, আমি যখন জানি তুই আসবিই তখন তোর জন্য রান্না করব না?
খোকন চায়ের কাপে চুমুক দিয়েই মাকে বলে, যেমন বাবা তেমন তুমি! দুজনেই মেয়েটার মাথা খাছ।
ওর মা একটু রাগের ভান করে বলেন, তুই চুপ কর।
সোনালী খুশির হাসি হেসে বলল, ঠিক হয়েছে।
খোকন কটমট করে সোনালীর দিকে তাকিয়ে বলল, আমি তোর জ্যাঠামণি বা বড়মা না। ঠিক একটা থাপ্পড় খাবি।
খোকনের মা এবার সত্যি রেগে বললেন, কথায় কথায় থাপ্পড় মারা কি ধরনের কথা?
বেশ তো শাড়ি-টাড়ি পরছে। এবার কোন একটা হাবা-কানা ধরে বিয়ে দিয়ে দাও না।
সোনালী বলল, তোমার কি এমন পাকা ধানে মই দিয়েছি যে তুমি আমাকে তাড়াতে চাও?
খোকনের মা সোনালীর দিকে তাকিয়ে বললেন, দু-এক বছর পরে সত্যি তোর বিয়ের কথা ভাবতে হবে।
খোকন মুহূর্তের জন্য সোনালীকে একবার ভালো করে দেখেই বলল, দু-এক বছর দেরি করারই বা দরকার কী?
সোনালী গম্ভীর হয়ে বলল, আমার ব্যাপারে তোমাকে মাথা ঘামাতে হবে না।
খোকনের মা বললেন, খোকন যাই বলুক না কেন, এবার সত্যিই তোর বিয়ের কথা ভাবতে হবে।
সোনালী কোনো কথা না বলে লজ্জায় ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
২. পঁচিশ বছর আগেকার কথা
পঁচিশ বছর আগেকার কথা।
মিস্টার সরকার অফিস থেকে বাড়িতে ফিরেই স্ত্রীকে বললেন, শিবানী একটা খবর আছে।
স্বামীর গলার টাই খুলে দিতে দিতে শিবানী জিজ্ঞাসা করলেন, আবার বদলী নাকি?
না।
তবে আবার কি খবর?
মিস্টার সরকার দুহাত দিয়ে স্ত্রীর কোমর জড়িয়ে ধরে হাসতে হাসতে বললেন, যদি বলতে পারো তাহলে তোমাকে এক সপ্তাহের জন্য দার্জিলিং ঘুরিয়ে আনব।
এই বর্ষায় আমি দার্জিলিং যাচ্ছি না।
কেন?
আমি কি পাগল যে এই বর্ষায় দার্জিলিং যাব?
বর্ষাতেই তো দার্জিলিং যেতে হয়। শহরে কোন জানাশুনা লোক দেখা যাবে না। সারাদিন বেশ ঘরের মধ্যে…
অসভ্যতা না করে খবরটা বলো।
অফিস থেকে গাড়ি কিনতে বলেছে।
গাড়ি কিনতে বলেছে মানে?
মানে গাড়ি কেনার টাকা দেবে, মাসে মাসে আড়াইশো টাকা কেটে নেবে।
আর অ্যালাউন্স তো দেবে?
তা তো দেবেই।
তবে তোমাকে আমি গাড়ি চালাতে দিচ্ছি না।
তোমাকে চালাতে পারছি আর গাড়ি চালাতে পারব না?
স্বামীর জামার বোতাম খুলতে খুলতে শিবানী জিজ্ঞাসা করলেন, কবে গাড়ি কিনতে হবে?
এই মাসের মধ্যেই কিনতে হবে!
কি গাড়ি কিনবে?
তুমি বলো।
অস্টিন। ঘোটর মধ্যে ভারি সুন্দর গাড়ি।
তোমার দাদার অস্টিন আছে বলে কি আমাকেও অস্টিনই কিনতে হবে?
এই পৃথিবীতে যেন আমার দাদাই একমাত্র অস্টিন চড়েন!
আমিও অস্টিন কিনব ভেবেছি!
আজে-বাজে রঙের গাড়ি নিও না।
তুমি কি রঙের চাও?
স্টিল গ্রে।
.
নমস্কার স্যার। আমাকে চৌধুরী সাহেব…
তোমার নামই কি বিহারীলাল দাস?
হ্যাঁ স্যার।
চৌধুরী তো তোমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
কৃতার্থের হাসি হেসে বিহারী বলল, ওঁদের বাড়ির সবাই আমাকে খুব স্নেহ করেন।
তাই বলছিল বটে।
আমার বাবা চৌধুরী সাহেবের বাবার গাড়ি চালাতেন। আর চৌধুরী সাহেব তো আমার কাছেই গাড়ি চালানো শিখেছেন।
শিবানী বললেন, এই সাহেবকে স্টিয়ারিং ধরতে দেবে না।
বিহারী হাসে।
না না হাসির কথা নয়।
কিন্তু সাহেব যদি বলেন?
সাহেব কান্নাকাটি করলেও দেবে না।
শিবানীর কথায় শুধু বিহারী না মিস্টার সরকারও হাসেন।
হাসি থামলে মিস্টার সরকার বিহারীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, মাইনে-টাইনে কাজকর্মের ব্যাপারে চৌধুরী যা বলেছে তাতে আপত্তি নেই তো?
না স্যার।
সোমবার আমার গাড়ির ডেলিভারী পাব।
আমি কখন আসব স্যার?
সকাল নটা-সাড়ে নটার মধ্যে এসো।
বিহারী দুজনকে নমস্কার জানিয়ে চলে গেল।
সরকার দম্পতির জীবনে বিহারীলাল দাসের সেই প্রথম আবির্ভাব।
বছর ঘুরে পূজা এলো। শিবানী মিস্টার সরকারকে জিজ্ঞাসা করলেন, হ্যাঁগো বিহারীকে একটা ধুতি-পাঞ্জাবি দেবে না?
ও তো অফিস থেকে মাইনে পাবে।
তা পাক। হাজার হোক তোমাকে দাদা বলে ডাকে, আমাকে বউদি বলে। আমাদেরও তো একটা কর্তব্য আছে।
মিস্টার সরকার ও-কথার কোনো জবাব না দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, পূজায় তুমি আমাকে কি দিচ্ছ?
শিবানী স্বামীর কানে কানে বলল, অনেক অনেক ভালোবাসা।
বিহারী সত্যিই বড় ভালো মানুষ। সব সময় মুখে হাসি লেগে আছে। কোন সময় কাজে বলে না। সর্বোপরি অত্যন্ত সৎ লোক।
বউদি!
কি বিহারী?
একটা ভীষণ অন্যায় হয়ে গেছে।
মিসেস সরকার হেসে জিজ্ঞাসা করেন, তোমার না আমার?
আপনি কেন অন্যায় করবেন? আমারই অন্যায় হয়েছে।
কি হয়েছে?
শনিবার আপনাদের সিনেমার টিকিট কেটে বাকি পয়সা ফেরৎ দিতে ভুলে গিয়েছিলাম।
বিহারী একটা টাকা আর কিছু খুচরো পয়সা এগিয়ে দিতে গেলেও মিসেস সরকার নিলেন না। বললেন, এত বড় অন্যায় যখন করেছ তখন তোমাকে কিছু খেসারত দিতে হবে।
বলুন বউদি।
আমাকে একটু ঢাকুরিয়া নিয়ে যেতে হবে।
বিহারী এক গাল হাসি হেসে বলল, এ খেসারত দিতে তো আমি সব সময় প্রস্তুত।
মিসেস সরকার ঘুরে দাঁড়াতেই বিহারী বলল, বউদি পয়সাটা নিলেন না?
না।
ঢাকুরিয়া যাবার পথে বিহারী গাড়ি চালাতে চালাতেই মিসেস সরকারকে বলে, বউদি প্রায় তিন বছর গাড়ি কেনা হয়েছে কিন্তু একবারও আপনারা গাড়ি নিয়ে বাইরে কোথাও গেলেন না।
তোমার দাদার বলে সময় হয় না।
সামনের সপ্তাহেই তো দাদার তিন দিন ছুটি।
কেন?
অ্যানুয়াল কনফারেন্সের জন্য বেশি খাটতে হয়েছে বলে সামনের সপ্তাহে দাদার ডিপার্টমেন্টের সব অফিসারদের তিন দিন ছুটি।
ছুটির কথা তোমাকে কে বলল?
অফিসেই শুনেছি।
আজ?
আজ না। কনফারেন্স শেষ হবার দিনই সব অফিসারদের বলে দেওয়া হয়েছে।
অথচ তোমার দাদা আমাকে কিছুই জানাননি।
হয়তো ভুলে গিয়েছেন।
তোমার দাদার সব কথা মনে থাকে। শুধু ছুটির কথা বলতেই ভুলে যান।
বিহারী হাসে।
একটু চুপ করে থাকার পর মিসেস সরকার জিজ্ঞাসা করেন, সামনের সপ্তাহে কোন তিন দিন ছুটি জানো?
বৃহস্পতি-শুক্র-শনি।
তার মানে তো চার দিন ছুটি!
হ্যাঁ।
কিছুক্ষণ পরে বিহারী বলে, এই বছরে কোম্পানির অনেক মাল বিক্রি হয়েছে বলে এই ছুটির সময় বাইরে বেড়াবার জন্য বোধহয় কোম্পানি থেকেই খবর দেবে।
এসব কিছু আমাকে বলে না।
দাদা যেন জানতে না পারেন আমি আপনাকে বলেছি।
জানলেই বা কি হবে?
না বউদি, দাদাকে আমার কথা বলবেন না।
আচ্ছা বলব না।
.
মিস্টার সরকার গাড়িতে বসতেই বিহারী জিজ্ঞাসা করল, সোজা বাড়ি যাব?
হ্যাঁ।
পার্ক স্ট্রিট ছাড়িয়ে লাউডন স্ট্রিটে ঢুকতেই বিহারী বলল, দাদা একটা কথা বলব?
কি?
কাল বউদির জন্মদিন। কিছু কিনবেন না?
দেখেছ! একদম ভুলে গিয়েছিলাম।
গাড়ি ঘুরিয়ে নেব? চল গড়িয়াহাট ঘুরে যাই।
গড়িয়াহাটেই যখন যাচ্ছেন তখন ঢাকুরিয়ার দাদা-বউদিকে কাল আসার কথা বলে আসবেন কি?
মিস্টার সরকার একটু হেসে বললেন, বিহারী তুমি স্টিয়ারিং না ধরলে যে আমার সংসার করাই অসম্ভব হয়ে পড়বে।
কি যে বলেন দাদা?
দ্যাখো বিহারী, স্ত্রী-পুত্রকে শুধু অন্নবস্ত্র দিলেই সংসারে শান্তি আসে না। এইরকম ছোটখাটো দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করলেই সংসারে শান্তি পাওয়া যায়।
একটু পরে মিস্টার সরকার বললেন, ভালো কথা বিহারী, সামনের আঠারই আমাদের চৌধুরীর বাবা-মার বিয়ের ডায়মণ্ড জুবিলী। তার আগে তোমার বউদিকে নিয়ে একটা ভালো ধুতি আর শাড়ি কিনে আনার কথা মনে করিয়ে দিও তো।
দেবো।
ওদের দুজনের খেয়াল না থাকলেও বিহারীর ঠিক মনে আছে।
মিস্টার সরকারকে নিয়ে অফিসে বেরুবার সময় বলল, বউদি আমি দাদাকে পৌঁছে ফিরে আসছি।
কেন?
চৌধুরী সাহেবের বাবা-মার ধুতি-শাড়ি…
মিসেস সরকার হাসতে হাসতে বললেন, আমার একদম মনে ছিল না।
আপনি তৈরি হয়ে থাকবেন।
ঠিক আছে।
মিস্টার সরকার অফিস যাবার জন্য প্রায় তৈরি। শিবানী ওর পার্স, ডায়েরী, কলম, রুমাল এগিয়ে দিচ্ছেন।
বিহারী একটু দূর থেকেই বলল, বৌদি, দাদা কি তৈরি?
হ্যাঁ।
দাদা কি চেকটা নিয়েছেন?
শিবানী নয়, মিস্টার সরকার জিজ্ঞাসা করলেন, পেট্রোল পাম্পের চেক তত দিয়ে দিয়েছ। আজ আবার কিসের চেক?
বিহারী বলল, আজই তো ইন্সিওরেন্সের…
ওকে কথাটা শেষ করতে হল না। শিবানী বললেন, আজই তো প্রিমিয়াম দেবার লাস্ট দিন, তাই না?
মিস্টার সরকার বললেন, আমি তো একদম ভুলে গিয়েছিলাম।
শিবানী হাসতে হাসতে বললেন, আজ যদি বিহারী মনে না করিয়ে দিত তাহলে…
মিস্টার সরকার বিহারীকে শুনিয়েই একটু জোরে বললেন, বিহারী ভুলে গেলে ওকে শূলে চড়াতাম না!
.
এ সংসারে বিহারীর একটা বিশেষ ভূমিকা, বিশেষ মর্যাদা অনস্বীকার্য। ঘরে-বাইরের ছোট-বড় খুঁটিনাটি হাজার দিকেই ওর নজর। ওর নজর না দিয়ে উপায় নেই। সরকার দম্পতি জানেন, বিহারী যখন আছে তখন চিন্তার কিছু নেই।
তারপর একদিন এ-সংসারে খোকনের আবির্ভাব হতেই হঠাৎ সবকিছু মোড় ঘুরে গেল। বিহারী এখন আর পার্শ্ব চরিত্র নয়, এ সংসারের অন্যতম মুখ্য চরিত্র।
খোকনের অন্নপ্রাশন হয়ে গেল।
পরের দিন সকালে চা-জলখাবার খেয়ে সবাই মিলে গল্পগুজব হচ্ছিল। হঠাৎ মিস্টার সরকারের মা বললেন, যে যাই বলো, বিহারী না থাকলে কাল একটা কেলেঙ্কারি হতো।
শিবানী হাসতে হাসতে বললেন, আপনার আদুরে ছেলে শুধু চাকরি করতে জানে। কোনোমতে একদিন টোপর মাথায় দিয়ে বিয়ে করেছিল ঠিকই কিন্তু ওকে নিয়ে সংসার করা যে কি দায়, তা আমি আর বিহারী ছাড়া কেউ জানে না।
শিবানীর মা বললেন, এই বয়সের ছেলেরা কোন কালেই সংসারী হয় না। আরও দুটো-একটা ছেলেমেয়ে হোক, তারপর নিশ্চয়ই সংসারী হবে।
শিবানী একটু জোরেই হাসলেন। তারপর বললেন, এই খোকন হবার সময় আমার যা শিক্ষা হয়েছে তাতে আমার আর ছেলেমেয়ে হয়ে কাজ নেই।
মিস্টার সরকারের দিদি মীনা বললেন, যাইহোক শিবানী, আমি এবার বিহারীকে নিয়ে যাচ্ছি। চা বাগানে থাকতে হলে বিহারীর মতন একজন অল রাউন্ডার দরকার।
দিদি, তুমি কি আমার এই উপকারটুকু করার জন্যই দার্জিলিং থেকে এসেছ?
