- বইয়ের নামঃ মৌ
- লেখকের নামঃ নিমাই ভট্টাচার্য
- প্রকাশনাঃ সাহিত্যম
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১-২. হঠাৎ একটা বড় গাড়ি
০১.
হঠাৎ একটা বড় গাড়ি বাড়ির সামনে এসে থামতেই মৌ জানলার সামনে দাঁড়িয়ে নীচের দিকে তাকায়। তারপর ভদ্রলোককে গাড়ি থেকে নামতে দেখেই ও পিছন ফিরে চিৎকার করে, ও মা, শান্তদা এসেছে।
মৌ তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতেই দেখে মা দু’হাত দিয়ে শান্তদাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে প্রায় কাঁদতে কাঁদতে বলছেন, এতকাল পরে তোর আমাদের কথা মনে পড়ল?
ভাল মা, তুমি শুনলে অবাক হবে ক’টা বছর কিভাবে কাটিয়েছি। কেন কী হয়েছিল?
ঘরের ভিতর থেকে বিমলবাবু গলা চড়িয়ে বলেন, অনু, কার সঙ্গে কথা বলছ?
মৌ গলা চড়িয়ে বলে, বাবা, শান্তদা এসেছে।
শান্ত এসেছে?
হ্যাঁ, হ্যাঁ।
শান্ত বলে, ভাল মা, চল, ভাল কাকার কাছে যাই।
হ্যাঁ, চল।
ও ঘরে ঢুকেই শান্ত বিমলবাবুকে প্রণাম করে।
বিমলবাবু দু’হাত দিয়ে ওর মুখখানা ধরে কপালে স্নেহ চুম্বন দিয়ে বলেন, ক’দিন ধরেই তোর আর মৌয়ের ছবিটা দেখতে দেখতেই ভাবছিলাম, এতদিনে তুই কত বড় হয়েছিস, কী করছিস, কোথায় আছিস এইসব আর কি!
অনুপমা দেবী বলেন, তুই দাদার মৃত্যু সংবাদ জানিয়েছিলি কিন্তু তোর মা কেমন আছে তা তো জানাস নি।
হ্যাঁ, হ্যাঁ সব বলছি। তার আগে এক কাপ কফি তো খাই।
হ্যাঁ, বাবা, এখনই দিচ্ছি।
মৌ বলে, মা তোমরা কথা বল, আমি কফি করে আনছি।
শান্ত ওর দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলে, ভাল না হলে কিন্তু তুই আমার কাছে মার খাবি।
এখনও মারামারি করার অভ্যাস যায়নি তোমার?
তোর সঙ্গে মারামারি আর ঝগড়াঝাটি করেই বড় হয়েছি। সে অভ্যাস কী কখনও যায়?
মৌ হাসতে হাসতে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়।
মৌ চলে যেতেই শান্ত বলে, এখানে থাকতে থাকতেই আমি আই-আই-এম’ এর এনট্রান্স পরীক্ষা দেবার সপ্তাহখানেক পরই বাবা নাগপুর বদলি হলেন।
অনুপমা দেবী বলেন, তোরা ওখানে যাবার মাসখানেক পরই তো তোর মায়ের ইউট্রাস রিমুভ করা হয়, তাই না?
হ্যাঁ, ভাল মা; তবে ওই অপারেশনের পরই মা-র কিছু না কিছু প্রবলেম শুরু হল।
আমি জানি, এই অপারেশনের পর অনেকেরই অনেক সমস্যা শুরু হয়।
শান্ত বলে, ভাগ্যক্রমে আমি আই. আই. এম আমেদাবাদে জয়েন করার আগেই মা বেশ ভাল হয়ে গেল।
মৌ দু’কাপ কফি এনে বাবা আর শান্তকে দেয়।
কফির কাপে চুমুক দিয়েই শান্ত হাসতে হাসতে বলে, মৌ, তুই তো দারুণ কফি করেছিস।
আমি তো তোমার মতো অকর্মণ্য না।
বিমলবাবু একটু হেসে বলেন, ওরে মৌ, যে ছেলে আমেদাবাদ আই. আই. এম থেকে এম. বি. এ করেছে তাকে তুই অকর্মণ্য বলছিস?
ও এম. বি. এ হয়েছে তো কী হয়েছে? আমিও তো এম. এ পাস করেছি।
কী যে বলিস তুই!
শান্ত বলে, ভাল কাকা, মৌ-এর কথা এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দেবেন।
মৌ ওকে বলে, তুমি এই ঘর থেকে বেরোও, তারপর তোমাকে দেখাচ্ছি।
মৌ ওই ঘর থেকে চলে যায়।
শান্ত, তোর মা-র কথা বল।
হ্যাঁ, ভাল মা, বলছি।
বিমলবাবু বলেন, তোর বাবা যখন মারা যান, তখনও কী তুই আই. আই. এম-এর ছাত্র?
আমি আই. আই. এম থেকে বেরুবার আগেই ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ দিয়ে একটা বিখ্যাত ব্রিটিশ ব্যাঙ্কে চাকরি পাই।
তারপর?
ওই ব্যাঙ্কে কাজ করতে শুরু করার ঠিক তিন দিন পরই বাবা হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলেন।
কী আশ্চর্য!
জানেন ভাল কাকা, কেন জানি না, আমার মনে হল এই ব্যাঙ্কে কাজ করলে আমার ভাল হবে না। বাবা মারা যাবার পরদিনই আমি ওই ব্যাঙ্কের চাকরি ছেড়ে দিলাম।
হ্যাঁ, এইরকম মনে হয় বৈকি।
অনুপমা দেবী বলেন, এবার তোর মা-র কথা বল।
হ্যাঁ, ভাল মা, বলছি।
মুহূর্তের জন্য থেমে শান্ত বলে, বাবা মারা যাবার বছর খানেক পরের কথা। একদিন অফিস থেকে ফিরে দেখি, মা শুয়ে আছে।
.
মা, তুমি শুয়ে আছো কেন?.
আমার পেটে খুব জ্বালা করছে; তাছাড়া দু’বার পটি করতে গিয়ে শুধু রক্ত বেরুলো।
সেকি?
হ্যাঁ, তাই তো ভাবছি, পেটে আলসার-টালসার হল কিনা।
তুমি চিন্তা করো না, আমি এখনই ডাঃ পাতিলকে আসতে বলছি।
অনুপমা দেবী বলেন, ডাঃ পাতিল ওকে দেখে কী বললেন?
উনি তিন দিনের ওষুধ দিয়ে বললেন, এই ওষুধে যদি পেটের জ্বালা আর ব্লিডিং বন্ধ না হয় তাহলে আমি ডাঃ কেশকারকে রেফার করব।
কোন ডাঃ কেশকারের কথা বলছেন? যিনি ক্যান্সার স্পেশালিস্ট নাকি…
হ্যাঁ, ওই ডাঃ কেশকারকেই রেফার করব।
তোর মা-র কি ক্যান্সার হয়েছিল?
হ্যাঁ, মা-র ক্যান্সারই হয়েছিল।
ইস!
তবে ভাল মা, একটা অপারেশনের পরই মা-র পেটের জ্বালা চলে যায়। মাকে দেখে কেউ বুঝতেই পারত না মা সর্বনাশা রোগে ভুগছেন।
ও ঠিক মত খাওয়া-দাওয়া করতে পারত?
জীবনের শেষ তিন বছর মা শুধু লিকুইড খেতেন।
তারপর?
হঠাৎ একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি, মা হাউ হাউ করে কাঁদছেন আর বেশ কষ্ট করে বললেন, নিশ্বাস নিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আর বুকের ডান দিকে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে।
ডাঃ কেশকারকে খবর দিলি?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, সঙ্গে সঙ্গেই ওকে ফোন করলাম।
উনি কী বললেন?
ডাঃ কেশকার খুব গম্ভীর হয়ে বললেন, আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই বোধহয় তোমার মা তোমাকে ছেড়ে চলে যাবেন।
শান্ত একটু উত্তেজিত হয়ে বলে, জানো ভাল মা, ডাঃ কেশকারের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে রিসিভার নামিয়ে রাখার পরই..
না। শান্ত কথাটা শেষ করতে পারে না।
হঠাৎ সবাই চুপচাপ; কারুর মুখেই কোন কথা নেই।
একটু পরেই মৌ ও ঘরে এসে বলে, ও মা, খেতে দেবে না? বড্ড খিদে লেগেছে।
শান্ত সঙ্গে সঙ্গে বলে ভাল, আমিও হোটেল থেকে ব্রেকফাস্ট করে আসি নি।
হ্যাঁ, চল। তোদের দু’জনকে খেতে দিচ্ছি।
খেতে খেতেই শান্ত বলে, হ্যাঁরে মৌ, এখন কী করছিস?
মৌ হাসতে হাসতে বলে, এম. এ. আর রিসার্চ করার পর আমি ভগবান বুদ্ধের উন্নততর বামফ্রন্টের উন্নততর বেকার।
ওর কথায় শান্ত হো হো করে হেসে ওঠে।
বিমলবাবু ডাইনিং টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে বলেন, হ্যাঁ, ওর একটা চাকরি হলে বড়ই ভাল হত। গভর্নমেন্ট যেভাবে ইন্টারেস্ট রেট কমিয়েছে, তাতে আমার মতো রিটায়ার্ড লোকেরা সত্যি বিপদে পড়েছে।
মৌ বলে, শান্তদা, তুমি কোন হোটেলে উঠেছ?
তাজ বেঙ্গলে।
তার মানে ইউ আর রিয়েলি এ বিগ বস!
হঠাৎ আমার পিছনে লাগলি কেন?
সোজা কথা, আমাকে একটা চাকরি দাও।
সত্যি চাকরি করবি?
তবে কী তোমার সঙ্গে ঠাট্টা করছি?
একটু চুপ করে থাকার পর শান্ত বলে, আমাদের চাকরিতে মাঝেমধ্যে বাইরে যেতে হবে, তাতে কোন আপত্তি নেই তো?
বাইরে মানে?
দু’চার মাস অন্তর আমাদের বোম্বের হেড অফিসে আসতে হবে। তাছাড়া তোকে মাসে একবার করে শিলং, গুয়াহাটি, গ্যাংটক, কাঠমাণ্ডু আর থিম্পু যেতে হবে।
মৌ বেশ উত্তেজিত হয়ে বলে, রিয়েলি?
তবে কী আমি তোর সঙ্গে ঠাট্টা করছি?
ওইসব জায়গায় গিয়ে কোথায় থাকব?
ভাল হোটেলেই থাকবি।
মাইনে কত পাবো?
দুতিন শো’র কম হবে না।
শান্তর কথা শুনে বিমলবাবু আর অনুপমা দেবী হেসে ওঠেন।
মৌ বলে, অত টাকা মাইনে পেলে আমার মাথা ঘুরে যাবে।
যাইহোক তুই কী এখন আমার সঙ্গে যাবি?
তাজ-এ লাঞ্চ খাওয়াবে?
শুধু লাঞ্চ কেন, তোকে ডিনারও খাওয়াব।
এবার মৌ দৃষ্টি ঘুরিয়ে বলে, মা, যাব?
শান্তর সঙ্গে যাবি তা আবার জিজ্ঞেস করার কী আছে।
মৌ হাসতে হাসতে বলে, শান্তদা একটু দাঁড়াও; একটু সেজেগুজে আসি।
প্রায় আধঘণ্টা পরে মৌ নীচে নেমে আসতেই শান্ত ওর চোখের পর চোখ রেখে বলে, মাই গড! তোকে কি দারুণ সুন্দর দেখাচ্ছে!
আমাকে সব সময়ই সুন্দর দেখায়।
তুই এত অহংকারী?
অহংকারের কী আছে? যা সত্যি তাই বললাম।
ভাল মা, ধন্য তোমার মেয়ে, ধন্য তার রূপ!
.
০২.
সে অনেক দিন আগেকার কথা।
পুজোর ছুটিতে লক্ষ লক্ষ বাঙালীর মতো ওরাও পুরী গিয়েছেন; উঠেছেন পুরী হোটেলেই। দুপুরে খেতে গিয়েই দেখা গেল, ওই দূরে কোনার দিকে একটা টেবিলই খালি আছে; আর সব টেবিলে আবাসিকরা খাওয়া-দাওয়া করছেন।
বিমলবাবু বললেন, অনু, চল, ওখানেই বসি।
একটা অল্পবয়সী ছেলে দুটো গেলাসে জল দিয়ে একটা জলের জাগ রেখে চলে গেল।
এখানে কী আমরা বসতে পারি?
বিমলবাবু আর অনুপমা তাকিয়ে দেখেন, প্রায় ওদের বয়সীই এক দম্পতি।
হ্যাঁ হ্যাঁ বসুন।
বিমলবাবু একটু হেসেই বলেন।
ওদের দু’জনের মুখোমুখি বসেই মনিকা দেবী অনুপমা দেবীকে বলেন, আপনারা বোধহয় আমাদের পাশের ঘরেই আছেন, তাই না?
অনুপমা দেবী কয়েক মুহূর্ত ওর মুখের দিকে তাকিয়েই একটু হেসে বলেন, হ্যাঁ, তাইতো। পাশের বারান্দায় আপনাদের দুজনকেই দেখি।
আমরাও তো আপনাদের দেখি।
ওরা চারজনেই না হেসে পারেন না।
আমি অপূর্ব সরকার আর আমার স্ত্রী মনিকা।
আমি বিমল চৌধুরী আর আমার স্ত্রী অনুপমা।
আমরা কলকাতায় থাকি; আপনারা কোথায় থাকেন?
আমরাও কলকাতায় থাকি।
এইভাবেই শুরু হল ওদের আলাপ পরিচয়।
খাওয়া-দাওয়ার পর ডাইনিং হল থেকে বেরিয়েই অপূর্ববাবু বলেন, মিঃ চৌধুরী, কলকাতায় আপনারা কোথায় থাকেন?
আমরা প্রতাপাদিত্য রোডে থাকি? আপনারা?
প্রতাপাদিত্য রোড শুনেই চৌধুরী হাসতে শুরু করেন।
কী হল? হাসছেন কেন?
আমরাও তো প্রতাপাদিত্য রোডে থাকি। তারপর?
দুটো বাড়ির নম্বর জানাজানির পর দেখা গেল, ওরা প্রায় সামনা-সামনি বাড়িতে থাকেন।
অনুপমা দেবী হাসতে হাসতে বলেন, আমরা থাকি দুটো মুখোমুখি বাড়িতে অথচ আমাদের আলাপ হল জগন্নাথ দেবের কৃপায় এই শ্রীক্ষেত্রে।
হ্যাঁ, ভাই, ঠিক বলেছেন।
মনিকা দেবী সঙ্গে সঙ্গে বলেন, জগন্নাথ দেবের কৃপায় আমাদের যোগাযোগের ফল বোধহয় ভালই হবে।
বোধহয় না, নিশ্চয়ই ভাল হবে।
.
একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া গল্পগুজব করে ওদের সময় বেশ কেটে যায়।
কখনো অপূর্ববাবুর ঘরে বসে বিমলবাবু আড্ডা দেন। আবার কখনো অন্য ঘরে অনুপমা দেবী আর মনিকা দেবী গল্প করেন।
মনিকাদি, তোমরা ক’দিন এখানে থাকবে?
দশদিন।
উনি সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করেন, তোমরা কদিন কবে?
আমরা বারো দিন থাকব; তার মানে তোমাদের একদিন পরে কলকাতা পৌঁছব।
বারো দিনই পুরী থাকবে?
ইচ্ছা আছে দু’একদিন চিৎকার পাড়ে থাকার।
অনুপমা দেবী একটু হেসে বলেন, তোমরাও চিল্কা চল; খুব মজা হবে।
মনিকা দেবী একটু হেসে পেটের উপর হাত রেখে বলেন, সাত মাস; তাই এবার আর বিশেষ ঘুরাঘুরি করব না।
তাহলে তো তোমার ঘুরাঘুরি করা ঠিক হবে না।
সামনের বছর আমরা একসঙ্গে এসে খুব ঘুরব।
হ্যাঁ, ঠিক আছে।
অনুপমা দেবী না থেমেই বলেন, তুমি যখন যেতে পারবে না, তখন আমরাও এবার চিল্কা যাব না।
আমার জন্য তোমরা কেন যাবে না? তোমরা ঘুরে এসো।
এই অবস্থায় তোমাকে ফেলে যেতে পারব না।
কিন্তু…
না, না, কোন কিন্তু না। বেশ তো গল্পগুজব করে আমাদের দিনগুলো কাটছে।
এইভাবেই শুরু হল দুটি পরিবারের ঘনিষ্ঠতা।
.
মনিকাদি, তুমি এই শাক আর টক ডাল দিয়ে ভাত খেও; তোমার ভাল লাগবে।
মনিকা একগাল হেসে বলেন, তুমি কী আজকাল আমার অবস্থা চিন্তা করেই রান্না করছ?
শুধু তোমার জন্য তো রান্না করিনি; আমরাও তো খাবো।
এ সে যাইহোক আমাকে কী রোজই তোমার কিছু না কিছু দিতে হবে?
কী আশ্চর্য! আমি কী রোজ রান্না করি না?
অনুপমা না থেমেই বলেন, তুমি অত-শত প্রশ্ন করবে না। আমি যখন যা দেব, তোমাকে তা খেতে হবে।
মনিকা হাসতে হাসতে বলেন, তুমি ভালবেসে দিচ্ছ আর আমি খাব না, তাই কখনো হয়?
দেখতে দেখতে দুটো মাস কেটে গেল।
তারপর একদিন মনিকার ছেলে হয়।
এই ছেলেকে দেখতে ওদের কত আত্মীয়স্বজন আসেন, চলেও যান।
অনুপমা সংসারের কাজকর্ম রান্নাবান্না নিয়ে সকালে বেশ ব্যস্ত থাকে কিন্তু স্বামী অফিস রওনা হলেই চলে যায় ও বাড়ি।
ছেলেটাকে আমার কাছে দে তো; ওকে একটু প্রাণভরে আদর করি।
তুই বোধহয় জলখাবার না খেয়েই এসেছিস?
এত সকাল সকাল আবার কবে খাই?
বাজে বকিস না; সওয়া ন’টা বাজে। কেউ জলখাবার কী দশটা-এগারোটায় খায়?
সে কথা অনুপমার কানেও যায় না। উনি ছেলেকে আদর করতেই ব্যস্ত।
মনিকা গলা চড়িয়ে বলেন, মালতী আমাকে আর অনুকে খেতে দিবি?
মালতী রান্নাঘর থেকেই জবাব দেয়, হ্যাঁ, মা, দিচ্ছি।
একটু পরেই ও ওদের দুজনকে জলখাবার খেতে দেয়।
নে অনু, শুরু কর।
আচ্ছা মনিকা, আমাকে কী রোজই তোর সঙ্গে খেতে হবে?
আমার সঙ্গে খেলে কী তোর জাত যাবে?
অনুপমা হাসতে হাসতে খেতে শুরু করেন।
খাওয়া শেষ হতেই অনুপমা বলেন, মনিকা ছেলের তেলটা দে তো; আমি বাবুসোনাকে ভাল করে তেল মাখিয়ে দিই।
মনিকা তেলের শিশিটা এগিয়ে দিয়ে একটু হেসে বলেন, নে, প্রাণভরে তেল মাখা।
তুই কী জানিস না, বাচ্চাদের ভালভাবে মালিশ করে তেল না মাখালে ওদের শরীর ভাল হয় না?
জানব না কেন? তাই বলে তোর মতো ঘণ্টাখানেক ধরে কেউ তার বাচ্চাকে তেল মাখায় না।
.
তারপর?
চাকা ঘুরে যায়। বছর তিনেক পর অনুপমা গর্ভবতী হলেন।
ভূমিকায় অদল-বদল হল। এবার অনুপমার ভূমিকায় মনিকা, মনিকার ভূমিকায় অনুপমা।
শোন অনু, এই সুক্তো খাবি, আর এই আচার রেখে গেলাম। মাঝেমধ্যে একটু আচার খেলে ডাল-তরকারী খেতে ভালই লাগবে।
তুই আগে যে আচার দিয়েছিলি, সেটাও খুব ভাল ছিল।
মনে হয়, এটাও তোর ভাল লাগবে।
ছেলেটাকে নিয়ে এলি না কেন?
ও এখন এত ছটফটে আর দুরন্ত হয়েছে যে ও হয়তো তোর পেটে লাথি-টাথি লাগিয়ে দেবে।
বাবুসোনা কখনই লাথি-টাথি লাগাবে না; তুই এখনি মালতাঁকে দিয়ে ছেলেটাকে পাঠিয়ে দে।
সত্যি পাঠাব?
একশ’বার পাঠাবি।
অনুপমা একটু হেসে বলেন, ও এলে আমার সময়টা বেশ ভাল কাটবে।
তারপর একদিন অনুপমা কন্যা সন্তানের মা হলেন।
.
এই মেয়ে যখন বছর খানেকের, তখন ওরা আবার একসঙ্গে পুরী গেলেন এক সপ্তাহের জন্য। মহানন্দে এক সপ্তাহ কাটিয়ে হাওড়া স্টেশনে ফিরেই অঘটন। মনিকা দেবী হাতে একটা ব্যাগ নিয়ে প্ল্যাটফর্মে পা দিতেই স্লিপ করে পড়ে গিয়েই বেদনায় বিকট চিৎকার করেন।
তারপর সোজা উডল্যান্ডস নার্সিংহোম। অর্থপেডিক একবারূরীক্ষা করতেই তার মুখ গম্ভীর হল।
মিঃ সরকার, আমার মনে হচ্ছে ঊরুর হাড় দু’জায়গায় ফ্র্যাকচার হয়েছে। এক্স-রে রিপোর্ট দেখে অপারেশন করে স্টীলেরড ঢোকাতে হবে বলেই মনে হচ্ছে।
অর্থপেডিকের সন্দেহই ঠিক ছিল।
ডাঃ ঘোষ বললেন, কাল সকালেই অপরেশন করব।
পরের দিন সাড়ে তিন ঘণ্টা ধরে অপারেশন করার পর ও. টি থেকে বেরিয়ে ডাঃ ঘোষ বললেন, অপারেশন ঠিকই হয়েছে, তবে মিসেস সরকারকে তিন মাস বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে।
তিন মাস শুয়ে থাকতে হবে?
একটা ফরেন বডি হাড়ের মধ্যে ঢুকিয়েছি।
দু’জায়গার হাড় জোড়া লাগতে ছ’ থেকে আট সপ্তাহ সময় লাগবে; তাছাড়া স্টীল রড় দুটো ঠিক মতো ফিক্সড হওয়া চাই।
এর আগে ওর ভাল হবার সম্ভাবনা নেই?
ওষুধপত্তর ঠিক মতো খাওয়াবেন; গড উইলিং একটু তাড়াতাড়ি কন্ডিসন ইমপ্রুফ করতে পারে। দু’মাস পরে একবার এক্স-রে করে দেখব কি অবস্থা।
বিকেলে ভিজিটিং আওয়ার্সে অনুপমা ওর ছেলেকে নিয়ে নার্সিংহোমে যায়। বাবুসোনা মাকে এইভাবে শুয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়। মনিকা একবার ছেলেকে বুকের উপর নিয়ে আদর করতেই নার্স বলেন, ম্যাডাম, ছেলেকে ফিরিয়ে দিন। সামান্য একটু টান লাগলেই অপারেশনের জায়গার স্টিচ ছিঁড়ে যেতে পারে।
নে অনু, ছেলেকে ধর।
হ্যাঁ, অনুপমা ওর ছেলেকে কোলে তুলে নেয়।
দিন দশেক পর মনিকা অনুপমাকে দেখিয়ে ছেলেকে বলেন, বাবুসোনা, এই মা কেমন?
মা ভাল, ভাল মা ভাল।
ব্যস, অনুপমা ওর সারা জীবনের জন্য ভাল মা হয়ে গেল।
৩-৪. রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কারেন্সী অফিসার
অপুর্ববাবু রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কারেন্সী অফিসার আর বিমলবাবু আশুতোষ কলেজে ইংরেজির অধ্যাপক। সপ্তাহের ছ’দিনই দু’জনকে ব্যস্ত থাকতে হয়। একটু ঢিলেঢালা আয়েষী দিন কাটাবার সুযোগ শুধু রবিবার। দু’জনেরই ঘুম ভেঙে যায় ভোরবেলায় কিন্তু দুজনেই গড়িমসি করে বিছানা ছাড়েন দেরি করে।
কিগো, বিছানা ছেড়ে উঠবে না নাকি? চটপট উঠে পড়ে মুখ ধুয়ে নাও; আর দেরি করলে চা ঠান্ডা হয়ে যাবে।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, উঠছি।
অনুপমা ঘর থেকে বেরুতে বেরুতে বলেন, তুমি চা খেয়ে বাজার যাবে
তো?
কোন রবিবার বাজার যাই না বলতে পারো?
অনুপমা সে কথার উত্তর না দিয়েই চলে যান।
রবিবার সকালে বাজার যাবার ঝামেলা নেই অপূর্ববাবুর। উনি শনিবার অফিস থেকে ফেরার পথে জগুবাবুর বাজার বা লেক মার্কেট থেকে সারা সপ্তাহের বাজার করে বাড়ি ফেরেন।
যাইহোক বিমলবাবু বাজার থেকে ফেরার পাঁচ-দশ মিনিটের মধ্যেই অপূর্ববাবু এসে হাজির হবেনই।
কী হে বিমল। বাজার থেকে কখন ফিরলে?
এই তো একটু আগে।
এ রবিবার ঘুম থেকে উঠেই বাজার যাওয়া সত্যি ঝামেলার ব্যাপার তাই না?
হ্যাঁ, দাদা, ঠিকই বলেছ কিন্তু না গিয়ে তো উপায় নেই; অন্য কোনদিন তো বাজারে যাবার সুযোগ নেই।
উইক ডে’জ-এ তত তোমাকে বড্ড সকাল সকাল বেরুতে হয়।
হ্যাঁ, দাদা।
বিমলবাবু না থেমেই বলেন, সপ্তাহে পাঁচদিনই তো আমাকে মেয়েদের মর্নিং সেকশনে দুটো ক্লাস নিতে হয় সওয়া আটটায় আর ন’টায়। বহু অনুরোধ উপরোধ করেও এই ক্লাস দুটো ছাড়তে পারছি না।
কলেজ থেকে ফিরতেও তো তোমার বেশ দেরি হয়।
সপ্তাহে একদিন শুধু আড়াইটেতে ক্লাস শেষ হয়; শুধু সেদিনই বাড়ি ফিরে খেতে পারি।
ঠিক সেই সময় অনুপমা দু’কাপ কফি নিয়ে ঘরে ঢোকে। এক কাপ অপূর্ববাবুর দিকে এগিয়ে ধরে বলেন, দাদা, এই নিন।
অন্য একটা স্বামীর সামনে ধরে বলেন, তুমি ধরো।
কফির কাপে একবার চুমুক দিয়েই অপূর্ববাবু বলেন, সিস্টার, কী রান্না করছ?