তুই বল শিবানী, ওই মহাদেব নোখোর স্বামীকে নিয়ে চা বাগানে থাকা যায়?
মীনার কথায় সবাই হাসেন।
মীনা বললেন, তোমরা হাসছ কিন্তু যে লোকটা অফিসে আর তাসের আড্ডা ছাড়া আর কিছু জানে না, তাকে নিয়ে…
ওকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে মিস্টার সরকারের ছোট বোন বীণা বললেন, দিদি বিহারীকে বউদি ছাড়বে না। তুই বরং আমার বরটাকে নিয়ে যা।
মীনা একবার অজয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, অজয় তো একটা ক্লাউন! ওকে নিয়ে কে সংসার করবে?
অজয় সঙ্গে সঙ্গে শিবানীকে বলল ডার্লিং, এই অপমানের পর এক্ষুনি চারটে রসগোল্লা আর পর পর দু কাপ চা না খেলে আমি আর বাঁচব না।
ইন্ডিয়া কিং সিগারেট চাই না?
আমি কি সুহাসদার মতন নেশাখোর?
তাও তো বটে!
হঠাৎ হন্তদন্ত হয়ে বিহারী এসে শিবানীকে বলল, বউদি, ছশো টাকা দিন!
শিবানী রেগেই বললেন, আমি টাকা পাব কোথায়? তোমার দাদার কাছ থেকে নাও।
বিহারী হেসে বলল, কালো হাত ব্যাগ থেকে এখন দিন। পরে আমি…
দ্যাখো বিহারী, তুমিও তোমার দাদার মতন বেশ ওস্তাদ হয়ে গেছ।
এখন দিন। পরে আমি ঠিক দিয়ে দেবো।
শিবানী উঠে ঘরের দিকে যেতে যেতে বললেন, তোমার দাদা বুঝি ভয়ে এলেন না?
দাদা একটু কাজে বেরিয়েছেন।
বাজে বোকো না। এক মিনিট আগে ওর গলা শুনলাম আর…
অজয় বললেন, ডার্লিং আমার টাকাটাও এনো।
শিবানী ঘুরে দাঁড়িয়ে অজয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার এক লাখ টাকাই আনব?
না, না, হাজার খানেক।
শিবানী মীনার দিকে তাকিয়ে বললেন, জানো দিদি, তোমাদের এই জামাই গতবার কলকাতায় এসে কি রকম ফোর-টোয়েন্টি করে আমার…
ডার্লিং তুমি সে টাকা এখনও পাওনি? আমি তো ফিরে গিয়েই তোমাকে চেক পাঠিয়েছিলাম।
ব্যাঙ্ক অফ বে অফ বেঙ্গলের চেক আমার দরকার নেই।
শিবানীর কথায় সবাই হেসে উঠলেন।
.
আস্তে আস্তে সবাই চলে গেলেন। সবার পৌঁছনোর সংবাদও এলো। সবাই চিঠিতে বিহারীর কথা লিখেছেন।
কদিন পরে শিবানী ওকে বললেন, বিহারী, চিঠিতে সবাই তোমার কথা লিখেছেন। মীনাদি আর অজয় লিখেছে তোমাকে নিয়ে ওদের ওখানে ঘুরে আসতে।
সত্যি বউদি, একবার ঘুরে এলে হয়।
ওরা এত করে বলেছে যে না গেলে অত্যন্ত অন্যায় হবে।
যাইহোক, খোকনের অন্নপ্রাশনের জন্য আপনাদের সব আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে বেশ আলাপ-পরিচয় হয়ে গেল।
তোমাকে তো সবারই খুব ভালো লেগেছে।
ভালো কথা বউদি, আপনাদের আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে আমার কত আয় হয়েছে জানেন?
আয় হয়েছে নাকি? কত?
তিনশো দশ টাকা পেয়েছি।
দেড়শো টাকা ব্যাঙ্কে জমা দিয়ে দিও।
না বউদি, এ টাকা থেকে কিছুই ব্যাঙ্কে রাখতে পারব না!
কেন?
সন্তোষের বইপত্তর কিনতে হবে, তাছাড়া এবার শীতে লেপতোষক না করালে…
পুরো টাকাই লাগবে?
হ্যাঁ বউদি।
ঠিক আছে, আমি তোমাকে একশো টাকা দেব। এই একশো টাকা ব্যাঙ্কে রেখে দেবে।
আপনাদের দয়ায় খেয়ে-পরে বেঁচে আছি। আপনি আবার টাকা দেবেন কেন?
খোকনের অন্নপ্রাশনে এত খাটা-খাটনি করলে…
দাদা তো আমাকে ধুতি-সার্ট কিনে দিয়েছেন। আবার…
এত বড় একটা কাজ তুমি উদ্ধার করে দিলে আর তোমাকে কিছুই দেবো না? তাই কী
দুদিন পরে বিহারী বলল, বউদি, ব্যাঙ্কে আমার কত জমেছে জানেন?
কত?
চোদ্দশো পঞ্চাশ।
এর একটি পয়সাতেও তুমি হাত দেবে না।
বিহারী হাসে।
সেদিন রাত্রে শুয়ে শুয়ে ওরা স্বামী-স্ত্রী খোকনের অন্নপ্রাশনের কথাই আলোচনা করছিলেন।
জানো শিবানী, আমি ভীষণ নার্ভাস ছিলাম।
কেন?
এত লোকজন নেমন্তন্ন করে যদি কোন কেলেঙ্কারি হয়, সেই ভেবেই আমি মনে মনে খুব নার্ভাস ছিলাম।
আর আমরা নেমন্তন্ন করতে তো কাউকে বাদ দিইনি।
বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজন, অফিসের লোকজন–এদের তো বাদ দেওয়া যায় না।
যাইহোক, বেশ ভালয় ভালয় সব হয়ে গেল।
তবে হ্যাটস অফ টু চৌধুরী আর বিহারী।
চৌধুরীদা বড় বাড়ির ছেলে। অনেক কাজকর্মের অভিজ্ঞতা থাকা স্বাভাবিক কিন্তু বিহারী যে এসব কাজেও এত এক্সপার্ট তা আমি ভাবতে পারিনি।
আমিও কল্পনা করতে পারিনি।
আমি ওকে একশো টাকা দিয়েছি।
খুব ভালো করেছ। ও ডেকরেটর আর মিষ্টির দোকানের বিল থেকে কত টাকা বাঁচিয়েছে জানো?
কত?
দুশো পঁচাত্তর টাকা।
তুমি হলে একটা পয়সাও বাঁচাতে পারতে না।
অসম্ভব।
তাছাড়া বিহারী খোকনকে কি দারুণ ভালোবাসে, তোমাকে কী বলব।
হ্যাঁ, খোকনও ওর খুব ভক্ত হয়ে উঠেছে। আই মাস্ট ডু সামথিং ফর বিহারী।
কি করবে?
আমাদের অফিসের সব ড্রাইভারের অ্যাকসিডেন্ট ইন্সিওরেন্স আছে। অফিসই প্রিমিয়াম দেয়। অফিসারদের ড্রাইভারদের অ্যাকসিডেন্ট ইন্সিওরেন্স করলে অফিস থেকে অর্ধেক প্রিমিয়াম দেবে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। ভাবছি, বাকি অর্ধেক প্রিমিয়াম আমি দিয়ে ওরও একটা…
খুব ভালো হবে। হাজার হোত কলকাতা শহরে ড্রাইভারী করা! কখন কি হয় কিছুই বলা যায় না।
তা তো বটেই।
.
দেখতে দেখতে খোকন তিন বছরের হল। বিহারী কদিন আসছে না। খোকনকে রোজ বিকেলে গাড়িতে বসাতেই হবে। ও স্টিয়ারিং নেড়ে-চেড়ে ঘণ্টা দুই কাটিয়ে দেয়।
সেদিন বিকেলে মিস্টার সরকার অফিস থেকে ফিরতেই শিবানী বললেন, জানো একটু আগে বিহারী এসে খবর দিয়ে গেল ওর একটা মেয়ে হয়েছে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। বিহারী খুব খুশি।
ছেলেটা এত বড় হবার পর মেয়ে হল, খুশি হবারই তো কথা। খোকন আরো একটু বড় হবার পর তোমার একটা মেয়ে হলে আমিও কি কম খুশি হবো?
এত সব খায় না।
খায় না মানে? আমাদের একটা মেয়ে হবে না?
একটা হবার ঠেলাতেই আমার জান বেরিয়ে গেছে। ন্যাড়া বেলতলায় বার বার যায় না।
তাই বলে…
ন্যাকামি কোরো না। ওই কষ্ট আমি আর সহ্য করতে পারব না।
খুব কষ্ট হয়? কষ্ট হবে কেন? এত আরাম লাগে যে…
শিবানী চলে গেলেন।
পরে চা খাবার সময় মিস্টার সরকার বললেন, শিবানী বিহারীর মেয়েকে একদিন দেখে এসো।
তুমি যাবে না?
না, না, আমি গেলে ওর স্ত্রী লজ্জা পাবে।
তা ঠিক।
দাদা কাল আপনি ট্যাক্সিতে অফিস যাবেন!
মিস্টার সরকার অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কেন? গাড়ির ফুয়েল পাম্প কি আবার গণ্ডগোল করছে?
বিহারী নির্মম ঔদাসীন্যের সঙ্গে বলল, গাড়ি ঠিকই আছে।…
তবে?
কাল খোনকে পোলিও ভ্যাকসিন দেবার জন্য…
মিস্টার সরকার জানেন বিহারীর এসব সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার কোন ফল নেই। তাই বললেন, ঠিক আছে।
খোকনের সঙ্গে বিহারীর খুব ভাব। মাত্র কমাসের শিশু হলেও বিহারীকে দেখলেই ও হাসবে, কোলে চড়ার জন্য হাত বাড়িয়ে দেবে।
খোকনকে কোলে নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে বিহারী শিবানীকে বলে, জানেন বউদি, আমি গত জন্মে খোকনের কাছে গাড়ি চালানো শিখেছিলাম।
শিবানী হাসতে হাসতে বলেন, তাই নাকি?
তাইতো এবার আমি ওকে গাড়ি চালানো শেখাব।
শিবানী ঠাট্টা করে জিজ্ঞাসা করেন, এখনই শেখাবে?
না বউদি, ঠাট্টার কথা নয়। আপনি দেখবেন খোকনের মতন ড্রাইভিং…
তোমার খোকন তো সবই করবে।
করবেই তো!
.
শিবানী হাসতে হাসতে স্বামীকে বললেন, বিহারী আজ কি বলছিল জানো?
কি?
ট্রাফিক পুলিশটা নম্বর নিয়েছে বলে ও বলছিল, খোকনকে পুলিশ কমিশনার হতেই হবে।
ও একটা বদ্ধ পাগল!
কিন্তু ও খোকনকে এত ভালোবাসে যে তা বলার নয়।
তা ঠিক।
বিহারীর বাড়ি থেকে ঘুরে এসেই শিবানী মিস্টার সরকারকে বললেন মেয়েটার রং কালো হলেও দেখতে ভারি সুন্দর হবে।
তাই নাকি?
দিন কয়েক পরে তুমিও একবার দেখে এসো। মেয়েটাকে তোমার নিশ্চয়ই ভালো লাগবে।
মিস্টার সরকার শিবানীর কানে কানে বললেন, যতদিন তুমি আমাকে একটা মেয়ে দিচ্ছ না, ততদিন অন্যের মেয়েদের নিশ্চয়ই ভালো লাগবে।
একটা ছেলে দিয়েছি। আমি আর কিছু দিতে পারব না।
ছি, ছি, ওকথা বলে না।
অত যদি মেয়ের সখ হয় তাহলে আরেকটা বিয়ে করো।
ঠিক আছে। ডিভোর্স করে তোমাকেই আবার বিয়ে করছি।
শিবানী হাসতে হাসতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
.
কদিন পরে বিহারী শিবানীকে বলল, বউদি, এবার দাদাকে গাড়ি চালানো শিখিয়ে দিই?
কেন?
আমি দু-চার দিন না থাকলে দাদার খুব অসুবিধে হয়।
কেন? অফিসের গাড়িতেই তো যাতায়াত করেন।
অফিস যাতায়াত চলে যায় ঠিকই কিন্তু আর তো কোথাও যেতে পারেন না।
এই বয়সে গাড়ি চালাতে গিয়ে…
দাদার কি এমন বয়স হয়েছে? অফিসের সাতজন ডেপুটি ডিভিশন্যাল ম্যানেজারের মধ্যে দাদার বয়স সব চাইতে কম।
শেখাবে শেখাও কিন্তু তোমার দায়িত্ব।
আপনি কিছু চিন্তা করবেন না বউদি। আমি তিন মাসের মধ্যেই দাদাকে এমন গাড়ি চালানো শিখিয়ে দেবো যে তখন আমি বড় জামাইবাবুদের টি গার্ডেনে চাকরি নিয়ে…
শিবানী হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি খোকনকে ছেড়ে যেতে পারবে?
বিহারী কোন জবাব দিতে পারে না। শুধু হাসে।
মাস চারেক পরের কথা।
স্টিয়ারিং-এ মিস্টার সরকার, পাশে বিহারী, পিছনে শিবানী আর খোকন।
দক্ষিণেশ্বর হয়ে গান্ধীঘাট। সেখান থেকে ঢাকুরিয়া হয়ে বাড়ি।
শিবানী হাসতে হাসতে বললেন, বিহারী, তোমার ছাত্র তাহলে অনার্স নিয়েই পাস করলেন।
৩. দিনগুলো বেশ কাটছে
দিনগুলো বেশ কাটছে। মিস্টার সরকার ডিভিশনাল ম্যানেজার হয়েছেন। বোম্বে বদলী হবার কথা হয়েছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত কলকাতাতেই থেকে গেছেন। মাঝে অবশ্য এক বছরের জন্য পাটনা যেতে হয়েছিল, তবে শিবানী বা খোকনকে নিয়ে যাননি। ওরা পাটনা গেলে খোকনের পড়াশোনার গণ্ডগোল হতো। মিস্টার সরকার প্রত্যেক মাসে একবার আসতেন। বিহারী ছিল বলে শিবানীর কোন অসুবিধে হয়নি। তাছাড়া শ্বশুর-শাশুড়ি মাস ছয়েক ছিলেন।
.
বিহাইকাকা, ও বিহাইকাকা, শুনে যাও। পড়ার ঘর থেকেই খোকন বিহারীকে ডাকে।
কিরে খোকনদা?
কাছে এসো। কানে কানে বলব। খুব প্রাইভেট কথা।
মিস্টার সরকার হাসতে হাসতে স্ত্রীকে বললেন, শিবানী তোমার ছেলের মাথায় বোধহয় কোন মতলব এসেছে।
শিবানীও হাসেন। বলেন, বিহারী আদর দিয়ে দিয়েই ছেলেটার বারোটা বাজাবে।
বিহারী কোন মতে হাসি চেপে গম্ভীর হয়ে বলল, আমি কী করলাম বউদি?
না, না, তুমি কি করবে? তুমি কিছু করোনি।
বিহারী কিছু বলার আগেই আবার খোকন ডাকল, কি হলো বিহাইকাকা? এলে না?
মিস্টার সরকার খোকনের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি এখানে এসে বলে যাও না!
আমি যে পড়ছি।
খোকনের জবাব শুনে তিনজনেই হাসেন।
বিহারী আর দেরি না করে খোকনের কাছে যায়। খোকন কানে কানে ফিস ফিস করে কি যেন বলে। বিহারীও ওর কানে কানে জবাব দেয়।
বিহারী ড্রইংরুমে ফিরে আসতেই ওরা দুজনে ওর দিকে তাকালেন। বিহারী একটু হেসে খুব চাপা গলায় ফিস ফিস করে বলল, আজ গেমস পিরিয়ডে খোকনের কেডস জুতোটা কে ব্লেড দিয়ে কেটে দিয়েছে।
শিবানী বললেন, তাই নাকি?
মিস্টার সরকার বললেন, এর আগের মাসেই তো…
যাকগে। ওকে কিছু বলবেন না। বউদি, আমাকে দশটা টাকা দিন। ওর একজোড়া মোজাও কিনতে হবে।
শিবানী বললেন, ওর কি মাসে মাসেই এক জোড়া জুতোমোজা লাগবে?
ছেলেরা যদি দুষ্টুমি করে, ও কি করবে? বিহারী এক নিশ্বাসেই বলে, তাছাড়া যে গরু দুধ দেয়, তার চাটিও ভালো লাগে।
মিস্টার সরকার হাতের খবরের কাগজ না নামিয়েই বললেন, খোকনের সব ব্যাপারেই বিহারীর ওই এক যুক্তি।
শিবানী বললেন, ছেলে আমার কি এমন একেবারে বিদ্যাসাগর হয়েছে যে…
ওকথা বলবেন না বউদি; খোকনের মতন ছেলে ওদের ক্লাশে আর একটাও নেই;
আবার ওঘর থেকে খোকনের গলা শোনা গেল, বিহাইকাকা, আমার পড়া হয়ে গেল।
এবার শিবানী হাসেন। সোফা থেকে উঠতে উঠতে বললেন, নতুন জুতো-মোজা কেনার জন্য আর পড়ায় মন বসছে না।
.
খোকন আরো বড় হয়।
সকাল বেলায় স্কুল যাবার সময় বিহারীকে বলে, বিহাইকাকা, তুমি ঠিক তিনটের মধ্যে বাড়ি চলে এসো। সাড়ে তিনটের মধ্যে মাঠে না পৌঁছলে ভালো জায়গা পাব না।
তুমি স্কুল থেকে বাড়িতে এসেই একবার ফোন কোরো।
না, না, আমি বাবাকে ফোন করব না। অফিসে ফোন করলেই বাবা ভীষণ রেগে যায়।
তাহলে বউদিকে বোলো।
মার তখন ঘুমুবার সময়। মাকে ফোন করতে বললে মাও রেগে যাবে। তুমি চলে এসো।
বিহারীকে আসতেই হয়। না এসে পারে না।
সন্ধের পর মাঠ থেকে ফিরে এসেই বিহারী বলে, বউদি, এক বাটি সরষের তেল দিন।
সরষের তেল কি হবে?
খোকনদা আমার কাধ-পিঠ মালিশ করবে।
শিবানী হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করেন, কেন? কি হয়েছে?
বিহারী একবার খোকনের দিকে তাকিয়ে বলে, এত বড় বুড়োধাড়ী ছেলেকে কাঁধে করে খেলা দেখাতে হলে…
খোকন আর চুপ করে থাকে না। বলে, বিহাইকাকা, অযথা আমাকে দোষ দেবে না।
তবে কাকে দোষ দেবো খোকনদা?
খোকন এবার মাকে বলে, জানো মা, বিহাইকাকাই আমাকে বলল, খোকনদা, আমার কাঁধে চড়। তা নয়ত কিছু দেখতে পাবি না।
.
বিহারী হাসতে হাসতে বলে, হারে খোকনদা, তুই কি চিরকালই আমাকে বিহাইকাকা বলবি?
ওর প্রশ্ন শুনে খোকনও হাসে। জিজ্ঞাসা করে, কেন, আমার বিহাইকাকা ডাক তোমার ভালো লাগে না?
তুই যা বলে ডাকবি তাই আমার ভালো লাগবে।
তাহলে তুমি ওকথা বলছ কেন?
এমনি জিজ্ঞাসা করছিলাম। বিহারী কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর জিজ্ঞাসা করে, আচ্ছা খোকন, এখন তো তুই একটু বড় হয়েছিস, তবে কেন তুই এখনও দাদা বউদিকে সব কথা বলতে পারিস না?
খোকন দুহাত দিয়ে বিহারীর গলা জড়িয়ে ধরে বলে, আমি তোমাকে বিরক্ত করি বলে তুমি রাগ করো?
দূর পাগল! তোর উপর আমি কখনও রাগ করতে পারি?
কিন্তু আমি তো তোমাকে খুবই বিরক্ত করি।
তুই বিরক্ত না করলে আমার পেটের ভাত হজমই হবে না।
দুজনে এক সঙ্গে হেসে ওঠে।
দুজনে আরো কত কথা হয়।
বিহারী বলে, আচ্ছা খোকন, আমি যদি কোনো কারণে তোদের বাড়িতে কাজ না করি…
খোকন একটু বিরক্ত হয়েই প্রশ্ন করে, তার মানে? তোমাকে কি মা বা বাবা কিছু বলেছেন?
না, না, কেউ কিছু বলেননি।
তাহলে তুমি হঠাৎ একথা বললে কেন?
কোনো কারণ নেই রে খোকনদা! এমনি বললাম। হাজার হোক মানুষের কথা কেউ কি কিছু বলতে পারে?
খোকন কিছুতেই বিশ্বাস করে না। বলে, না না বিহাইকাকা, তুমি চেপে যাচ্ছ।
বিহারী খোকনকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বলে, সত্যি বলছি কিছু হয়নি। তবে মনে মনে নানা কথা ভাবতে ভাবতে এসব কথা প্রায়ই মনে হয়।
না না বিহাইকাকা তুমি আর এসব ভাববে না। ঠিক তো?
বিহারী হাসে। বলে, ঠিক আছে খোকনদা, আমি আর এসব কথা ভাবব না।
.
বেশ চলছিল কিন্তু হঠাৎ একদিন সবকিছু ওলট-পালট হয়ে গেল।
অ্যাকসিডেন্ট।
মিস্টার সরকারের টেলিফোন পেয়েই শিবানী প্রায় পাগলের মতন চিৎকার করে উঠলেন, অ্যাকসিডেন্ট! তোমার?
না, না, আমি গাড়িতে ছিলাম না। বিহারী…
বিহারী নেই?
আছে আছে। হাসপাতালে…
কোথায় অ্যাকসিডেন্ট হলো?
আমার এক কলিগকে নিয়ে টিটাগড়ের কারখানায় যাবার পথে…
তোমার কোন কলিগ?
মিত্তির। তার কিছু হয়নি।
কিভাবে অ্যাকসিডেন্ট হলো?
একটা লরি অ্যাকসিডেন্ট করে পালাবার সময় আমার গাড়িতে এমন ধাক্কা লাগিয়েছে যে…
বিহারীর কোথায় লেগেছে?
বোধহয় বুকের দু-তিনটে হাড় ভেঙেছে আর ডান হাতটা…
ডান হাত নেই?
আছে, তবে বোধহয় কিছু কাটাকাটি করতে হবে।
কি সর্বনাশ!
যাই হোক আমি আবার এক্ষুনি হাসপাতালে যাচ্ছি…
তুমি একলা?
না, না, অফিসের অনেকেই হাসপাতালে আছে।…
কোন্ হাসপাতালে?
আর. জি. কর-এ। যাই হোক খোকনকে কিছু বোলো না। ও শুনলে…
আমি হাসপাতালে আসব?
এখন গিয়ে কোনো লাভ নেই। বিহারীকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গেছে।
দিন পনেরো পরে খোনকে দেখেই বিহারী কাঁদতে কাঁদতে বলল, খোকনদা ছুটির ঘণ্টা পড়লেও যেতে পারলাম না। তোর জন্য থেকে যেতে হল।
খোকন কাঁদতে কাঁদতে বলল, বিহাইকাকা, আমার আর গাড়ি চালানো শেখা হল না।
দাদা তোমাকে শেখাবেন।
না বিহাইকাকা, আমি অন্য কারুর কাছে শিখতে পারব না।
নারে খোকনদা, ওই অস্টিনে চড়িয়ে তোকে আমি নার্সিং হোম থেকে এনেছিলাম। তোকে ওই গাড়ি চালাতেই হবে।
না বিহাইকাকা, আমি ও গাড়ির স্টিয়ারিং টাচ করব না, কোনদিনও না। তুমি দেখে নিও। তিনমাস কেটে গেল।
হাসপাতাল থেকে ছুটি পাবার আগের দিন বিহারী মিস্টার সরকার আর শিবানীর দিকে তাকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি বাড়ি গিয়ে কি করব দাদা? বউদি, কিভাবে আমার সংসার চলবে?
মিস্টার সরকার বললেন, অত চিন্তা কোরো না সব ঠিক হয়ে যাবে।
কিন্তু যার ডান হাতের চারটে আঙুল নেই, সে কি কাজ করবে?
শিবানী বললেন, তোমার দাদা আর চৌধুরিদা যখন আছেন তখন তুমি অত ভাবছ কেন?
এই তিনমাস হাসপাতালে আসা যাওয়া করার জন্য বিহারীর স্ত্রী মিস্টার সরকারের সামনে একটু আধটু কথাবার্তা বলেন। বলতেই হয়। না বললে চলে না। উনি বিহারীকে বললেন, চৌধুরি সাহেব আর দাদা-বউদি যখন আছেন তখন আমিই সংসার চালিয়ে নেব তোমাকে কিছু করতে হবে না।
আমাকে যমের দুয়ার থেকে ফিরিয়ে আনতে ওঁরা যা করলেন, তার কোনোই তুলনা হয় না। ওঁরা আর কত করবেন?
.
চৌধুরিদের পুরনো গ্যারেজ আর ড্রাইভারের থাকার ঘর মেরামত হল। সামনের দিকে ছোট মুদিখানা দোকান বিহারীলাল স্টোর্স তার পিছনেই ওদের থাকার ব্যবস্থা। বিহারীর ছেলে সন্তোষ ক্লাস টেন-এ উঠেছে। ও আগের মতনই পড়তে লাগল। বিহারী দোকান চালায়। ওর স্ত্রী সংসার চালায় আর স্বামীকে দেখে। বিহারীর মেয়ে কালীকে শিবানী নিজের কাছে নিয়ে এলেন।
মিস্টার সরকার বললেন, যাই বলো বিহারী, তোমার মেয়ে এমন কিছু কালো নয় যে ওকে কালী বলে ডাকতে হবে।
দাদা, ও কালো না?
না, ও শ্যামবর্ণ।
বিহারী হেসে বলে, কালী যদি শ্যামবর্ণ হয়, তাহলে আমি ফরসা।
কালী একটা সোনার টুকরো মেয়ে। তাই আমি ওর নাম দিয়েছি সোনালী।
সোনালী!
হ্যাঁ সোনালী।
স্নেহ বড় বিচিত্র সম্পদ। স্নেহ দিয়ে বনের পশুকেও বশ করা যায়। সোনালীকে তো যাবেই।
সোনালী!
কি জ্যাঠামণি?
বড়মাকে বলে এসো আমি পরশুদিন চিড়িয়াখানা যাব। বাড়িতে ফিরতে দেরি হবে।
তুমি একলা যাবে জ্যাঠামণি?
আর কে যাবে?
আমি আর খোকনদা যাব না?
ওখানে বাঘ-সিংহ আছে। তোমাদের ভয় করবে।
তোমার ভয় করবে না?
করবে, তবে অল্প অল্প।
তোমার অল্প ভয় করবে কেন?
আমি যে বড় হয়েছি।
সোনালী একবার নিজেকে আপাদমস্তক দেখে বলল, আমিও বড় হয়ে গেছি।
তাই নাকি?
হ্যাঁ জ্যাঠামণি আমি বড় হয়ে গেছি।
কি করে বুঝলে?
আমাকে মা-বড়মা কেউ কোলে নিতে পারে না।
সোনালী মাথা নেড়ে ছোট্ট দুটো বিনুনি দুলিয়ে বলতে লাগল, না! পারে না।
তাহলে আমার সোনালী সত্যি বড় হয়েছে।
তাছাড়া আমি তো লুডো খেলাও শিখে গেছি।
সত্যি?
আমি মিথ্যে কথা বলি না। বড়মা বলেছে মিথ্যে কথা বললে জিভে ঘা হয়।
রবিবার সবাই মিলে চিড়িয়াখানা গেলেন। বাড়ি ফেরার পথে বিহারীর ওখানে।
গাড়ি থামতেই সোনালী চিৎকার করল, বাবা, আমি হাতির পিঠে চড়েছি।
তাই নাকি?
হ্যাঁ বাবা।
খোকনদা, তুই চড়েছিস?
তুমি এর মধ্যেই ভুলে গেলে বিহাইকাকা? তুমি আমাকে কতবার চড়িয়েছ মনে নেই?
আজ চড়েছিস? চড়েছি।
সোনালী দৌড়ে ভিতরে গিয়ে মাকে খবরটা দিয়েই আবার বাইরে বেরিয়ে আসে। পিছন পিছন ওর মা।
মিস্টার সরকার হেসে বললেন, সোনালী বড় হয়ে গেছে। আর আমাদের চিন্তা নেই। ও বাঘ-সিংহ দেখেও ভয় পায় না, তাছাড়া লুডো খেলাও শিখে গেছে।
চিড়িয়াখানার বাঘ-সিংহ দেখে কেউ আবার ভয় পায় নাকি?
শিবানী জিজ্ঞাসা করলেন, সন্তোষ কোথায়?
বউদি, ও আজকাল এই পাড়ারই একটা ছেলের কাছে পড়তে যায়। সেখানেই গেছে।
দোকান কেমন চলছে?
এক পয়সা ভাড়া তো দিতে হচ্ছে না, আর দাদা টাকা-পয়সার ব্যবস্থা যেভাবে করে দোকান সাজিয়ে দিয়েছেন তাতে তিনজনের মোটামুটি চলে যাচ্ছে।
বিহারীর স্ত্রী বললেন, আগের মতন এখন আর অত ঘাবড়ে যান না। দোকান তো উনি একলাই চালিয়ে নিচ্ছেন।
আরো কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলার পর শিবানী বললেন, সোনালী, তুই আজ এখানে থাক। কাল বিকেলে তোর জ্যাঠামণি এসে তোকে নিয়ে যাবে।
ঠিক নিয়ে যাবে তো?
মিস্টার সরকার হাসতে হাসতে বললেন, তুই না থাকলে এই বুড়োকে কে দেখবে?