অনুপমা একগাল হেসে বলেন, মনিকা তো সকালেই বলেছে এই সপ্তাহে তিন দিন ইলিশ খাওয়াবে, তাই শুধু তেতোর ডাল করছি।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, দাদা।
আমাকে এক বাটি পাঠিও তো।
অনুপমা আবার হাসতে হাসতে বলেন, আপনি না বললেও ঠিকই পাঠাতাম।
জানো সিস্টার, তোমার হাতের নিরামিষ রান্না-খেলেই মায়ের রান্নার কথা মনে হয়। তোমার নিরামিষ রান্না এক কথায় পূর্ব।
আপনি আমাকে ছোট বোনের মতো স্নেহ করেন বলেই আমার রান্না আপনার এত ভাল লাগে।
হ্যাঁ, তা বলতে পারো।
অপূর্ববাবু একটু হেসে বলেন, সিস্টার, আসল কথা হচ্ছে, প্রিয়জন ভালবেসে যা দেয়, তা পাবার আনন্দই আলাদা।
হ্যাঁ, দাদা, ঠিক বলেছেন।
আসল কথা হচ্ছে, এই যে আমি তোমাকে ছোটবোনের মতো স্নেহ করি, ভালবাসি, তুমি যে আমাকে বড় ভাইয়ের মতো শ্রদ্ধা করো, ভালবাসো, বা ঘটনাচক্রে আমরা দুটো পরিবার এত ঘনিষ্ঠ হয়েছি, আজকাল এই ধরনের সম্পর্ক দুর্লভ হয়েছে। এ যুগের মানুষ বড় বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়েছে।
একদম ঠিক কথা বলেছেন। বিমলবাবু বলেন, দাদা, তুমি খুব ভাল করেই জানো, আগে কলকাতায় পাড়াকেন্দ্রিক একটা সম্পর্ক ছিল। আগে পাড়ার মধ্যেই আমাদের ঠাকুমা, বড় জ্যেঠিমা, ছোট জ্যেঠিমা, ভাল কাকা, নতুন কাকা, বড়দি, মেজদি, রাঙাদি ইত্যাদিকে নিয়ে আমরা কি আনন্দেই থেকেছি; আজকাল তা কল্পনাও করা যায় না।
অপূর্ববাবু সঙ্গে সঙ্গে বলেন, হ্যাঁ ভাই, ঠিক বলেছ। আগে আমাদের বাগবাজার পাড়ায় রোজ সন্ধেবেলায় একদল বয়স্ক মানুষ তাস আর পাশা খেলায় মেতে উঠতেন। আমার বাবা প্রতিদিন সন্ধের পর তাসের আড্ডায় না গেলে শান্তি পেতেন না।
উনি মুহূর্তের জন্য থেমেই বলেন, আমার মা আবার নাটক দেখতে খুব ভালবাসতেন; তিনি চিরকাল নাটক দেখতে গিয়েছেন পাড়ার রাঙা ঠাকুরপো আর তার স্ত্রী বা বৌদির সঙ্গে।
বিমলবাবু বলেন, দাদা, তুমি বোধহয় স্বীকার করবে পাড়াভিত্তিক এই কালচার, এই সম্পর্ক নষ্ট হল প্রথমে পার্টিশন আর অপর নকশাল আন্দোলনের জন্য। এই নকশাল আন্দোলনই আমাদের মধ্যে এমন সন্দেহ আর অবিশ্বাসের বীজ পুঁতে দিল যে পাড়ার অতি পরিচিতজনও আমাদের অপরিচিত মনে হতে শুরু হল।
হ্যাঁ ভাই, তুমি ঠিকই বলেছ।
অনুপমা বলেন, দাদা, এই পাড়াতে আমরা অনেকেরই মুখ চিনি কিন্তু আমাদের মধ্যে কোন সম্পর্কই গড়ে ওঠেনি।
জানো সিস্টার, আমি তোমার দিদিকে কী বলি?
কী বলেন?
বলি, পুরীতে তোমাদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় ঘনিষ্ঠতা না হলে তোমার ঊরুর হাড় ভাঙার পর তিন-চার মাস তোমার ছেলেকে কে দেখত?
অনুপমা একটু হেসে বলেন, দাদা, ভুলে যাবেন না জগন্নাথদেবই আমাদের মিলিয়ে দিয়েছেন।
হ্যাঁ সিস্টার, ঠিকই বলেছ।
অপূর্ববাবু সঙ্গে সঙ্গে একটু হেসে বলেন, আমাদের ছেলে-মেয়ে দুটোর কপাল দেখো। মৌ ছাড়া আমাদের ছেলের কোন বন্ধু নেই। আবার আমাদের ছেলে ছাড়া মৌ-য়ের কোন বন্ধু নেই অথচ এই পাড়ায় কী কম ছেলেমেয়ে আছে?
হ্যাঁ দাদা, সত্যিই তাই।
হঠাৎ মনিকা দেবী এসে হাজির। উনি ঘরে ঢুকেই স্বামীকে বলেন, বাড়িতে ফিরে যে খাওয়া-দাওয়া করতে হবে তা কী ভুলে গিয়েছ?
কী আশ্চর্য! এত বকবক না করে মাছের ঝোলের পাত্রটা হাতে করে আনলেই তো এখানেই তেতোর ডাল আর মাছের ঝোল দিয়ে দু’মুঠো ভাত খেতে পারতাম।
অনুপমা সঙ্গে সঙ্গে নেচে ওঠেন। উনি মনিকা দেবীকে বলেন, তুই প্লিজ মালতাঁকে বলে দে…
তুই তো আচ্ছা পাগলামী শুরু করলি!
অপূর্ববাবু হাসতে হালতে বলেন, তোমাদের কাউকে কিছু করতে হবে না। আমি আর মালতী সব নিয়ে আসছি।
হ্যাঁ, হ্যাঁ নিয়ে এসো।
.
এইভাবেই মিলেমিশে দুটি পরিবারের দিনের পর দিন, মাসের পর মাস তো দূরের কথা, চলে যায় বছরের পর বছর।
প্রতিদিনের মতো সেদিনও দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর মনিকা আর অনুপমা গল্পগুজব করছেন।
জানিস মনিকা, এখন মাঝে মাঝে মনে হয়, এই তো সেদিন পুরী বেড়াতে গিয়ে তোদের সঙ্গে আলাপ। বাবা জগন্নাথদেবের কৃপায় তোর মতো বন্ধু আর দাদার মতো বড় ভাই পেলাম। আমরা নিজেরা তিন বোন, কোন ভাই নেই। তাইতো দাদাকে পেয়ে আমার যে কি আনন্দ। কি তৃপ্তি পেয়েছি, তা বলতে পারব না।
তুই তো দাদার কথা বলছিস; আর তোর দাদা বলেন, জানো মনিকা, আমার স্থির বিশ্বাস অনু গতজন্মে আমার ছোট বোন ছিল। তা না হলে অমন পাগলের মতো কী আমাকে এত শ্রদ্ধা করতে বা ভালবাসতে পারে?
হ্যাঁ, তা হতে পারে। তবে এটা আমিও বিশ্বাস করি, আমার সঙ্গে দাদার কোন না কোন একটা বিশেষ যোগাযোগ, বিশেষ সম্পর্ক ছিল।
অনুপমা না থেমেই বলে, আমার যখন টাইফয়েড হল, তখন দাদা যা করেছেন, তা কোন পাতানো দাদা করতে পারে না। আর ওই হতভাগা ছেলেটা আমার কষ্ট দেখে কি কান্নাই কাদত!
তুই ভুলে যাস কেন, শান্ত তো তোরও ছেলে।
একশ’ বার ও আমার ছেলে।
মনিকা একটু হেসে বলেন, দেখতে দেখতে ছেলেমেয়ে দুটো কত বড় হয়ে গেল!
হ্যাঁ, ঠিক বলেছিস। আর শান্ত যত বড় হচ্ছে তত হ্যান্ডসাম হচ্ছে। তোর পেটের মেয়েটাকে কি চোখে পড়ে না?
মনিকা না থেমেই বলেন, মৌ-য়ের মতো সুন্দরী মেয়ে তো খুবই কম চোখে পড়ে। ওর চোখ-মুখের কোন তুলনা হয় না। তাছাড়া ওর চোখ দুটো
এমন যে মনে হয় সবসময় হাসছে।
বাবা! ওকে তোর এত সুন্দরী মনে হয়?
তুই যেন গাছ থেকে পড়লি?
তুই বোধহয় মনে করিস, মৌ-এর মতো সুন্দরী মেয়ে ভূ-ভারতে নেই।
আমি মোটেও তা ভাবি না; তবে মৌ যে অত্যন্ত সুন্দরী, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
একটু চুপ করে থাকার পর অনুপমা একটু হেসে বলেন, তবে ছেলেমেয়ে দুটোকে দেখে মনে হয়, ভবিষ্যতে ওরা আমাদের সম্পর্কটা বজায় রাখবে।
মনিকাও একটু হেসে বলেন, হ্যাঁ, তা রাখবে বলেই তো মনে হয়।
.
০৪.
শান্ত মৌ-কে নিয়ে বাড়ির বাইরে আসতেই ড্রাইভার বিদ্যুৎবেগে নিজের সিট ছেড়ে বেরিয়ে এসে পিছন দিকের দরজা খুলে দাঁড়ায়।
বিমলবাবু বলেন, হারে শান্ত, তুই ক’দিন কলকাতায় থাকবি?
ভাল কাকা, সেটা কাল বুঝতে পারব, তবে তিন-চারদিন নিশ্চয়ই থাকতে হবে।
অনুপমা দেবী বলেন, তুই আমার কাছে কবে খাবি?
শান্ত হাসতে হাসতে বলে, আমার ভাল মাতৃদেবী হুকুম,করলেই আমি তার প্রসাদ গ্রহণ করব।
ওর কথা শুনে ওরা স্বামী-স্ত্রী না হেসে পারেন না।
গাড়িতে ওঠার আগেই শান্ত বলে, ভাল মা, মৌ-এর জন্য চিন্তা করো না; ওকে বোধহয় রাত্রে খাইয়ে-দাইয়েই দিয়ে যাব।
তোর সঙ্গে যাচ্ছে, চিন্তার কী আছে? তবে দশটা-সাড়ে দশটার, বেশি রাত করিস না; আজকাল বেশি রাত পর্যন্ত জাগতে পারি না। এ99)
না, না, অত রাত হবে না।
গাড়ি স্টার্ট করতেই শান্ত ড্রাইভারকে বলে, হোটেল চলিয়ে।
ড্রাইভার মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।
শান্ত বাঁ হাত দিয়ে মৌ-য়ের ডান হাতটা চেপে ধরতেই দু’জনে দু’জনের দিকে তাকিয়ে শুধু হাসে। সে হাসিতে দু’জনেরই খুশি ঝরে পড়ে; কারুর মুখেই কোন কথা নেই কিন্তু মনে মনে দুজনেই কত কথা বলে।
বেশ কিছুক্ষণ পরে মৌ বলে, আর্মি নাইন থেকে টেনে উঠতে না উঠতেই তুমি কলকাতা থেকে চলে গেলে।
আমি চলে যাবার আগের দিনের কথা তোর মনে আছে?
সেদিনের কথা সারাজীবনেও ভুলতে পারব না।
মৌ মুহূর্তের জন্য থেমেই বলে, সেদিন তুমি কী কাণ্ডটাই করেছিলে; আমি লজ্জায় কুঁকড়ে গিয়েছিলাম।
শান্ত একটু হেসে বলে, সেদিন কী করেছিলাম?
কী করো নি?
মৌ হাসতে হাসতেই বলে, সেদিন তুমি চুমু খেতে খেতেই ব্লাউজের বোতাম খুলে আমার বুকে পর্যন্ত হাত দিয়েছিলে। সেদিন যেমন লজ্জা, তেমনই ভয় করছিল।
আর কিছু না?
মজাও লেগেছিল।
তুই বরাবরই সুন্দরী। তারপর তুই যত বড় হয়েছিস, তত বেশী সুন্দরী হয়েছিস। চোদ্দ-পনের বছর বয়সেই পদ্মের পাপড়ির মতোই তোর শরীরে যৌবন ফুটে উঠেছে। তাইতো যাবার আগের দিন তোকে একটু ভাল করে আদর না করে পারিনি।
আই. আই. এম, এ পড়ার সময় তোমাদের ব্যাচ-এ নিশ্চয়ই অনেক মেয়ে ছিল।
হ্যাঁ, প্রায় অর্ধেকই মেয়ে ছিল।
তাদের মধ্যে ক’জনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়?
সকাল ন’টা থেকে সাড়ে পাঁচটা-ছ’টা পর্যন্ত আমাদের এমনভাবে কাটাতে হতো যে সব ছেলেমেয়ের মধ্যেই যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে।
তার মানে তোমার হাত থেকে অন্তত কয়েকটি মেয়ে নিষ্কৃতি পায়নি। তাইতো?
শান্ত হো হো করে হেসে ওঠে।
.
গাড়ি তাজ বেঙ্গলে পৌঁছায়।
এ ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করেই শান্ত দুহঁত দিয়ে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে ওর মাথার উপর মুখখানা রেখে বলে, আ! কি শান্তি!
মৌ-ও দু’হাত দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে।
মৌ, তুই আগের মতোই আমাকে ভালবাসিস তো?
আগের থেকে এখন তোমাকে অনেক বেশি ভালবাসি।
সত্যি?
হ্যাঁ, সত্যি।
কিন্তু কেন এখন বেশি ভালবাসিস?
আগে যখন তোমাকে কাছে পেয়েছি, তখন তোমাকে সত্যি ভাল লাগত; মনের মানুষকে ভালবাসার স্বাদ-আহ্লাদ বা আনন্দের গুরুত্ব তখন ঠিক বুঝতে পারতাম না।
এখন?
মৌ একটু হেসে বলে, এখন দেহ-মন আগের চাইতে অনেক পরিণত হয়েছে; তাইতো মনের মানুষকে ভালবাসতে আদর করতে খুব ইচ্ছা করে। খুব ইচ্ছা করে আদর পেতে, ভালবাসা পেতে।
শান্ত দু’হাত দিয়ে ওর মুখখানা ধরে বলে, প্লীজ আমাকে একটু আদর কর।
সত্যি আদর করব?
হ্যাঁ, প্লীজ।
মৌ দু’হাত দিয়ে ওর মুখখানা ধরে মনের সুখে চুমু খায়। তারপর জিজ্ঞেস করে, তোমার ভাল লেগেছে? খুশি হয়েছ?
শান্ত একটু হেসে বলে, হ্যাঁ ভাল লেগেছে কিন্তু আরেকবার চুমু খেলে খুব খুশি হব।
মৌ আবার ওকে খুব ভাল করে চুমু খায়।
কী খুশি হয়েছ তো?
হ্যাঁ, খুশি হয়েছি তবে মাঝে মাঝে চুমু না খেলে খুশি ভাব চলে যাবে।
মৌ আলতো করে ওকে একটা থাপ্পর মেরে হাসতে হাসতে বলে, আমার সঙ্গে মজা হচ্ছে, তাই না?
শান্ত হঠাৎ কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ওর উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে হাসতে হাসতে বলে, এবার তোমাকে আমি আদর করব।
মৌ কিছু বলার আগেই ও ওকে চুমু খেতে খেতেই ব্লাউজ খুলে বুকে হাত দিতে শুরু করে। না, শান্ত ওখানেই থামে না…
আঃ! কী করছ?
শান্ত তখন ওকে প্রাণভরে পাবার জন্য পাগল হয়ে উঠেছে; মৌ-ও তখন আত্মহারা হয়ে উঠেছে। পরিপূর্ণভাবে পাবার নেশায় দু’জনেই জ্বলে উঠেছে।
আগুন নিভতেই শান্ত ওর বুকের উপর লুটিয়ে পড়ে; মৌ চোখ বুজেই দু’হাত দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে। পনের-কুড়ি মিনিট দু’জনেই প্রায় বেহুঁস হয়ে ওইভাবে থাকে।
তারপর শান্ত বলে, মৌ!
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মৌ ওর দিকে তাকায়।
রাগ করেছ?
মৌ আলতো করে মাথা নেড়ে বলে, না।
খুশি হয়েছ? ভাল লেগেছে?
শান্তদা, আমিও রক্তমাংসের মানুষ; খিদে-তৃষ্ণার মতো আমারও কামনা-বাসনা আছে। প্রিয় মানুষের কাছে এই আদর ভালবাসা আর আনন্দ পাবার স্বপ্ন দেখে সব মেয়েরা।
তাহলে তোমার ভাল লেগেছে, কী বল?
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই ভাল লেগেছে কিন্তু আমরা ঠিক করলাম কী?
মৌ, আমরা ছোটবেলা থেকেই দুজনে দুজনকে ভালবাসি। তারপর আস্তে আস্তে যত বড় হয়েছি, দু’জনে দু’জনকে তত বেশি কাছে চেয়েছি। আজ আমরা দু’জনেই যথেষ্ট বড় হয়েছি বলেই তো…
শান্ত কথাটা শেষ করে না।
আমি কী তোমাকে সত্যি আনন্দ দিতে পেরেছি?
হ্যাঁ, মৌ, সত্যি তুমি আমাকে আনন্দ দিয়েছ।
যাক অন্তত একটা সান্ত্বনা পেলাম আমি তোমাকে আনন্দ দিতে পেরেছি।
আচ্ছা মৌ, আমি কী তোমাকে আনন্দ দিতে পেরেছি?
আমি কী করে অস্বীকার করব, তুমি আমাকে আনন্দ দাওনি?
মৌ আলতো করে ওকে চুমু খেয়ে বলে, সত্যি তুমি দারুণ আনন্দ দিয়েছ।
দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর দুজনে দু’জনের গলা জড়িয়ে শুয়ে থাকে। দু’জনের মুখেই হাসি; কারুর মুখেই কোন কথা নেই।
কী হল হাসছ কেন?
হাসছি এই কথা ভেবে যে ছেলের নাম শান্ত, সে কত অশান্ত হয়ে পাগলামী করতে পারে, তাই ভেবে হাসছি।
তুমি কী কম পাগলামী করেছ?
আমি আবার কখন পাগলামী করলাম?
না, না, তুমি পাগলামী করো নি; তুমি ধীরস্থির ধ্যানমগ্ন ছিলে।
মৌ হাসতে হাসতে বলে, আমি যদি পাগলামী করে থাকি, তার জন্য তুমি দায়ী।
হ্যাঁ, আমি সানন্দে স্বীকার করব আমি দায়ী।
শান্ত একটু পরেই বলে, তুমি ঘুমোবে না?
আজ জীবনে প্রথম তোমাকে এভাবে জড়িয়ে শুয়েছি; ঘুমিয়ে সময়টা নষ্ট করব কেন?
ওর কথা শুনে শান্ত না হেসে পারে না।
তোমার ঘুম পাচ্ছে?
শান্ত একটু হেসে বলে, তোমার মতো আগ্নেয়গিরির পাশে শুয়ে কোন পুরুষের ঘুম আসতে পারে?
অসভ্য কোথাকার! আমি আগ্নেয়গিরি?
তোমার মধ্যে যে আগুন দেখেছি সে আর কী বলব?
আঃ! তুমি চুপ করো।
শান্ত হাতের ঘড়ি দেখে বলে, সাড়ে চারটে বাজে, চা-কফি খাবে?
আড়াইটের সময় খেয়ে উঠেছি। এখন আর চা-কফি খাব না।
একটু কেনাকাটা করতে হবে; এখন বেরুবে?
হ্যাঁ, বেরুতে পারি।
তাহলে উঠে পড়ো।
হ্যাঁ, উঠছি।
.
গড়িয়াহাটের দোকানে ঢুকেই শান্ত বলে, আমার স্ত্রীর জন্য বেশ ভাল দুতিনটে সিল্কের শাড়ি দেখান তো।
মৌ ওর দিকে তাকাতেই শান্ত দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেয়।
সেলসম্যান বেশ কিছু ভাল ভাল শাড়ি শো-কেসের উপর ছড়িয়ে দিয়ে বলেন, স্যার, দেখুন তো পছন্দ হয় কিনা।
শান্ত দু’চারটে শাড়ি দেখেই বলে, বা! বেশ ভাল তো। ও এবার পাশ ফিরে বলে, মৌ, দেখ তো কোনটা কোনটা তোমার পছন্দ।
সব শাড়িগুলোই আমার পছন্দ; সবগুলোই কিনে দাও।
ওর কথায় শুধু শান্ত না, সেলসম্যানও হেসে ওঠেন।
এবার মৌ বলে, আমার তো শাড়ির দরকার নেই; যাইহোক আমি একটা শাড়ি নিচ্ছি।
কোনটা তোমার পছন্দ!
এইটা।
গুড।
সেলসম্যান শাড়িটি আলাদা করে রাখতেই শান্ত বলে, মৌ প্লীজ আর একটা শাড়ি নাও।
দোকানে যেসব শাড়ি ঝোলানো ছিল, তার মধ্যে একটা শাড়ি দেখিয়ে মৌ বলে, এরকম শাড়ি দেখান তো।
সেলসম্যান ওইরকম শাড়ির বাণ্ডিল বের করেন, মৌ ওই বাণ্ডিলের একটা শাড়ি পছন্দ করে।
শান্ত বলে, সত্যি ভারী সুন্দর শাড়ি।
এবার শান্ত বলে, আমার মায়ের জন্য একটা ভাল সিল্কের শাড়ি চাই; সাদা খোলের ভাল বর্ডার দেওয়া শাড়ি।
হ্যাঁ, বুঝেছি।
মায়ের জন্য সিল্কের শাড়ি পছন্দ করার পর শান্ত বলে, এবার মায়ের জন্য একজোড়া ভাল তাঁতের শাড়ি চাই।
হ্যাঁ, মায়ের জন্য তাঁতের শাড়ি পছন্দ করার পর শান্ত বলে, এবার এক জোড়া ভাল ধুতি চাই।
হ্যাঁ, তাও হল।
স্যার, আর কিছু চাই?
না।
শান্ত সঙ্গে সঙ্গে পার্স থেকে একটা ডেবিট কার্ড বের করে সেলসম্যানের হাতে দেয়।
যাইহোক সই-টই করে ডেবিট কার্ড ফেরত নেবার পর শান্ত কাপড়ের প্যাকেটগুলো হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসে।
মৌ ওর দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলে, এবার কি কিনতে হবে?
তুমি যা বলবে।
এত কাপড়-চোপড় কেনার দরকার ছিল?
এতদিন পর কলকাতা এলাম, ভাল মা-ভাল কাকাকে কি কিছু দিতে ইচ্ছে করে না আমার? ওরা কি আমার কেউ না?
কথাটা বলতে বলতে শান্তর গলা ধরে আসে; দুটো চোখ ছলছল করে।
মৌ ওর একটা হাত চেপে ধরে বলে, সরি শান্তদা, কথাটা বলা আমার ঠিক হয়নি।
মৌ, আমি দেবতা না; নিছক রক্ত-মাংসের মানুষ। তবে অমানুষ না। আমি আমার মা-বাবাকে হারিয়েছি, এখন এই পৃথিবীতে তোমরা তিনজন ছাড়া আমার আর কোন আপনজন নেই।
হ্যাঁ, তা আমি জানি।
এই যে ভাল কাকা টানাটানির কথা বললেন; কথাটা শুনে আমার খুব কষ্ট হয়েছে। বারবার মনে হচ্ছে, আমি এত টাকা মাইনে পাই কিন্তু কেন এতকাল ভাল মা-ভাল কাকাকে প্রত্যেক মাসে দু পাঁচ হাজার টাকা। পাঠাইনি? ওরা তো আমাকে সন্তান জ্ঞানেই চিরকাল স্নেহ করেছেন।
তুমি সত্যি বড় ভাল। তোমার কথাগুলো শুনে আমার যে কি গর্ব হচ্ছে তা ভাবতে পারবে না।
আমাকে নিয়ে গর্ব করতে হবে না; তুই শুধু দেখবি আমি মনুষ্যত্ব বিসর্জন দিয়ে অমানুষ না হই।
তোমার বিবেক আছে। তাইতো তুমি কোনদিনই অমানুষ হতে পারবে না।
.
হোটেলে ফিরে আসার পর কফি খেতে খেতে ওরা কথা বলে।
শান্ত একটু হেসে বলে, তুই ভাবতে পারবি না, মাঝে মাঝে কিছু মানুষ আমাকে কি ডেঞ্জারাস প্রলোভনের ফাঁদে ফেলতে চায়।
ওরা প্রলোভন দেখায় কেন।
ব্যবসার স্বার্থে, অনেক টাকা লাভ করার লোভে।
তোমার সঙ্গে ব্যবসার কী সম্পর্ক?
কফির কাপে লম্বা চুমুক দিয়ে শান্ত বলে, আসল কথা হচ্ছে আমাদের জনসন অ্যান্ড হ্যারিসন কোম্পানীর তৈরি কোন না কোন জিনিষ ভারতবর্ষের অন্তত আশি ভাগ মানুষ ব্যবহার করে।
হ্যাঁ, তা বলতে পারো।
সারা বছরে আমরা আশি হাজার কোটি টাকার জিনিষ বিক্রি করি; এই মাল বিক্রি করার দায়িত্ব আমাদের চারজনের। আমার দায়িত্ব আঠারো হাজার কোটি টাকার মাল বিক্রি করার।
মৌ একটু হেসে বলে, বাবা! শুনেই তো আমার মাথা ঘুরে যাচ্ছে।
না, না, মাথা ঘুরে যাবার মতো ব্যাপার না। আমাদের কোম্পানীর এত ভাল সুনাম যে আমাদের তৈরি কোন কিছু সম্পর্কেই মানুষের কোন অভিযোগ নেই।
তা ঠিক।
এখন আসল সমস্যার কথা বলি। ধরো উত্তরবঙ্গ আর সিকিমে চার হাজার কোটি টাকার জিনিষ বিক্রির টার্গেট। বেশ কিছু ব্যবসাদার চার হাজার কোটি টাকার র্জিনিষ বিক্রির এজেন্সী নিতে চায়।
একজন ব্যবসাদারই সব জিনিষ বিক্রির এজেন্সী চায়?
হ্যাঁ।
কিন্তু কেন?
যাতে চার শ’ কোটি টাকা লাভ করতে পারে।
মাই গড!
শান্ত একগাল হেসে বলে, ওহে সুন্দরী, এই এজেন্সী পাবার জন্য ব্যবসাদাররা আমাকে কত রকমের প্রলোভন দেখায়, তা তুই ভাবতে পারবি না।
মৌ-ও একটু হেসে বলে, শুনি, কী ধরনের প্রলোভন দেখায়।
কোন ব্যবসাদার দু’এককোটি টাকা ব্রিফকেসে ভর্তি করে পাঠায়, কেউ দিতে চায় দিল্লী, বোম্বে বা ব্যাঙ্গালোরে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট। বিদেশে বেড়াবার সব খরচ, ছেলে-মেয়ের বিয়ের খরচ বা বিদেশে পড়াশুনা করার সব খরচ ও আরো কত কি।
আর কী দেবে?
হ্যাঁ, আরো দেবার আছে। শুনবি, আরো কী দিতে চায়?
হ্যাঁ, শুনতে চাই।
শান্ত হাসতে হাসতে বলে, এমন অনেক ব্যবসাদার আছে যারা তাদের সুন্দরী যুবতী স্ত্রী বা মেয়েকেও পাঠায় আমার সঙ্গে কয়েকদিন ঘুরে আসার জন্য।
এ রাম! কী বলছ তুমি?
হ্যাঁ, মৌ, সত্যি কথাই বলছি।
বউ বা মেয়েকে পাঠালে তুমি কী করো?
কখনো তাদের বকুনি দিয়ে ফেরত পাঠাই, আবার কখনো বলি তোমাদের চাইতে আমার স্ত্রী অনেক সুন্দরী, অনেক ভাল, সে আমাকে যে আনন্দ দেয়, তা তোমরা কল্পনা করতে পারবে না।
সত্যি তাই বল?
হ্যাঁ, মৌ, সত্যি তাই বলি।
শান্ত মুহূর্তের জন্য থেমে বলে, যেসব ব্যবসাদাররা মেয়ে-বউ পাঠায় তাদের আমি সোজা জানিয়ে দিই, আমি তোমাদের দু’এক কোটি টাকার ব্যবসা করারও সুযোগ দেব না।
ওই কথা শুনে ওরা চলে যায়? সবাই হাত-পা ধরে ক্ষমা চায়; তাছাড়া অনেকেই কান্নাকাটি করে। তারপর ওদের ব্যবসা দাও? ওই বছর কখনই দিই না; কাউকে কাউকে দু’এক বছর পরে দিই।
মৌ ওকে দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বুকের উপর মাথা রেখে বলে, শান্তদা, তুমি কোনদিন ব্যবসাদারদের প্রলোভনের ফঁদে পা দিও না। আমি কিন্তু চিন্তায় থাকলাম।
আমি কথা দিচ্ছি, আমি যদি একদিনের জন্যও কোন মেয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ি, তাহলে আমি আর তোকে স্পর্শ করব না।
তুমি তো জানো, মেয়েরা সব দুঃখকষ্ট সহ্য করতে পারে কিন্তু মনের মানুষের উপর অন্য কোন মেয়ের অধিকার কিছুতেই সহ্য করতে পারে না।
শান্ত আলতো করে ওকে চুম্বন দিয়ে বলে, আমি চিরকাল শুধু তোরই থাকব; আমি কোনদিনই অন্য কাউকে মুহূর্তের জন্যও ভালবাসতে পারব না। আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হবে না। এবার অন্য কথা বলি।
অন্য কী কথা?
আমরা এখানে না খেয়ে এখান থেকে চারজনের খাবার নিয়ে গিয়ে সবাই মিলে একসঙ্গে খাওয়া যাবে।
মৌ একগাল হেসে বলে, হ্যাঁ, হ্যাঁ সেই ভাল।
.
বিমলবাবু দরজা খুলে দিতেই শান্ত চিৎকার করে, ভাল মা, কোথায় গেলে? শিগগির এদিকে এসো।
অনুপমা দেবী ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলেন, অমন চিৎকার করছিস কেন? ভাল মা কী হারিয়ে গেছে?
তা হারিয়ে যেতে পারো।
আমি কোন দুঃখে হারিয়ে যাব?
হয়তো একটা সত্যিকারের ভাল ছেলে পাবার জন্য এখান থেকে চলে গেলে।
আমার যে ছেলে আছে, সেই যথেষ্ট।
ভাল মা, আগে এগুলো ধরো।
কী আছে এতে?