তুমি মোটেও বুড়ো হওনি।
রওনা হবার আগে বিহারী একবার গাড়িটা দেখে, স্টিয়ারিংটা নাড়াচাড়া করে। তারপর বলে, বউদি, দাদাকে যদি গাড়ি চালানো না শেখাতাম তাহলে আজ কত অসুবিধে হতে বলুন তো!
দিন আরো এগিয়ে চলে। সোনালী আরো কাছে আসে, আরো আপন হয়। তারপর একদিন স্কুলে ভর্তি হয়। ভোরবেলায় যায়। দশটায় ছুটি। দুপুরে বড়মার কাছে বসে পরের দিনের পড়াশুনা করে নেয়। কখনও খোকনের সঙ্গে গল্প করে, লুডো খেলে। নয়তো ক্যারাম। খেয়াল হলে ডাইনিং টেবিলে টেবিল টেনিস।
আজ সোনালীর জন্মদিন। আজ স্কুলে যায়নি। ভোরবেলায় উঠে স্নান করে নতুন জামা পরে জ্যাঠামণি, বড়মা, খোকনদাকে প্রণাম করে। আশীর্বাদ নেয়। তারপর অফিস যাবার সময় মিস্টার সরকার ওকে বাবা-মার কাছে পৌঁছে দেন। পরের দিন সকালে সন্তোষ পৌঁছে দিয়ে যায়।
দিনগুলো বেশ কেটে যায়। দেখতে দেখতে বছরের পর বছর পার হয়।
.
জানালায় দাঁড়িয়ে দূর থেকে মিস্টার সরকারের গাড়ি দেখেই সোনালী দৌড়ে রান্নাঘরে গিয়ে কেটলি গ্যাসে চড়িয়ে দেয়। তারপর উনি গলিটা পার হয়ে বাড়ির সামনে গাড়ি থামাতে-না-থামাতেই সোনালী গ্যাস বন্ধ করে কেটলির মধ্যে চা ফেলে দেয়! উনি ঘরে বসতে-না-বসতেই সোনালী ট্রেতে দু কাপ চা আর চারটে বিস্কুট নিয়ে ঢোকে। শিবানী চা-বিস্কুট নামিয়ে সেন্টার টেবিলে রাখতে রাখতে বলেন, আমার মেয়ে তোমাকে কি রকম ভালোবাসে?
মিস্টার সরকার সোনালীকে কাছে টেনে নিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, তুই আমাকে সত্যি ভালোবাসিস?
সোনালী একটু হেসে মাথা নাড়ে।
আমি তোকে একটুও ভালোবাসি না।
সোনালী বেশ গম্ভীর হয়ে বলল, জ্যাঠামণি, তুমি মিথ্যে কথা বললে জিভে ঘা হবে আর বড়মা খুব রাগ করবে।
আমি মিথ্যে কথা বলছি না। আমি সত্যি তোকে একটুও ভালোবাসি না।
ভালো না বাসলে আমার ছবি অত বড়ো করে শোবার ঘরে ঝুলিয়ে রেখেছ কেন?
সোনালীর কথায় ওরা দুজনেই হাসেন।
সোনালী ভিতরে চলে যাবার পর শিবানী বললেন, সোনালী সত্যি তোমাকে খুব ভালোবাসে। তোমার আসার সময় হলে ও যেভাবে জানালায় দাঁড়িয়ে হাঁ করে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে, তা দেখে আমিই অবাক হয়ে যাই।
মিস্টার সরকার চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, তা ঠিক। আমার সবকিছু খুঁটিনাটি ব্যাপারেও ওর নজর আছে।
শিবানী হেসে বললেন, আজ স্কুল থেকে ফিরে আমাকে কি বলেছে জানো?
কি?
বলেছে, বড়মা, একটা লোকের পায়ে খুব সুন্দর একটা জুতো দেখলাম। জ্যাঠামণিকে ওই রকম জুতো কিনে দেবে? ওইরকম জুতো পরলে জ্যাঠামণিকে খুব সুন্দর দেখাবে।
মিস্টার সরকার হাসেন।
শিবানী চা খেতে খেতে বলেন, সেদিন ঢাকুরিয়ায় দাদাকে লখনৌ চিকনের পাঞ্জাবি পরতে দেখেই মেয়ে ধরল, বড়মা, জ্যাঠামণিকে ওই রকম পাঞ্জাবি তৈরি করে দাও।
তাই বুঝি তুমি লখনৌ চিকনের পাঞ্জাবি কিনে আনলে?
কি করব? সোনালী এমন করে ধরল যে পাঞ্জাবি না কিনে পারলাম না।
আজকাল আর খোকনের সঙ্গে ঝগড়া করে না?
না, আজকাল আর ঝগড়া হয় না। একটু বেশি তর্ক হলেই আমার কাছে ছুটে আসে।
বাড়িতে একমাত্র ছেলে বা মেয়ে সব সময় একটু বেশি আদুরে, একটু খামখেয়ালী হয়। সোনালী এসে সেদিক থেকে খোকনের উপকারই হয়েছে।
প্রথম প্রথম খোকনের মধ্যে একটু দ্বিধা ছিল।
দ্বিধা মানে?
মানে, ও ভারত ড্রাইভার বিহারীর মেয়ে, কিন্তু সে-ভাবটা আস্তে আস্তে চলে গেছে। এখন ওকে ঠিক নিজের বোনের মতনই ভালোবাসে।
দরজার ওপাশ থেকে সোনালী বলল, জ্যাঠামণি অফিসের জামা-কাপড় ছাড়বে না?
ওর কথায় ওরা দুজনেই হাসেন।
মিস্টার সরকার ওকে ডাকেন, সোনালী শুনে যা।
সোনালী ঘরে ঢুকে বলে, কী বলছ জ্যাঠামণি?
সোনালীকে কোলে বসিয়ে মিস্টার সরকার বললেন, এত খিদে লেগেছে যে উঠতে পারছি না।
আজ লাঞ্চের সময় কিছু খাওনি?
নারে।
কেন?
এত কাজে ব্যস্ত ছিলাম যে কিছুতেই উঠতে পারলাম না।
তার পরেও কিছু খেতে পারলে না?
মিস্টার সরকার ঠোঁট উল্টে বললেন, লাঞ্চের পর কি আর সময় হয়?
তাই বলে কি না খেয়ে কেউ কাজ করে নাকি? সোনালী উঠে দাঁড়িয়ে ওর হাত ধরে টানতে টানতে বলে, আর বকবক না করে এবার উঠে পড়ো।
মিস্টার সরকার সোনালীকে কোলে-তুলে নিয়ে বলেন,
আমাদের সোনালী
বেড়াতে যাবে মানালী
করে না হেঁয়ালি
আছে একটু খামখেয়ালি।
এক গাল হাসি হেসে সোনালী বলল, দেখলে বড়মা, জ্যাঠামণি কি সুন্দর কবিতা বানালো।
শিবানী হেসে বলল, তোর জ্যাঠামণি রবিঠাকুর হয়ে গেছে।
না বড়মা, ঠাট্টার কথা নয়। সত্যি কবিতাটি খুব সুন্দর হয়েছে।
মিস্টার সরকার হাসতে হাসতে বললেন, তোকে একটুও ভালোবাসি না বলেই তো কবিতাটা ভালো হল।
তুমি আমাকে ভালোবাস না? সোনালী মিট মিট করে হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করল।
মিস্টার সরকার মাথা নেড়ে বললেন, না।
সোনালী হাসতে হাসতে বলল, তাই বুঝি রোজ রোজ লুকিয়ে লুকিয়ে আমার জন্য…
মিস্টার সরকার হঠাৎ খুব জোরে চিৎকার করে বললেন, বাজে কথা বলবি না। আমি কোনোদিন কাউকে লুকিয়ে লুকিয়ে কিছু দিই না।
সোনালী হাসি চাপতে পারে না। বলে, তুমি লুকিয়ে দিলেও আমি সবাইকে বলে দিই।
আজেবাজে কথা বললে একটা থাপ্পড় খাবি।
সোনালী আর শিবানী হাসতে হাসতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
৪. মিস্টার সরকার বাড়ি ফিরতেই
মিস্টার সরকার বাড়ি ফিরতেই খোকন প্রণাম করল। ছেলেকে একবার ভালো করে দেখে নিয়ে বললেন, এই মাসে তুই বেশ লম্বা হয়েছিস তো।
শিবানী বললেন, ছেলের পায়ের দিকে তাকালেই বুঝবে কেন এত লম্বা হয়েছে।
মিস্টার সরকার ছেলের পায়ের দিকে তাকাতেই সোনালী বলল, হোস্টেলে গিয়ে খোকনদার অনেক কায়দা বেড়েছে।
খোকন সঙ্গে সঙ্গে ওর মাথায় একটা চাটি মেরে বলল, আবার ফড় ফড় করছিস?
তোমার কায়দা বেড়েছে, বলব না?
কিছু কায়দা বাড়েনি।
তোমার মাথার চুল আর পায়ের জুতো দেখে তো আমি প্রথমে…
আবার?
ড্রইংরুমে চা খেতে খেতে গল্প গুজব হয়। হঠাৎ মিস্টার সরকার বললেন, শিবানী চলল আমরা সবাই মিলে সপ্তাহ খানেকের জন্য পুরী ঘুরে আসি।
তুমি ছুটি পাবে?
তা পেয়ে যাব।
খোকন বলল, আগে জানলে আমি পুরী পর্যন্ত কনসেশন নিতে পারতাম।
মিস্টার সরকার বললেন, সে আর কি হবে।
শিবানী বললেন, রেল কোম্পানিকে অযথা কতকগুলো টাকা দিতে হতো না।
সোনালী বলল, পুরী তো এক রাত্তিরের জার্নি। আমি আর খোকনদা থ্রী টায়ারে চলে যাব। তোমরা?
খোকন সঙ্গে সঙ্গে সোনালীকে বলল, আবার খোকনদাকে টানছিস কেন? কেন? তোমার থ্রী টায়ারে যেতে লজ্জা করবে? ছাত্রজীবনে বেশি বাবুগিরি করা ভালো।
দ্যাখ সোনালী বুড়ীদের মতো ফালতু উপদেশ দিবি না।
মিস্টার সরকার বললেন, খোকন, সোনালী কিছু অন্যায় বলেনি। আমি তোমাদের ফার্স্ট ক্লাসে নিয়ে যেতে পারি ঠিকই কিন্তু দশ-বারো ঘন্টার জার্নির জন্য অযথা এক গাদা টাকা ব্যয় করার কোনো দরকার আছে কি?
খোকন হেসে বলে, আমি একবারও বলিনি থ্রী টায়ারে যাব না। তবে এবার এসে দেখছি সোনালী বড্ড পাকা পাকা কথা বলছে।
এতক্ষণ পরে শিবানী বললেন, তুই ভুলে যাস না খোকন, সোনালী ক্রমশ বড় হচ্ছে।
খোকন সোনালীর দিকে তাকিয়ে বলল, শাড়ি পরেই তোর মাথাটা গেছে।
পরের দিন দুপুরে মিস্টার সরকার টেলিফোনে টিকিট হয়ে যাবার খবর দিতেই বাড়িতে উত্তেজনার ঢেউ বয়ে গেল।
শিবানী বললেন, সোনালী কাল সুটকেশ-টুটকেশ গুছিয়ে ফেলতে হবে।
আচ্ছা।
দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর, শিবানী একটু বিশ্রাম নিতে-গেলেন।
খোকন নিজের ঘরে যেতেই সোনালী এসে জিজ্ঞাসা করল, দেশলাই আনতে হবে?
দেশলাই আছে। অ্যাসট্রেটা নিয়ে আয়।
সোনালী ড্রইংরুম থেকে অ্যাসট্রে আনতেই খোকন সিগারেট ধরাল। সিগারেটে একটা টান দিয়েই জিজ্ঞাসা করল, সোনালী, পুরী তোর কেমন লাগে রে?
সমুদ্র বা পাহাড়ে কারুর খারাপ লাগে নাকি?
পুরী আমার তত ভালো লাগে না।
কেন?
ওখানে ভোরবেলায় আর সন্ধ্যেবেলায় ছাড়া তো বেড়াবার উপায় নেই।
তা ঠিক। রোদ্দুর উঠলে আর সমুদ্রের ধারে যাওয়া যায় না।
তাছাড়া পুরীতে তো আর কোথাও বেড়াবার জায়গা নেই।
জগন্নাথের মন্দির?
মন্দিরে কি লোকে সারাদিন পড়ে থাকবে?
তাহলে অন্য কোথাও যাবার কথা তুমি জ্যাঠামণিকে বললে না কেন?
ধারে কাছে আর যাবার জায়গা কোথায়? তাছাড়া বাবা-মার পুরী খুব ভালো লাগে।
পুরী তোমার একেবারেই ভালো লাগে না?
পুরীর সমুদ্রে চান করতে খুব ভালো লাগে।
দু-এক মিনিট পরে খোকন জিজ্ঞাসা করল, সমুদ্রে চান করতে তোর কেমন লাগে?
ভালো, তবে এবার আর করব না।
কেন?
এখন ওই অত লোকের সামনে চান করা যায়? লজ্জা করবে না?
খোকন সিগারেট টানতে গিয়েও পারে না। হাসে।
হাসছ কেন?
তোর কথা শুনে।
এমন কি হাসির কথা বললাম?
তুই এমনই বড় হয়ে গেছিস যে পুরীর সমুদ্রে আর চান করতেই পারবি না?
গায়ে অত কাপড়-গামছা জড়িয়ে চান করতে বিরক্ত লাগে।
তুই তাহলে সত্যি বড় হয়েছিস?
ভুলে যেও না আমি সামনের বার হায়ার সেকেন্ডারি দেবো।
খোকন সিগারেট টানতে গিয়েও মাথা নেড়ে জানায়, সে ভুলে যায়নি।
তাছাড়া জানো, আমাদের ক্লাসের দুটো মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে।
চোখ দুটো বড় বড় করে খোকন বলে, সত্যি?
বড়মাকে জিজ্ঞাসা করো।
তোদের ক্লাসের মেয়েরা বিয়ের কি বোঝে?
আমাদের ক্লাসেও অনেক পাকা পাকা মেয়ে আছে। শিউলিটা তো ভীষণ বদ হয়ে গেছে।
বদ হয়েছে মানে?
সুকুমার বলে একটা লোফার ছেলের সঙ্গে ওর খুব ভাব। যেখানে-সেখানে ঘুরে বেড়ায়।
তুই কী করে জানলি?
অনেক বন্ধুরা দেখেছে। তাছাড়া দুজন দিদিমণি দেখে ওকে খুব বকাবকি করেছেন।
তাহলে তোর বন্ধুরাও ওস্তাদ হয়ে উঠেছে।
একটু চুপ করে থাকার পর সোনালী চাপা হাসি হাসতে হাসতে বলল, আমার এক বন্ধুর তোমাকে খুব ভালো লাগে।
সত্যি?
তুমি বড়মাকে বললো না।
বলব না, কিন্তু মেয়েটা কে?
মায়া।
সে আমাকে দেখল কোথায়?
ও তো দু-তিন দিন পর পরই আমার কাছে আসে। আজ সকালেও তো এসেছিল।
ওই মায়া?
হ্যাঁ।
বিয়ে করবে?
জানি না।
তবে আর কী ভালো লাগল?
সোনালী আবার হেসে বলে, শুধু তোমাকে দেখার জন্যই ও আজ সকালে এসেছিল।
তাই নাকি?
সত্যি বলছি।
আবার কবে আসবে?
তা কি আমাকে বলে গেছে?
.
দুদিন পর পুরী এক্সপ্রেস হাওড়া স্টেশন ছাড়ার পরই খোন একটা সিগারেট ধরিয়ে সোনালীকে বলল, বাবা-মার সঙ্গে ফার্স্ট ক্লাসে না গিয়ে ভালোই হয়েছে।
কেন, সিগারেট খেতে পারতে না বলে?
হ্যাঁ। খোকন সিগারেটে টান দিয়ে বলল, ট্রেনে উঠেই সিগারেট ধরাতে না পারলে আজকাল একদম ভালো লাগে না।
তবে তখন যে খুব রেগে গিয়েছিলে?
মোটেও রাগিনি।
মিথ্যে কথা বোলো না খোকনদা। নিতান্ত জ্যাঠামণি আর বড়মা আমাকে সাপোর্ট করলেন, নয়ত…
দ্যাখ সোনালী বাবা-মার চাইতে আমি তোকে কম ভালোবাসি না…
তা জানি।
তোর উপর ঠিক রাগ করতে পারি না।
তবে যখন-তখন আমাকে যা তা বলো কেন?
সিগারেটে খুব জোরে একটা টান মেরে খোকন বলল, ও তোকে একটু রাগাবার জন্য।
তুমি বড্ড আমার পিছনে লাগো।
তবে কি বাবা-মার পিছনে লাগব?
সোনালী হাসে।
.
ট্রেন ছুটে চলেছে। অনেক প্যাসেঞ্জার এর মধ্যেই শোবার ব্যবস্থা করে নিয়েছেন। অনন্যরা কেউ বা খাওয়া-দাওয়া করছেন অথবা গল্প-গুজব করছেন।
খোকন আবার সিগারেট ধরায়। বলে, দ্যাখ সোনালী, আজকাল বাবা-মা আমার চাইতে তোকে বেশি ভালোবাসেন।
আমি অত বেশি-কম বুঝি না।
তুই কাছে না থাকলে তো বাবার মুখের চেহারাই বদলে যায়।
কি জানি? আমি দেখিনি।
মা একটু চাপা। ঠিক প্রকাশ করতে চান না কিন্তু প্রতি মুহূর্তেই ধরা পড়ে যান।
তুমি জ্যাঠামণি-বড়মার একমাত্র ছেলে। তোমাকে কি ওঁরা কম ভালোবাসতে পারেন?
কিছুক্ষণ পরে খঙ্গপুর আসে। খোকন দুটো কফি কিনে একটা সোনালীকে এগিয়ে দিতেই ও বলল, এখন কফি খেলে রাত্তিরে ঘুমোব কখন?
একটু অনিয়ম, একটু অত্যাচার না করলে বাইরে বেড়াবার আনন্দ কি?
তুমি এই দু বছর হোস্টেলে থেকে বেশ বদলে গেছ।
হোস্টেলে না গেলেও এই পরিবর্তন হতো।
পরিবর্তন হলেও এতটা হতো না।
এই বয়সটাই পরিবর্তনের বয়স।
তা ঠিক।
এই বয়সে সব ছেলেমেয়েরাই হঠাৎ অদ্ভুতভাবে সব ব্যাপারেই সচেতন হয়ে ওঠে। সবকিছু জানতে চায়, বুঝতে চায়, এক্সপেরিমেন্ট করে দেখতে চায়।
সোনালী মুগ্ধ হয়ে খোকনের কথা শোনার পর বলে, তুমি আজকাল কত সুন্দর করে কথা বলো।
খোকন হেসে বলল, তাই নাকি?
সত্যি খোকনদা তোমার কথাবার্তার ধরনটা একেবারে বদলে গেছে।
খোকন একটু হাসে। কিছু বলে না।
সোনালী বলল, খোকনদা, পুরীতে গিয়ে আমরা সারা রাত গল্প করব।
আমার সারা রাত আড্ডা দেওয়া অভ্যাস আছে কিন্তু তুই পারবি না।
খুব পারব।
বারোটা-একটার পর তুই ঠিক ঘুমিয়ে পড়বি।
তুমি গল্প করলে আমি কিছুতেই ঘুমোব না।
আর যদিও বা একটা রাত কোনোমতে জেগে থাকিস তাহলে আর তার পরের দিন সকালে তো…
কিচ্ছু হবে না।
আচ্ছা দেখা যাবে।
একটু চুপ করে থাকার পর সোনালী জিজ্ঞাসা করল, কি খোকনদা, তোমার ঘুম পাচ্ছে নাকি?
খোকন হেসে বলল, এখুনি?
এখন কটা বাজে?
মোটে এগারোটা কুড়ি।
এখনও সাড়ে এগারোটাও বাজেনি?
না।
সোনালী একবার চারপাশে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিয়ে বলল, সবাই কী ঘুম ঘুমোচ্ছ!
আমাদের দেশের কটা মানুষ জীবন উপভোগ করতে জানে? কোনমতে খেয়েদেয়ে বউকে জড়িয়ে শুতে পারলেই…
শুনতেও সোনালী লজ্জা পায়। খোকনের মুখের উপর হাত দিয়ে বলল, চুপ করো!
চুপ করবো?
হ্যাঁ।
কেন? আমি কি মিথ্যে কথা বলছি?
তা বলছি না তবে…
সোনালী কথাটা শেষ না করে খোকনের দিকে তাকায়।
কথাটা শেষ না করে আমার দিকে তাকিয়ে কি দেখছিস?
দেখছি আর ভাবছি। একটু থেমে সোনালী আবার বলল, দেখছি তোমাকে আর ভাবছি তোমার কথা।
খোকন কিছু বলল না, শুধু একটু হাসল।
সোনালী ওর সিগারেটের প্যাকেটটা নাড়াচাড়া করতে করতে বলল, সত্যি খোকন, তুমি কত বড় হয়ে গেছ। মনে হয় এইতো সেদিনও তুমি বাবার কাঁধে চড়ে…
তুই যে দিদিমা-ঠাকুমার মতন কথা বলছিস!
সোনালী একটু হেসে বলে, তুমি যখন এখানে থাকে না তখন সময় পেলেই আমি পুরনো অ্যালবামগুলো দেখি।…
কেন?
তোমার-আমার ছোটবেলার ছবিগুলো দেখতে মজা লাগে।
ছেলেবেলার ছবি দেখতে সবারই মজা লাগে।
আমি কি শুধু ছবি দেখি?
তবে?
যখন একলা একলা ভালো লাগে না, তখন তোমার ছবিগুলো দেখতে দেখতে তোমার সঙ্গে কত কথা বলি।
খোকন হাসতে হাসতে বলে, তুই কি পাগল নাকি?
এতে পাগলের কি আছে?
ছবির সঙ্গে কি কেউ কথা বলে?
একলা একলা ভালো না লাগলে কি করব?
তাই বলে অ্যালবামের ছবিগুলোর সঙ্গে কথা বলবি?
বলব না কেন? কিছুক্ষণ অ্যালবামের ছবিগুলো দেখার পর মনটা বেশ ভালো হয়ে যায়।
অতি উত্তম কথা।
সোনালী খোকনের একটা হাত ধরে একটু টান দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, তারপর কি করি জানো?
কি?
তোমাকে চিঠি লিখতে বসি।
হা ভগবান!
সোনালী একটু রাগ করেই বলে, তুমি এ রকম হা ভগবীন, হা ভগবান করবে না।
করব না?
না।
তুই এত সেন্টিমেন্টাল হলে বিয়ের পর স্বামীর ঘর করবি কি করে?
তোমার মতন আমি চট করে বিয়ে করব না।
আমি বুঝি চট করে বিয়ে করতে চাই?
তোমার কথাবার্তা শুনে তাইতো মনে হয়।
খুব ভালো কথা। কিন্তু তুই বিয়ে করবি না কেন?
বিয়ে করব না, তা তো বলিনি। তাই বলে তোমার মতন আমি চটপট বিয়ে করে পালাতে চাই না।
কেন?
কেন আবার? তোমাদের ছেড়ে চলে যাবার কথা আমি ভাবতেও পারি না।
আচ্ছা সোনালী, একটা কথা বলবি?
বলব না কেন?
বাবা-মা আর আমার মধ্যে সব চাইতে কাকে বেশি ভালোবাসিস?
ওঁদের দুজনের সঙ্গে কি তোমার তুলনা হয়?
কেন হয় না?
ওঁদের একরকম ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি আর তোমাকে অন্য রকম ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি।
অন্যরকম মানে?
আমি অতশত বোঝাতে পারব না।
হঠাৎ গাড়ির গতি কমে আসতেই খোকন হাতের ঘড়ি দেখে বলল, পৌনে একটা বাজে। তোর ঘুম পাচ্ছে না?
না।
আস্তে আস্তে চলতে চলতে গাড়ি থামল।
সোনালী জিজ্ঞাসা করল, এটা কোন্ স্টেশন?
বালাশোর।
তার মানে বাংলাদেশ ছাড়িয়ে এসেছি?
হ্যাঁ।
জানলার পাশ দিয়ে চাওয়ালা যেতেই খোকন ওকে জিজ্ঞাসা করল, চা খাবি?
এত রাত্তিরে চা খাব?
চা না খেলে রাত জাগবি কিভাবে?
চায়ে চুমুক দিতেই সোনালী বলল, আমি বোধহয় জীবনে এত রাত্রে আর চা খাইনি।
জীবনে এতকাল যা করিসনি, এখন তো তাই করার বয়স আসছে।
তুমি হোস্টেলে থেকে বড় ওস্তাদ হয়েছ।
এখনও ওস্তাদ হবে না?
চা খাওয়া শেষ। গাড়িও ছেড়ে দিয়েছে।
খোকন জিজ্ঞাসা করল, হারে তুই কি সত্যিই ঘুমুবি না?
চা খাবার পরই কারুর ঘুম পায়?
শুয়ে পড়। আস্তে আস্তে ঘুম এসে যাবে।
না, আমি শোব না।
কেন রে?
এমন করে সারারাত তো কোনোদিন জাগিনি, তাই বেশ লাগছে।
সত্যি বলছিস?
সত্যি বলছি। সোনালী একটু থেমে বলল, তাছাড়া তোমাকেও তো অনেক কাল এভাবে পাই না।
তাহলে আমার সঙ্গে ঝগড়া করিস কেন?
ভালো লাগে।
কিছুক্ষণ চুপচাপ। সামনের বার্থের এক ভদ্রমহিলা ঘুম থেকে উঠে বাথরুম গেলেন।
খোকন বলল, দেখলি, উনি কিভাবে আমাদের দেখলেন?
ওসব তুমি দ্যাখো।
কি অদ্ভুত সন্দেহের দৃষ্টিতে উনি আমাদের দেখলেন, তা তুই ভাবতে পারবি না।
অদ্ভুত দৃষ্টিতে দেখার কি আছে?
এ দেশে ছেলেমেয়েদের গল্প করতে দেখলেই তো বুড়োদের দুশ্চিন্তার শেষ নেই।
সোনালী হেসে বলল, তা ঠিক।
.
গাড়ি এগিয়ে চলে। রাত আরো গম্ভীর হয়। খোকন ঘন ঘন সিগারেট ধরায়।
আর কত সিগারেট খাবে?
খোকন সিগারেটে টান দিয়ে হেসে জিজ্ঞাসা করল, খুব বেশি সিগারেট খাচ্ছি নাকি?
এইতো পাঁচ মিনিট আগেই…
মাত্র তিন প্যাকেট সিগারেট নিয়ে তো গাড়িতে উঠেছি।
ছি, ছি, এত কম সিগারেট কেউ খায়?
খোকন কিছু না বলে সিগারেটে আবার একটা টান দিল।
সোনালী জিজ্ঞাসা করল, ফেরার সময় জ্যাঠামণি যদি তোমাকে আলাদা আসতে না দেন? যদি ওঁদের সঙ্গেই ফার্স্ট ক্লাশে আসতে হয়?
ছাত্র জীবনে বিলাসিতা করা আমি একটুও পছন্দ করি না।
সোনালী হাসতে হাসতে খোকনের গায়ের ওপর লুটিয়ে পড়ল।
ভদ্ৰক পার হতেই ওরা শুয়ে পড়ল।
.
রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর বারান্দায় বসে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করার পর মিস্টার সরকার পরপর দুবার হাই তুলতেই শিবানী বললেন, চলো শুতে যাই। খোকন আর সোনালীর দিকে তাকিয়ে বললেন, যা তোরাও শুতে যা।
খোকন বলল, এখুনি?
এগারোটা বেজে গেছে। আর রাত করিস না।
কিরে সোনালী, তোর ঘুম পেয়েছে নাকি?
সোনালী জবাব দেবার আগেই ওর মা বললেন, ঘুম না পাবার কি হয়েছে? সারাদিন ধরে এত ঘোরাঘুরির পর ঘুম পাবে না?
সবাই উঠে দাঁড়াতেই শিবানী সোনালীকে বললেন, হয়, টেবিল লাইট না হয় বাথরুমের আলোটা জ্বালিয়ে রাখিস।
আচ্ছা।
ঘরে ঢুকেই খোকন জিজ্ঞাসা করল, কিরে সোনালী, ঘুমোবি নাকি?
ঘুমোব না তবে শুয়ে শুয়ে গল্প করব।
কেন?
সারাদিন ঘোরাঘুরি করে পা-দুটো বড় ব্যথা করছে।
তার মানে তোর ঘুমোনোর মতলব।
মোটেও না।
আমি সারারাত জাগব বলে দশ প্যাকেট সিগারেট কিনে এনেছি।
দশ প্যাকেট!
এক রাত্রেই দশ প্যাকেট লাগবে না তবে চার-পাঁচ প্যাকেট লাগবে।
খোকনদা, তুমি এত সিগারেট খেও না।
আবার বুড়ীদের মতন হিতোপদেশ দিচ্ছিস? হোস্টেলে কত ছেলে মদ খায় জানিস?
মদ!
হ্যাঁ মদ। হুইস্কী, রাম।
মদের নাম রাম? সোনালী হাসতে হাসতে প্রশ্ন করে।
হাসছিস কিরে!
মদের নাম রাম শুনেও হাসব না?
সোনালীর বিছানায় পাশাপাশি বসেই ওরা চাপা গলায় কথা বলে। খোকন বলল, আমাদের হোস্টেলে মদ খাবার কথা কিভাবে বলা হয় জানিস?
কিভাবে?
বলা হয়, আজ অত নম্বর ঘরে রাম নাম।
সোনালী শুনে হাসে। তারপর জিজ্ঞাসা করে, তুমি কোনোদিন খেয়েছ নাকি?