আমাদের চারজনের খাবার।
তুই আবার আমাদেরও খাবার এনেছিস?
ইয়েস মাম্মী।
আবার মাম্মী বলেছিস? মাম্মী বললেই থাপ্পড় খেতে হয়, তা কী ভুলে গেছিস?
মৌ হাতের প্যাকেটগুলো নিয়ে মা-বাবার ঘরে গিয়েই গলা চড়িয়ে বলে, মা, খাবারের প্যাকেটগুলো ডাইনিং টেবিলে রেখে তাড়াতাড়ি এদিকে এসো।
হ্যাঁ, মা আসছি।
.
সবাই ওই ঘরে আসতেই মৌ পরপর দুটো প্যাকেট খুলে একটু হেসে বলে, মা, শান্তবাবু এই দুটো আমাকে দিয়েছেন।
বিমলবাবু আর অনুপমা দেবী হাসতে হাসতে বলেন, দুটোই তো-দারুণ ভাল শাড়ি।
দুটোই দারুণ ভাল শাড়ি, দুটোই দারুণ দামী শাড়ি কিন্তু শান্তবাবুকে বারবার বারণ করা সত্ত্বেও তিনি আমার কথা শুনিলেন না।
শান্ত সঙ্গে সঙ্গে বলে, আমি যা ইচ্ছে তাই তোকে দেব; তাই তোকে নিতে হবে। ব্যবহারও করতে হবে।
এবার মৌ আরেকটা প্যাকেট খুলে দুটো ধুতি বের করে বলে, বাবা, তোমার ধুতি।
ধুতি দুটো হাতে নিয়ে বিমলবাবু খুশির হাসি হেসে বলেন, বাঃ! খুব সুন্দর।
মৌ এবার অন্য প্যাকেট থেকে একটা শাড়ি বের করে বলে, ভাল ছেলে তার ভাল মা-কে এই দুটো শাড়ি দিয়েছে।
শাড়ির উপর হাত রেখেই অনুপমা দেবী একটু হেসে বলেন, বুঝলি মৌ, এবার এই শাড়ি পরে বুক ফুলিয়ে সবাইকে বলতে পারব, আমার ভাল ছেলে এই সব শাড়ি দিয়েছে।
শান্ত অনুপমা দেবীকে জড়িয়ে ধরে বলে, মাতৃদেবী, বড্ড খিদে লেগেছে; প্লিজ এবার খেতে দাও।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, চল।
খাওয়া শুরু করেই বিমলবাবু বলেন, শান্ত, রিয়েলী ভেরি গুড ফুড; তোের পছন্দ আছে।
অনুপমা দেবী স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলেন, ভুলে যেও না, তাজ বেঙ্গলের খাবার। ওখানকার খাবার কখনো খারাপ হতে পারে?
খাওয়া-দাওয়ার পর হোটেলে ফিরে যাবার আগে শান্ত বলে, ওহে মৌ দেবী, কাল কী আমার সঙ্গে একটু ঘুরাঘুরি করতে পারবেন? আপনি থাকলে আমার একটু উপকারই হবে।
আপনার উপকার করিতে আমি সর্বদাই প্রস্তুত।
ভাল কাকা-ভাল মাকে প্রণাম করে শান্ত গাড়িতে ওঠে।
৫-৬. বিমলবাবুদের আদি নিবাস
বিমলবাবুদের আদি নিবাস জলপাইগুড়ি। ওর ঠাকুর্দা অভয়চরণ অর্থাভাবে স্কুলের সপ্তম শ্রেণিতেই পড়াশুনা ছাড়তে বাধ্য হন ও তরাই অঞ্চলে বাবার সামান্য চা-বিস্কুটের দোকানে কাজ করতে শুরু করেন। অভয়চরণ যখন মাত্র ষোল বছরের তখন ওর পিতৃবিয়োগ হয় ও বিধবা মা আর দুটি ছোট বোনের দায়িত্ব তাকে নিতে হয়। উনি পরিশ্রম করতে কখনই কুণ্ঠাবোধ করতেন না; তাইতো উনি ঠিক করলেন, ভোর থেকে একটু রাত পর্যন্ত দোকান খোলা রাখবেন।
ওদের বাড়ি থেকে বড় রাস্তার ধারের ওই দোকান ছিল প্রায় বারো মাইল দূরে। বাড়ি থেকে যাতায়াত করলে কোনমতেই সাড়ে ন’টা-দশটার আগে দোকান খোলা সম্ভব হত না; দোকান বন্ধ করতে হত সন্ধে হতে না হতেই। অভয়চরণ জানতেন, ওদের চায়ের দোকানের সামনের রাস্তা দিয়েই শুধু কোচবিহার বা তরাইয়ের বিভিন্ন অঞ্চলে না, ভূটানেও যাতায়াত করতে হয় লোকজন ও গাড়িকে। ওই অঞ্চলের বিভিন্ন চা বাগানে যারা কাজকর্ম বা ব্যবসা করেন, তারাও ভোরবেলায় ওই রাস্তা দিয়ে যান ও বিকেল-সন্ধের দিকে ফেরেন। অভয়চরণ ঠিক করলেন ভোর হতে না হতেই ওকে দোকান খুলতে হবে ও খোলা রাখতে হবে সন্ধে ঘুরে যাবার পরও দু’তিন ঘণ্টা।
মা, কাল থেকে আমি দোকানেই থাকব।
দোকানে থাকবি কেন?
ভোরে দোকান খুললে অনেক খদ্দের পাব; দোকান বন্ধও করব একটু রাত করে।
ঘুমুবি কোথায়?
দোকানেই ঘুমোব।
খাওয়া-দাওয়ার কী হবে?
দোকানের কাছেই একটা বাড়ি আছে, ওই বাড়ির ছেলের সঙ্গে আমার খুব ভাব। ওর মা-ও আমাকে খুব ভালবাসেন। ওরাই আমাকে খেতে দেবেন।
কিন্তু…
অভয়চরণ ওর মা-র দুটি হাত ধরে বলে, তুমি কিছু চিন্তা করো না, সত্যি আমি ভাল থাকব।
অভয়চরণের মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, কী আর বলব! আমাদের পেট চালাবার জন্য তোকে কি কষ্টই করতে হবে।
মা, তুমি বিশ্বাস করো আমার কোন কষ্ট হবে না।
.
অভয়চরণ নিরুপায়। তাইতো ওকে মিথ্যে কথা বলেই দোকানে থাকার অনুমতি নিতে হয়।
অভয়চরণ শুরু করে নতুন সংগ্রাম।
সূর্য ওঠার অনেক আগেই অভয়চরণ ঘুম থেকে উঠেই আবছা অন্ধকারে গাছপালার আড়ালে যায় প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে। তারপর মুখ ধুয়েই উনুন ধরিয়ে চায়ের জল বসিয়ে দুধের পাত্র উনুনের পাশে রাখে।
কী আশ্চর্য! জল ফুটতে না ফুটতেই তিনজন খদ্দের এসে হাজির।
চা হবে?
হ্যাঁ, বাবু, হবে।
আমাদের তিনটে স্পেশাল চা দাও।
হ্যাঁ, বাবু, দিচ্ছি।
অভয়চরণ ওদের হাতে চায়ের গেলাস তুলে দিতেই একজন বলেন বিস্কুট দাও।
বাবু, তিনজনকেই দেব?
হ্যাঁ, তিনজনকেই দেবে।
বাঁশ দিয়ে তৈরি বেঞ্চিতে বসে বাবুরা চা-বিস্কুট খায়।
বাঃ! বেশ চা বানাতে পারিস তো তুই।
অভয়চরণ একগাল হেসে বলেন, আপনাদের ভাল লেগেছে?
হ্যাঁ, সত্যি ভাল লেগেছে। আমাদের আরো তিনটে চা দাও।
হ্যাঁ, বাবু, দিচ্ছি।
দ্বিতীয়বার ওদের চা খাওয়া শেষ হতেই একজন পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করেই বলেন, তোর কত হয়েছে?
বাবু, ছ’টা চা বারো আনা আর তিনটে বিস্কুট তিন আনা মোট পনের আনা।
ভদ্রলোক এক টাকার একটা নোট অভয়চরণকে দিয়ে বলেন, তোকে আর এক আনা ফেরত দিতে হবে না।
অভয়চরণ ডান হাত কপালে ছোঁয়ায়।
খুশিতে ভরে যায় ওর মন।
দু’এক মিনিট পরই একটা মোটর সাইকেল এসে থামে ওর দোকানের সামনে। মোটর সাইকেলে বসে বসেই একজন বলেন, চা হবে?
হ্যাঁ, বাবু, হবে।
চা কত করে?
এক আনা করে।
না, না, এক আনা না, দু’আনা করে চা দে আমাদের দু’জনকে।
এখনই দিচ্ছি।
অভয়চরণ ওদের হাতে বড় গেলাসের চা দিতেই একজন বাবু বলেন, দুটো করে বিস্কুট দে।
চা বিস্কুট খাওয়া শেষ হতেই এক বাবু অভয়চরণের দিকে তাকিয়ে বলেন, তুই তো বেড়ে চা করিস।
অভয়চরণ কৃতজ্ঞতার হাসি হাসে।
হ্যাঁরে, সিগ্রেট আছে?
হ্যাঁ, আছে।
কী সিগ্রেট আছে?
বাবু, পাশিংশো আর সিজার।
এক প্যাকেট সিজার দে।
অভয়চরণ বেশ লজ্জিত হয়ে বলে, বাবু পুরো প্যাকেট তো হবে না।
যা আছে তাই দে।
ভদ্রলোক পাশ ফিরে ওর সহযাত্রী বন্ধুকে বলেন, শালা গোবিন্দবাবুকে সিগ্রেট না খাওয়ালে তো ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রাখবে।
ও শালা, মহা খচ্চর আছে। বিল থেকে তো বিশ-পঁচিশ টাকা কেটে রাখার পরও ছোটলোকটাকে সিগ্রেট খাওয়াতে হবে।
অন্য বাবু বলেন, তোর কত হয়েছে?
চার আনার চা, চার আনার বিস্কুট আর তিন আনার…
এক টাকার একটা নোট এগিয়ে ধরে উনি বলেন, এই নে ধর।
অভয়চরণ পাঁচ আনা ফেরত দেবার জন্য এগিয়ে ধরতেই বাবু বলেন, একটা ম্যাচ বক্স দে।
হ্যাঁ, অভয়চরণ দেশলাই আর বাকি পয়সা ভদ্রলোকের সামনে ধরতেই উনি দেশলাইটা তুলে নিয়ে বলেন, ওটা রেখে দে।
ওরা তখনও মোটর সাইকেলে স্টার্ট দেন নি, হঠাৎ একটা গাড়ি এসে থামল। গাড়িতে বসে বসেই এক ভদ্রলোক অভয়চরণের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, চা হবে?
হ্যাঁ, বাবু, হবে।
কেক আছে?
আজ্ঞে কাঞ্চনজঙ্ঘা বেকারীর কেক আছে।
চারটে চা–চারটে কেক দাও।
বাবু, এক আনার চা দেব নাকি দু’আনার–
না, না, এক আনার চা দিও না।
অভয়চরণ চা বানাতে বানাতেই দেখে, বাবুরা গাড়িতে বসে বসেই খুব গম্ভীর হয়ে কথা বলছেন; ওদের চোখ মুখ দেখে ওর মনে হয়, বাবুরা খুব জরুরী কাজে যাচ্ছেন।
অভয়চরণ ওদের চা আর কেক দিয়ে একটু দূরে দাঁড়ায় গেলাসগুলো ফেরত নেবে বলে।
একটু পরেই আগের বাবুই গাড়ির ভিতর থেকে একটু মুখ বের করে বাঁ হাতে তুড়ি মেরে অভয়চরণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, আরো চারটে কেক দাও।
এক মিনিটের মধ্যেই অভয়চরণ ওদের কেক দেয়।
ওদের চা খাওয়া শেষ হতেই ওরা গেলাস ফেরত দেন।
কত হয়েছে?
বাবু, আটটা কেক একটাকা আর চারটে চা আট আনা।
ভদ্রলোক দু’টাকার একটা নোট ওর হাতে দিতেই গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলতে শুরু করে; অভয়চরণ গলা চড়িয়ে বলেন, বাবু, পয়সা…
গাড়ি ততক্ষণে অনেক দূরে চলে গেছে।
প্রায় ঘণ্টা দুয়েক এইভাবে খদ্দেরের পর খদ্দের আসায় অভয়চরণ নিজে একটু চা আর বিস্কুট খাবার ফুরসত পায়নি। এতক্ষণ খালি পেটে থাকায় পেটের মধ্যে অস্বস্তি বোধ করে। না, আর দেরি না করে এক গেলাস চা তৈরি করার পর একটা বিস্কুট নিতে গিয়েও নেয় না, ও আপনমনেই একটু হেসে একটা কেক তুলে নেয়।
খুব খুশি মনেই অভয়চরণ চা-কেক খেতে শুরু করে আর মনে মনে চিন্তা করে এইভাবে যদি খদ্দের আসে তাহলে তো দোকানের স্টক বাড়াতে হবে কিন্তু স্টক বাড়িয়ে রাখবে কোথায়? দোকান বড় করতে হলে তো অনেক টাকা চাই কিন্তু ও কোথায় টাকা পাবে? এইসব সাত-পাঁচ চিন্তা করতে করতেই অভয়চরণ ঠিক করে, দোকান ঘর বড় করতে না পারলেও কিছু স্টক বাড়াতেই হবে।
পাঁচ-সাত মিনিট পরই হরেন সাপ্লায়ারের মোপেড এসে থামে। মোপেডের ইঞ্জিন বন্ধ করেই উনি অভয়চরণের দিকে তাকিয়ে বলেন, তুই এরই মধ্যে দোকান খুলেছিস?
অভয়চরণ এক গাল হেসে বলে, কাকা, আজ ছ’টার আগেই দোকান খুলেছি।
কী বলছিস তুই?
কাল রাত্রে আমি দোকানেই ঘুমিয়েছি।
এইটুকু দোকানের মধ্যে ঘুমোলি কী করে?
গুটিসুটি মেরে শুয়েছিলাম।
অভয়চরণ গম্ভীর হয়ে বলে, কাকা দশটা-এগারোটায় দোকান খুলে আর সন্ধে লাগতে না লাগতেই দোকান বন্ধ করে বিশেষ কিছুই হচ্ছিল না। তাইতো ঠিক করেছি, এই দোকানেই থাকব আর সপ্তাহে একদিন দুপুরের দিকে বাড়ি গিয়ে মাকে সংসার খরচের টাকা পৌঁছে দেব।
তুই ঠিকই সিদ্ধান্ত নিয়েছিস। তুই যদি ভোর থেকে রাত আটটা ন’টা পর্যন্ত দোকান খোলা রাখতে পারিস, তাহলে তোর আয় প্রচুর বেড়ে যাবে কিন্তু তোর খাওয়া-দাওয়ার কী হবে?
কাল তো মুড়ি আর বাতাসা খেয়েই কাটিয়ে দিয়েছি। তবে ঠিক করেছি মা-র কাছ থেকে দু’একটা বাসন এনে রোজ একটু সিদ্ধ ভাত খাবো।
যেভাবেই হোক ভাত খাবি, তা না হলে শরীর ভেঙে যাবে।
অভয়চরণ ওর হাতে চায়ের গেলাস তুলে দেয়।
হরেন এক চুমুক চা খেয়েই বলেন, আজ সকালে কেমন খদ্দের হল?
অভয়চরণ এক গাল হেসে বলে, খুব ভাল, প্রায় সব স্টকই শেষ।
তাহলে তো ভালই বলতে হবে।
উনি সঙ্গে সঙ্গেই বলেন, বল কী কী দেব।
কাকা, সবই বেশি বেশি করে চাই। তাছাড়া দু’এক রকম একটু ভাল বিস্কুটও রাখব।
যত বেশি রকমের জিনিষ রাখবি তত বেশি বিক্রি হবে। আমি থাকতে তোকে মালপত্তরের চিন্তা করতে হবে না।
কিন্তু কাকা, ইচ্ছা থাকলেও তো বেশি জিনিষ এইটুকু দোকানে রাখতে পারব না।
যদি ভাল বিক্রি হয়, তাহলে দোকানটা বড় করতে হবে।
সে তো অনেক টাকার ব্যাপার।
হরেন একটু হেসে বলেন, ব্যবসা বাড়াবার জন্য টাকার অভাব হয় না।
হরেন সাপ্লায়ার আর কথা না বাড়িয়ে ওকে সবরকমের মালপত্র অনেক বেশি দিয়ে মোপেডে স্টার্ট দেন।
যাইহোক অভয়চরণ স্বপ্নেও ভাবেনি, সারাদিন দোকান খোলা রাখলে এত বিক্রি হতে পারে। পরের দিন ও হরেন সাপ্লায়ারকে বলে, জানেন কাকা, কাল ভোর ছ’টা থেকে রাত নটা পর্যন্ত দোকান খোলা রেখে যা বিক্রি হয়েছে, তা আগে এক সপ্তাহেও হত না।
হরেন সাপ্লায়ার একটু হেসে বলেন, ওরে অভয়, ভুলে যাস না এইটাই ভূটান আর আসাম ছাড়া ওই দিকের সর্বত্র যাবার মেন রাস্তা। তাছাড়া এই রাস্তা দিয়েই চা বাগানগুলোয় যেতে হয়। এই রাস্তার উপর যাদেরই দোকানে ভাল স্টক থাকবে তাদেরই বিক্রি ভাল হতে বাধ্য।
উনি মালপত্র দিয়ে চলে যাবার আগে বলেন, আমি এক সপ্তাহের মধ্যে তোর দোকান বড় করে দিচ্ছি।
.
সত্যি জগদীশ মিস্ত্রি যে এক সপ্তাহের মধ্যে দোকানটাকে এত সুন্দর আর বড় করে দেবে, তা অভয়চরণ ভাবতে পারেনি।
তারপর হরেন সাপ্লায়ার ওকে বলেন, কীরে অভয়, দোকানঘর তোর পছন্দ হয়েছে?
কাকা, সত্যি বলছি এত ভাল হবে তা ভাবিনি।
অভয়চরণ না থেমেই বলে, উপরের খোপে আমি আমার বিছানাপত্র রাখব। দোকানের তাকগুলোতে সব জিনিষ সাজিয়ে রাখক আর নীচে রাখব এক্সট্রা স্টক আর এক পাশে রাখব রান্না-খাওয়ার বাসনপত্র।
এবার তো ভাল করে শুতে পারবি?
হ্যাঁ, কাকা, খুব ভালভাবে শুতে পারব।
অভয়চরণ সঙ্গে সঙ্গে বলে, কাকা কত খরচ হল?
জগদীশ পুরো হিসেব দেয়নি। তবে বোধহয় সাড়ে তিন-চারের বেশি হবে না।
কাকা, আমাকে কীভাবে শোধ করতে হবে?
তুই প্রত্যেক সপ্তাহে আমাকে চল্লিশ-পঞ্চাশ টাকা দিতে পারবি না?
অভয়চরণ একটু হেসে বলে, হ্যাঁ কাকা, তা পারব।
হরেন সাপ্লায়ার মালপত্র দিয়ে চলে যাবার আগে বলেন, আমি জগদীশকে বলেছি চারজন করে বসতে পারে এমন দুটো বেঞ্চি তোকে দিয়ে যেতে।
অভয়চরণ একগাল হেসে বলে, তাহলে তো খুব ভাল হয়।
.
তারপর?
তারপর আর কি? অভয়চরণের অদৃষ্টের চাকা বন বন করে ঘুরতে শুরু করল। কোনদিনই তিনশ সাড়ে তিনশ’র কম বিক্রি হয় না। সপ্তাহে দু’একদিন সাড়ে চারশ-পাঁচশ টাকার বিক্রি হয়।
দোকানে খদ্দের না থাকলেই অভয়চরণ কোন না কোন বই পড়ে। ও যখনই বাড়ি যায়, তখনই বাল্যবন্ধু শশাঙ্কর কাছ থেকে দু’একটা বই নিয়ে আসে। খদ্দের এলেই অভয়চরণ হাতের বই রেখে ওদের হুকুম মতো কাজ করে। কদাচিৎ কখনও কোন কোন খদ্দের ওকে জিজ্ঞেস করেন, দেখি কী পড়ছ।
অভয়চরণ তাকে হাতের বই তুলে দিতেই ভদ্রলোক একবার বইয়ের পাতা উল্টেই বলেন, তুমি ঐতিহাসিক রমেশ মজুমদারের লেখা ‘ভারতের ইতিহাস’ পড়ছ?
হ্যাঁ।
বইটা পড়তে ভাল লাগছে?
হ্যাঁ, খুব ভাল লাগছে।
ভাল।
এইভাবেই কেটে যায় মাসের পর মাস, ঘুরে যায় বছর। এই এক বছরের মধ্যেই অভয়চরণ সংসারের চেহারা বদলে দেয়। দু’বোনকে আবার স্কুলে ভর্তি করে দেয়। মা-বোনেদের মুখে হাসি দেখে অভয়চরণ মনে মনে বড় শান্তি পায়।
ওদিকে কিছু কিছু খদ্দেরের সঙ্গেও অভয়চরণের বেশ মধুর সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
ছাতি বন্ধ করে দিনহাটা স্কুলের মাস্টারমশাই শশধরবাবুকে বেঞ্চিতে বসতে দেখেই অভয়চরণ ওকে প্রণাম করে বলে, স্যার, ভাল আছেন?
হ্যাঁ, ভাল আছি। তুমি ভাল আছ?
আপনাদের পাঁচজনের আশীর্বাদে ভালই আছি।
তোমার মা-বোনেরা ভাল…
হ্যাঁ, স্যার, ওরাও ভাল আছে।
বেশ।
স্যার, চা খাবেন তো?
হ্যাঁ, দাও। যতক্ষণ বাস না আসে। ততক্ষণ তো বসতেই হবে।
অভয়চরণ ওর হাতে চায়ের গেলাস তুলে দিয়েই বলে, স্যার আপনার মেয়ে-জামাই ভাল আছেন?
হ্যাঁ, ওরা ভালই আছে।
শশধরবাবু চায়ের গেলাসে এক চুমুক দিয়েই একটু হেসে বলেন, তবে আমার তিন বছরের নাতি কি ওস্তাদ হয়েছে, তা তুমি ভাবতে পারবে না।
দাদুকে কাছে পেলে ও তো একটু বাঁদরামী করবেই।
কাল ওই বাঁদরটা বলছে, দাদু, তুমি বাবার মতো মোটর সাইকেল চালাতে পারো?
আপনি কী বললেন?
আমি বললাম, না। আমার খুব ভয় করে।
শশধরবাবু সঙ্গে সঙ্গে হাসতে হাসতে বলেন, ওই বাদরটা আমাকে বলে, তুমি এক নম্বরের ভীতু।
অভয়চরণ একটু জোরেই হেসে ওঠে।
.
তিস্তা তোর্ষার জল আরো গড়িয়ে যায়।
গাড়িটা দোকানের সামনে থামতেই অভয়চরণ দৌড়ে গিয়ে দরজা খোলে। মিঃ সেনগুপ্ত গাড়ি থেকে নামতেই অভয়চরণ ওকে প্রণাম করে।
মিঃ সেনগুপ্ত হাসতে হাসতে বলেন, দেখা হলেই কী প্রণাম করতে হবে?
আপনি গুরুজন। আবার আমার শুভাকাঙ্ক্ষী। তাছাড়া আপনি আমাকে স্নেহ করেন। আপনাকে প্রণাম করলে আমারই ভাল হবে।
অভয়চরণ সঙ্গে সঙ্গে বলে, স্যার নতুন মা ভাল আছেন?
হ্যাঁ, নন্দিতা ভাল আছে?
স্যার, দিদির কী খবর?
তুমি তো জানো, ওকে আমি হস্টেলে রেখেছি। আমাদের চা বাগান থেকে শিলিগুড়িতে যাতায়াত করলে তো ও পড়াশুনারই সময় পাবে না।
তা ঠিক।
তবে পাপড়ি তো প্রত্যেক মাসেই দু’একদিনের জন্য আসে।
দিদি যখনই যাতায়াত করে তখনই আমার সঙ্গে কিছুক্ষণ গল্পগুজব না করে যায় না।
হ্যাঁ, ও তোমাকে খুবই পছন্দ করে।
অভয়চরণ মিঃ সেনগুপ্তর হাতে চায়ের গেলাস তুলে দিয়েই একটু হেসে বলে, স্যার, দিদির নাম পাপড়ি দিয়ে খুব ভাল করেছেন, দিদি সত্যি ফুলের মতো পবিত্র।
ওর কথা শুনে মিঃ সেনগুপ্ত না হেসে পারেন না।
অভয়চরণ ড্রাইভার হৃদয়কে চা দিয়ে বলে, দাদা, চা খাও।
তোমার এখানে চা না খেয়ে স্যারও যেতে পারেন না, আমিও যেতে পারি না।
সে তো আমার সৌভাগ্য।
চা খাওয়া শেষ করেই মিঃ সেনগুপ্ত ড্রাইভারকে বলেন, হৃদয় বইয়ের প্যাকেটটা অভয়কে দিয়েছ?
স্যার, চা খেয়ে দিচ্ছি।
চা খেয়ে হৃদয় বইয়ের প্যাকেটটা অভয়চরণের হাতে দিতেই মিঃ সেনগুপ্ত বলেন, এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথের ‘গল্পগুচ্ছ’ আছে, তোমার নিশ্চয়ই ভাল লাগবে।
উনি না থেমেই বলেন, অভয় মনে রেখো রবীন্দ্রনাথ পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ গল্প লেখক।
অভয়চরণ ওকে প্রণাম করতেই মিঃ সেনগুপ্ত গাড়িতে উঠতে উঠতে বলেন, আজ আসি।
অভয়চরণ শুধু মাথা নাড়ে আর অবাক হয়ে ভাবে ওর কথা।
.
এই অঞ্চলের সমস্ত চা বাগানের মধ্যে সব চাইতে বড় ও বিখ্যাত হচ্ছে মডার্ন টি এস্টেট। অভয়চরণ আগে এর নামও শোনে নি; হরেন কাকার কাছে শুধু শুনেছিল, এই রাস্তা দিয়েই যারা মোপেড, স্কুটার, মোটর সাইকেলে যাতায়াত করে তারা প্রায় সবাই হয় কোন না কোন চা বাগানে কাজ করে অথবা ব্যবসা করে।
হরেন কাকা একটু হেসে বলেন, এদের সবার পকেটেই টু-পাইস থাকে। এদের একটু খাতির করলে আখেরে তোরই ভাল হবে।
কাকা, আমি তো সব খদ্দেরকেই যথেষ্ট সম্মান করি।
ভালই করিস।
.
তারপর আস্তে আস্তে অভয়চরণের সঙ্গে খদ্দেরদের আলাপ পরিচয় হতে শুরু হয়।
বাবু, আপনি কী এই দিকের কোন চা বাগানে কাজ করেন?
কেন বল তো?
আপনি তো সপ্তাহের ছ’দিনই আমার এখানে চা খেয়ে ওই দিকে যান তাই…
বীরেনবাবু একটু হেসে বলেন, থার্ড ক্লাস মাড়োয়ারির ফোর্থ ক্লাস বাগানে গোলামী করি। হালারা আমাদের রক্ত চুষে খাচ্ছে।
সব বাগানের মালিকরাই কী ওইরকম?
না, না।
বীরেনবাবু না থেমেই বলেন, সব দিক দিয়েই এই অঞ্চলের বেস্ট বাগান হচ্ছে মডার্ন।
সব দিক দিয়েই বেস্ট মানে?
এই অঞ্চলের সব বাগানের চাইতে ওদের চা সব চাইতে ভাল। ওখানকার প্রত্যেক কর্মচারী ন্যায্য মাইনে পায়, বোনাস পায়। তাছাড়া ওই বাগানের ম্যানেজার সাহেবকে তো সব কর্মচারীরা দেবতার মতো ভক্তি করে।
আচ্ছা!
হ্যাঁ, অভয়, উনি অসম্ভব ভাল মানুষ। উনি প্রতিদিন লেবার কোয়ার্টার্স থেকে শুরু করে হাসপাতালেও আসেন স্টাফ বা লেবারদের সুবিধে-অসুবিধের খোঁজখবর নিতে।
অন্য বাগানের ম্যানেজাররা তা করেন না?
ঘোড়ার ডিম করেন।
বীরেনবাবু একটু তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলেন, অন্য বাগানের ম্যানেজারদের প্রধান কাজ হচ্ছে ঘুষ খাওয়া, চুরি করা আর ফুর্তি করা।
.
অভয়চরণের কাছে চা খাবার জন্য অন্যান্য খদ্দেরদের মধ্যে ছ’জন মধ্যবয়সী ভদ্রলোক আসেন তিনটে মোটর সাইকেল চড়ে। ওদের দেখে মনে হয় ওরা ভাল চাকরি করেন। আস্তে আস্তে ওদের সঙ্গেও বেশ ভালই আলাপ-পরিচয় হয় অভয়চরণের; তাইতো জানতে পারে, ওরা ছ’জনই মডার্ন টি এস্টেটে কাজ করেন।
শুনছিলাম, এই অঞ্চলের মধ্যে আপনাদের বাগানের চা সব চাইতে ভাল। কথাটা কি ঠিক?
ছ’জনের মধ্যে যিনি বয়সে বড় তিনি বেশ জোর করে বলেন, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
উনি না থেমেই বলেন, অন্য বাগানে একই গাছ থেকে পনের বিশ বছর পাতা নেওয়া হয় কিন্তু আমাদের বাগানে ক’বছর অন্তরই পুরনো গাছের জায়গায় নতুন গাছ লাগানো হয়। তাইতো আমাদের বাগানের চা এত ভাল।
ওদের যিনি বয়সে অপেক্ষাকৃত তরুণ তিনি হাসতে হাসতে বলেন, ‘মডার্ন’ হচ্ছে আমাদের যৌবনের উপবন, বার্ধক্যের বারাণসী।
অন্যরা প্রায় একসঙ্গে বলেন, ঠিক বলেছিস।
.
ছ’-আট মাস পরের কথা।
অভয়চরণের দোকানে হঠাৎ একটা বড় মোটর গাড়ি এসে থামতেই ড্রাইভার তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে এসে বলে, তোমার নাম কী অভয়চরণ?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
ড্রাইভার সঙ্গে সঙ্গে ফিরে গিয়ে পিছনে বসা সাহেবকে কি যেন বলে। তারপরই একজন অত্যন্ত সুদর্শন ভদ্রলোক গাড়ি থেকে নেমে এসে একটু হেসে বলেন, আমি মডার্ন টি এস্টেটের ম্যানেজার অপূর্ব সেনগুপ্ত।
অভয়চরণ সঙ্গে সঙ্গে ওকে প্রণাম করেই বলে, স্যার আমার কি সৌভাগ্য।
আমাদের বাগানের অনেকেই তো তোমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তাদের কাছেই শুনলাম, তুমি নিয়মিত ভাল ভাল বই পড়ো।
স্যার, ভাল ভাল বই পড়তে আমার খুব ভাল লাগে; তাই যখন খদ্দের থাকে না, তখন বই পড়ি।
এখন কোন বই পড়ছ?
স্যার, শিবনাথ শাস্ত্রীর আত্মজীবনী পড়ছি।
খুব ভাল।
স্যার, দয়া করে একটু চা খাবেন?
দয়া করে বলছ কেন? এবার থেকে যাতায়াতের পথে সবসময় তোমার এখানে চা খাব।
অভয়চরণ একগাল হেসে বলে, স্যার, গাড়িতে বসুন আমি এখুনি চা দিচ্ছি।
গাড়িতে বসব কেন? তোমার বেঞ্চিতেই বসছি।
মিঃ সেনগুপ্ত বেঞ্চিতে বসেই বলেন, আমার ড্রাইভার মাখনকে চা দিও।
হ্যাঁ, স্যার দেব।
চা খাওয়া শেষ হতেই মিঃ সেনগুপ্ত পার্স বের করে বলেন কত হয়েছে? স্যার, আট আনা।
উনি একটা পাঁচ টাকার নোট এগিয়ে ধরে বলেন, এটা নাও এরপর কয়েকবার চা খেয়ে আর দাম দেব না।
অভয়চরণ হাসে।
আবার সন্ধের পর মিঃ সেনগুপ্তর গাড়ি এসে থামে ওই দোকানের সামনে।
মিঃ সেনগুপ্ত একটা মোটা বই এগিয়ে ধরে বলেন, এটা হচ্ছে চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা বিদ্যাসাগরের জীবনী।
অভয়চরণ বই হাতে নিয়ে বলে, স্যার, কি বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ জানাব তা ভেবে পাচ্ছি না।
ধন্যবাদ দিতে হবে না; বইটা পড়ো।
নিশ্চয়ই পড়ব।
এবার আমাদের চা খাওয়াও তো।
হ্যাঁ, স্যার, দিচ্ছি।
এইভাবেই শুরু হল ওদের সম্পর্ক।
কয়েক মাস পরের কথা।
.
সেদিন রবিবার। হঠাৎ একটা জিপ এসে থামল অভয়চরণের দোকানের সামনে। ও ভেবেছিল, বোধহয় কোন কন্ট্রাক্টারের জিপ। তারপর সেনগুপ্ত সাহেবকে জিপ থেকে নামতে দেখেই ও অবাক। সঙ্গে সঙ্গে জিপ থেকে নামেন মিসেস সেনগুপ্ত।
মিঃ সেনগুপ্ত একটু হেসে বলেন, নন্দিতা এই হচ্ছে অভয়।
অভয়চরণ প্রথমে ওকে, তারপর সেনগুপ্ত সাহেবকে প্রণাম করে।
নন্দিতা ওর মাথায় হাত দিয়ে বলেন, ভাল থাকো বাবা।
উনি সঙ্গে সঙ্গে একটু হেসে বলেন, তোমার এত প্রশংসা শুনতে হয় যে তোমাকে না দেখে থাকতে পারছিলাম না।
স্যার আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করেন।
সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
আগে বল, আমাদের ওখানে কবে আসবে?
আপনি আমার নতুন মা। আপনাদের কাছে যেতে খুব ইচ্ছা করে কিন্তু যেতে হলে তো দোকান বন্ধ রাখতে হবে।
মিঃ সেনগুপ্ত বলেন, অভয়, তোমার দোকানে কী রোজই সমান খদ্দের আসে? একই টাকার বিক্রি হয়?
না, স্যার, রবিবার খুব সকালে আর সন্ধের পর কিছু খদ্দের আসে। দিনে খুব কম খদ্দের আসে।
নন্দিতা সঙ্গে সঙ্গে বলেন, তাহলে চল আমাদের সঙ্গে, সন্ধের আগেই ফিরে আসবে।
গেটের বাইরে জিপ থামে। সেনগুপ্ত দম্পতির পর অভয়চরণ জিপ থেকে নেমে দেখে বিরাট বাংলোর সামনে সবুজ কার্পেটের মতো লন আর তার পাশে সুন্দর সুন্দর ফুলের গাছ। দূর থেকে বাংলো দেখেই ও অবাক হয়।
একটু পিছন ফিরে নন্দিতা বলে, এস অভয়।
সেনগুপ্ত সাহেব আগেই প্রায় লাফাতে লাফাতে বাংলোয় ঢুকেই গলা চড়িয়ে বলে, মাদার দেখো কে এসেছে।
দ্বিধা সংকোচে অভয়চরণ ধীর পদক্ষেপে বাংলোর বারান্দায় পা দিতেই পরমা সুন্দরী অষ্টাদশীকে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে বলে, নতুন মাকে দেখতে কি ভাল; দেখে মনে হয়, সব সময় হাসছেন কিন্তু তুমি তো অসাধারণ সুন্দরী।
পাঁপড়ি হাসতে হাসতে বলে, কী হল? দাঁড়িয়ে পড়লে কেন? এস ভিতরে এস।
হ্যাঁ, চল।
অভয়চরণ এগিয়ে আসতেই নন্দিতা বলেন, মুন্নী, তুই অভয়কে তোর ঘরে নিয়ে যা। তোরা গল্প কর। আমি একটু পরে আসছি।
পাঁপড়ি অভয়চরণকে নিয়ে ওর ঘরে ঢুকেই বলে, যেখানে খুশি বসতে পারো।
অভয়চরণ একবার চারদিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিয়ে সামনের একটা চেয়ারে বসে।
পাঁপড়ি একটা মোড়া নিয়ে ওর সামনে বসেই বলে, তুমি কী জানো, বাবা তোমাকে খুব ভালবাসেন?
অভয়চরণ একটু হেসে বলে, স্যার সত্যিই আমাকে খুব স্নেহ করেন।
ভাল ভাল বই পড়তে তোমার খুব ভাল লাগে, তাই না?
হ্যাঁ।
তুমি বাংলা-ইংরাজি দু’রকম বই-ই পড়ো?
আমি শুধু বাংলা বই পড়ি। আট বছর আগে স্কুল ছাড়ার পর তো আর ইংরেজি পড়া হয়নি।
তাতে কী হয়েছে? একটু কষ্ট করে পড়লেই বুঝতে পারবে।
আমি আগে একটা ইংলিশ-বেঙ্গলী ডিক্সনারী কিনব। তারপরই ইংরেজি বই পড়া শুরু করব।
পাপড়ি সঙ্গে সঙ্গে উঠে গিয়ে একটা মোটা বই এনে ওর হাতে দিয়ে বলে, এই নাও ডিক্সনারী। এবার তো ইংরেজি বই পড়বে?
তুমি ডিক্সনারী আমাকে দিলে কিন্তু তোমার তো অসুবিধে হবে
না, না আমার অসুবিধে হবে না। আমার আরো একটা ডিক্সনারী আছে।
অভয়চরণ একটু হেসে বলে, দিদি, তুমি আমার দারুন উপকার করলে। তোমাকে কি বলে কৃতজ্ঞতা বা ধন্যবাদ জানাব তা ভেবে পাচ্ছি না।
পাঁপড়ি হাসতে হাসতে বলে তুমি একটা গাগল! আমাকে মোটেও কৃতজ্ঞতা বা ধন্যবাদ জানাতে হবে না
দিদি, তুমি দেখতে যেমন অসম্ভব সুন্দর, তোমার মনও ঠিক সেইরকম সুন্দর। ভগবান নিশ্চয়ই তোমার ভাল করবেন।
পাঁপড়ি জোরেই হেসে ওঠে।
ঠিক সেই সময় মিঃ সেনগুপ্ত ওই ঘরে ঢুকেই বলেন, মাদার হাসছ কেন?
ইওর অভয় ইজ টু গুড এ বয়।
নো ডাউট অ্যাবাউট দ্যাট।
.
‘পরশপাথর’-এর গল্প পড়েছে অভয়চরণ। এই পরশপাথরের ছোঁয়ায় সবকিছু সোনা হয়ে যায়। অভয়চরণের বাস্তব জীবনে এই কি অপূর্ব সেনগুপ্তই ওর পরশপাথর।
সেনগুপ্ত সাহেবের কৃপাতেই ওদের অফিসার্স ক্লাবে মদ ছাড়া অন্যান্য জিনিষ সাপ্লায়ের ঠিকা পায়। শুরু হল চা-কফি-চিনি-গুঁড়ো দুধ, সাত-আট রকমের বিস্কুট, ক’রকমের দামী সিগারেট-দেশলাই ছাড়া পাঁচ রকমের কোল্ড ড্রিঙ্ক।
তারপর?
বছর পাঁচেক পরই শুরু হল চা বাগানের সাপ্লাই।
তারপর?
চার-পাঁচ বছরের মধ্যেই শুরু হল একটার পর একটা চা বাগানের সাপ্লাই।
.
অভয়চরণ অকৃতজ্ঞ না। তাই তো মিঃ সেনগুপ্ত রিটায়ার করার পর কল্যাণীর বাড়িতে চলে গেলেও নববর্ষ আর বিজয়ার পরদিনই অভয়চরণ তার ‘স্যার’ আর নতুন মাকে প্রণাম করতে কোনদিন ভোলে নি। না, কোনদিন ভোলেনি ওদের দু’জন আর পাঁপড়ি দিদির জন্মদিনে প্রণাম আর শুভেচ্ছা জানানো ছাড়াও নানা উপহার পাঠাতে।
.
ছোট দু’বোন বি.এ পাস করার পরই অভয়চরণ ওদের বিয়ে দিয়েছেন দুটি সুপাত্রের সঙ্গে। মায়ের পছন্দমতো মেয়েকে নিজেও বিয়ে করেছেন।
তারপর?
অভয়চরণ অর্থাভাবে লেখাপড়া করতে পারেন নি বলেই উনি পাঁচ ছেলেকেই উচ্চশিক্ষিত করার স্বপ্ন দেখেন কিন্তু মানুষের সব স্বপ্ন কী সার্থক হয় নাকি সার্থক হতে পারে?
সারাজীবন অক্লান্ত পরিশ্রম করায় বাহান্ন বছরেই অভয়চরণ হৃদরোগে আক্রান্ত হলেন; মাস তিনেক পর সুস্থ হলেও অনেকটাই কর্মশক্তি হারালেন। বড় ছেলে অমল বরাবরই অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র থাকায় সে তখন কলকাতায় হস্টেলে থেকে এম. এ পড়ছে কিন্তু পরের তিন ছেলে দু’তিন বারের চেষ্টায় মাধ্যমিকের গণ্ডী পার হলেও ওরা কেউই উচ্চমাধ্যমিক পাস করতে পারল না।
প্রথমে অজয় আর অমিত বাবার ব্যবসা দেখতে শুরু করল।
ব্যস, ওদের আর কে দেখে? শুরু হল দু’ভাইয়ের মদ্যপান; প্রথমে লুকিয়ে চুরিয়ে। তারপর অনেকটাই খোলাখুলি।
অভয়চরণের শরীর দিন দিনই ভেঙে পড়ছে। তাইতো তিনি পাঁচ ছেলেকে ব্যবসার অংশীদার করতে চাইলেন কিন্তু বড় ছেলে অমল স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, সে ব্যবসা বাণিজ্য বোঝে না। তাইতো অংশীদারও হতে চায় না। শেষ পর্যন্ত অন্য চার ছেলেকেই অভয়চরণ ব্যবসার সমান অংশীদার করে দিলেন।
অমল এম. এ. বি. টি পাস করে কাটোয়ার স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করার পর পরই অভয়চরণের মৃত্যু হয়। শ্রাদ্ধাদি শেষ হবার পর অমল তার মাকে কাটোয়ায় নিজের কাছে নিয়ে আসে।
ওদিকে অমলের সবচেয়ে ছোট ভাই অমিত ছাড়া অন্য তিন ভাই আগেই নিজেদের পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করেছে আর সারা জলপাইগুড়ি শহরে ছড়িয়ে গেছে ওদের বেলেল্লাপনার খবর।
শুধু কী তাই?
দিন দিন একদিকে হারাতে শুরু হল সাপ্লায়ের ব্যবসা, অন্যদিকে শুরু হল ব্যাঙ্কের টাকা মারা ও লুকিয়ে-চুরিয়ে সম্পত্তি বিক্রি আর দীর্ঘ মেয়াদী লিজ নেওয়া।
তারপর ছোট ভাই অমিত অন্য তিন ভাইয়ের বিরুদ্ধে শুরু করল মামলা।
.
বিমলবাবু একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, বুঝলি শান্ত, আঠারো বছর ধরে মামলা চলার পর শেষ হল হাইকোর্টের রায়-এ। এই রায়-এর ফলে তিন ভাই ভিখিরি হয়ে গেল। আমার আর ছোট ভাই অমিতের জুটলো আঠারো লাখ করে। আমি আমার ভাগের টাকা দিয়ে দিলাম জলপাইগুড়ির এক অখ্যাত গ্রামের স্কুলে যেখানে আমার ঠাকুর্দা অভয়চরণ ক্লাস সিক্স পর্যন্ত পড়ে সেভেনেই পড়াশুনা ছাড়তে বাধ্য হন।
খুব ভাল করেছেন।
শান্ত উঠে দাঁড়াতেই বিমলবাবু বলেন, তোকে আর একটু বসতে হবে।
শান্ত বসতেই উনি একটু হেসে বলেন, আমার আদি বাড়ি জলপাইগুড়ি শুনেই তোর মা একদিন বললেন, দিদিমার কাছে শুনেছি উনি অনেক বছর জলপাইগুড়ির একটা চা বাগানে ছিলেন।
দিদিমা ছিলেন মানে? ওর স্বামী কী চা বাগানে চাকরি করতেন?
না, না; দিদিমার স্বামী না, দিদিমার বাবা একটা নামকরা চা বাগানের ম্যানেজার ছিলেন।
উনি কোন বাগানের ম্যানেজার ছিলেন?
যতদূর মনে পড়ছে বোধহয় মডার্ন।
আপনার দিদিমার নাম কী?
পাঁপড়ি।
বিমলবাবু একগাল হেসে বলেন, এবার আমি বলি, আপনার দিদিমার বাবার নাম অপূর্ব আর মা-র নাম নন্দিতা।
মনিকা দেবী চোখ দুটো বড় বড় করে বলেন, আপনি তাদের নাম জানলেন কী করে?
বিমলবাবু আবার হাসতে হাসতে বলেন, আপনার দিদিমার বাবা রিটায়ার করার পর তো কল্যাণীর বাড়িতে থাকতেন।
কী আশ্চর্য! আপনি তো আমার মাথা ঘুরিয়ে দিচ্ছেন।
উনি না থেমেই বলেন, সত্যি করে বলুন তো কী করে আপনি এসব জানলেন।
আমার ঠাকুর্দার ডায়েরী থেকে। অপূর্ব সেনগুপ্ত ছিলেন আমার ঠাকুর্দার জীবন দেবতা; ওরই কৃপায় ঠাকুর্দা চা বাগানের বিখ্যাত সাপ্লায়ার হয়ে প্রায় রাস্তার ভিখারী থেকে রাজা হয়েছিলেন। আপনার দিদিমাকে আমার ঠাকুর্দা বলতেন ‘দিদি আর ওকে ‘দাদা’ বললেন অভাবনীয় সুন্দরী পাঁপড়ি।
এই কথা বলেই বিমলবাবু হো হো করে হেসে ওঠেন।
মনিকা দেবী বলেন, কেন জানি না দিদিমা বিয়ে করেন বোধহয় চল্লিশ বছর বয়সে আর তার সাত-আট বছর পর আমার মায়ের জন্ম।
এসব আমি জানি না।
বিমলবাবু সঙ্গে সঙ্গেই একটু হেসে বলেন, মোটকথা অভয়চরণ পাঁপড়ির মধুর সম্পর্কের বৃত্ত বোধহয় সম্পূর্ণ করবে শান্ত আর মৌ।
.
শান্ত হাসতে হাসতে বলে, ভাল কাকা, এ তো ড্রিম কাম ট্রু।
ওরে ট্রুথ ইজ স্ট্রেনজার দ্যান ফিকসন।
ঠিক বলেছেন।
.
০৬.
এম. এ পরীক্ষা শেষ হবার পর মৌ-এর মনে হল যেন মহাযুদ্ধের শেষ হল। কবে শুরু হয়েছিল এই যুদ্ধ, তা আজ আর ওর ঠিক মনে পড়ে না। তবে স্পষ্ট মনে পড়ছে, তারপরের আট দশ-বছরের যুদ্ধের কথা। বছরে দুতিনটে পরীক্ষা দিতে দিতে প্রায় ধৈর্য হারিয়ে ফেলার পর মাধ্যমিক।
দু’বছর পর আবার পরীক্ষা। সব গুরুজনেরাই বলেন, ভবিষ্যত জীবনের রাজপথে হাঁটার আসল পাসপোর্ট এই পরীক্ষা।
অর্থাৎ?
এক মিনিট সময় নষ্ট করবে না; দিন-রাত শুধু পড়তে হবে।
দু-তিন মাস পরও বন্ধুদের সঙ্গে একটা সিনেমা দেখব না?
নৈব নৈব চ।
এই দু’বছর সব ভুলে যাও; এখন তোমার ধ্যান-জ্ঞান শুধু…
বুঝেছি, আর বলতে হবে না। তোমরা কেউ বুঝতে চাও না, সতের-আঠারো বছরের মেয়ের মন। তোমরা জানো না, আমাদের মনেপ্রাণে এখন রামধনু রঙের খেলা। ক’বছর আগে থেকেই শরীরে জোয়ার আসতে শুরু করেছে কিন্তু এখন যে জোয়ারে ভাসিয়ে দিচ্ছে সারা শরীর। বাথরুমে চান করার সময় নিজেই নিজেকে দেখে অবাক হই, মুগ্ধও হই; বাপরে বাপ, কত ঢেউ খেলছে এই শরীরে।
হঠাৎ যেন নিজেই নিজেকে ভালবাসতে শুরু করি।
কে আমাদের মনের খবর রাখে?
তোমরা কী জানো, আমি আর শ্রীতমা যখন স্কুলে যাই ঠিক সেই সময় তখন পার্কের কোণায় দাঁড়িয়ে থাকে দেবুদা আর ওর দু’তিনজন বন্ধু। ওরা শুধু হাঁ করে আমাদের দুজনকে দেখে না, ওরা দু’চোখ দিয়ে যেন আমাদের গিলে খেতে চায়। শুধু কী চাই? ওদের মধ্যে কে একজন দু’এক কলি প্রেমের গানও গেয়ে ওঠে।
আমি আর শ্রীতমা কনুই দিয়ে একটু খোঁচা মেরে মুখ টিপে হাসি।
শুধু ওদেরই বা দোষ দিই কী করে? পথেঘাটে কত বয়স্ক লোকও বিশ্রী হ্যাংলার মতো আমাদের দেখে। সত্যি বলছি, এই লোকগুলোকে দেখলেই আমাদের ঘেন্না করে।
যাকগে ওইসব। ওইসব নিয়ে আমরা মোটেও চিন্তা করি না। আপাতত আমাদের চিন্তা জীবনের রাজপথে পৌঁছবার পাসপোর্ট জোগাড় করার। তাছাড়া অবসর পেলেই আমরা আমাদের নিয়েই চিন্তা করি, চিন্তা করি মনের মানুষের। সত্যি শান্তদাকে কাছে পাবার জন্য পাগল হয়ে উঠি।
তারপর?
তারপর কলেজে ঢুকেই হঠাৎ বসন্তের বাতাস আমাদের যেন উড়িয়ে নিয়ে গেল। স্কুলের বন্দী জীবন থেকে মুক্তি পেয়ে হঠাৎ একটু স্বাধীনতার স্বাদ পেয়ে মনে নতুন আনন্দের জোয়ার। ক্লাসের অন্য মেয়েরা অচেনা হলেও চেনা হল কয়েকদিনের মধ্যেই। বেশ কয়েকজনের সঙ্গে বন্ধুত্ব হতেও দেরি হল না।
বিলিভ মী, তোকে দেখেই আমার ভাল লেগেছিল।
রিয়েলী?
আমি এক গাল হেসে বলি, ইয়েস রুচিরা, ইয়েস।
আমি না থেমেই বলি, আমাকে দেখে তোর কী মনে হয়েছিল?
সত্যি কথা বলব?
তবে কী মিথ্যে কথা বলবি?
তুই দারুণ সুন্দরী; তাইতো ভেবেছিলাম খুবই,অহঙ্কারী হবি।
আচ্ছা?
হ্যাঁ, সত্যি বলছি।
রুচিরা প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বলে, কলেজে আসার দু’তিন দিন পর ক্যান্টিনে তোর সঙ্গে আলাপ হতেই বুঝলাম আমার ধারণা ভুল। সেদিন তোর সঙ্গে কথা বলে এত ভাল লেগেছিল যে রাত্রে টেলিফোন করে তোর সঙ্গে কথা না বলে থাকতে পারিনি।
সেদিন রাত্রে তোর টেলিফোন পেয়ে আমারও খুব ভাল লেগেছিল।
গঙ্গা দিয়ে আরো জল গড়িয়েছি।
ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব হয়েছে আরো কয়েকজনের সঙ্গে।…
.
জানো শান্তদা, দেখলাম সবাই কোন না কোন ছেলের প্রেমে পড়েছে।
তাই নাকি?
দু’তিনজন তো স্বীকার করেছে তারা অনেক দূর এগিয়ে গেছে।
অনেক দুর মানে?
মানে শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে।
ভেরি গুড।
এই কথা বলেই শান্ত হাসতে হাসতে বলে, আমি তখন কলকাতায় থাকলে তুমিও সেই অমৃতের স্বাদ পেতে।
অসভ্য কোথাকার।
ওহে সুন্দরী, যতক্ষণ মনের মানুষের কাছে সেই আনন্দ না পাওয়া যায়, ততক্ষণ বলা যায় আঙুর ফল টক কিন্তু সেদিন যখন আমাকে ভাসিয়ে দিলে, তখন তো মনে হয়নি।…
আঃ! শান্তদা।
আমার বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে রাখলে কী চরম সত্য মিথ্যা হয়ে যাবে?
আমি জানি না, প্লীজ চুপ করো।
শান্ত আস্তে আস্তে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে, মৌ, একটা চরম সত্যি কথা জেনে রাখো; আমরা যতক্ষণ বিশেষ কিছু না পাই ততক্ষণই সৎ। যাকে কেউ ঘুষ দেয় না বা যার ঘুষ খাবার সুযোগ নেই তিনি সৎ থাকতে বাধ্য হন কিন্তু ঘটনাচক্রে ওই মানুষই যদি ঘুষ খাবার সুযোগ পায় তখন আর তিনি ঘুষ নিতে দ্বিধা করেন না।
হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ।
সেইরকম যে ছেলে-মেয়ে মিলেমিশে আনন্দ করার সুযোগ না পায় ততক্ষণ তারা ভাল কিন্তু সুযোগ পেলে কোন ছেলেমেয়েই নিষিদ্ধ ফল খেতে দ্বিধা করে না।
হ্যাঁ, শান্তদা ঠিক বলেছ।
.
জানো শান্তদা, আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুর কাছ থেকে একটা ব্যাপার জেনে আমি অবাক হয়েছি।
কী খবর জেনে অবাক হয়েছিস?
সায়নী আমার খুবই প্রিয় বন্ধু। ক্লাস ইলেভেন থেকে এম. এ পর্যন্ত একসঙ্গে পড়েছি। ওর থেকে মাত্র ছ’বছরের বড় ওর ছোট মামা। ছোটবেলা থেকেই দু’জনের মধ্যে খুব ভাব।’হায়ার সেকেন্ডারী পরীক্ষা দিয়ে মামাবাড়ি যাবার পর ছোট মামার সঙ্গে যে শারীরিক সম্পর্ক শুরু হয়েছে তা এখনও চলছে।
শান্ত হাসতে হাসতে বলে, আগেকার দিনে ঠাকুমা-পিসিমারা ঠিকই বলতেন।
ওরা কী বলতেন?
বলতেন, আগুন আর বারুদ কাছাকাছি এলে তো জ্বলে উঠবেই।
আচ্ছা!
তোর বন্ধুর সঙ্গে ছোট মামার সম্পর্ক আছে বলে অবাক হবার কারণ নেই; কারণ কারুর সঙ্গে ছোট মামা, কারুর সঙ্গে ছোট কুর্কি, বা পিসতুতো-মাসতুতো ভাইয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হওয়া যতটা সহজ বাইরের কোন ছেলের সঙ্গে তেমন ঘনিষ্ঠতা হওয়া অসম্ভব।
হ্যাঁ, ঠিক বলেছ।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর মৌ বলে, বড় হবার পর তোমাকে কাছে না পেয়ে আমি যে কি করে কটা বছর কাটিয়েছি তা তুমি কল্পনা করতে পারবে না।
কী করব বল? নতুন চাকরি, অমানুষির্ক পরিশ্রম, বাবার অসুস্থতা, বাবার মৃত্যু, মা-র অসুস্থতা, তারপর তার মৃত্যু, আমি তখন কোনমতে কর্তব্য পালন করে চলেছি।
বুঝেছি।
মৌ, তুই ভাবতে পারবি না, নতুন চাকরি করতে করতে আমি কী করে ওদের বেস্ট ট্রিটমেন্ট দেবার জন্য লক্ষ লক্ষ টাকার ব্যবস্থা করেছি।
শান্ত না থেমেই বলে, যখন একটু সামলে নিয়েছি আবার নিজের দিকে ফিরে তাকাবার অবকাশ পেয়েছি, তখনই আমি তোদের কাছে ছুটে এসেছি।
মৌ ওর গলা জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে বলে, গুড বয়!
এখন গুড বয় মনে হচ্ছে কিন্তু এই ক’বছর ধরে তো ভেবেছিস শান্তদা তোদের ভুলে গেছে অথবা গোল্লায় গেছে বা হয়তো ভেবেছিস শান্তদা এক নম্বর বেইমান।
শান্ত না থেমেই বলে, আর তুই তো ভেবেছিস আমি তোকে ঠকিয়েছি, তোর সঙ্গে ভালবাসার অভিনয় করে নিশ্চয়ই এতদিনে বিয়ে করে মহা ফুর্তিতে দিন কাটাচ্ছি।
হয়েছে? নাকি আরো কিছু বলবে?