খাইনি তবে অনেকেই জোর-জুলুম করে।
না না, তুমি কক্ষনো খাবে না। জ্যাঠামণি-বড়মা জানতে পারলে ভীষণ কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।
খাব না ঠিকই কিন্তু খেলেও কি ওরা জানতে পারবে?
একদিন না একদিন ঠিক জানতে পারবে।
খোকন আর একটা সিগারেট ধরিয়ে একটা টান দিয়ে বলল, দ্যাখ সোনালী, ছেলেমেয়েরা বড় হবার পর কত যে ফাজিল, কত বদ হয় তা বাবা-মারা ঠিক আন্দাজ করতে পারে না।
না, পারে আবার না?
সত্যিই পারে না। ছেলেমেয়ে সম্পর্কে বাপ-মার এমনই অন্ধ স্নেহ থাকে যে তাদের বেশি খারাপ ভাবতে পারে না।
সোনালী ভাবে।
খোকন সিগারেটে টান দিয়ে জিজ্ঞাসা করে, কি ভাবছিস?
তোমার কথা।
বেশি দূর যাবার কি দরকার? এই যে আমি আর তুই এখনও গল্প করছি বা আমি একটার পর একটা সিগারেট খাচ্ছি তা কি বাবা-মা পাশের ঘরে থেকেও জানতে পারছেন?
তা ঠিক।
তাহলে ভেবে দ্যাখ, বাড়ির বাইরে বা হোস্টেলে থেকে ছেলে-মেয়েরা কি করে তা বাবা-মা জানবে কি করে?
ঠিক বলেছ। সোনালী আবার কি যেন ভাবে। তারপর খোকনের একটা হাত ধরে বলে, তুমি আমার একটা কথা রাখবে খোকনদা?
কী কথা?
আগে বলো রাখবে কিনা।
জেনে কী করে বলব?
অসম্ভব কিছু বলব না।
তাহলে নিশ্চয়ই রাখব।
ঠিক?
আগে থেকে প্রতিজ্ঞা না করিয়ে কী কথা রাখতে হবে, সেটা তো বল।
তুমি অন্য ছেলেদের মতন খারাপ হবে না।
খোকন হেসে বলে, খারাপ হবে না মানে?
মানে এমন কিছু করবে না যাতে তোমাকে কেউ খারাপ বলে।
এ কথার কোনো মানেই হল না।
কেন?
সব কাজই একজনের কাছে ভালো, অন্যের কাছে খারাপ।
তবুও মাঝামাঝি একটা কিছু তো আছে।
সেটাও এক-এক জনের কাছে এক-এক রকম।
সোনালী খোকনকে একটা ধাক্কা দিয়ে বলে, তুমি বড় তর্ক করো।
খোকন হেসে বলে, আচ্ছা তর্ক করব না কিন্তু তুই কী করতে বারণ করেছিস, তা তো বলবি।
বলছি যে তুমি বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে কোনোদিন মদ-টদ খাবে না।
হুজুগে পড়ে যদি কোনোদিন খাই?
হুজুগে পড়েও খাবে না।
কেন খেলে কি হয়েছে? একদিন মদ খেলেই কি আমি খারাপ হয়ে যাব?
আমি বলছি তুমি খাবে না।
তুই আমার কে যে তোর কথা আমাকে শুনতে হবে?
সোনালী চমকে উঠল, কী বললে? আমি তোমার কে?
তোর কথা শুনতেই হবে?
না। তুমি শুতে যাও, আমি এবার ঘুমোব।
সারারাত গল্প করবি না?
না, তুমি শুতে যাও।
সোনালী রাগ করে মুখোনা ঘুরিয়ে রাখে। খোকনও একটু ঝুঁকে পড়ে ওর মুখের সামনে মুখ নিয়ে জিজ্ঞাসা করে, তুই সত্যি রাগ করেছিস?
সোনালী কোনো জবাব দেয় না।
খোকন আবার জিজ্ঞাসা করে, কিরে, কথা বলবি না?
তুমি শুতে যাও।
তুই জবাব না দিলে আমি শুতে যাব না।
না রাগ করিনি, খুশি হয়েছি।
খোকন হাসে।
সোনালী রেগে যায়। বলে, আর দাঁত বের করে হাসতে হবে না।
হাসব না?
নিজের বিছানায় গিয়ে যা ইচ্ছে কর। এবার আমি শোব।
সত্যি শুবি?
হ্যাঁ।
দু-এক মিনিট চুপ করে থাকার পর খোকন নিজের বিছানায় চলে গেল।
হঠাৎ খোকনের ঘুম ভেঙে গেল। প্রথমে ঠিক বুঝতে পারল না। বেশ কিছুক্ষণ পরে বুঝল, কেউ কাঁদছে। এত রাত্রে কোথায় কে কাঁদছে, তা ভেবে পেল না। আরো ভালো করে কান পেতে শুনল। খোকন চমকে উঠল, সোনালী কাঁদছে?
তাড়াতাড়ি উঠে ওর কাছে যেতেই কান্নার শব্দ আরও স্পষ্ট হল।
খোকন ডাকল, সোনালী!
কোনো জবাব নেই।
আবার ডাকল, সোনালী কাদছিস কেন, কী হয়েছে?
সোনালী কোনো জবাব দেয় না, দিতে পারে না। উপুড় হয়ে শুয়ে আগের মতনই কাঁদে।
সোনালী, তোর শরীর খারাপ লাগছে, মাকে ডাকব?
কাঁদতে কাঁদতেই ও জবাব দিল, না, তুমি শুতে যাও।
এবার খোকন ওর পাশে বসে মাথার উপর হাত রেখে বলল, তুই কাঁদছিস আর আমি শুয়ে থাকব?
আমি তোমার কে যে আমার কান্নার জন্য তোমাকে জেগে থাকতে হবে?
এতক্ষণে ওর কান্নার কারণ বুঝতে পেরে খোকন হাসতে হাসতে বলল, হা ভগবান! তুই আমার এই কথার জন্য কাঁদছিস?
ছি, ছি, খোকনদা, তুমি ও-কথা বললে কেমন করে? এতকাল পরে তুমি জানতে চাইলে আমি তোমার কে?
খোকন ওর মাথায় পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, আমার ওই সামান্য একটা কথার জন্য…
ওটা তোমার সামান্য কথা হল?
আচ্ছা আর ও-কথা বলব না। তুই ঠিক হয়ে শো, আমি তোকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি।
আমার জন্য তোমাকে কিছু করতে হবে না। তুমি শুতে যাও।
তুই না ঘুমুলে আমি এখান থেকে উঠছি না।
আমি তোমার কে?
খোকন ঝুঁকে পড়ে ওর মুখের ওপর মুখ রেখে কানে কানে বলল, তুই আমার সোনা, সোনালী!
সোনালী মুখ তুলেই বলল, এখন আর গরু মেরে জুতো দান করতে হবে না।
গরু মেরে জুতো দান করছি নাকি?
এর আগে যা তা বলে এখন আর আমাকে সোনা সোনালী বলে ভোলাতে হবে না।
সত্যি বলছি তোকে ভোলাবার জন্য বলিনি। তোকে আমি কত ভালোবাসি, তা জানিস না?
হাতের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলল, ঘণ্টা ভালোবাসো।
নারে সোনালী, তোকে আমি সত্যি ভালোবাসি।
মা কালীর নামে দিব্যি করে বল।
আমি মা কালীর নাম করে বলছি তোকে আমি ভালোবাসি।
সোনালী আর পারে না। এক মুহূর্তে কান্না থেমে যায়, অভিমান চলে যায়। হঠাৎ দু-হাত দিয়ে খোকনের কোমর জড়িয়ে ধরে ওর পায়ের উপর মাথা রেখে বলে, যেমন তুমি আমাকে দুঃখ দিয়েছ, তেমন তুমি সারা রাত এইভাবে বসে থাকবে। আমি তোমার কোলে মাথা রেখে ঘুমোব।
খোকন একটু অস্বস্তি বোধ করে কিন্তু কিছু বলতে পারে না। ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, এই ভাবে সারারাত বসে থাকা যায় পাগলী?
আমি কিছু জানি না।
তুই ঠিক হয়ে বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়। আমি তোকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি।
সোনালী আরো জোরে ওকে আঁকড়ে ধরে বলে, তোমাকে আমি ছাড়ছি না। ঠিক এইভাবে বসে থাকতে হবে।
এইভাবে কি বেশিক্ষণ বসে থাকা যায়?
আমি জানি না।
তুই জানিস না?
না।
খোকন কিছু বলে না। চুপ করে বসে বসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল। বোধহয় আধঘণ্টা-পঁয়তাল্লিশ মিনিট।
সোনালী মুখ তুলে খোকনের মুখের দিকে তাকিয়ে, একটু হেসে বলল, কেমন জব্দ!
সোনালী পা-টা ব্যথা হয়ে গেছে।
হোক।
ওর কথায় খোকন না হেসে পারে না। বলে, সত্যিরে বড় ব্যথা করছে।
তোমার কথায় আমার আরো অনেক বেশি ব্যথা লেগেছিল।
সোনালী, তুই বালিশে মাথা রাখ। আমি একটু হেলান দিয়ে বসি।
তারপর তুমি পালিয়ে যাবে?
সত্যি পালাব না।
ঠিক?
আমি বলছি তো পালাব না।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর সোনালী বলল, অনেক দিন পর তোমার কোলে মাথা রেখে শুয়েছি, তাই না খোকনদা?
হ্যাঁ, অনেক দিন পর।
আগে আমরা একসঙ্গে শুয়ে কত রাত পর্যন্ত গল্প করতাম। আর বড়মা ঘরে ঢুকলে আমরা ঘুমের ভান করতাম, তাই না?
সত্যি সেসব দিনগুলোর কথা ভাবলে ভারি মজা লাগে।
আচ্ছা খোকনদা, হোস্টেলে থাকার সময় আমার কথা তোমার মনে পড়ে?
কেন মনে পড়বে না?
কি মনে পড়ে?
অনেক কিছু।
অনেক কিছু মানে?
অনেক কিছু মানে সবকিছু। আমাদের হাসি-ঠাট্টা ঝগড়া-মারামারি…
আমি তো মাঝে মাঝে লুকিয়ে লুকিয়ে তোমার জন্য কাঁদি।
কেন?
কেন আবার? একলা একলা ভালো লাগে না বলে।
তাহলে আমি এলে ঝগড়া করিস কেন?
আমি মোটেও ঝগড়া করি না।
আবার একটু চুপচাপ।
আচ্ছা খোকনদা, আমি তোমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছি বলে তোমার ভালো লাগছে না?
তোকে সব সময়ই আমার ভালো লাগে। বিশেষ করে হোস্টেলে চলে যাবার পর তোকে বোধহয় বেশি ভালোবাসতে শুরু করেছি।
সত্যি?
এখন বাবা-মার চাইতে তোর জন্য বেশি মন খারাপ লাগে।
পুরী এসে ভালোই হয়েছে, তাই না?
হ্যাঁ।
তুমি সমুদ্রে চান করবে?
করতেও পারি, ঠিক নেই। তুই তো সমুদ্রে চান করবি না বলেছিস।
না আমি সমুদ্রে চান করব না।
সত্যি সোনালী, তুই যেন হঠাৎ বড় হয়ে গেছিস।
এখন আমাকে দেখলে বেশ বড় মনে হয়, তাই না?
তা একটু হয় বৈকি।
তোমাকেও আজকাল বেশ বড় দেখায়। সোনালী একবার ওর দিকে তাকিয়ে বলল, আজকাল তোমাকে যে দেখে সেই ভালো বলে।
তুই ঠিক উল্টো কথা বললি। মেয়েরা বড় হলে ভালো দেখায়। ছেলেরা না।
আমি ঠিকই বলেছি। আমি বড় হয়েছি কিন্তু আমি যেরকম ছিলাম, সেই রকমই আছি। একটুও বদলাইনি।
অনেক বদলে গেছিস।
কি বদলেছি?
খোকন হেসে বলল, সে কথা আমি বলতে পারব না।
কেন?
কেন আবার? বলতে নেই।
সোনালী আর প্রশ্ন করে না। চুপ করে থাকে। ভাবে।
খোকনদা, আমার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে।
ঘুমো।
সনালী খোকনের হাত দুটো চেপে ধরেছিল। আস্তে আস্তে ওর হাত দুটো আলগা হয়ে গেল। সোনালী ঘুমিয়ে পড়ল।
হঠাৎ সোনালীর ঘুম ভেঙে গেল। খোকন তখনও ওইভাবে পাশে বসে আছে!
কটা বাজে খোকনদা?
আবছা আলোয় খোকন হাতের ঘড়িটা ভালো করে দেখে বলল, সোয়া চারটে।
এ রাম! তোমাকে সারারাত জাগিয়ে রাখলাম। তুমি এখানেই শুয়ে পড়ো। আমি তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি।
আমি আমার বিছানায় যাই।
এখানেও শোও। চিরকাল তো এক বিছানায় শুয়ে মারামারি করেছি। এখন এত লজ্জা কেন?
খোকন শুয়ে পড়ল কিন্তু এতকাল পরে সোনালীর পাশে শুয়েই ওর সারা শরীরের মধ্যে দিয়ে একটা বিদ্যুৎ তরঙ্গ বয়ে গেল।
৫. পরের দিন দুপুরে খোকন
পরের দিন দুপুরে খোকন সোফায় বসে সিগারেট টানছিল। সোনালী বিছানার উপর বসে ভাজা মশলা চিবুতে চিবুতে বলল, কাল রাত্রে তোমাকে খুব কষ্ট দিয়েছি, তাই না খোকনদা?
কষ্ট দিয়েছিস নাকি?
এক সেকেন্ডের মধ্যে তুমি ঘুমিয়ে পড়লে দেখে আমার এত কষ্ট লাগছিল যে কী বলব।
তুইও তো সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লি।
মোটেও না। আমি আর ঘুমোইনি।
বাজে বকিস না।
সত্যি বলছি আর ঘুম এলো না।
কেন?
সোনালী একটু হেসে বলল, তুমি এমন ক্লান্ত, অসহায় হয়ে আমাকে জড়িয়ে শুয়েছিলে যে আমি তোমাকে ছেড়ে উঠতেও পারলাম না ঘুমোতেও পারলাম না।
বানিয়ে বানিয়ে আজেবাজে কথা বলবি না।
সত্যি খোকনদা, তুমি ঠিক ছোটবেলার মতন…
এই বুড়ো বয়সে ছেলেবেলার মতন…
আজ্ঞে হ্যাঁ।
খোকন মনে মনে একটু লজ্জা পায়। একটু পরে খোকন জিজ্ঞাসা করল, আমি ওইভাবে শুয়েছিলাম বলে তোর রাগ হয়নি?
রাগ হবে কেন? তবে অনেক কাল পরে তুমি আমার পাশে শুয়েছিলে বলে একটু অস্বস্তি লাগছিল।
অস্বস্তি মানে?
তোমার হাত-টাত কত ভারী, কত মোটা হয়ে গেছে।…
খোকন হাসে।
তবে তোমার গায়ে একটা ভারি সুন্দর গন্ধ আছে।
খোকন হেসে জিজ্ঞাসা করে, তাই নাকি?