আর কী বলব?
শান্তদা, তোমার প্রতি মা-বাবার এত অন্ধ স্নেহ যে তুমি খুন করলেও ওরা তা কখনই বিশ্বাস করবেন না। তুমি আমার মায়ের পেটে না জন্মালেও ওরা তোমাকে প্রথম সন্তানই মনে করেন, তা জানো?
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই জানি ও বিশ্বাসও করি।
আমার কথা শুনবে?
হ্যাঁ, বল।
মৌ ওর গলা জড়িয়ে চোখের পর চোখ রেখে বলে, তুমি কী জানো প্রেম- ভালবাসার ব্যাপারে ছেলেদের চাইতে মেয়েরা অনেক বেশি সিরিয়াস। তারা একবার কাউকে মন দিলে আর তাকে সারাজীবনেও ভুলতে পারে না।
শান্ত হাসতে হাসতে বলে, আমি মাঝে মধ্যে এখানে এলে আর তোর এম. এ পর্যন্ত পড়া হতো না।
কেন?
এর মধ্যে তোকে অন্তত নিশ্চয়ই বার ছয়েক মেটারনিটি ওয়ার্ডে ভর্তি করতে হতো।
আঃ! শান্তদা!
শান্ত একটু চাপা হাসি হেসে বলে, একদিক দিয়ে এখন এসে ভালই করেছি।
শুনি, কোনদিক দিয়ে ভাল করেছ।
তুই তো এখন গাছপাকা আম, যেমন মিষ্টি তেমনি রসে ভরপুর। তোকে পেয়ে এখন কি ভালই লাগছে।
আমি গাছপাকা আম?
তুই তো এখন চব্বিশ বসন্তের পরিপূর্ণ ফোঁটা পদ্মের মতো…
আর কিছু না?
মৌ, সত্যি বলছি তুই যে আমাকে কি আনন্দে রেখেছিস তা জানিস না। তোর জন্য আমি জীবনে পরিপূর্ণতার স্বাদ পাচ্ছি।
সত্যি তাই?
হ্যাঁ মৌ, সত্যি তাই।
শান্ত সঙ্গে সঙ্গে বলে, আমাকে পরিপূর্ণভাবে পেয়ে তুই কোন পূর্ণতার স্বাদ পাচ্ছিস না?
বেশ কিছু বছর শূন্যতার জ্বালা সহ্য করার পর এখন তোমাকে পেয়ে নিশ্চয়ই ভাল লাগছে।
মৌ না থেমেই ওর মুখের সামনে মুখ নিয়ে বলে, আবার সেই পুরনো শূন্যতার জ্বালা আমাকে সহ্য করতে হবে না তো?
কখনই না।
এই কথা বলেই শান্ত ওকে বুকের মধ্যে টেনে নেয়।
মৌ-ও ওকে দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে।
দু’চার মিনিট নীরবতার পর মৌ বলে, শান্তদা একটা কথা বলব?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, বল।
তুমি যখন আমাকে বুকের মধ্যে টেনে নাও, তখন যে কি শান্তি পাই তা তুমি ভাবতে পারবে না।
তাই নাকি?
হ্যাঁ শান্তদা, এখন আমার কোন দুঃখ কষ্ট নেই, অভাব-অভিযোগ নেই, ভূত-ভবিষ্যত নিয়ে কোন দুশ্চিন্তা নেই; এখন আমার মন আনন্দে টইটুম্বর।
তুই আমাকে সত্যি খুব ভালবাসিস।
নিশ্চয়ই ভালবাসি; তা না হলে কেউ এভাবে নিজেকে উজাড় করে সবকিছু বিলিয়ে দিতে পারে?
শান্ত আলতো ওকে একবার চুমু খায়।
মৌ আবার বলে, নিজেকে কখনই এভাবে বিলিয়ে দিতে পারতাম না যদি তুমি আমাকে না ভালবাসতে। তুমিও আমাকে পাগলের মতো ভালবাসো।
সত্যি তাই মনে করিস?
হ্যাঁ, সত্যিই তাই বলে তো তুমি আমাকে প্রাণভরে পাবার জন্য কি পাগলামীই করো!
তুই পাগলামী করিস না?
পাগলের পাল্লায় পড়ি বলেই তো পাগলামী করতে বাধ্য হই। যত দোষ নন্দ ঘোষ, তাই না?
কী করব? নন্দ ঘোষই যদি প্রথম আগুন জ্বালায়, তাহলে তো সে আগুন ছড়িয়ে পড়বেই।
শান্ত হো হো করে হেসে ওঠে।
.
ওরা দুজনে সারাদিন শুধু হোটেলের ঘরে বসে থাকে না। রোজই সকালের দিকে শান্ত এক একদিন এক এক এরিয়ার ডিস্ট্রিবিউটারের দীর্ঘ আলোচনা করে ড্রইং- ডাইনিং রুম-এ বসে। এইসব আলোচনার সময় মৌ-ও শান্তর পাশে থাকে।
মিঃ কেজরিওয়াল, দিস ইজ মহুয়া…
মিঃ কেজরিয়াল সঙ্গে সঙ্গে দু’হাত জোড় করে ওকে নমস্কার করে বলেন, নমস্তে মেম সাব!
মৌ-ও দু’হাত জোড় করে ওকে নমস্কার করে।
শান্ত ধীরে ধীরে বলে, মহুয়া খুবই উচ্চশিক্ষিতা ও অত্যন্ত বুদ্ধিমতী মেয়ে; ও আমাদের কোম্পানীতে শিগগিরিই জয়েন করবে।
স্যার, আপনাদের বহু প্রোডাক্টই তো মেয়েদের জন্য; সেইগুলোর ব্যাপারে ওর পরামর্শ আমাদের খুবই সাহায্য করবে।
হ্যাঁ, তা তো করবেই কিন্তু অন্যান্য প্রোডাক্টের ব্যাপারেও ওর মতামত খুবই গুরুত্বপূর্ণ হবে বলে মনে হয়।
স্যার, তা তো হবেই।
আপনাদের প্রত্যেককে উইকলি সেলস্ রিপোর্ট ওর কাছে পাঠাতে হবে প্রতি সোমবার।
হ্যাঁ স্যার, নিশ্চয়ই পাঠাব।
শান্ত একইভাবে নন্দলাল জালান, বিমলেন্দু পাইন, অশোক মেটা, জগদীশ্বর আগরওয়াল, গঙ্গাশরণ যাদব আর নরনারায়ণ বসাকের সঙ্গে মহুয়ার পরিচয় করিয়ে দেন।
.
এই পর্ব মিটতেই মৌ বলে, শান্তদা, আমি কী পারব এই কাজ করতে?
আসল কথা হচ্ছে, এদের সবাইকে প্রতিনিয়ত চাপে রাখতে হবে বিক্রি বাড়াবার জন্য।
কিন্তু কীভাবে চাপে রাখব?
এদের প্রত্যেককে বলবে, এই প্রোডাক্ট, ওই প্রোডাক্ট, সেই প্রোডাক্টের বিক্রি বাড়াও।
শান্ত একটু হেসে বলে, এরা প্রত্যেকেই জানে ওদের বিরুদ্ধে কোন রিপোর্ট হেড অফিসে গেলেই এজেন্সি বা ডিস্ট্রিবিউটরশিপ চলে যেতে পারে; তাইতো ওরা যেভাবেই হোক বিক্রি বাড়াবেই।
আমার মতো মেয়ের কথাকেও ওরা সত্যি গুরুত্ব দেবে?
আলবাত দেবে।
শান্ত সঙ্গে সঙ্গে বলে, হাজার হোক তুমি ভারতের অন্যতম বিখ্যাত কোম্পানীর একজন অফিসার হিসেবে কথা বলবে। ওরা কোম্পানীর অফিসারদের যেমন ভয় করে, সেইরকমই ভক্তি করে।
ও একটু হেসে বলে, তোকে দু’একটা টেকনিক শিখিয়ে দেব, দেখবি তাতে কি দারুণ কাজ হবে।
মৌ একটু হেসে বলে, প্লীজ একটা উদাহরণ দাও।
তুই হাতের ফাইলের কাগজগুলো একটু উল্টেপাল্টে দেখে নিয়েই বলবি, মিঃ কেজরিওয়াল, লাস্ট ক’ উইকের রিপোর্টে দেখছি প্রত্যেক সপ্তাহে জগদীশ্বর আগরওয়াল, পাইন আর অশোক মেটার বিক্রি দশ কোটি থেকে বাইশ কোটি টাকার মাল বেশি বিক্রি করছেন কিন্তু আপনার বিক্রি বাড়ছে না কেন?
যাদের বিক্রি বাড়ছে বললাম, তাদের বিক্রি কী সত্যি বাড়ছে?
শান্ত গম্ভীর হয়ে বলে, না, কিন্তু তোর কথা শুনেই কেজরিওয়ালের মুখ শুকিয়ে যাবে।
তারপর?
তারপর তুই ওকে বলবি, আপনি আমাদের কোম্পানীর বহু পুরনো ডিস্ট্রিবিউটর হিসেবে যথেষ্ট সুনাম আছে; তবে আমার মনে হয়, আপনার সেলসম্যানরা বোধহয় ঠিক মতো কাজ করছে না।
শান্ত হাসতে হাসতে বলে, দেখবি তোর এই কথায় ম্যাজিকের মতো কাজ করবে।
.
ডিস্ট্রিবিউটর এজেন্টদের সঙ্গে কথাবার্তার পর্ব শেষ, এবার শান্তকে ফিরতে হবে মুম্বাই।
ভাল কাকা, এবার আমাকে ফিরতে হবে।
এরই মধ্যে?
ভেবেছিলাম তিন-চারদিনের বেশি থাকব না কিন্তু নানা কারণে ছ’দিন রইলাম। তাইতো ঠিক করেছি কালই ফিরে যাব।
আবার কবে আসবি?
এবার থেকে এক-দেড় মাস অন্তরই আমাকে আসতে হবে।
তাহলে তো ভালই।
আর একটা কথা।
হ্যাঁ, বল।
আমি ঠিক করেছি মৌ-কে কলকাতাতেই আমাদের কোম্পানীর কাজে লাগিয়ে দেব।
মৌ কী পারবে সে কাজ করতে?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, খুব পারবে।
বিমলবাবু একটু হেসে বলেন, ও যদি পারে সে কাজ করতে, তাহলে আমি আপত্তি করব কেন?
তবে ওকে একটা ফর্মাল ইন্টারভিউ তো দিতে হবে আমাদের মুম্বাই অফিসে; তারপর ওকে তিন-চার সপ্তাহ ধরে ট্রেনিং দেওয়া হবে।
মৌ-কে কবে যেতে হবে?
আমি ভাবছিলাম ওকে সঙ্গে নিয়েই যাব।
মৌ রাজি আছে?
ও তো এক পায়ে খাড়া।
ও রাজি থাকলে আমি আপত্তি করব কেন?
বিমলবাবু সঙ্গে সঙ্গেই বলেন, তুই তোর ভাল মা-র সঙ্গেও এই ব্যাপারে কথা বলিস।
শান্ত হাসতে হাসতে বলে, ভাল মা-র সঙ্গে কথা বলেছি, তার বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই।
তবে আবার কী? তবে দেখিস বোম্বের মত অচেনা শহরে ও যেন একা একা না ঘুরতে বেরোয়।
ওকে কখনই একলা ছাড়ব না; তেমন দরকার হলে আমাদের অফিসের কাউকে ওর সঙ্গে পাঠাব।
তাহলে তো ভালই হয়।
.
পরের দিন সকালে শান্ত হোটেল থেকে রওনা হয়ে এয়ারপোর্ট যাবার পথে মৌ-কে তুলে নিতে আসে। প্রণাম করে ভাল কাকাকে।
বিমলবাবু ওকে আশীর্বাদ করেই বলেন, তোকে কাছে পেয়ে ভরসা বেড়ে গেল; মাঝে মাঝেই একটু দেখে যাস।
হ্যাঁ, ভাল কাকা, নিশ্চয়ই আসব। এখন আপনারা দু’জন ছাড়া আমার আপনজন তো কেউ নেই।
শান্ত অনুপমা দেবীকে প্রণাম করেই ওকে দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে, এখন তোমার চাইতে আপনজন আর কেউ নেই। তুমি যে কি ধাতুতে গড়া, তা ভগবানই জানেন। আমি তোমাকে যত বিরক্ত করি, তুমি তত আনন্দ পাও, তত খুশি হও।
শান্ত ওর হাতে একটা খাম দিয়েই গাড়িতে ওঠে।
.
মেরিন ড্রাইভের ফ্ল্যাটে পৌঁছেই শান্ত টেলিফোন করে কলকাতায়।
ভাল কাকা, আমি শান্ত বলছি।
তোরা এর মধ্যেই পৌঁছে গেছিস?
হ্যাঁ, ভাল কাকা। মেরিন ড্রাইভের ফ্ল্যাটে পৌঁছেই তো ফোন করছি। এবার মৌ-এর সঙ্গে কথা বলো।
হ্যাঁ, দে।
মৌ বলে, জানো বাবা, প্লেনে কি আনন্দেই এলাম।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, বাবা।
প্লেনে কিছু খেয়েছিস?
দারুণ খেয়েছি।
শান্তর ফ্ল্যাটটা কেমন?
ওয়ান্ডারফুল! অনেক দিনের পুরনো বাড়ি; তাই প্রত্যেকটা ঘরই হলঘরের মতো। তাছাড়া সব চাইতে ভাল হচ্ছে নীচে রাস্তার ঠিক পাশেই আরব সাগর ভাবাই যায় না।
যাইহোক সাবধানে থাকিস আর মাঝে মাঝে টেলিফোন করতে ভুলিস না।
না, না, ভুলব না।
এবার মা-র সঙ্গে কথা বল।
হ্যাঁ, দাও।
অনুপমা দেবী রিসিভার ধরেই বলেন, ভালভাবে পৌঁছেছিস?
হ্যাঁ, মা, খুব ভালভাবে এসেছি।
বোম্বে বিরাট শহর। একলা একলা কোথাও বেরুবি না।
শহরটা তো চিনি না; একলা বেরুব কোথায়?
এবার শান্তকে দে তো।
এই নাও।
হ্যাঁ, ভাল মা, বলো।
তুই আমাকে অতগুলো টাকা দিয়ে গেলি কেন?
বেশ করেছি।
অনুপমা হাসতে হাসতে বলেন, ওরে হতভাগা অতগুলো টাকা দিয়ে আমি কী করব?
যা ইচ্ছে।
তোর উপর আমার সত্যি খুব রাগ হয়েছে।
সামনের বার কলকাতা গেলে তুমি আচ্ছাসে আমাকে পিটুনি দিও। তাহলে তো হবে?
তোকে নিয়ে আমি কী করি বলতো?
আমাকে শুধু আদর করবে।
অনুপমা হো হো করে হেসে ওঠেন।
৮. মৌ জানলার ধারে
মৌ জানলার ধারে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে দেখছিল সামনের আরব সাগর; কখনও কখনও দৃষ্টি গুটিয়ে এনে দেখছিল, মেরিন ড্রাইভ দিয়ে অজস্র গাড়ির ছোটাছুটি। কখনো কখনো এইসব দৃশ্য বিভোর হয়ে দেখতে আপনমনে হাসে।
সত্যি কত সিনেমায় এই দৃশ্য দেখেছি! আর আজ? আমিই সেই দৃশ্যের মুখোমুখি।
হঠাৎ শান্ত পিছন থেকে দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বলে, কী দেখছিস?
মেরিন ড্রাইভের ওপাশেই আরব সাগর, সত্যি ভাবা যায় না। সত্যি ওয়ান্ডারফুল!
আর যে জড়িয়ে ধরেছে?
সে তো আমার আনন্দের মহাসাগর।
আর কিছু না?
সে আমার হৃৎপিণ্ডের ওঠানামা, আমার নিশ্বাস-প্রশ্বাসের মতোই একান্ত আমার।
সত্যি?
এক শ’বার সত্যি।
আমাকে দেখবি না?
আমি ঘুমের মধ্যেও তোমাকে দেখতে পাই, তা জানো?
শান্ত আলত করে ওর হাত ধরে টেনে এনে সোফায় বসে ওকে কোলে বসিয়ে বলে, এখানে এসে তোর কেমন লাগছে?
এই স্বপ্নই তো দেখছিলাম বেশ কিছু দিন ধরে।
মৌ মুহূর্তের জন্য থেমে আলতো করে ওর ঠোঁটে ঠোঁট চুঁইয়ে বলে, সত্যি বলছি, এখনো যেন মনে হচ্ছে, স্বপ্ন দেখছি।
আমিও তোকে ছেড়ে আর থাকব না।
শান্ত বুক ভরে একবার নিশ্বাস নিয়ে বলে, সেই ছোটবেলা থেকে তুই ছিলি আমার একমাত্র খেলার সাথী আবার আমি ছিলাম তোর একমাত্র বন্ধু আর খেলার সাথী।
হ্যাঁ, সত্যিই তাই।
আবার একটু বড় হবার পর থেকেই দু’জনের চোখেই রঙীন নেশা, রঙীন স্বপ্ন, তাই না মৌ?
তুমি ঠিক বলেছ।
মৌ না থেমেই বলে, স্কুল-কলেজে যাবার পথে যেসব ছেলেরা ভাব জমাবার চেষ্টা করতো, তাদের দেখলেই কি রাগ হততা! তুমি ছাড়া আর কোন ছেলেই আমার মনে দাগ কাটতে পারলো না।
তারপর?
এম. এ. পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ক’টা বছর পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেই হতো কিন্তু এম.এ. পরীক্ষা শেষ হবার পর তোমার কথা ভাবতে গেলেই নানা দুঃশ্চিন্তার জন্য মন খারাপ হতো।
কী দুশ্চিন্তা?
কখনো মনে হতো, তুমি কী আমাকে ভুলে গেলে। আবার কখনো সন্দেহ হতো, আচ্ছা শান্তদা কি অন্য কোন মেয়েকে বিয়ে করেছে…
আমি তো ভাবিনি, তুই অন্য ছেলেকে বিয়ে করে বেশ ভাল আছিস।
এখন তুমি যাই বলল, ক’বছর তুমি আমাদের তিনজনকে খুবই দুঃশ্চিন্তার মধ্যে রেখেছিলে।
শান্ত একটু হেসে বলে, ঐ অধ্যায়টা বাদে এখন বল, গত সপ্তাহটা তোর কেমন কেটেছে?
মৌ ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে খুব আস্তে আস্তে বলে, দারুণ! ফ্যানটাস্টিক।
তাই নাকি?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
ও সঙ্গে সঙ্গেই প্রশ্ন করে, লাস্ট উইক তোমার কেমন কেটেছে?
সে আর কি বলব? একটা মডার্ন উর্বশী আমার এতদিনের ব্রহ্মচর্য ব্রত ভঙ্গ করে দিলো!
মৌ হাসতে হাসতে বলে, আহা হা! কি ভাল ছেলে রে!
সত্যি বলছি, যুবক-যুবতীদের লীলা খেলার বিষয়ে আমি কিছুই জানতাম না কিন্তু উর্বশীর উন্মত্ত যৌবন আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল।
মৌ ওর কোল থেকে নেমেই বলে, এখানে যতদিন থাকব, তুমি আমাকে স্পর্শ করবে না।
স্পর্শ করব না কিন্তু তোর প্রতি কর্তব্য পালন তো করব।
কর্তব্য? কিসের কর্তব্য?
তোর সব রকমের প্রয়োজন, চাহিদা, ইচ্ছা ইত্যাদি তো মিটাতে হবে।
মৌ হাসতে হাসতে ওকে জড়িয়ে ধরে বলে, লিওপার্ড কান্ট চেঞ্জ ইট স্পটস্। নেকড়ের কালো কালো ছোপ কিছুতেই তুলে ফেলা যায় না, তাই না?
.
সেই কোন কালে যাযাবর লিখেছিলেন, বিজ্ঞান দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ। কথাটি ষোল আনার উপরে আঠারো আনা সত্য। বিমান যাত্রায় দূর দূরান্তর পৌঁছনো যায় খুবই অল্প সময়ে কিন্তু আগে-পরে হ্যাপা কম নয়।
বারোটার প্লেন? এয়ারপোর্ট পৌঁছতে হবে পাক্কা দুঘন্টা আগে। তারপর? বিশুদ্ধ গণতান্ত্রিক নিয়মে সব বিমানযাত্রীই সন্দেহজনক। তাইতো সবাইকেই আত্মসমর্পণ করতে হবে দেশপ্রেমিক সিপাহীদের কাছে একাধিকবার।
অতঃপর?
যাও খোকা-খুকি বিমানে বসো।
বিজ্ঞান যে বেগ দিয়ে আবেগ কেড়ে নিয়েছে তার জ্বলন্ত জীবন্ত প্রমাণ পাবেন বিমান সেবিকাদের শুকনো প্রাণহীন সেবাযত্নে।
যাইহোক এইসব দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে গন্তব্যে পৌঁছবার পরও মুক্তি নেই। তিন-চারশ’ যাত্রীর মালপত্তরের সঙ্গে লাইন দিয়ে আপনার সুটকেশ-ব্যাগটির জন্য হা-হুঁতাশ করে দাঁড়িয়ে থাকতেই হবে।
শুধু কী তাই?
মুখে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, পরনে লুঙ্গি গেঞ্জি পরে স্বচ্ছন্দে বনগাঁ বা ব্যান্ডেল লোকালে যাতায়াত করা সম্ভব হলেও বিমান যাত্রায় আপনাকে সেজেগুজেই যেতে হবে; তারজন্য কী কম সময় লাগে?
তাই তো মৌ সত্যি ক্লান্তবোধ করছিল।
শান্তদা, সত্যি বড় টায়ার্ড লাগছে; তাছাড়া ঘুমও পাচ্ছে। আমি শুতে যাচ্ছি; প্লীজ তুমি ডিসটার্ব কোরো না।
না, না, ডিসটার্ব করব না; তুই শুতে যা।
মৌ বেডরুমের দিকে পা বাড়িয়ে বলে, তুমি একটু বিশ্রাম করবে না?
হ্যাঁ, করব একটু পরে।
পরে কেন এখনই এসো।
কয়েকটা টেলিফোন করেই আসছি।
বেশি দেরি কোরো না।
না, না, দেরি করব না।
মৌ শোয়র সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়ে।
শান্ত কর্ডলেস টেলিফোন হাতে নিয়েই টেলিফোন করতে শুরু করে।
.
বেশ কিছুক্ষণ ঘুমুবার পর মৌ-এর ঘুম পাতলা হয়েছে; ঠিক তখনই ওর কানে আবছা আবছা ভেসে আসে এক মহিলার সঙ্গে শান্তদার কথাবার্তা। ও একটু কান খাড়া করতেই বুঝতে পারে, হ্যাঁ, শান্তদা এক মহিলার সঙ্গে কথা বলছে।
মৌ বিছানা থেকে নেমে ড্রইং-ডাইনিং রুমে পা দিয়েই একজন বয়স্কা মহিলাকে দেখে থমকে দাঁড়ায়। মহিলাও ওকে একবার দেখেই শান্তকে বলে, ইনি কে?
শান্ত এক গাল হেসে বলে, আমার স্ত্রী।
মহিলা মৌ-কে একবার ভাল করে দেখেই এক গাল হেসে বলে, তোমার স্ত্রী তো দারুণ সুন্দরী।
মহিলা দৃষ্টি ঘুরিয়ে শান্তকে বলে, এবার কী কলকাতা গিয়েছিলে বিয়ে করতে?
না, না; আমাদের বিয়ে হয়েছে অনেক দিন আগে।
তাহলে ওকে এতদিন এখানে আনোনি কেন?
ও পড়াশুনা করছিল।
তাই বলে স্বামীর ঘর করবে না?
মহিলা মাথা নাড়তে নাড়তে বলে, এতকাল ওকে না এনে খুব ভুল করেছ।
বাঈ, ও তো আবার কলকাতা ফিরে যাবে।
কেন? কেন?
ও তো কলেজে পড়ায়।
তুমি কী বউকে খেতে-পরতে দিতে পারবে না যে ওকে কলকাতার কলেজে চাকরি করতে হবে?
শান্ত গম্ভীর হয়ে বলে, ওর কোন ভাইবোন নেই; তাছাড়া মা-বাবার বয়স হয়েছে। তাই ও আর কিছুদিন কলকাতায় থাক; তারপর ওকে এখানে নিয়ে আসব।
এবার বাঈ মৌ-এর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শান্তর উদ্দেশে বলে এমন সুন্দরী বউকে ছেড়ে থাকো কী করে?
শান্ত একটু হেসে বলে, সত্যি বলছি, বাঈ, ওকে ছেড়ে থাকতে সত্যি খুব খারাপ লাগে। বাধ্য হয়েই ওকে কলকাতায় রেখেছি, তবে খুব বেশি দিন আর ওকে ওখানে ফেলে রাখব না।
শান্ত মৌ-এর পাশে দাঁড়িয়ে বলে, জানো বাঈ, একে কে পছন্দ করেন?
কে?
আমার মা।
মা-জী ঠিক মেয়েকেই পছন্দ করেছেন। আমি তোমার বউকে দেখেই বুঝেছি, ও খুব ভাল মেয়ে।
এবার শান্ত মৌ-কে বলে, বাঈ মা-র সময় থেকে আমাদের বাড়িতে কাজ করছে। মা ওকে সব রকম বাঙালী রান্না করতে শিখিয়েছেন।
মৌ একটু হেসে বলে, তাই নাকি?
শুধু তাই না। বাঙ্গ যেমন মশলা দোসা বানাতে পারে, সেইরকমই মিক্সড ফ্রায়েড রাইস আর চিলি চিকেনও খুব ভাল করে।
মৌ অবাক হয়ে বলে, বাঈ এত রকম রান্না জানে?
মা থাকতেই বাঈ সংসার চালায়। আলমারী থেকে টাকা নিয়ে ও বাজার-হাট করে, অন্য কাজের মেয়েটাকে খেতে দেয়, মাইনে দেয়…
এবার বাঈ মৌ-কে বলে, কী করব? মা-জীর শরীর ভাল ছিল না বলে আমাকেই সব সামলাতে হতো। তাছাড়া উনি আমাকে খুবই বিশ্বাস করতেন।
বাঈ না থেমেই বলে, মা-জী আমার ছোট মেয়ের বিয়েতে কি দিয়েছিলেন জানো?
কী দিয়েছিলেন?
নিজের একটা ভাল হার পালিশ করে আমার মেয়েকে দেন; তাছাড়া আমাকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছিলেন।
হ্যাঁ, মা ঐরকমই ছিলেন।
তোর স্বামীও কম কিছু করেনি।
ও কী করেছিল?
মেয়ের বিয়ের বেনারসী শাড়ি, ব্লাউজ, পেটিকোট আর জামাইয়ের জন্য গরদের ধুতি-কুর্তা, হাতের ঘড়ি সোনার আংটি আর কুর্তার জন্য সোনার বোতাম দিয়েছিল।
বাঈ না থেমেই একটু হেসে বলে, আমি ওকে এত করতে বারণ করেছিলাম কিন্তু ওর পাগলামীর তো নেই।
মৌ পাশে দাঁড়ানো শান্তকে একটা চিমটি কেটেই একটু হেসে বলে, এর পাগলামীর পরিচয় আমি খুব ভালভাবেই পেয়েছি।
তবে বিবিজি, তোমার স্বামী সত্যি খুব ভাল ছেলে।
বাঈ রান্নাবান্না করে চলে যাবার সময় মৌ-কে বলে, বিবিজি, টেবিলের উপর সবকিছু সাজিয়ে রেখেছি; তবে খাবার আগে একটু গরম করে নিও।
হ্যাঁ, নেব।
ভাল করে খাবে আর তোমার পাগলা স্বামীকেও ভাল করে খাওয়াবে।
মৌ হাসতে হাসতে বলে, ও খাবার আগে পাগলামী করবে না তো।
বাঈ গম্ভীর হয়ে বলে, তুমি সোজা বলে দেবে, আগে খেয়ে নাও, তারপর যা ইচ্ছে পাগলামী কোরো।
বাঈ আর দাঁড়ায় না; সেদিনের মতো চলে যায়।
শান্ত সঙ্গে সঙ্গে মৌ-কে জড়িয়ে ধরে বলে, শুনলে তো, বাঈ কী বলল?
বাঈ তো অনেক কথাই বলল।
সব শেষে বলল, খাওয়া-দাওয়ার পর যা ইচ্ছে পাগলামী করতে।
মৌ হাসতে হাসতে ওর পিঠে আলতো একটা ঘুষি মেরে বলে, যা ইচ্ছে পাগলামী করো কিন্তু আজ তুমি আমাকে টাচ্ করবে না।
টাচ্ করব না?
নো স্যার।
তাহলে তুমি আমাকে টাচ …
মাই ডিয়ার মি. সরকার, আই উইল অলসো নট টাচ্ ইউ।
শান্ত দু’হাত দিয়ে ওর মুখখানা ধরে বলে, মৌ, আজ তো আমাদের ফুলশয্যা; আজই তো প্রথম রাত যখন আমরা দু’জনে এক সঙ্গে…
মৌ হাসতে হাসতে বলে, আমাকে বাথরুমে যেতে দাও; গায় একটু জল ঢেলে আসি।
.
মৌ বাথরুম থেকে বেরিয়ে পোশাক বদলে চুল আঁচড়ে ফেস টাওয়েল দিয়ে আরেকবার মুখ পরিষ্কার করে। তারপর ড্রেসিং টেবিলের বিরাট আয়নার সামনে একটু ঘুরে-ফিরে নিজেকে দেখতে দেখতে একটু হাসে।
মৌ এ ঘরে-ও ঘরে উঁকি দিয়ে শান্তকে দেখতে না পেয়ে এদিক-ওদিক তাকাতেই দেখে, ও বারান্দায় বসে আছে। একটু কাছে যেতেই বুঝতে পারে, শান্ত স্নান করার পর পায়জামা-পাঞ্জাবি পরেছে।
মৌ ওর পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই শান্ত বলে, সন্ধের পর আলো জ্বললে মেরিন ড্রাইভ দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়, তাই না?
শান্তর একটা হাত দু’হাত দিয়ে চেপে ধরে বলে, সত্যি অপূর্ব।
আমাদের দেশে সমুদ্রের ধারে তো কত শহরই রয়েছে কিন্তু আর কোথাও এই অপরূপ দৃশ্য দেখা যাবে না।
.
আরব সাগরের কোল ঘেষে ধনুকের মতো বেঁকে গিয়েছে মেরিন ড্রাইভ; অন্যদিকে বাড়ির পর বাড়ি। রাস্তাঘাট ঘরবাড়ি সবই আলোয় আলো। ’গোল্ডেন নেকলেস’ একেই বলে।
শুধু কী তাই?
সামনে আরব সাগরের অসংখ্য লঞ্চ আর নৌকায় আলো জ্বলে উঠেছে বলে যেন মনে হয়, অসংখ্য পুণ্যার্থী জলে ভাসিয়েছেন অসংখ্য প্রদীপ।
এই পরিবেশে ভাল লাগা, ভালবাসা জন্ম নেবেই। তাই তো সব বয়সেরই নারী-পুরুষ হাত ধরাধরি করে হাঁটছেন মেরিন ড্রাইভের ফুটপাথ ধরে।
এইসব দেখতে দেখতে মৌ যেন নিজেকে নিজের মধ্যে হারিয়ে ফেলে; খেয়ালই করেনি, কখন সে শান্তদার কোলে বসে দু হাত দিয়ে ওর গলা জড়িয়ে ধরে মুখের পর মুখ রেখেছে।
এই অনন্ত রহস্যময় পৃথিবীর কোন কোন পরিবেশে মানুষের মন সঙ্কুচিত হয়, আবার কোন কোন বিশেষ পরিবেশে মানুষ নিজেকে বিলিয়ে না দিয়ে তৃপ্তি পায় না। ঘটনাচক্রে আজ সেই বিশেষ পরিবেশের সোনাঝরা মুহূর্ত, যখন এই প্রাচীন পৃথিবীর নবীন দুই যাত্রী নিজেদের বিলিয়ে দেবার নেশায় উন্মাদ হয়ে ওঠে। তারপর? একটা বিচিত্র পূর্ণতার স্বাদে শান্ত আর মৌ-এর মন ভরে ওঠে।
.
পরদিন অফিসে গিয়ে শান্ত ডাইরেক্টর মি. পাতিলকে বলে, স্যার, আমার একটা প্রস্তাব আছে।
ইয়েস টেল মী।
স্যার, আমি চাইছি, ডিস্ট্রিবিউটর-এজেন্টদের প্রতিনিয়ত চাপে রাখার জন্য একজন পার্টটাইম প্রোমেশন অফিসার রাখতে।
নট এ ব্যাড আইডিয়া কিন্তু এই অফিসারের মাইনে কত দিতে হবে? স্যার, আমরা ওকে মাইনে দেব না; শুধু ফিক্সড অ্যালাউন্স দেব আর ঘুরাঘুরির খরচ দেওয়া হবে।
কত অ্যালাউন্স দিতে চাও?
স্যার, প্রথম বছরের জন্য পনের হাজার টাকা; তারপর ওর কাজ দেখে পরের বছর কিছু বাড়িয়ে দেবেন।
এই কাজের জন্য কোন ছেলে বা মেয়েকে তোমার পছন্দ হয়েছে?
হ্যাঁ, স্যার, সদ্য এম.এ পাস একটা মেয়েকে পছন্দ হয়েছে।
ও কোন এরিয়া দেখাশুনা করবে?
স্যার, গ্রেটার ক্যালকাটা; ফ্রম কল্যাণী টু ঠাকুরপুকুর।
এই মেয়েটি কাজ শুরু করলে তুমি ক্যালকাটা যাওয়া কমিয়ে দেবে না তো?
শান্ত একটু হেসে বলে, না, স্যার, আমাকে তো প্রত্যেক মাসেই দু’ এক সপ্তাহের জন্য ওদিকে যেতে হবে।
তাহলে ঠিক আছে।
স্যার, আপনি কী মেয়েটির ইন্টারভিউ নিতে চান?
আমি কী পার্ট-টাইমারের ইন্টারভিউ নিতে পারি?
মি. পাতিল মুহূর্তের জন্য না থেমেই বলেন, মেয়েটি যখন তোমার আন্ডারে কাজ করবে, তুমিই ওকে ডেকে পাঠাও, দু’ এক সপ্তাহ ওকে ব্রীফ করো, তারপর ওকে নিয়ে কলকাতায় গিয়ে এজেন্ট-ডিস্ট্রিবিউটরদের সঙ্গে পরিচয় করাবার পর ওকে বলে দাও, কীভাবে কাজ করবে—দ্যাটস্ অল।
স্যার, আপনি কী মি. ডি কস্টাকে বৃলেঞ্জবেন, মেয়েটিকে পার্ট-টাইমার হিসেবে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার দিতে?
তুমি ওকে একটা নোট দাও যে আমার সঙ্গে আলোচনা করে সবকিছু ঠিক হয়েছে। আর হ্যাঁ, মেয়েটির সিকিউরিটির কথা ভেবে ও যেন সব সময় আমাদের ট্রান্সপোর্ট অপারেটরের গাড়িতে যাতায়াত করে; মেয়েটির সই করা পেপার্স পাঠালেই অপারেটরকে এখান থেকে চেক পাঠিয়ে দেবে।
স্যার, আর একটা কথা।
হ্যাঁ, বল।
মেয়েটিকে কী ট্রেনে আসতে বলব?
নেভার! একটা মেয়েকে একলা দু’তিন দিন ধরে ট্রেনে আসতে বলা যায়? ওকে আসা-যাওয়ার প্লেন ভাড়া দেবে আর আমাদের জুনিয়ার অফিসারদের রেটে ডেলি অ্যালাউন্স আর ডেলি দু’শ টাকা করে ট্রান্সপোর্ট…
স্যার, অশেষ ধন্যবাদ।
.
অফিসের পর শান্ত বাড়ি ফিরতেই মৌ এগিয়ে আসে।
শান্ত হাসতে হাসতে বলে, বল সুন্দরী, কোন পাড়ে ভিড়াব তোমার সোনার তরী?
মৌ হাসতে হাসতে বলে, কী হল? এত খোস মেজাজে?
আগে আমার ওষ্ঠে তোমার ওষ্ঠের বিষ ঢেলে দাও, তার সঙ্গে সঙ্গেই তুমি হাতে একটা বিশেষ কিছু পাবে।
আগে হাতে কিছু পাই, তারপর পুরস্কারের কথা চিন্তা করব।
ঠিক হ্যায় মেমসাহাব! লিজিয়ে নাম্বার ওয়ান।
শান্ত সঙ্গে সঙ্গে ওর হাতে অ্যাপয়েন্ট লেটার তুলে দেয়।
চিঠিটার উপর দিয়ে চোখ বুলিয়েই মৌ খুশিতে চিৎকার করে ওঠে, ও মাই গড! তুমি তো দারুণ লোক।
মেমসাহাব, তোমার প্লেনে আসা-যাওয়ার খরচ এগার হাজার টাকা।
কী হচ্ছে কি?
মেমসাহাব, আমাদের কোম্পানীর নিয়ন্ট অনুযায়ী এখানে পনের দিন থাকার খরচ–দিন প্রতি পাঁচ শ’ পঁচাত্তর হিসেবে আটহাজার ছ’শ পঁচিশ টাকা।
শান্তদা, তুমি কী গৌরী সেনের কোম্পানীতে চাকরি করো?
মেমসাহাব, দৈনিক দুশ’ টাকা হিসেবে পনের দিন অফিস যাতায়াতের খরচ এই তিন হাজার।
শান্ত একটু হেসে বলে, ব্যস, দ্যাটস্ অল।
কী ব্যাপার বল তো? রাম না জন্মাতেই রামায়ণ?
মৌ না থেমেই বলে, কাজে যোগ দেবার আগেই তোমাদের কোম্পানী আমাকে এত টাকা দিল কেন?
ওহে সুন্দরী, ভুলে যেও না, ভারতের অন্যতম বিখ্যাত কোম্পানীর একজন হতে চলেছ তুমি; কোম্পানীর নিয়ম অনুসারেই তোমাকে টাকা দিয়েছে।
সত্যি অবাক হচ্ছি।
দু এক মিনিট চুপ করে থাকার পর মৌ এগার হাজার টাকা ওর হাতে দিয়ে বলে, তুমিই আমাকে প্লেনে এনেছ, আবার তুমিই আমাকে নিয়ে যাবে; এই টাকাটা তোমার।
এখন তুই টাকাটা রেখে দে; পরে নেব।
.
তিন দিন পরের কথা।
মৌ শান্তর সঙ্গে ওদের অফিসে পা দিয়েই অবাক। এত সুন্দর, এত ঝকঝকে; তাছাড়া প্রত্যেক কোনে সবুজের সমারোহ। দেয়ালে অপূর্ব পেন্টিং। সিকিউরিটি গার্ড, দ্বাররক্ষকদের স্যালুট। লিফট-এরূধ্যে সরোদের মৃদু আওয়াজ।
বারো তলায় লিফট্ থামল।
শান্তর পিছন পিছন মৌ ওর ঘরে পা দিয়েই বলে লাভলি!
সামনেই আরব সাগর আর সীমাহীন আকাশ। ওদিকে পিছন ফিরেই শান্ত বসে তার গদীওয়ালা বিরাট চেয়ারে। সামনে বিরাট টেবিল। একদিকে চার রঙের চারটে টেলিফোন। অন্যদিকে কমপিউটার। ঘরের এক কোনে ভারি সুন্দর কাঁচের গণেশ মূর্তি।
শান্ত চেয়ারে বসতে না বসতেই একজন বয়স্কা মহিলা ঘরে ঢুকেই একটু হেসে বলেন, স্যার, গুড মর্নিং!
ইয়েস দিদি, মর্নিং!
শান্ত সঙ্গে সঙ্গেই মৌ-কে দেখিয়ে ওকে বলেন, দিদি, দিস ইজ মহুয়া চৌধুরী…
নমস্কার! নমস্কার!
দু’জনের নমস্কার বিনিময়ের পর শান্ত বলেন, মহুয়া, দিদি হচ্ছেন মিসেস যশোদা যোশী, আমার সেক্রেটারী।
মিসেস যোশী হাসতে হাসতে মৌ-কে সুন্দর বাংলায় বলেন, স্যার ভারি বিচিত্র মানুষ। অফিসের সব সিনিয়র অফিসারদের সেক্রেটারীরা ইয়াং স্মার্ট সুন্দরী মেয়েরা কিন্তু ওদের কাউকে না রেখে…
মৌ এক গাল হেসে বলে, আপনি এত সুন্দর বাংলা শিখলেন কী করে? আমার বাবা রেলের অফিসার হিসেবে অনেক দিন কলকাতায় ছিলেন; আমি নব নালন্দা থেকে হায়ার সেকেন্ডারী পাস করেছি।
বুঝেছি।
আমি স্যারের সামান্য সেক্রেটারী কিন্তু উনি আমাকে দিদি বলেন বলে আমি খুব অস্বস্তিবোধ করি।
আপনি দিদির মতো বলেই উনি দিদি বলেন।
মৌ না থেমেই বলে, তাছাড়া আপনি কখনই সামান্য সেক্রেটারী না; সেক্রেটারীদের সাহায্য ছাড়া কী কোন অফিসার ঠিক ভাবে কাজ করতে পারবেন?
এবার শান্ত বলেন, দিদি, মহুয়ার ব্যাপারটা আপনি জানেন?
হ্যাঁ, স্যার, জানি কিন্তু আমার একটা প্রশ্ন আছে।
কী প্রশ্ন?
যে মেয়ে ইকনমিক্স নিয়ে এম.এ পাস করেছে তা সরাসরি অফিসার না করে কেন…
শান্ত একটু হেসে বলেন, বুঝেছি।
এক নিশ্বাসেই উনি বলেন, আপনি তো জানেন, আমাদের কোম্পানীতে অফিসার নিয়োগের ব্যাপারে কত রকমের নিয়ম-কানুন; তারপর ছ’মাসের ট্রেনিং। তাই…
হ্যাঁ, স্যার, বুঝেছি।
দিদি, আমি মহুয়াকে একবার মি. পাতিলের কাছে নিয়ে যেতে চাই; প্লীজ দেখুন তো উনি ফ্রী আছেন কি না।
হ্যাঁ, স্যার, দেখছি।
মিসেস যোশী নিজের ঘরে যান কিন্তু তিন-চার মিনিট পরই ফিরে এসে বলেন, হ্যাঁ, স্যার, আপনি এখনই যেতে পারেন।
.
শান্ত মহুয়াকে নিয়ে ডাইরেক্টর সাহেবের ঘরে ঢুকতেই মি. পাতিল এক গাল হেসে বলেন, শান্ত, সো দিস ইজ ইওর মহুয়া?
ইয়েস স্যার।
মি. পাতিল ওদের দুজনকেই বলেন, প্লীজ বসুন।
ওরা সামনের চেয়ারে বসতেই মি. পাতিল বলেন, মহুয়া, টেল মী ওয়ান থিং; আপনি কলেজের লেকচারার না হয়ে আমাদের কোম্পানীর কাজ করবেন কেন?
স্যার, একই সিলেবাস মতো বছরের পর বছর পড়াবার চাইতে একটু চালেনজিং কাজ করতে চাই।
রিয়েলী?
ইয়েস স্যার, আই মীন ইট।
ভবিষ্যত সম্পর্কে কিছু ভেবেছেন?
মৌ এক গাল হেসে বলে, স্যার, ইফ অল ইজ ওয়েল, তাহলে কোন কোম্পানীর ইকনমিক প্ল্যানিং বা ইকনমিক সার্ভে সম্পর্কে কাজ করতে চাই।
ইকনমিক প্ল্যানিং বা সার্ভের ব্যাপারে কী বলতে চান?
স্যার, যাস্ট একটা উদাহরণ দিচ্ছি।
হ্যাঁ, বলুন।
আমাদের দেশে এমন শহর আছে, যেখানে সব চাইতে কম দামী আইসক্রীম বিক্রি হয় নব্বই টাকায়, প্রত্যেকটি বাড়ির কাজের মেয়ের মোবাইল ফোন আছে আর লাখ দুয়েক টাকা সেলামী ছাড়া পঁচিশ হাজার টাকার কমে অত্যন্ত সাধারণ এলাকায় দু’ঘরের বাড়ি ভাড়া পাওয়া যায় না, সেখানে কী এক টাকা বা দু টাকা দামের শ্যাম্পুর পাউচ বিক্রি করার প্ল্যান করা উচিত?
লাভলি।
মি. পাতিল সঙ্গে সঙ্গে একটু হেসে বললেন, শান্ত, আপনি সত্যি একটা ভাল মেয়েকে সিলেক্ট করেছেন। এই মেয়েকে আমরা কখনই মাসে মাসে মাত্র পনের হাজার দিতে পারি না; উই মাস্ট পে হার অ্যাটলিস্ট টোয়েন্টি ফাঁইভ থাউজ্যান্ড…
মৌ সঙ্গে সঙ্গে বলে, স্যার, প্লীজ আগে দেখুন আমি কাজ করতে পারি কিনা; তারপর না হয়..
ওকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই মি. পাতিল বলেন, আজ আমি বলে দিচ্ছি, ভবিষ্যতে আপনি হয়তো আমাদের কোম্পানীর ডাইরেক্টর হবেন।
.
বাড়ির দরজা খুলে ভিতরে ঢুকেই শান্ত মৌ-কে কোলে তুলে নিয়ে দু’চার পাক চক্কর দিয়েই দু’হাত দিয়ে ওকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে দীর্ঘ চুম্বন দেয়।
মৌ শুধু হাসে।
তোর কথা শুনে মি. পাতিল প্রায় হিপনোটাইজড হয়েছিলেন।
মৌ দু’হাত দিয়ে ওর গলা জড়িয়ে ধরে মুখের সামনে মুখ নিয়ে বলে, সবই তো তোমার জন্য; দেখছি, তুমি আমার পরশ পাথর। তোমার ছোঁয়াতেই সব সোনা হয়ে যাচ্ছে।
আসলে তুই হচ্ছিস, সোনার টুকরো মেয়ে; এবার থেকে তুই শুধু এগিয়ে যাবি।
তুমি কী জ্যোতিষ যে এই কথা বলছ?
জ্যোতিষ কেন হব? তুই দেখিস, আমার কথা বর্ণে বর্ণে ফলতে বাধ্য।
মৌ ওর দুটো হাত ধরে বলে, শান্তদা, আমি তোমার পিছনে থাকতে পারলেই সুখী হব।
একটু পরই ব্যাগ ভর্তি জিনিসপত্র নিয়ে বাঈ আসতেই মৌ জিজ্ঞেস করে, ব্যাগে কী আছে?
তোমাদের সংসারের জিনিসপত্র নিয়ে এলাম।
শান্ত সঙ্গে সঙ্গে বলে, বাঈ, ভুলে যেও না, আমার মা এই সংসারের ভার তোমার হাতে তুলে দিয়েছেন; এই সংসার তোমার।
এখন তোমার বউ এসেছে; এখন এই সংসার সে চালাবে।
মৌ বলে, বাঈ, আমি কখনই সংসার চালাতে পারব না; তুমি যেমন সংসার চালাচ্ছো সেইরকমই চালাবে।
আমার বয়স হচ্ছে না?
তুমি এখনো একশ’ বছর বাঁচবে।
কথাটা বলেই শান্ত হো হো করে হেসে ওঠে।
বাঈ একটু হেসে মৌ-কে বলে, বউ, এবার তোমার স্বামী আমার হাতে মার খাবে।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, বাঈ, তুমি সত্যি ওকে মারো তো; ওকে শাসন করা খুবই দরকার।
বাঈ আর কথা না বাড়িয়ে হাসতে হাসতে কিচেনের দিকে যায়।
মৌ আর শান্তও ওদের ঘরের দিকে যায়।
তারপর ওরা বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পোশাক বদলে ঘর থেকে বেরুতেই বাঈ বলে, তোমাদের খেতে দিয়েছি; গরম গরম খেয়ে নাও।
কী খেতে দিয়েছ?
বউ, তোমার স্বামী একই খাবার পর পর দুদিন খায় না; সাহেবের সবকিছু নিত্য নতুন চাই। তাই তো আজ দিয়েছি মোগলাই পরোটা।
মৌ হাসতে হাসতে বলে, ও আবার আমাকে বাতিল করে নতুন বউ আনবে না তো?
ও বহু ভাগ্য করে তোমার মতো বউ পেয়েছে, দেখব তো ওর কত বড় সাহস, তোমার বদলে নতুন বউ আনে।
.
ঘণ্টা বারো ডিউটি করে ক্লান্ত অবসন্ন অর্কদের বিশ্রাম করতে গিয়েছেন অনেক আগেই। আরব সাগরের আকাশে শুক্লা পঞ্চমীর এক টুকরো চাঁদ। চির চঞ্চলা মেরিন ড্রাইভ যেন পরমা সুন্দরী বাঈজীর মতো ঘাঘরা-চোলি
পরে গলায় এক গোছ মুক্তোর মালা জড়িয়ে নাচতে শুরু করেছে।
মেরিন ড্রাইভ সত্যি যেন মায়াবিনী উর্বশী-রম্ভা।
শান্তর কাঁধে মাথা রেখে মৌ বলে, তোমাদের এই মেরিন ড্রাইভে কি যেন রহস্য আছে; মনের মধ্যে কেমন যেন নেশা ধরে যায়।
হ্যাঁ, সত্যি বড় রোমান্টিক পরিবেশ; তাছাড়া এই সময় বারান্দায় বসে চারদিক দেখতে দেখতে সমস্ত পৃথিবীকেই ভালবাসতে ইচ্ছে করে।
হ্যাঁ, শান্তদা, ঠিক বলেছ।
.
দু’ এক মিনিট চুপ করে থাকার পর শান্ত আলতো করে মৌ-কে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে বলে, মা যখন বেশ অসুস্থ, তখনও এইরকম সন্ধের পর আমি মাকে বারান্দায় বসিয়ে বলতাম, মা, চারপাশ তাকিয়ে দেখো, পৃথিবী কি সুন্দর।…
ক্ষীণ কণ্ঠে মনিকা দেবী বলেন, হ্যাঁ, বাবা, সত্যি খুব সুন্দর।
মা, আমাদের সবার সৌভাগ্য যে আমরা এই সুন্দর পৃথিবীতে জন্মেছি, তাই না?
উনি শুধু একটু মাথা নাড়েন।
মা, আমরা সবাই অনেক অনেক দিন এই পৃথিবীতে থাকব, ভালভাবে থাকব, তাই না?
আবার সেই ক্ষীণ কণ্ঠে উনি বলেন, হ্যাঁ, সবাই ভাল থাকুক।
তুমিও ভাল থাকবে?
মনিকা দেবী খুব আস্তে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, আমার তো উপর থেকে ডাক এসে গেছে…
.
জানিস মৌ, ঠিক পরের দিনই মা চলে গেলেন।
কথাটা বলেই শান্ত কেঁদে ওঠে।
মৌ ওকে দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলে, কত ছোট ছোট বাচ্চারাও তো মা-কে হারায়; তোমার ভাগ্য ভাল বলে এত বছর ধরে মায়ের আদর ভালবাসা পেয়েছ। তাছাড়া কারুর মা-বাবাই তো চিরকাল বেঁচে থাকেন না।
শান্ত কোন কথা বলে না।
মৌ আবার বলে, তুমি কী জানো না, আমরা কেউই অমর না; আমাদের সবাইকেই একদিন চলে যেতে হবে।
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর শান্ত বলে, মা চলে যাবার পর এই ফ্ল্যাটে আমি কিছুতেই একলা থাকতে পারছিলাম না। রাতের পর রাত আমি পায়চারি করে কাটিয়েছি।
ও না থেমেই মৌ-এর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, তারপর কী করলাম জানিস?
কী করলে?
রোজ ড্রিঙ্ক করা শুরু করলাম।…
তুমি ড্রিঙ্ক করো?
শুধু অফিসের পার্টিতে করি; তাছাড়া কদাচিৎ কখনও…
মা মারা যাবার পর তুমি একলা একলাই ড্রিঙ্ক করতে?
হ্যাঁ। তারপর শান্ত মৃদু হসে বলে, আকণ্ঠ হুইস্কী গিলে নেশার ঘোরে বিছানায় লুটিয়ে পড়তাম।
তখন কলকাতায় আমাদের কাছে আসার কথা মনে হয়নি?
বার বার মনে হয়েছে, ভাল মা-র কাছে ছুটে যাই কিন্তু ঠিক তখনই আমাকে ক’মাসের জন্য চিফ মার্কেটিং ম্যানেজারের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হল বলে…
বুঝেছি।
কথায় কথায় রাত হয়। তারপর খেয়েদেয়ে ওরা শুতে যায়। মৌ ওকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে শান্তও শান্তিতে ঘুমুতে দেরি করে না।
.
দুটো সপ্তাহ দেখতে দেখতে কেটে গেল।
সাত সকালে ঘুম থেকে ওঠা, তারপর দু’এক কাপ চা খেতে খেতে টাইমস অব ইন্ডিয়ার পাতাগুলো একটু উল্টে দেখা…হাতের ঘড়িতে পৌনে আটটা দেখেই চল বাথরুম। প্রথম পাঁচ-দশ মিনিট শাওয়ারের তলায়, তারপর ভালভাবে সাবান মাখা…
বাথরুম থেকে বেরিয়ে ড্রেসিং টেবিলের লম্বা আয়নায় নিজেকে দেখতে দেখতে সাজগোজ, চুল আঁচড়ানো, আলতো করে খোঁপা বাঁধা।
ততক্ষণে শান্তও টাইয়ের নট বাঁধতে বাঁধতে ডাইনিং টেবিলে হাজির; পাশের চেয়ারে বসে মৌ। বাঈ ব্রেকফাস্ট দেয়।
তারপর আবার মৌ ড্রেসিং টেবিলের লম্বা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আঁচল ঠিক করে, ফেস টাওয়েল দিয়ে মুখ পরিষ্কার করার পর ন্যাচারাল কালারের লিপস্টিক বুলিয়ে নেয় ঠোঁটে।
মৌ, আয়াম রেডি।
সো অ্যাম আই।
এর পর অফিস।
শান্ত ওর চেম্বারে যায়, মৌ যায় ট্রেনিং অ্যান্ড ব্রিফিং রুমে।
দিনের শেষে আবার মেরিন ড্রাইভের ফ্ল্যাটে।
সন্ধের পর ব্যালকনিতে দু’জনে পাশাপাশি বসে আরব সাগর আর মেরিন ড্রাইভের মায়াবী পরিবেশে কত মনের কথা বলে।
রাত আরো গম্ভীর হয়।
দু’জনে দু’জনের নিবিড় সান্নিধ্যে চির রহস্যময় আনন্দ-সাগরে ভেসে যায়।
.
০৮.
শান্ত মৌ-কে নিয়ে কলকাতা আসে কিন্তু একটা রাতও এখানে কাটায় না। ভাল কাকা ভাল মা-র সঙ্গে দু’এক ঘণ্টা কথাবার্তা বলেই আবার এয়ারপোর্ট যায় গুয়াহাটির প্লেন ধরতে।
শান্ত রওনা হবার আগে মৌ জিজ্ঞেস করে, তুমি কী বোম্বে ফেরার পথে দু একদিন এখানে থাকবে?
ঠিক বলতে পারছি না। আমাকে নর্থ ইস্টের সাতটা রাজ্যেই যেতে হবে। যদি চট পট কাজকর্ম শেষ হয়, তাহলে হয়তো এখানে এক-আধদিন কাটাতে পারি; তা না হলে গুয়াহাটি থেকে সোজা বোম্বে যেতে হবে।
শান্ত প্রায় না থেমেই বলে, তুই সোমবার থেকে কাজকর্ম শুরু করে দে; দিদি খুব রেগুলারলি তোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে।
হ্যাঁ, দিদি বলেছেন।
মৌ সারাদিন ধরে মা-বাবাকে বোম্বের গল্প করে; বিশেষ করে ‘দিদি’ আর ‘বাঈ’-এর কথা শুনে ওরা খুব খুশি হন।
জানো মা, তোমরা ভাবতে পারবে না, মেরিন ড্রাইভের উপর শান্তদার ফ্ল্যাটটা কি সুন্দর আর কত বড়।
তাই নাকি?
হ্যাঁ মা; তিনটে বিরাট বিরাট বেডরুম ছাড়াও একটা ভারি সুন্দর গেস্টরুম। প্রত্যেক ঘরের সঙ্গে ব্যালকনি; ওখানে বসে মেরিন ড্রাইভ আর আরব সাগর দেখতে কি ভাল লাগে, আর কি বলব।
তাই নাকি?
ও মা, তুমি যদি সন্ধের পর ঐ ব্যালকনিতে বসো, তাহলে একদিকে ধনুকের মতো বেঁকে যাওয়া মেরিন ড্রাইভের আলো আর সামনের দিকে তাকালে দেখবে, আকাশে এক টুকরো চাঁদ আর এক ঝাঁক তারা, নীচে আরব সাগরের কালো জলে অসংখ্য ছোট-বড় প্রদীপের ভেসে যাওয়া দেখে তুমি মুগ্ধ হতে বাধ্য।
কারা ছোট বড় প্রদীপের আলো সমুদ্রে ভাসিয়ে দেয়?