সত্যি। তোমার গায়ের গন্ধ আমার খুব ভালো লাগে।
সবার গায়েই একটা গন্ধ থাকে। তোরও আছে।
আমার গায়ে গন্ধ?
হ্যাঁ, তোর গায়েও গন্ধ আছে বৈকি!
সোনালী বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বলল, ঘণ্টা আছে।
সোনালী আর কথা বলে না। শুয়ে পড়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ওর ঘুম আসে। সামনের সোফায় বসে সিগারেট টানতে টানতে খোকন ওর দিকে তাকায় অনেকক্ষণ। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
পাশ ফিরতে গিয়ে হঠাৎ সোনালী চোখ মেলে তাকায়। খোকনকে দেখে। জিজ্ঞাসা করে, তুমি একটু ঘুমোবে না খোকনদা?
না।
রাত্রে তো ঘুম হয়নি। এখন একটু ঘুমোও।
সোনালী আবার ঘুমিয়ে পড়ে।
বিকেলবেলায় সমুদ্রের ধারে বেড়াতে বেড়াতে মিস্টার সরকার সোনালীকে বললেন, এখানে সুন্দর সুন্দর সিল্কের শাড়ি পাওয়া যায়। দামও সস্তা।
তাহলে বড়মাকে একটা ভালো শাড়ি কিনে দাও।
তুই কিনবি না?
আমি সিল্কের শাড়ি দিয়ে কি করব?
আমি তো ভাবছিলাম শুধু তোর জন্যই একটা শাড়ি কিনব।
কেন?
তোর বড়মার অনেক শাড়ি আছে।
তা হোক। তুমি বড়মাকেই কিনে দাও।
খোকন হাসতে হাসতে বলল, সোনালী তুই বেশ ভালোভাবেই জানিস বাবার মাথায় যখন এসেছে তখন তোর শাড়ি কিনবেনই, কিন্তু বেশ ন্যাকামি করে…
সোনালী আর এক মুহূর্ত দেরি না করে ওর পিঠে দুম করে একটা ঘুষি মেরে বলল, আর আজেবাজে কথা বলবে?
ও ভয়ে কম্পিত নয় বীরের হৃদয়।
ওরা তিনজনেই হাসেন।
শিবানী হাসতে হাসতে বললেন, তোদর ছেলেমানুষী আর যাবে না।
পরের দিন সকালে গভর্নমেন্ট এম্পোরিয়াম থেকে দুটো শাড়িই কেনা হল। এম্পোরিয়াম থেকে হোটেলে ফেরার পর শিবানী বললেন, সোনালী আজ বিকেলে এই শাড়িটা পরিস।
কলকাতায় গিয়ে পরব।
না আজ বিকেলেই পরিস।
বিকেলে ওই শাড়িটা পরে সোনালী সামনের বারান্দায় আসতেই মিস্টার সরকার আর ওঁর স্ত্রী একসঙ্গে বললেন বাঃ! কী সুন্দর দেখাচ্ছে।
সোনালী ওদের দুজনকে প্রণাম করল। খোকন এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে ভুবনেশ্বর গেছে। খেয়ে-দেয়ে রাত দশটা-সাড়ে দশটায় ফিরবে। তাই ওকে প্রণাম করতে পারল না।
মিস্টার সরকার সোনালীকে একটু আদর করে বললেন, তুই সত্যিই সোনালী।
শিবানী ওর কপালে একটা চুমু খেয়ে বললেন, যত দিন যাচ্ছে তুই তত সুন্দরী হচ্ছিস।
লজ্জায় আর খুশিতে সোনালী মুখ তুলতে পারে না।
সমুদ্রের ধারে বেড়াতে গিয়ে সবাই একবার সোনালীর দিকে দেখেন। ও লজ্জায় মুখ তুলে হাঁটতে পারে না। মিস্টার সরকার গর্বের সঙ্গে বললেন, দেখেছ শিবানী আজকে কেউ সমুদ্র। দেখছে না, সবাই তোমার মেয়েকে দেখছে।
বড়মা, জ্যাঠামণি এইসব কথা বললে আমি এক্ষুনি হোটেলে ফিরে যাব।
শিবানী বললেন, কালও কত লোক তোকে দেখেছিলেন। এতে লজ্জা পাবার কি আছে?
.
রাত্রে বি এন আর হোটেলের ডাইনিংরুমে এক মজার কাণ্ড ঘটল। মধ্য বয়সী এক দম্পতি মিস্টার সরকার শিবানীকে বললেন, আপনার এই মেয়েটিকে যে আমি পুত্রবধু করার লোভ সামলাতে পারছি না।
সোনালী ওই কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে ঘরে চলে গেল।
সোনালীর কাণ্ড দেখে ওরা চারজন একসঙ্গে হেসে উঠলেন।
দু-এক মিনিটের মধ্যে খোকন ফিরে এসে ওকে এত সেজেগুঁজে একলা থাকতে দেখে জিজ্ঞাসা করল, তুই একলা একলা কী করছিস?
এমনি বসে আছি।
বাবা মা কোথায়?
ডাইনিংরুমে।
তোর খাওয়া হয়ে গেছে?
হ্যাঁ।
ওঁদের খাওয়া হয়নি?
হয়েছে।
তবে ওঁরা কি করছেন?
এক ভদ্রলোক-ভদ্রমহিলার সঙ্গে কথা বলছেন।
তা তুই চলে এলি?
সোনালী এতক্ষণ মুখ নীচু করে একটার পর একটা প্রশ্নের জবাব দিয়েছে। এবার ও খোকনের দিকে তাকিয়ে বেশ একটু উৎকণ্ঠার সঙ্গে বলল, জানো খোকনদা ওই ভদ্রমহিলা কি অসভ্য!
খোকন অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, কেন কি হয়েছে?
হঠাৎ বড়মা আর জ্যাঠামণিকে এসে বলছে আপনার মেয়েকে পুত্রবধু করতে ইচ্ছে করছে!
খোকন হো হো করে হেসে উঠল আর সঙ্গে সঙ্গে সোনালী ওর হাতে একটা চড় মেরে বলল, তুমিও ভীষণ অসভ্য।
কয়েক সেকেন্ড পরেই সোনালী খোকনকে প্রণাম করতেই ও জিজ্ঞাসা করল, চড় মেরেই প্রণাম?
নতুন শাড়ি পরেছি না।
খোকন কয়েকটা মুহূর্তের জন্য অপলক দৃষ্টিতে সোনালীকে দেখে বললে, সত্যি আজ তোকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে।
সকালবেলার প্রথম ঝলক সোনালী রোদের মতন ও হঠাৎ মিষ্টি হেসে বলল, সত্যি খোকনদা?
খোকন ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, দারুণ!
খোকন আর কোন কথা না বলে বাবা মার সঙ্গে দেখা করতে গেল। দশ-পনেরো মিনিট পরে এঘরে ফিরে আসতেই সোনালী জিজ্ঞাসা করল, জ্যাঠামণি বা বড়মা আমার সম্পর্কে কিছু বললেন?
খোকন মুখ টিপে হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করল, তুই কি জানতে চাস? বিয়ের কথা?
খুব গম্ভীর হয়ে সোনালী বলল, বাজে অসভ্যতা কোরো না।
তোর ভয় নেই। কেউ তোকে দুম দাম বিয়ে দিয়ে পার করবে না।
সোনালী চুপ করে বসে থাকে। কোনো প্রশ্ন, কোনো মন্তব্য করে না।
খোকন চুপ করে থাকে না। আস্তে আস্তে সোনালীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, তোর বিয়ে দিতে হবে ঠিকই কিন্তু বাবা-মা তোকে ছেড়ে থাকার কথা ভাবতেই পারেন না।
সোনালী এবারও কিছু বলে না।
খোকন বলে, আমি ভাবতেই পারি না তুই অন্য কোথাও চলে যাবি। তুই না থাকলে আমি তো বোবা হয়ে যাব।
সোনালী এসব কথার কোন জবাব না দিয়ে শুধু বলল, আর কথা না বলে জামা-কাপড় বদলে শুয়ে পড়ো।
তোর ঘুম পাচ্ছে নাকি?
আজ বোধহয় সারারাতই জেগে থাকব।
কেন?
কেন আবার? দুপুরে ঘণ্টা চারেক ঘুমিয়েছি।
তাহলে তো আজ জোর আড্ডা হবে।
না, না, তুমি এত ঘোরাঘুরি করে এসেছ, তুমি নিশ্চয়ই ঘুমোবে।
গল্প করলে আমার ঘুম আসে না।
তুমি শোও। আমি তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি। সোনালী একটু থেমে, একটু হেসে বলল, কাল রাত্রে তুমি আমাকে যা দিয়েছ, তার কিছু প্রতিদান আজ দিই।
সে রাত্রে খোকন সত্যি ঘুমিয়ে পড়ে।
এরপর যখন খোকন ছুটিতে এসেছে তখনই কথায় কথায় বলেছে মা, সোনালী যদি পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমাকে চা না দেয় তাহলে পুরীর ওই ভদ্রলোকের ছেলে ক্যাবলার সঙ্গেই আমি…
সোনালী দুম দুম করে খোকনের পিঠে দুটো-তিনটে ঘুষি মেরে বলে, ক্যাবলার বোনের সঙ্গে তোমার বিয়ে দেবো।
বিহাইকাকা বলেছিল ক্যাবলা ছেলেটি বেশ ভালো। মল্লিক বাজারে মোটরের চোরাই পার্টস বিক্রি করে বেশ টু পাইস…
আর কেবলি বুঝি তোমার সঙ্গে আই-আই টিতে পড়ে?
তবে ক্যাবলা জামাই হলে বাবা নিশ্চয়ই ওকে অফিসের জমাদার করে নেবে।
সোনালী বাচ্চাদের মতন চিৎকার করে, খোকনদা!
শিবানী আর শুয়ে থাকতে পারে না। উঠে এসে বললেন, তোদের জ্বালায় কোনোদিন দুপুরে আমার বিশ্রাম করার উপায় নেই।
দ্যাখো না বড়মা…
ওকে এক কাপ চা করে দিলেই তো…
কিন্তু আমাকে যা তা বলছে কেন?
খোকন…তুই বড্ড ওর পিছনে লাগিস।
খোকন ফিরে যাবার দু-এক দিন আগে সব ঝগড়া হঠাৎ থেমে যায়।
জানিস সোনালী, হোস্টেলে এমনি বেশ ভালোই থাকি কিন্তু ছুটির পর ফিরে গিয়ে কিছুদিন বড্ড খারাপ লাগে।
সত্যি বলছ, নাকি আমাকে খুশি করার জন্য বলছ?
সত্যি বলছি। হোস্টেলে পড়াশুনা ইয়ার্কি-বাঁদরামি করে দিনগুলো ভালোই কাটে, তবে এখন ফিরে গিয়ে মাসখানেক শুধু এখানকার কথা মনে পড়বে।
আমার কথা মনে পড়ে?
খোকন সিগারেট টানতে টানতে শুধু মাথা নাড়ে।
কি মনে হয়?
খোকন দু-এক মিনিট কি যেন ভাবে। তারপর আস্তে আস্তে দৃষ্টিটা বাইরের দিকে ঘুরিয়ে যেন আপন মনেই বলে, তোর কথা খুব বেশি মনে হয়।
কেন?
খোকন যেন ওর কথা শুনতে পায় না। বলে, তোকে নিয়ে অনেক কথা ভাবি।
আমাকে নিয়ে এত কী ভাবে খোকনদা?
ও একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলে, সে এখন বলতে পারব না।
কেন?
খোকন ওর দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলে, মানুষ মনে যা কিছু ভাবে তা কি সব সময় বলতে পারে?
আমার কথা আমাকেও বলা যায় না?
খোকন আবার মাথা নাড়ল। বলল, না।
বেশ কিছুক্ষণ পরে সোনালী বলল, তুমি চলে গেলে আমারও খুব খারাপ লাগে। মনে হয় কেন তোমার সঙ্গে ঝগড়া করতাম, কেন তোমার গা টিপে দিইনি…
আর কি মনে হয়?
বাড়িটা ভীষণ ফাঁকা লাগে!
তাই নাকি?
হ্যাঁ খোকনদা। লেখাপড়া, কাজকর্ম কিছুতেই মন বসাতে পারি না।
কেন?
কেন আবার? শুধু তোমার কথা মনে হয়।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর হঠাৎ খোকন তাকে জিজ্ঞাসা করল, তুই সত্যিই আমাদের ছেড়ে চলে যাবি?
কোথায় চলে যাব?
কোথায় আবার? বিয়ে করে চলে যাবি?
ওসব কথা আমি ভাবি না।
একেবারেই ভাবিস না?
না।
কিন্তু একদিন তো তোকে চলে যেতে হবে, তা তো জানিস?
সোনালী কোন জবাব দেয় না।
আচ্ছা সোনালী আমি যদি তোকে যেতে না দিই?
সোনালী হেসে বলে, এখানে থাকতে পারলে তো আমারই মজা।
সত্যি বল তুই থাকবি?
থাকব না কেন?
তোর আপত্তি নেই?
এখানে থাকতে আমার আবার কি আপত্তি?
মিস্টার সরকার অফিস থেকে এসে বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতেই বললেন, শিবানী আমি একদম ভুলে গিয়েছিলাম আজই মিস্টার ব্যানার্জির মেয়ের বিয়ে।
আজই? শিবানী অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।
আমার একদম মনে ছিল না। তারপর ঘোষের কাছে শুনেই…
আজ তো আঠারোই। আমারও একদম খেয়াল ছিল না।
চটপট তৈরি হয়ে নাও। একটা শাড়ি কিনতে হবে তারপর মিত্তিরকে তুলে নিয়ে হাওড়া হয়ে কোন্নগর যাওয়া।
মিত্তিরের গাড়ি কি হলো?
ওর গাড়ি টিউনিং করতে গ্যারেজে দিয়েছে।
তার মানে পার্ক সার্কাস ঘুরে হাওড়া হয়ে কোন্নগর?
কি আর করা যাবে? তুমি তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও।
কাল খোকন যাবে, আর আজ… কিন্তু ব্যানার্জির মেয়ের বিয়েতে না গিয়ে তো উপায় নেই।
তা ঠিক। শিবানী একটু ভেবে বললেন, ফিরতে ফিরতে নিশ্চয় বারোটা একটা হয়ে যাবে?
মিস্টার সরকার একটু হেসে বললেন, এখন ছটা বাজে। সাতটায় বেরিয়ে শাড়ি কিনে মিত্তিরের বাড়ি পৌঁছতেই আটটা। সোনালীর হাত থেকে চায়ের কাপ নিতে নিতে বললেন, বিয়ে বাড়ি পৌঁছতেই দশটা বেজে যাবে।
তার মানে ফিরতে ফিরতে দুটো আড়াইটে!