মৌ হাসতে হাসতে বলে, আসলে ওগুলো ছোট-বড় লঞ্চের আর নৌকার আলো কিন্তু দূর থেকে মনে হবে…
অনুপমা দেবী এক গাল হেসে বলেন, বুঝেছি।
উনি সঙ্গে সঙ্গে বলেন, তাহলে তুই ভালই ছিলি?
হ্যাঁ, মা, সত্যি খুব ভাল ছিলাম।
এতক্ষণ চুপ করে থাকার পর বিমলবাবু বলেন, শান্ত তো আমাদেরও ছেলে; সে তো মৌ-কে ভাল রাখবেই।
.
সোমবার।
ঠিক ন’টায় ট্রান্সপোর্ট এজেন্টের গাড়ি আসে। মৌ বেরুবার আগে মা-বাবাকে প্রণাম করতেই অনুপমা দেবী বলেন, তুই কখন ফিরবি?
আশা করছি, দেড়টা-দুটোর মধ্যেই ফিরে আসব।
তাহলে তুই এলেই আমি খাব।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমরা এক সঙ্গেই খাব।
শুরু হয় মৌ-এর কর্মজীবন।
কোন খবর না দিয়েই মৌ হাজির হয় নন্দলাল জালানের অফিসে।
কোম্পানীর অফিসারের এমন অপ্রত্যাশিত আগমনে মি. জালান কয়েক মুহূর্তের জন্য একটু ঘাবড়ে গেলেও সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলে নিয়ে এক গাল হেসে দু হাত জোড় করে বলেন, কি সৌভাগ্য! অফিস খুলতে না খুলতেই আপনার দর্শন লাভ…বসুন, ম্যাডাম বসুন।
মৌ সামনের চেয়ারে বসেই একটু হেসে বলে, কেমন আছেন?
ম্যাডাম, আপনাদের কৃপায় ভালই আছি।
ব্যবসার খবর?
ঠিকই আছে।
ঠিকই আছে মানে? বিক্রি বেড়েছে, নাকি কমেছে?
ম্যাডাম বাজার কখনই এক রকম থাকে না; কখনও একটু বাড়বে, কখনও আবার একটু কমবে–এভাবেই তো বাজার চলে।
স্যাটারডে ক্লোজিং-য়ের রিপোর্ট দেখি।
ম্যাডাম, পুরো রিপোর্ট এখনও তৈরি হয়নি।
কেন? চার-পাঁচটা সেন্টার থেকে রিপোর্ট আসেনি।
মৌ বেশ বিরক্ত হয়ে বলে, আপনি তো ভাল করেই আমাদের কোম্পানীর নিয়ম-কানুন জানেন..
হ্যাঁ, ম্যাডাম, খুব ভাল করেই জানি।
কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করবেন অথচ ঠিক মতো রিপোর্ট তৈরি করবেন না, তা চলবে না।
মৌ সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, আজকের মধ্যেই রিপোর্ট…
হ্যাঁ, হ্যাঁ, ম্যাডাম, আজই রিপোর্ট রেডি হয়ে যাবে।
হলেই ভাল; তা না হলে তো পরের সপ্তাহে সাপ্লাই আটকে যেতে পারে। আচ্ছা নমস্কার।
কথাটা শুনেই মি. জালানের মুখ শুকিয়ে যায়; তবু বলেন, নমস্কার!
বেশি না, তিনজন ডিস্ট্রিবিউটার আর এজেন্টদের কাছে যেতেই দিকে দিকে বার্তা রটে গেল ক্রমে।
.
জানেন পাইনদাদা, নতুন ম্যাডাম বড় কড়া অফিসার আছেন। কাজের কথা ছাড়া একটাও অন্য কথা বলেন না। তাছাড়া ঠিক মতো রিপোর্ট না পেলেই পরের সপ্তাহে সাপ্লাই বন্ধ হতে পারে বলেন।
বলেন কী? এই মহিলাকে তো ঠাণ্ডা করার দরকার।
কি যে বলেন দাদা? উনি এক কাপ চা-কফি পর্যন্ত খান না; অন্য কিছু করতে গেলে হয়তো আমরা ব্ল্যাক লিস্টেড হব।
তাহলে তো সত্যি চিন্তার ব্যাপার।
দেখছি, রিপোর্ট তৈরির জন্য একটা আলাদা লোক রাখতেই হবে।
তাহলে আমিও রিপোর্ট তৈরির জন্য একটা লোক রাখি, কি বলেন?
মি. জালান একটু হেসে বলেন, আমরা যখন বছরে প্রায় কোটি টাকা প্রফিট করি, তখন একটা নতুন লোক রাখার জন্য বছরে অন্তত ছত্রিশ হাজার খরচ করতে আপত্তি কী?
না, না, আপত্তির কিছু নেই।
বেশি দিন না, মাস খানেকের মধ্যেই কোম্পানী বুঝতে পারলো, গ্রেটার ক্যালকাটা এরিয়ায় বিক্রি বাড়ছে। শান্তও টেলিফোন করে জানালো, মৌ, তুই জয়েন করার পর থেকেই বিক্রি বাড়ছে বলে মি. পাতিল খুব খুশি।
.
মৌ চাকরি পাওয়ায় সংসারের চেহারাও বদলে গেল। যে রাধা মাসি বরাবর আনাজ কাটা আর রাত্রে খাবার জন্য রুটি-তরকারি করতো, সে এখন দিনেও রান্না করে। মেয়ের তাগিদেই বিমলবাবু আর অনুপমা দেবী রোজ বিকেলে সাদার্ন এভিন্যুতে বেড়াতে যান। হাজার হোক সারাজীবন অধ্যাপনা করেছেন বলে বিমলবাবু বরাবরই পড়াশুনা করে সময় কাটান। মাসে দু’বার গোলপার্কের রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউটের লাইব্রেরী থেকে তিনটে করে বই আনেন পড়ার জন্য। আগে সংসারের কাজকর্মের জন্য অনুপমা দেবী শুধু খবরের কাগজ পড়তেন; অন্য বইটই পড়ার সময় পেতেন না। এখন তার অনেক সময়, তাইতো আবার আশাপূর্ণা দেবীর ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’ পড়া শুরু করেছেন।
শুধু তাই না।
কত আমন্ত্রণ-নিমন্ত্রণ আসে বিমলবাবুর কাছে; কখনও কোন পুরনো সহকর্মীর নাতি-নাতনীর বিয়ে, আবার কখনো প্রিয় ছাত্র-ছাত্রীদের ছেলে-মেয়ের বিয়ে। আমন্ত্রণ আসে অন্যান্য কারণেও; কখনো কারুর গৃহপ্রবেশ বা বিয়ের পঁচিশ-পঞ্চাশ বছর উপলক্ষে। এইসব ধারে-কাছে হলে সস্ত্রীক বিমলবাবু সেই সব নিমন্ত্রণ রক্ষা করলেও একটু দূরে হলেই অক্ষমতা জানাতেন।
এখন?
মৌ গাড়ির ব্যবস্থা করে বলে পুরনো দিনের প্রিয় ছাত্রী শীলার মেয়ের বিয়েতে নৈহাটি যেতেও দ্বিধা করলেন না বা পুরনো সহকর্মী দ্বিজেনবাবুর নাতির পৈতে উপলক্ষে শ্রীরামপুর ঘুরে এলেন।
এইভাবেই কেটে গেল তিনটে মাস।
.
দিন পনের পরের কথা; হঠাৎ মিসেস যোশীর ফোন।
মহুয়া, আমি মিসেস যোশী বলছি।
মৌ একটু হেসে বলে, হ্যাঁ, হ্যাঁ বলুন।
পাতিল সাহেব আপনাকে এই সপ্তাহের মধ্যেই দেখা করতে বলেছেন।
উনি হঠাৎ দেখা করতে বলছেন কেন?
তা আমি জানব কেমন করে।
মিসেস যোশী মুহূর্তের জন্য থেমেই বলেন, স্যার হয়তো জানেন, কেন পাতিল সাহেব আপনাকে দেখা করতে বলেছেন; আপনি স্যারের সঙ্গে কথা বলবেন?
হ্যাঁ, দিন।…
শান্ত রিসিভার তুলেই বলে, বল, মৌ, কী খবর?
দিদি বললেন, পাতিল সাহেব আমাকে এই সপ্তাহেই দেখা করতে বলেছেন।
হ্যাঁ, দিদি ঠিকই বলেছেন।
কিন্তু কেন?
তা বলতে পারব না, তবে এইটুকু বলতে পারি, উনি তোর কাজে খুবই সন্তুষ্ট।
মৌ একটু থেমেই বলে, ওখানে ক’দিন থাকতে হবে, তা কী উনি বলেছেন?
আমাকে উনি শুধু বলেছেন, তোকে খবর দিতে আর বলেছেন, কয়েক দিন সময় হাতে নিয়ে আসতে।
শান্ত সঙ্গে সঙ্গে বলে, তুই কবে আসতে পারবি?
বুধবারের আগে পারব না।
আমি কী পাতিল সাহেবকে বলব, তুই বুধবার আসবি?
হ্যাঁ, বলতে পারো।
তুই কোন ফ্লাইটে আসছিস জানলে আমি এয়ার পোর্টে তোকে রিসিভ করব।
আমি কালকেই তোমাকে জানিয়ে দেব।
ঠিক আছে।
.
শান্তর সঙ্গে ওকে ঘরে ঢুকতে দেখেই মি. পাতিল এক গাল হেসে বলেন, ইয়েস মিস চৌধুরী, ওয়েলকাম টু আওয়ার হেড অফিস।
মৌ না হেসে পারে না।
বসুন, বসুন।
ওরা দু’জনে সামনের চেয়ারে বসতেই মি. পাতিল বলেন, মিস চৌধুরী, আগে বলুন, কেমন আছেন।
স্যার, ভাল আছি।
আমাদের কাজ করতে কেমন লাগছে?
স্যার, বেশ ইন্টারেস্টিং লাগছে।
দ্যাটস্ ভেরি গুড।
মি. পাতিল একটু থেমেই হাত দিয়ে শান্তকে দেখিয়ে বলেন, মি. সরকার ইস্টার্ন রিজিয়নের গত মাসের যে রিপোর্ট আমাকে দিয়েছেন, তা দেখে বুঝলাম, আপনার এরিয়ায় ভালই সেলস্ বেড়েছে।
হ্যাঁ, স্যার, একটু বেড়েছে।
মি. পাতিল একটু হেসে বলেন, আপনি যাকে একটু বেড়েছে বলছেন, আমাদের কাছে তা ভেরি পজিটিভ সাইন।
উনি একবার নিশ্বাস নিয়েই বলেন, আমরা চাই, আপনাকে আরো একটু দায়িত্ব দিতে।
স্যার, যদি পরিষ্কার করে বলেন, তাহলে ভাল হয়।
আমরা চাই, আপনি প্লীজ নর্থ বেঙ্গল আর সিকিমেরও দায়িত্ব নিন।
স্যার, আমি কী এত দায়িত্ব নেবার উপযুক্ত?
আমরা মনে করি, আপনি অনেক বড় দায়িত্ব নেবার উপযুক্ত।
মৌ চুপ করে চিন্তা করে।
কি হল মিস চৌধুরী।
স্যার, আমাকে কী প্রত্যেক সপ্তাহে ঐসব এলাকায় যেতে হবে?
নট অ্যাট অল; মাসে একবার করে গেলেই যথেষ্ট। তবে মাঝে মাঝে টেলিফোন করে ওখানকার ক্লায়েন্টদের একটু চাপে রাখবেন।
স্যার, মি. সরকার কী এইসব এলাকা আর দেখবেন না?
ওর কথা শুনে শান্ত শুধু হাসে।
মি. পাতিল বলেন, ও এখন কয়েক মাস নর্থ-ইস্ট নিয়ে খুবই ব্যস্ত থাকবে; তবে ওয়েস্ট বেঙ্গল-সিকিমও ওর দায়িত্ব।
স্যার, আমি আপনার প্রস্তাবে রাজি।
ভেরি গুড।
উনি সঙ্গে সঙ্গেই এক গাল হেসে বলেন, এখন থেকেই আপনি স্পেশাল প্রমোশন অফিসার ফর ওয়েস্ট বেঙ্গল অ্যান্ড সিকিম হলেন এবং কোম্পানীর অফিসার হিসেবে মাইনে, অ্যালাউন্স ও অন্যান্য সব সুযোগ-সুবিধা পাবেন।
স্যার, অশেষ ধন্যবাদ।
মি. সরকার কাল আপনাকে আমাদের অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের চিঠি দিয়ে দেবে। এর পর মি. মাথাইয়ের ডিপার্টমেন্ট আপনার নতুন এরিয়া খুব ভাল করে বুঝিয়ে দেবে।
স্যার, ওদের ব্রিফিং সত্যি খুব ভাল; তাছাড়া কাজে খুব হেলপ করে।
.
সন্ধেবেলায় মেরিন ড্রাইভের ফ্ল্যাটে ঢুকেই দু’জনে দু’জনকে জুড়িয়ে ধরে কয়েক মিনিট ধরে চুম্বন পর্ব চলে।
দু হাত দিয়ে শান্তর গলা জড়িয়ে ধরে মৌ বলে, প্রায় মাস খানেক তোমার সঙ্গে মহানন্দে কাটাবার পর এই তিন মাস যে কি করে কাটিয়েছি, তা শুধু আমিই জানি।
মৌ, বিশ্বাস কর, তোকে কাছে না পাবার জন্য আমিও নিঃসঙ্গতার জ্বালায় জ্বলে-পুড়ে মরেছি। রাতের পর রাত ঘুমোতে পারিনি।
আমারও তো একই অবস্থা। আমি আমার ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে শোবার পরই শুধু কেঁদেছি। তোমাকে যতদিন কাছে পাইনি, ততদিন অন্যরকম দুঃখ ছিল কিন্তু তোমার কাছে অত আদর ভালবাসা আর আনন্দ পাবার পর এই বিচ্ছেদ সত্যি অসহ্য।
হ্যাঁ, মৌ, ঠিক বলেছিস।
একটু পরই বাঈ আসে। মৌ-কে দেখেই ও এক গাল হেসে বলে, এতদিন পর এলে কেন?
মৌ গম্ভীর হয়ে বলে, সবই আমার কপাল! আমার স্বামী চায় না, আমি এখানে বেশি আসি।
বাঈ মাথা নেড়ে বলে, না, না, তুমি ঠিক বললে না। তুমি অনেক ভাগ্যের জোরে এই রকম স্বামী পেয়েছ। তুমি চলে যাবার পর অনেকদিন ওর মুখে হাসি দেখিনি; তাছাড়া খাওয়া-দাওয়াও করতো না ঠিক মতো।
.
সন্ধের পর সেই ব্যালকনিতে বসা। আলোয় ঝলমল মেরিন ড্রাইভ যেন বিয়ের কনের মতো সালঙ্করা আর আসন্ন নব বসন্তের জন্য সারা মুখে চাপা হাসি। ওদিকে চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে। আরব সাগরের জলে উছলে পড়ছে তার খুশি। আলোয় ঝলমল ছোট্ট ছোট্ট লঞ্চগুলো যেন এক দল আত্মহারা শিশু খেলতে মত্ত; আর ছোট্ট ছোট্ট নৌকাগুলো যেন মুগ্ধ হয়ে ওদের খেলা দেখছে।
দু’জনে পাশাপাশি বসে, হাতে হাত, শান্তর বুকের উপর মাথা রেখে মৌ বলে, এই পরিবেশ আর তোমার বুকে মাথা রাখলেই যেন মন-প্রাণ জুড়িয়ে যায়।
তোকে কাছে পেলে আমিও বড় শান্তি পাই।
রাত্রে খেতে বসে শান্ত একটু হেসে বলে, মৌ, তুই অফিসার হিসেবে এবার থেকে অফিস তোকে অনেক টাকা দেবে; কী করবি অত টাকা দিয়ে?
অফিস থেকে কত টাকা পাবো?
প্রভিডেন্ড ফান্ড কাটাকুটির পরও তুই প্রায় আশি হাজার হাতে পাবি; তাছাড়া গাড়ি, টেলিফোন, বাড়ি ভাড়া, এন্টারটেনমেন্ট অ্যালাউন্স, ট্রাভেলিং অ্যালাউন্স…
মৌ একটু জোরেই হেসে উঠে বলে, থাক, থাক, আর বলতে হবে না।
ও সঙ্গে সঙ্গে হাসি থামিয়ে বলে, বড় বড় প্রাইভেট কোম্পানীগুলো কর্মচারী আর অফিসারদের এত বেশি মাইনে দেয় বলেই তো ওদের তৈরি জিনিসপত্রের দাম এত বেশি হয়।
তা খানিকটা হয় বৈকি।
.
খাওয়া-দাওয়ার পর মৌ ঘরে গিয়েই শাড়ি ছেড়ে নাইটি পরে।
শান্ত ঘরে ঢুকেই ওকে নাইটির বোতাম লাগাতে দেখে বলে, অফিস থেকে এসেই তো নাইটি পরতে পারো।
নাইটি হচ্ছে রাতের পোক; এই পোষাক কী বাঈ-এর সামনে পরা যায়?
শান্ত আর কোন কথা না বলে শুতে যায়।
মৌ সযত্নে মুখে ক্রীম মাখে, হাতেও ক্রীম লাগায়; আলতো করে চুলের উপর দিয়ে চিরুনি টানে কয়েকবার।
তারপর?
বিছানায় যেতে না যেতেই শান্ত দু’হাত দিয়ে ওকে টেনে নেয়।
.
কী হল মৌ? কথা বলবি না?
এত আনন্দ, এত ভাললাগার পর কথা বলতে ইচ্ছে করে না।
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর মৌ বলে, শান্তদা, আমার একলা থাকতে একটুও ভাল লাগছে না। এবার আমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করো।
সত্যি বলছি, আমারও একলা থাকতে ভাল লাগে না কিন্তু অফিসের জন্য আমাকে বছর খানেক অপেক্ষা করতেই হবে।
কেন?
বছর খানেকের মধ্যেই পাতিল সাহেব কোম্পানীর চেয়ারম্যান হবেন আর ওর জায়গায় আমাকে যেতে হবে।
এ তো দারুণ খবর।
কিন্তু তার আগে আমাকে তিন-চার মাস করে দিল্লী, নাগপুর, হায়দ্রাবাদ আর চেন্নাইতে থাকতে হবে।
বোম্বে ফিরে আসার পর আমাদের বিয়ে হবে তো?
নিশ্চয়ই হবে।
৯. মেয়ের সাফল্য
মেয়ের সাফল্যে অভাবনীয় আনন্দিত বিমলবাবু ও অনুপমা দেবী; মা-বাবার আনন্দ দেখে খুশি মৌ-ও।
সারাদিন কাজকর্মের পর মৌ বাড়ি ফিরে এলে তিনজনে মিলে কত কথা, কত গল্পগুজব। মৌ উত্তরবঙ্গ বা সিকিম গেলেও প্রত্যেক দিন সন্ধের পর মা-বাবার সঙ্গে কতক্ষণ ধরে টেলিফোনে কথা বলে।
অনুপমা দেবী জিজ্ঞেস করেন, তুই কবে ফিরবি? কোচবিহার আর গ্যাংটক থেকে শিলিগুড়ি ফিরেছিস কী?
হ্যাঁ, ঘণ্টা খানেক আগেই ফিরেছি। কাল সকালে জলপাইগুড়ি গিয়ে দু’টো-আড়াইটের মধ্যে শিলিগুড়ি ফিরে সাড়ে চারটের প্লেনে কলকাতা রওনা হব।
তার মানে কাল সন্ধের মধ্যেই ফিরে আসবি?
হ্যাঁ, মা।
ওদিকে বিধাতাপুরুষ যে আমাদের সবার অজ্ঞাতে, অলক্ষে জমা-খরচের হিসেব লিখে চলেছেন, তা আমরা জানতে পারি না। পূর্ণিমার চাঁদও ক্ষয় হতে হতে অমাবস্যার অন্ধকারে পৃথিবী ডুবে যায়, যাবেই কিন্তু অন্ধকারও অনন্তকাল রাজত্ব করতে পারে না। আবার আকাশে চাঁদের দেখা পাওয়া যায়, যাবেই। এইভাবেই ঘুরে চলে আমাদের সুখ-দুঃখের কালচক্র।
ভোরের আলো ফুটলেও তখনও মৌ অঘোরে ঘুমুচ্ছে।
হঠাৎ অনুপমা দেবীর বিকট চিৎকার, ওরে মৌ, তোর বাবার কী হল? কথা বলছে না কেন?
ঐ চিৎকার শুনেই মৌ বিছানা থেকে লাফ দিয়ে উঠে ছুটে যায় মা-বাবার ঘরে।
অনুপমা দেবী হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ওরে, তোর বাবার কী হল? ও মৌ, তোর বাবা কথা বলছে না কেন?
দু’হাত দিয়ে বাবার মুখখানা ধরে মৌ-ও পাগলের মতো চিৎকার করে, বাবা! ও বাবা! বাবা!
মা-মেয়ের কান্নাকাটি আর চিৎকার শুনে ছুটে আসেন ঠিক পাশের বাড়ির ডা. চ্যাটার্জী আর তার স্ত্রী।
প্রথমে নাড়ি, তারপর চোখের মণি দেখেই ডা. চ্যাটার্জী মাথা নেড়ে বলেন, মৌ, তোর বাবা অনেক আগেই চলে গিয়েছেন।…
জ্যেঠু, কী বলছেন আপনি?
ম্যাসিভ সেরিব্রালে মুহূর্তের মধ্যে সব শেষ হয়েছে অন্তত ঘণ্টা চারেক আগে।
অনুপমা দেবী কাঁদতে কাঁদতেই চিৎকার করেন, মানুষটা চলে গেল অথচ আমি টের পেলাম না! ও চলে যাবার পরও আমি ওর পাশে চার ঘণ্টা ঘুমোলাম কী করে?
দেখতে দেখতে প্রতিবেশীদের ভীড়ে ঘর-বাড়ি ভর্তি। কেউ সান্ত্বনা দেন অনুপমা দেবীকে, কেউ কেউ সান্ত্বনা দেন মৌ-কে। কেউ কেউ বলেন, এ তো মহা ভাগ্যবানের মৃত্যু; নিজে না ভুগে, কাউকে কোন কষ্ট না দিয়ে দাদা চলে গেলেন। এর চাইতে ভাল মৃত্যু আর কি হয়!
কান্নাকাটি করতে করতেই মৌ কোনমতে খবরটা জানায় শান্তকে; শান্ত বলে, আমি নেক্সট ফ্লাইটেই আসছি।
কয়েক মিনিট পর মৌ ওর বাবার টেলিফোনের খাতাটা ডাক্তার জ্যেঠুর মেয়ে সায়নীর হাতে দিয়ে বলে, এর মধ্যে বাবার ঘনিষ্ঠ সহকর্মী আর প্রিয় ছাত্র-ছাত্রীদের টেলিফোন নম্বর আছে; তুই এদের খবরটা জানিয়ে দে।
আমি এক্ষুনি বাড়ি গিয়ে সবাইকে ফোন করছি।
তারপর?
আধ ঘণ্টার মধ্যেই আসতে শুরু করেন বিমলবাবুর পুরনো সহকর্মী আর ছাত্র-ছাত্রীরা। সবার চোখেই জল। ক’জন ঘনিষ্ঠ ছাত্রী জড়িয়ে ধরেন অনুপমা দেবী আর মৌ-কে।
প্রতিবেশী সুভাষবাবু বলেন, দাদা শুধু কাউকে কষ্ট দিলেন না, অন্যদের যাতে কাজকর্মে ক্ষতি না হয়, সেজন্য মারা গেলেন রবিবার ভোরে।
সঙ্গে সঙ্গে দু’ চারজন বলেন, হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন।
এগারটা বাজতে না বাজতেই শান্ত এসে হাজির। ও কাঁদতে কাঁদতে অনুপমা দেবীকে জড়িয়ে ধরে বলে, মা-বাবার পর ভাল কাকাও ফাঁকি দিয়ে চলে গেল; এবার তুমিও যাও। তোমরা সবাই চক্রান্ত করে পালাতে শুরু করেছ।
অনুপমা দেবী ওকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে, ওরে শান্ত, তোর ভাল কাকা আমার সঙ্গে এমন সর্বনাশা রসিকতা কেন করলেন বলতে পারিস?
.
তারপর?
তারপর আর কি? পাড়ার লোকজনই অন্তিম যাত্রার উদ্যোগ-আয়োজন করেন। বিমলবাবু জামাই সেজে জনা চারেকের কাঁধে উঠতেই অনুপমা দেবী মূর্ছা গেলেন; মৌ-ও মাথা ঘুরে পড়ে যেতে যেতে ক’জনে তাকে ধরে ফেলে। তবুও মৌ-কে যেতে হয় বাবার পিছন পিছন।
তারপর?
পঞ্চভূতে বিলিন হল বিমলবাবুর মরদেহ।
.
অনুপমা দেবী যেন তাঁর বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। তার মুখে কোন কথা নেই বললেই হয়। সব সময় শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন। অনেক অনুরোধ-উপরোধ করেও এক চামচের বেশি ভাত তার মুখে ওঠে না।
আর?
হঠাৎ কখনও কখনও খুব জোরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রায় আপন মনেই বলেন, তুমি চলে যাবার আগে একবার ডাকলেও না?
আবার কখনও কখনও বলেন, আমি এমন অপদার্থ স্ত্রী যে তুমি চলে যাবার পরও তোমারই পাশে অঘোরে ঘুমুলাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা! আমার মতো স্ত্রীকে নিয়ে তুমি এত বছর ঘর করলে কী করে?
.
তবু সূর্য ওঠে, অস্ত যায়। কখনও চাঁদের আলো, কখনো আবার অমাবস্যার অন্ধকার। স্কুল-কলেজ অফিস-আদালত যথারীতি আগের মতোই চলছে। মানুষজনও তাদের নিত্যকর্ম করে চলেছে। না, কোথাও ছন্দপতন হচ্ছে না, হবেও না।
শান্ত ফিরে গিয়েছে। মৌ-কেও আবার কাজ শুরু করতে হয়েছে। তবে মা-কে দেখার জন্য দুটি নার্স পালা করে দেখাশুনা করছে। এছাড়া পাড়ার মেয়ে-বউরা হরদম আসা-যাওয়া করছেন।
শান্ত রোজই ফোন করে। তাছাড়া প্রত্যেক শনিবার বা রবিবার এসে ভাল মা-কে দেখে যাচ্ছে। ডা. চ্যাটার্জী প্রত্যেক দিন অনুপমা দেবীর পালস্ দেখছেন, প্রেসার দেখছেন, স্টেথোর চেস্ট পিস ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছেন বুক-পিঠ। ক’দিন অন্তর ই-সি-জি হচ্ছে।
ডা. চ্যাটার্জীকে গম্ভীর দেখেই মৌ বলে, জ্যেঠু, মা-কে কেমন দেখলেন?
উনি যে বিশেষ ভাল নেই, তা তো তুই বুঝতে পারছিস। তবে ওকে ঠিক মতো খাওয়াতে পারলে ভাল হয়।
অনেক অনুরোধ-উপরোধ করেও তো মা-কে বেশি খাওয়ানো যাচ্ছে না; তবে সিস্টাররা খুবই দেখাশুনা করছেন।
ওরা খুব ভাল বলেই তো আমি তোর মা-কে দেখাশুনার জন্য লাগিয়েছি। যাইহোক ওষুধ পত্তর তো খাচ্ছেন; লেট আস হোপ ফর দ্য বেস্ট।
এইভাবেই বিমলবাবুর মৃত্যুর পর তিন মাস কাটলো।
.
সেদিন শনিবার।
সকালের ফ্লাইটে শান্ত এসেছে। ও অনুপমা দেবীকে জড়িয়ে ধরে একটু হেসে বলে, ভাল মা, আমি এলে তোমার ভাল লাগে?
অনুপমা দেবীও একটু হেসে খুব আস্তে আস্তে বলেন, খুব ভাল লাগে।
ঠিক সেই সময় ডা. চ্যাটার্জী এলেন।
শান্তকে দেখেই উনি বলেন, তুই কখন এলি?
একটু আগে এসেছি।
আর কথা না বাড়িয়ে ডা. চ্যাটার্জী অনুপমা দেবীকে পরীক্ষা করে ঘরের বাইরে যাবার জন্য পা বাড়াতেই সিস্টার বলেন, স্যার, কিছু ওষুধ চেঞ্জ করবেন নাকি?
কোর্স শেষ হয়েছে?