তবে কাল রবিবার। এই যা ভরসা।
তৈরি হয়ে সোনালীকে সব বুঝিয়ে ওদের বেরুতে বেরুতে সোয়া সাতটা হয়ে গেল।
ওরা বেরিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই খোকন সিগারেট ধরিয়ে একটা লম্বা টান দিয়ে বলল, সোনালী, চা কর।
ও হাসতে হাসতে বলল, জ্যাঠামণি, বড়মা বেরুবার সঙ্গে সঙ্গেই বুঝি তোমার বাঁদরামি শুরু হলো?
ভালো করে সেবা-যত্ন কর; তা নইলে আমি চলে যাবার পর মনে মনে আরও কষ্ট পাবি।
অযথা এসব কথা বলে আমার মন খারাপ করে দিও না।
খোকন হঠাৎ দু হাত দিয়ে ওর গলা জড়িয়ে ধরে কপালের সঙ্গে কপাল ঠেকিয়ে বলল, আমি চলে গেলে সত্যি তোর মন খারাপ হয়?
না হবার কি আছে?
তুই আমাকে ভালোবাসিস?
তুমি জানো না?
না।
বুঝতে পারো না?
খোকন অদ্ভুতভাবে ওর দিকে তাকিয়ে শুধু মাথা নাড়ল।
তাহলে তোমার জেনে কাজ নেই।
তুই বল না আমাকে ভালোবাসিস কিনা।
ভালোবাসব না কেন?
কি রকম ভালোবাসিস?
সোনালী মাথা দুলিয়ে বলল, আমি অত জানি না।
জানিস না?
না। সোনালী ওর হাত দুটো টেনে বলল, হাত খোলল। চা করব।
চা করতে হবে না।
এক মিনিট আগেই বললে চা কর। আবার…
আগে আমাকে একটু আদর কর।
অসভ্যতা কোরো না। তুমি হাত খোলো।
আগে আমাকে একটু আদর কর। তা না হলে আমি হাত খুলছি না।
অসভ্যতা কোরো না খোকনদা। তুমি আমাকে ছেড়ে দাও। আমার অনেক কাজ আছে।
একটু আদর না করলে আমি ছাড়ছি না।
আমি আদর করতে জানি না।
জানিস না?
না।
আমাকে আদর করতে ইচ্ছে করে না?
বাজে বকবে না। তুমি এই পাঁচ বছর হোস্টেলে থেকে অত্যন্ত অসভ্য হয়ে গেছ।
তাই নাকি?
আজ্ঞে হ্যাঁ। তুমি কি ভেবেছ আমি কিছুই বুঝি না? আমিও দুদিন পর বি-এ পরীক্ষা দেবো।
আমি কী অসভ্যতা করলাম?
সব বলা যায় না।
এমন অসভ্যতা করেছি যে বলাই যায় না?
তোমাদের মতন হোস্টেলের ছেলেদের কাছে এসব অসভ্যতা না হলেও…
কি সব অসভ্যতা?
বলেছি তো আমি সবকিছু খুলে বলতে পারব না। তুমি আমাকে ছেড়ে দাও।
খোকন একটু হেসে ওকে ছেড়ে দিল। বলল, তুই ঠাট্টা-ইয়ার্কি বুঝিস না সব ব্যাপারেই তুই বড্ড সিরিয়াস।
সোনালী ড্রইংরুম থেকে বেরুতে বেরুতে বলল, এ ধরনের ঠাট্টা-ইয়ার্কি তুমি আমার সঙ্গে করবে না।
আচ্ছা তুই চা কর।
পারব না।
চা খাওয়াবি না?
না।
কাল চলে যাবার পর যখন…
আমার কিছু মন খারাপ হবে না। তুমি আজই চলে যাও।
কিন্তু আমার যে ভীষণ চা খেতে ইচ্ছে করছে।
শুধু চা কেন, আরও অনেক কিছু খেতেই তোমার ইচ্ছে করছে কিন্তু আমার দ্বারা কিছু হবে না।
চা খাওয়াবি না?
তুমি আমার সঙ্গে বকবক কোরো না। সোনালী এবার আপন মনেই বলে, হাজার কাপ চা খাইয়েও তোমার মন ভরবে না। একটু আগেই তোমার যে মূর্তি দেখেছি তাতে আমার আর কিছু বুঝতে বাকি নেই।
খোকন ওর কথার কোনো জবাব না দিয়ে নিজের ঘরে গেল। প্যান্ট-বুশসার্ট পরে বেরুবার সময় বলল, আমার ফিরতে রাত হবে।
আমি একলা একলা থাকব?
খোকন চলে গেল।
সোনালী দরজা বন্ধ করে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল। ভাবছিল নানাকথা। খোকনদার কি মাথা খারাপ হয়েছে? ও কেন এমন পাগলামি করে? তাছাড়া আমার সঙ্গে কি ওর এই পাগলামি করার সম্পর্ক?
সোনালী খোকনের কথা ভাবতে ভাবতেই রান্নাঘরের কাজ শেষ করল। তারপর নিজের ঘরে এলো। বসল। সঙ্গে সঙ্গেই উঠে খোকনের সঙ্গে গার্ডেনে তোলা ওদের দুজনের ছবিটার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল। ঘড়িতে ঢং ঢং করে দশটা বাজতেই সোনালী চমকে উঠল। মনে মনে একটু ভয় পেল। তাছাড়া হঠাৎ খোকনের জন্য মনটা বড় চঞ্চল হয়ে উঠল। জানালা দিয়ে অনেকক্ষণ রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইল। না খোকন আসছে না। এক এক মিনিট এক এক ঘণ্টা মনে হয়। সোনালী ছটফট করে। ঘড়িতে সাড়ে দশটার ঘণ্টা বাজতেই ওর কান্না পায়।
সোয়া এগারটার সময় খোকন আসতেই সোনালী আর কান্না চেপে রাখতে পারে না। অঝোরে কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতেই বলে, এভাবে আমাকে একলা রেখে যাবার কোন মানে হয়? আমি ভয় ভাবনায় মরে যাচ্ছিলাম।
খোকন শুধু বলল, কাদিস না। আমার ঘরে আয়। কথা আছে।
আমাকে একলা রেখে তুমি এতরাত পর্যন্ত কেন বাইরে ছিলে, আগে সেকথা বলো।
সত্যি অন্যায় হয়েছে। তুমি আমাকে ক্ষমা কর।
খোকনের কথা শুনে সোনালী চমকে ওঠে। বলে, তুমি এভাবে কথা বলছ কেন খোকনদা?
খোকন নিজের ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, অন্যায় করেছি, ক্ষমা চাইব না?
সোনালী ওর পিছন পিছন ওর ঘরে ঢুকে জিজ্ঞাসা করল, তোমার কী হয়েছে বলো তো?
কি আবার হবে? কিচ্ছু হয়নি।
সোনালী খোকনের কপাল থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিতে দিতে বলল, আমাকেও বলবে না? আমি না তোমার সোনা, সোনালী?
খোকন আর চুপ করে থাকতে পারে না। দুহাত দিয়ে ওর কোমর জড়িয়ে বুকের ওপর। মাথা রেখে কাঁদতে কাঁদতে বলল, সোনালী, তোকে ছাড়া আমি বাঁচব না।
আমি কি মরে যাচ্ছি যে তুমি একথা বলছ?
না, না সোনালী, তোকে আমি হারাতে পারব না। কোনোদিন না। সোনালী আঁচল দিয়ে ওর চোখের জল মুছিয়ে দিতে দিতে বলে, আমি কোথায় হারিয়ে যাচ্ছি যে তুমি এমন করে কাঁদছ?
খোকন মুখ তুলে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, তুই আমাকে ভালোবাসিস না?
নিশ্চয়ই ভালোবাসি।
খুব ভালোবাসিস?
মনে তো হয়।
তুই আমাকে বিয়ে করতে…
সোনালী সঙ্গে সঙ্গে একটা হাত দিয়ে ওর মুখ চেপে ধরে বলে, খোকনদা!
সোনালীর হাত সরিয়ে খোকন বলল, আমি কি খুব অন্যায় কথা বললাম?
সোনালী কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি জানি না খোকনদা। তুমি আমাকে এসব প্রশ্ন কোরো না।
খোকন নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলল, আমার পাশে একটু বসবি?
সোনালী কোন জবাব না দিয়ে পাশে বসল।
তুই আমার জন্য খুব ভাবছিলি?
ভাবব না?
কি ভাবছিলি?
অনেক রকম আজেবাজে চিন্তা হচ্ছিল।
আজেবাজে মানে?
ভাবছিলাম কোনো বিপদে পড়লে কিনা।
খোকন একটু থেমে জিজ্ঞাসা করল, আমি তো কাল চলে যাচ্ছি। চিঠি লিখবি তো?
তুমি চিঠি লিখলেই জবাব দেবে।
না, এবার তুই আগে লিখবি।
কেন?
আমি যে প্রশ্ন করলাম, তার জবাব দিবি।
না, না খোকনদা, ওসব কথা আমি লিখতে পারব না!
কিন্তু আমি যে তোর জবাব না পেলে শান্তিতে পরীক্ষা দিতে পারব না।
মনে রেখো এবার ফাইন্যাল পরীক্ষা।
তাই তো বলছিলাম…
ওসব পাগলামি ছাড়ো। পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ হলে আমি আর তোমাকে ভালোবাসব না।
খোকন সোনালীর মুখের সামনে মুখ নিয়ে হাসতে হাসতে প্রশ্ন করল, পরীক্ষার রেজাল্ট যদি ভালো হয়, তাহলে আপত্তি করবি না তো?
লজ্জায় সোনালী প্রায় দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
.
পরীক্ষা দিয়ে ফিরতেই হাওড়া স্টেশনে সোনালীকে একলা দেখে খোকন অবাক। জিজ্ঞাসা করল, কিরে মা আসেনি?
না।
তুই একলা এসেছিস?
হ্যাঁ।
মা এলেন না কেন?
আমি বারণ করলাম।
কেন?
তোমার সঙ্গে ঝগড়া করব বলে।
ঝগড়া!
তুমি যেন গাছ থেকে পড়লে মনে হচ্ছে।
কিন্তু…
এই দুমাসের মধ্যে আমাকে একটা চিঠি দাওনি কেন?
খোকন সোনালীর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিস ফিস করে বলল, তোকে আজ দারুণ দেখাচ্ছে!
আঃ! কি বাজে বকছ!
স্টেশন থেকে বাইরে বেরিয়ে এসেই খোকন বলল, চল সোনালী রিকশা করে বাড়ি যাই।
তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে?
রিকশায় গেলে বেশ প্রাণভরে আড্ডা দেওয়া যাবে।
তুমি রিকশায় এসো। আমি ট্রামে-বাসে ফিরে গিয়ে বড়মাকে খবরটা দিই।
ট্যাক্সিতে উঠেই সোনালী বলল, তোমার চেহারাটা দারুণ খারাপ হয়ে গেছে।
হবে না? একে পড়াশুনোর চাপ, তার উপর তোর চিন্তা।
বড়মা জিজ্ঞাসা করলেও এই জবাব দেবে তো?
খোকন হাসে।
ছুটির দিনগুলো আনন্দে, হৈ-হুঁল্লোড় করে প্রায় ঝড়ের বেগে ফুরিয়ে গেল।
রেজাল্ট বেরুবার দিন বাড়িতে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল।
বিহারী ছুটতে ছুটতে এসে খোনকে জড়িয়ে ধরে বলল, খোকনদা এখন আমি মরলেও আমার কোনো দুঃখ থাকবে না।
কে তোমাকে মরতে দিচ্ছে?
তোর অনুমতি নিয়ে আমাকে মরতে হবে?
একশো বার!
.
রেজাল্ট বেরুবার এক মাসের মধ্যেই খোকন বাঙ্গালোরে বারোশো টাকা মাইনের চাকরি পেয়ে গেল। সবাই খুশি, সবাই আনন্দিত কিন্তু খোনকে দেখে খুশি হওয়া তো দূরের কথা, বেশ চিন্তিত মনে হয়!
শিবানী খোকনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞাসা করলেন, কিরে, তুই এত কি ভাবছিস?
কিছু না।
কিছু না বললেই আমি শুনব! আজ কদিন ধরে সব সময় চুপচাপ বসে আছিস। কি হয়েছে তোর?
সত্যি বলছি কিছু হয়নি।
রাত্রে সবাই শুয়ে পড়ার পর সোনালী আস্তে আস্তে খোকনের ঘরে এসে ওর পাশে বসল। একটু চুপ করে থাকার পর বলল, তোমাকে এমন চিন্তিত থাকতে দেখে জ্যাঠামণি ভীষণ চিন্তিত।
খোকন কোন কথা বলে না।
তুমি আমাকেও কিছু বলবে না?
কি বলব বল।
তুমি এত কি ভাবছ?
কি আর ভাবব? ভাবছি তোর কথা।
সোনালী আর কোনো প্রশ্ন করতে পারল না।
.
খোকনের বাঙ্গালোর রওনা হবার আগের রবিবারের কথা। সোনালী বন্ধুদের সঙ্গে সিনেমায় গেছে। খোকন ওর বাবা মার ঘরে ঢুকেই মুখ নীচু করে বলল, একটা কথা বলতাম।
ওর মা একটু হাসতে হাসতে বললেন, তা এমন করে বলছিস কেন?
খোকন মুখ নীচু করেই বলল, আমি সোনালীকে বিয়ে করব।
মিস্টার সরকার পাগলের মতন চিৎকার করে উঠলেন, ননসেন্স! ভাই-বোনে কখনো বিয়ে হয়?
শিবানী তাড়াতাড়ি খোকনের হাত দুটো জড়িয়ে ধরে বললেন, তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে?
খোকন জিজ্ঞাসা করল, তোমাদের মতামত বলবে না?
মিস্টার সরকার আবার গর্জে উঠলেন, রাসকেল, গেট আউট। এক্ষুনি বেরিয়ে যা হতভাগা!
শিবানী দুহাত দিয়ে ছেলেকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে উত্তেজনায় কাঁপতে কাঁপতে বললেন, হাজার হোক সোনালী একটা ড্রাইভারের মেয়ে…
খোকন পাগলের মতো হো হো করে হাসতে হাসতে বলল, মা! ওয়ান্ডারফুল! ওয়ান্ডারফুল! আমি ভুলে গিয়েছিলাম, সোনালী বিহারী ড্রাইভারের মেয়ে!
.
খোকনের পৌঁছনোর সংবাদ আসার পর কলকাতা থেকে ওরা তিনজনেই চিঠি দিলেন কিন্তু তার কোনো উত্তর এল না। মিস্টার সরকার টেলিগ্রাম করে ওর খবর জানতে চাইলেন।
ঠিক দুদিন পরের কথা।
এগারোটা বাজতে না বাজতেই মিস্টার সরকার অফিস থেকে ফিরে এসেই বাচ্চা ছেলের মতন কাঁদতে কাঁদতে বললেন, শিবানী, খোকন পাগল হয়ে গেছে!
পাগল!
হ্যাঁ।
ছোট্ট শিশুর মতন হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে মিস্টার সরকার টেলিগ্রামটা শিবানীর দিকে ছুঁড়ে দিলেন।
পাশের ঘর থেকে সোনালী উন্মাদিনীর মতন চিৎকার করে উঠল, খোকনদা!