স্যার, আরো দুদিনের ওষুধ আছে।
এই কোর্স শেষ হবার পর চেঞ্জ করব।
ডা. চ্যাটার্জী ঘরের বাইরে যেতেই শান্ত বলে, জ্যেঠু, ভাল মা-কে কেমন দেখলেন?
মৌ-এর কাঁধে একটা হাত রেখে উনি বলেন, তোর ভাল কাকা মারা যাবার পরও যে তার পাশে শুয়ে চার-পাঁচ ঘণ্টা ঘুমিয়েছেন, সেই অপরাধ বোধের ব্যাপারটা ওকে কুরে কুরে খাচ্ছে।
হ্যাঁ, জ্যেঠু, ঠিক বলেছেন।
মন থেকে যদি এই অপরাধবোধ না চলে যায়, তাহলে ওর শারীরিক উন্নতি হওয়া খুবই কঠিন।
ডা. চ্যাটার্জী চলে যেতেই মৌ আর শান্ত ঐ ঘরে ফিরে যায়।
সিস্টার ওদের বলেন, মাসিমা, অনেকক্ষণ শুয়ে আছেন; এবার ওকে একটু উঠে বসাব।
আমি ওকে উঠে বসাচ্ছি।
কথাটা বলেই শান্ত ওকে দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে আস্তে আস্তে বসিয়ে দিতেই অনুপমা দেবী ওরই গায় হেলান দেন। সিস্টার ওকে একটু দুধ খাওয়াতে যেতেই মৌ ওর হাত থেকে দুধের গেলাস আর চামচ নিয়ে নিজেই মা-কে একটু একটু করে দুধ খাওয়ায়।
দু’তিন চামচ দুধ খাওয়ার পরই অনুপমা দেবী হঠাৎ বেশ খানিকটা বমি করেই দু তিনবার হিক্কা তুলে এক হাত দিয়ে মেয়ের হাত ধরে শান্তর গায়ের পর ঢলে পড়েন।
মৌ গলা চড়িয়ে বলে, মা, ও মা, কী হয়েছে?
শান্ত দু’হাত দিয়ে ওর মুখখানা ধরে বলে, ভাল মা, বল, কী কষ্ট হচ্ছে?
সিস্টার সঙ্গে সঙ্গে ওকে শুইয়ে দেয়।
রাধা মাসি ছুটে গিয়ে ডা. চ্যাটার্জীকে ডেকে আনে।
ডা. চ্যাটার্জী ওর পালস দেখেই কানে স্টেথো দিয়ে চেস্ট পিস দিয়ে বুক পরীক্ষা করেই বলেন, সরি, সী ইজ নো মোর।
.
পুরো এক মাস ছুটির পর মৌ বোম্বে এসেছে পাতিল সাহেবের তলব পেয়ে; তবে ভবিষ্যত জীবন সম্পর্কে শান্তর সঙ্গে জরুরী কথাবার্তা বলবে বলে সোমবারের বদলে শনিবার সকালের ফ্লাইটেই এসেছে।
সারাদিন দু’জনেই আনন্দে খুশিতে কাটাবার পর সন্ধের সময় ব্যালকনিতে পাশাপাশি বসেই মৌ বলে, শান্তদা, এবার তো আমাদের ভবিষ্যতের কথা ভাবতে হবে।
হ্যাঁ, তা তো ভাবতেই হবে।
বল, কবে আমাদের বিয়ে হবে।
বলব, বলব।
একটু চুপ করে থাকার পর শান্ত বলে, তুই আমার মায়ের গুরুদেবকে দেখেছিস?
হ্যাঁ, একবার দেখেছি।
কবে?
হায়ার সেকেন্ডারী পরীক্ষা শেষ হবার কদিন পর।
ওকে তোর কেমন লেগেছিল।
অসম্ভব ভাল; দেখলেই মাথা নুয়ে আসে। তাছাড়া ওর চোখের দিকে কিছুতেই তাকানো যায়
শান্ত বলে, উনি খুবই বড় সাধক ছিলেন।
সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
কী করে বুঝলি?
মৌ একটু হেসে বলে, উনি আমাকে দেখেই বলেছিলেন, বেটি, তুই এম. এ পাস করেই খুব বড় চাকরি পাবি।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, শান্তদা।
শান্ত একটু হেসে বলে, আমি যখন মা-র পেটে মাত্র ছ’মাসের তখনই উনি মাকে দেখে বলেছিলেন, তুই তো ছেলের মা হতে যাচ্ছিস।
হ্যাঁ, আমি দু’মায়ের কাছেই এই কথা শুনেছি।
শান্ত উঠে দাঁড়িয়েই বলে, এবার ঘরে চল; তোকে মায়ের একটা চিঠি দেখাব।
হ্যাঁ, চল।
শান্ত ঘরে এসে আলমারীর লকার খুলে একটা চিঠি বের করে ওর হাতে দিয়ে বলে, পড়ে দ্যাখ।
..স্নেহের শান্ত, তোকে একটা বিশেষ কথা জানাবার জন্যই এই চিঠি লিখছি। আমি আমার পরমপূজ্য গুরুদেবকে বলেছিলাম, বাবা শান্ত যদি আমার হৃৎপিণ্ড হয় তাহলে মৌ আমার চোখের মণি। মৌ আমার গর্ভে না জন্মালেও ও আমার মেয়ে, আমি ওর মা। তাছাড়া ছোটবেলা থেকেই শান্ত আর মৌ-এর ভাব-ভালবাসা; ওরা যত বড় হয়েছে, তত গম্ভীর হয়েছে। ওদের ভালবাসা। আপনি দয়া করে অনুমতি দিলে আমি ওদের বিয়ে দিতে চাই।
গুরুদেব দু’এক মিনিট চোখ বন্ধ করে থাকার পর বললেন, আনুষ্ঠানিক বিয়ের তিন মাসের মধ্যে তোর মৌ বিধবা হবে; তবে আনুষ্ঠানিক বিয়ে না করে ওরা যদি শুধু মালাবদল করে একসঙ্গে জীবনযাপন করে তাহলে ওদের কোন অমঙ্গল হবে না।…
চিঠিটা পড়ে মৌ যেন বাকরুদ্ধ হয়; আপন মনে শুধু আকাশ-পাতাল চিন্তা করে।
শান্ত এক হাত দিয়ে আলতো করে ওকে ধরে বলে, আমরা মালাবদল করেই একসঙ্গে জীবন কাটিয়ে দেব।
মৌ একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নেড়ে বলে, না, শান্তদা তা হয় না।
কেন?
আমি সিঁথিতে সিঁদুর দিয়ে সবাইকে বলতে চাই, আমি তোমার স্ত্রী, তুমি আমার স্বামী।
আমরা একসঙ্গে থাকলেও তো সবাইকে সেই পরিচয় দেওয়া হবে।
আমি বালির উপর স্বপ্নের প্রাসাদ গড়তে চাই না।
বালির উপর প্রাসাদ গড়বি কেন? আমি কথা দিচ্ছি, জীবনেও কোনদিন তোর অমর্যাদা করব না।
আমি রক্ষিতার মতো জীবন কাটাতে চাই না।
না, শান্ত আর একটাও কথা বলে না; নীরব থাকে মৌ-ও।
খাওয়া-দাওয়া করে দু’জনেই শুতে চায় কিন্তু মাঝখানে অনেক দূরত্ব থাকে।
অন্যান্য রবিবারের মতো শান্ত দেরি করেই ঘুম থেকে ওঠে কিন্তু ফ্ল্যাটের কোথাও মৌ-কে দেখে না। ও মনে মনে ভাবে, মৌ হয়তো কোন হোটেলে চলে গেছে।
সোমবার অফিসে গিয়েই শান্ত জানতে পারে, মৌ চাকরি ছেড়ে দিয়েছে।
.
মৌ শূন্য মন নিয়ে শূন্য বাড়িতে ফিরে এল।
বাবাকে হারিয়ে মনে হয়েছিল যেন মাথার উপর এক আস্ত পাহাড় ভেঙে পড়ল; মাকে হারিয়ে মনে হল পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেল। তারপর? শেষ পারানির কড়ি শান্তদা।
শৈশব, কৈশোরের প্রাণের বন্ধু, প্রথম যৌবনে যাকে ভালবেসে, যার ভালাবাসা পেয়ে মনে-প্রাণে রামধনুর রঙে রাঙিয়ে উঠেছে, সেই শান্তদাকে বহুদিন পরে যৌবনের ভরা জোয়ারে পেয়ে উত্তাল আনন্দে দু’জনেই ভেসে গিয়েছি তাজ হোটেলের স্বপ্নময় পরিবেশে।
আর কী?
জীবনে প্রথম একটা বিচিত্র আনন্দঘন পূর্ণতার স্বাদ পায় মৌ।
আর শান্ত?
সে বাবাকে হারিয়েছে, হারিয়েছে মাকে আর তারপর থেকেই নিঃসঙ্গতার জ্বালায় জ্বলেপুড়ে মরেছে। মৌকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে তার অশান্ত মন শান্ত হয়েছে।
মেরিন ড্রাইভের ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে বসে দু’জনে দু’জনের হাত ধরে দু’জনেই ভবিষ্যতের আনন্দময় দ্বৈত জীবনের স্বপ্ন দেখেছে। রহস্যময় মধ্যরাত্রির অন্ধকারে দুটি প্রাণ যেন দরবারী কানাড়ার সুরের যাদুতে আন্দোলিত হয়।
তারপর?
বোধনেই হঠাৎ বিসর্জনের বাজনা বেজে ওঠে।
মৌ-এর মনপ্রাণ হঠাৎ জ্বালা করে ওঠে। শূন্য মন, শূন্য দৃষ্টি। সামনে যেন সব অন্ধকার।
.
কী হল মৌ? খেতে এসো। সব যে ঠান্ডা হয়ে গেল।
রাধা মাসি আপন মনেই বলে, তিন তিনবার তোমাকে ডেকে গেলাম, তা কি তোমার কানে যায়নি?
হ্যাঁ, মাসি আসছি।
মৌ খেতে বসতেই রাধা বলে, কাজকর্ম না করে সারাদিন বাড়িতে বসে কি যে ভাবো তা তুমিই জানো। তাছাড়া চব্বিশ ঘণ্টা বাড়ির মধ্যেই বা বসে থাক কেন? তোমার তো কম বন্ধুবান্ধব নেই; তাদের কাছে গেলেও তো মন ভাল হয়।
মৌ ওর কথার কোন জবাব দেয় না। কী জবাব দেবে? চুপ করে থাকে।
মৌ বেশ বুঝতে পারে, বুকের মধ্যে একটু চোরা কুঠী আছে যেখানে মুষ্টিমেয় কয়েকজন প্রাণের মানুষ পাকপাকি আসন বিছিয়ে বসেন। কী আশ্চর্য! সেখানেও শান্তদা?
মৌ মনে মনে বলে, ‘নয়ন ছেড়ে চলে গেলে। এলে সকল মাঝে/তোমায় আমি হারাই যদি/তুমি হারাও না যে..’। কী আশ্চর্য মানুষের মন? যাকে হারাতে চাই, সে কিছুতেই হারিয়ে যায় না। যাকে শত যোজন দূরে ফেলে এসেছি, সেই মনের পর্দায় অহরহ ভেসে ওঠে।
তাইতো ওর বলতে ইচ্ছা করে ‘মনে রবে কি না রবে সে আমার মনে নাই।/ক্ষণে ক্ষণে আমি তব দুয়ারে, অকারণে গান গাই’।
আবার কোন কোনদিন মৌ সাত সকালে উঠেই মা-বাবার ঘরে এদিক-ওদিক ঘুরে দেখে। হঠাৎ একটা আলমারী খুলে বাবার জামা-কাপড়গুলোতে হাত দেয়, গন্ধ শোঁকে। একটু হেসে মনে মনে বলে, জানো বাবা, তোমার জামাকাপড়ে এখনও তোমার গায়ের গন্ধ লেগে আছে।
তারপর এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখতে দেখতেই হঠাৎ একটা ছবি হাতে তুলে নিয়েই মৌ গলা চড়িয়ে বলে, ও মাসি, শিগগির একটা জিনিষ দেখে যাও।
রাধা ঘরে ঢুকেই বলে, ডাকছ কেন?
এই ছবিটা দেখ।
রাধা মাসির হাতে ছবিটা দিয়েই হাসতে হাসতে বলে, আমি যেদিন প্রথম শাড়ি পরে স্কুলে যাই, সেদিন বাবা আমার এই ছবি তোলেন।
তাই নাকি?
মাসি, বাবা সেদিন কি বলেছিলেন জানো?
কী বলেছিলেন?
বলেছিলেন, তোক দেখতে ঠিক আমার মায়ের মতো লাগছে।
আচ্ছা!
হ্যাঁ, মাসি।
সে মুহূর্তের জন্য থেমে বলে, বাবা সত্যি আমাকে মায়ের মতো ভালবাসতেন। তাইতো বাবা আমাকে কখনও ডাকতেন ‘মৌ মা’ বলে, কখনো আবার ‘মাদার’ বা জননী’ বলে।
রাধা হাসতে হাসতে নিজের কাজে চলে যায়।
মৌ সেদিন নিজের ঘরে বসেই হঠাৎ একটা পুরনো দিনের অ্যালবাম হাতে তুলে নিয়ে কয়েকটা পাতা উল্টিয়ে দেখার পরই একটা ছবি দেখে আপন মনেই বলে, তখন আমার বয়স কত? এগারো না বারো।
সেদিনের ঘটনা মৌ জীবনেও ভুলবে না; অথচ সেদিনের কথা মনে হলেই হাসি পায়।
.
সেদিন রবিবার।
মৌ বাথরুমে যাবার আগে প্রায় চিৎকার করে বলে, মা, আমি বাথরুমে যাচ্ছি; আমার দেরি হবে। ডাকাডাকি করো না।
দেরি হবে কেন?
অন্যদিন স্কুল থাকে বলে তো ভাল করে চান করতে পারি না; আজ সাবান মেখে ভাল করে চান করব, শ্যাম্পু করব। দেরি তো হবেই।
বেশি দেরি করিস না।
মৌ সে কথার জবাব না দিয়েই বাথরুমে ঢুকে যায়।
মিনিট দশেক পরের কথা।
হঠাৎ মৌ আতঙ্কে হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে পাগলের মতো চিৎকার করে, ও মা, শিগগির এসো, আমি আর বাঁচব না।
মনিকা দেবী প্রায় দৌড়ে বাথরুমে যান।
মৌ কাঁদতে কাঁদতেই বলে, ও মা আমার পেট থেকে কি রক্ত বেরুচ্ছে! দু’পা রক্তে ভেসে যাচ্ছে।
মনিকা দেবী একটু হেসে বলেন, তোর কিছু হয়নি; সব মেয়েদেরই এইরকম হয়। তুই সত্যি বড় হয়ে গেলি।
.
তারপর?
বিকেলের দিকে শান্ত আসতেই সেই ইসতে হাসতে বলে, জানো মা আজ আমাকে কী বলেছে?
ভাল মা কী বলেছে?
বলেছে, আমি বড় হয়ে গেলাম।
তার মানে?
তার মানে তাই।
ভাল মা হঠাৎ ও কথা বলল কেন?
মৌ একটু হেসে বলে, সে তুমি বুঝবে না।
আমি বুঝব না?
না।
কেন?
আমি অত-শত জবাব দিতে পারব না। আসল কথা হচ্ছে, কোন ছেলেকেই বলতে পারব না, মা কেন ও কথা বলেছে।
মৌ, প্লীজ আমাকে বল।
মৌ দুহাত দিয়ে ওর মুখখানা ধরে দু’গালে আলতো করে চুমু খেয়ে হাসতে হাসতে বলে, মাই ডিয়ার শান্তদা, তোমাকেও সে কথা বলা যাবে না।
বাড়ির মধ্যে ঘুরাঘুরি করতে করতে আরো কত কথা মনে হয়।
এইভাবেই বোম্বে থেকে আসার পর তিন মাস কেটে গেল।
.
রেজিষ্ট্রি চিঠিটা হাতে নিয়েই মৌ অবাক হয়। এইতো দিন পনের আগে নিজের ব্যাপারে সব প্রয়োজনীয় তথ্য জানিয়ে একটা আবেদন পত্র পাঠিয়েছিলাম। এরই মধ্যে…
হাজার হোক লোরেটো কলেজ; ওরা তো সরকারী বা পরকারী সাহায্যপ্রাপ্ত কলেজগুলোর মতো বিলম্বিত লয়ে কাজ করে না। ওখানে অধ্যাপনা করতে হবে জেনে মৌ-এর মন অনেক দিন পূর্বআনন্দে খুশিতে ভরে ওঠে।
ও মাসি, শিগগির শুনে যাও।
মৌ প্রায় চিৎকার করে বলে।
রাধা আঁচলে হাত মুছতে মুছতে ও ঘরে ঢুকেই বলে, আবার কী হল যে অমন চিৎকার করে ডাকলে?
মৌ দু’হাত দিয়ে ওর মুখখানা ধরে মুখের সামনে মুখ নিয়ে হাসতে হাসতে বলে, সামনের সোমবার থেকেই আমি একটা কলেজে পড়াব।
রাধাও হাসতে হাসতে বলে, তাহলে তুমিও দাদাবাবুর মতো কলেজে পড়াবে; সত্যি খুব ভাল খবর।
ও না থেমেই বলে, তোমার মতো গুণী মেয়ে কোন কাজ না করে বাড়ির মধ্যে বসে থাকবে, তা আমি ভাবতেই পারি না।
ও মাসি, আমার কলেজ শুরু ন’টায়; সাড়ে আটটার মধ্যেই বাড়ি থেকে বেরুতে হবে।
তুমি খাবে ক’টয়, সেটা বল।
ঠিক আটটায় খেতে বসব।
তখন কী তুমি ভাত-টাত খেয়ে যাবে?
না, না; অত সকালে কী ভাত খাওয়া যায়?
ঠিক আছে, জলখাবার খেয়েই যেও কিন্তু তুমি ফিরবে কখন?
বোধহয় আড়াইটে-তিনটের মধ্যে।
মৌ সঙ্গে সঙ্গেই বলে, আমি কাল সকালে একবার কলেজে যাব প্রিন্সিপালের সঙ্গে দেখা করতে; তখন সবকিছু জেনে আসব।
রাধা ডান হাত দিয়ে ওর গাল টিপে একটু হেসে বলে, আমাদের সোনার টুকরো মেয়েটা আবার সেজেগুজে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে কলেজে পড়াতে যাবে ভেবেও আমার ভাল লাগছে।
মৌ দু’হাত দিয়ে ওকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে বলে, তোমাকে মাসি বলে ডাকলেও তুমিও তো আমার একটা মা। আমার ভাল হলে যে তোমার ভাল লাগবে, তা কি আমি জানি না?
.
অনেক দিন পর মৌ অনেকক্ষণ ধরে শাওয়ারের তলায় দাঁড়িয়ে থাকে, খুব ভাল করে সাবান মাখে; স্নানের পর ‘ফেস ওয়াস’ দিয়ে মুখ পরিষ্কার করে। ভাল লাগার আনন্দে ড্রেসিং টেবিলে বড় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে ভাল করে দেখে; একটু প্রসাধনও করে। মনে মনে বলেন, ইয়েস, আয়াম স্টীল লুকিং প্রেটি গুড!
দুপুরবেলায় মৌ খেতে বসতেই রাধা জিজ্ঞেস করে, তুমি কী দাদাবাবুর মতো যোগমায়া আর আশুতোষ কলেজেই পড়াবে?
না, না, ও কলেজে না।
তবে কোন কলেজে?
মৌ একটু হেসে বলে, আমি পড়াব লোরেটো কলেজে।
সে আবার কাদের কলেজ?
মাসি, ওই কলেজ চালায় খ্রিস্টান সন্ন্যাসিনীরা।
তার মানে ওটা মেমসাহেবদের কলেজ?
হ্যাঁ, তা বলতে পারো।
ওখানে কারা পড়ে?
স্কুলের শেষ পরীক্ষায় যেসব মেয়েরা অনেক নম্বর পেয়ে খুব ভালভাবে পাস করে, শুধু সেই সব মেয়েরাই ওই কলেজে পড়ার সুযোগ পায়।
একটু চুপ করে থাকার পর রাধা বলে, ওই কলেজে কী খ্রিস্টান মেয়েরাই পড়ে?
মাসি, সব স্কুল-কলেজেই সব ধর্মের ছেলেমেয়েরা পড়তে পারে; লোরেটো কলেজেও নিশ্চয় সব ধর্মের মেয়েরাই পড়ে।
.
সন্ধের পর মৌ-কে লেখাপড়ার টেবিলে বইপত্তর নিয়ে বসতে দেখেই রাধা বলে, তুমি কী আবার কোন পরীক্ষা দেবে যে বইপত্তর নিয়ে বসেছ?
মৌ একটু হেসে বলে, না, মাসি, আমি কোন পরীক্ষা দেব না; তবে অনেক দিন পড়াশুনার সঙ্গে কোন যোগাযোগ নেই বলে কলেজ যাবার আগে একটু বইপত্তর উল্টেপাল্টে দেখছি।
ঠিক বুঝলাম না।
মাসি, ভাল ছেলেমেয়েদের পড়াতে হলে, যারা পড়াতেন তাদেরও একটু পড়াশুনা করে কলেজে যেতে হয়।
এবার বুঝেছি।
পরের দিন মৌ কলেজে গিয়ে প্রিন্সিপালের সঙ্গে দেখা করে; খুবই আন্তরিক কথাবার্তা হয় দু’জনের মধ্যে। তারপর প্রিন্সিপাল ওকে পরিচয় করিয়ে দেন কিছু অধ্যাপিকার সঙ্গে। মৌ খুশি মনেই বাড়ি ফিরে আসে।
শোনো মাসি, মঙ্গলবার আর শুক্রবার আমার ক্লাস শুরু সাড়ে এগারোটায়; ওই দু’দিন ভাত খেয়েই কলেজ যাব। অন্যান্য দিন আমি দুটো আড়াইটের মধ্যে কলেজ থেকে ফিরে ভাত খাব।
ঠিক আছে।
.
সোমবার।
মৌ অভ্যাস মতো ছ’টার আগেই ঘুম থেকে উঠে পড়ে। বাথরুম থেকে ঘুরে আসতেই রাধা ওকে চা-বিস্কুট দেয়। চা খেতে খেতে মৌ খবরের কাগজের উপর দিয়ে চোখ বুলিয়ে নিতে নিতেই বারবার ঘড়ি দেখে।
না, মৌ আর দেরি না করে বাথরুমে যায়। ভালভাবে স্নান করে, মাথায় শ্যাম্পু করে, তারপর ফেস ওয়াস দিয়ে মুখ পরিষ্কার করে।…
ঘরে এসে অন্তর্বাস পরার পর চিকনের কাজ করা সাদা ব্লাউজ পরার পর চিকনের কাজ করা সাদা খোলের শাড়ি পড়ে প্লিটগুলো ঠিক করে। বড় আয়নার সামনে বারবার ঘুরেফিরে নিজেকে দেখে; গোড়ালি দিয়ে শাড়ির পিছন দিকটা একটু নীচে নামায়। দেয়ালের ঘড়ির দিকে তাকিয়েই মৌ গলা চড়িয়ে বলে, মাসি, খেতে দাও।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, খাবার রেডি, তুমি এস।
চারটে লুচি হালুয়া দিয়ে খেয়েই মৌ উঠে পড়ে।
একি, আর খেলে না?
এখুনি তো দৌড়তে হবে; এখন কী বেশি খাওয়া যায়?
মুখ ধুয়েই ঘরে এসে ফেস টাওয়েল দিয়ে মুখ পরিষ্কার করে, ঠোঁটের উপর দিয়ে ন্যাচালার কালারের লিপস্টিক বুলিয়ে নিয়েই কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে মৌ নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে মা-বাবার ঘরে গিয়ে ওদের ছবিতে প্রণাম করে।
মৌ ওই ঘর থেকে বেরিয়েই রাধাকে প্রণাম করে বলে, মাসি, আশীর্বাদ করো, কলেজে যেন ঠিক মতো পড়াতে পারি।
নিশ্চয়ই ঠিক মতো পড়াতে পারবে।
তারপর রাধা হাসতে হাসতে বলে, তোমাকে ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে; তবে বাঁ হাতে কিছুই পরলে না?
বাঁ হাতে কিছু পরতে আমার ভাল লাগে না; ডান হাতে ঘড়ি আছে, তাই যথেষ্ট।
.
পৌনে ন’টা বাজতেই মৌ কলেজে পৌঁছে প্রিন্সিপালের সঙ্গে দেখা করে।
সিস্টার, গুড মর্নিং।
গুড মর্নিং ডক্টর মিস চৌধুরী।
দু পাঁচ মিনিট কথাবার্তা বলার পরই ঘণ্টা বাজে; তবে ওটা ওয়ার্নিং বেল। ফাঁইন্যাল বেল বাজতেই প্রিন্সিপাল সিস্টার জোনস্ মৌ-কে নিয়ে সেকেন্ট ইয়ার ক্লাসে যান।
ওরা দু’জনে ক্লাসে ঢুকতেই সব মেয়ে উঠে দাঁড়ায়। সিস্টার জোনস্ ওদের বসতে বলার ইঙ্গিত করেই বলেন, আই হ্যাভ টু ইনট্রোডিউস ইওর নিউ ইকনমিক্স লেকচারার ডক্টর মিস মহুয়া চৌধুরী। ডক্টর চৌধুরী স্টুডেন্ট লাইফে অত্যন্ত কৃতি ছাত্রী ছিলেন। গবেষণা করেছেন ভারত বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ প্রফেসর কেজরিওয়ালের অধীনে এবং ওর গবেষণার থিসিস বিচার করেছেন অন্য দু’জন বাদে অক্সফোর্ডের প্রফেসর ম্যাক্সওয়েল। তাহলেই তোমরা বুঝতে পারছ, তোমাদের নতুন লেকচারার কী অসাধারণ গুণী। যাইহোক আমার স্থির বিশ্বাস, ডক্টর চৌধুরীকে লেকচারার হিসেবে তোমাদের খুবই ভাল লাগবে আর তোমরা খুবই উপকৃত হবে।
এই কথাগুলো বলেই সিস্টার জোনস্ চলে যান।
মৌ একটু হেসে বলে, মাই ডিয়ার স্টুডেন্টস, আজ আমার জীবনের এক স্মরণীয় দিন। দীর্ঘদিন আমি তোমাদেরই মতো ছাত্রী ছিলাম আর আজ আমি প্রথম ছাত্রীদের পড়াবার সুযোগ পেলাম। সেজন্য আমি বোধহয় সারা জীবনেও তোমাদের কথা ভুলতে পারব না। তোমরা আমাকে বন্ধু মনে করলে আমি খুশি হব।
মৌ একটু থেমে বলে, আজ আমি জানব তোমরা কি পড়ছ এবং সেই মতো কাল থেকে আমি তোমাদের পড়াতে শুরু করব। আজ আমি তোমাদের সবার সঙ্গে পরিচিত হতে চাই।
…ইয়েস, হোয়াট ইজ ইওর নেম…আমি চৈতালী, আমি গার্গী, আমি মধুরিমা, আমি লিলি, আমি সায়ন্তনী, আমি ফিরোজা, আমি শ্রাবণী, আমি ডরোথী…
ঘণ্টা পড়তেই মৌ বলে, আমি আবার বলছি, আমার সঙ্গে তোমাদের সম্পর্ক যত ইনফর্মাল হবে, আমরা উভয়েই তত বেশি উপকৃত হব।
মৌ ক্লাস থেকে বেরুবার উদ্যোগ নিতেই ছাত্রীরা ওকে ঘিরে ধরে সমস্বরে বলে, ম্যাম, আপনাকে আমাদের দারুণ ভাল লেগেছে। সায়ন্তনী একটু হেসে বলল, আপনার সুন্দর মুখে সুন্দর হাসি দেখেই আমাদের প্রাণ জুড়িয়ে গেছে। অন্য মেয়েরাও কত কি বলে; সবার মুখেই খুশির হাসি। মৌ নিজেও খুশির হাসি হাসতে হাসতে ক্লাস থেকে বেরিয়ে আসে।
.
মেয়েরা সঙ্গে সঙ্গে শুরু করে তাদের নতুন লেকচারারকে নিয়ে আলোচনা।…
শ্রাবণী বলে, সী ইজ সো বিউটিফুল!
লিলি বলে, সোজা কথায় সী ইজ চার্মিং!
ফিরোজা বলে, মাই গড! কি দারুণ ফিগার!
সায়ন্তনী বলে, যেমন রূপ তেমনি রুচিসম্পন্ন।
চৈতালী বলে, আমি বলব, সী কেম, সী স-অ, সী কংকার্ড!
অন্য মেয়েরাও কত কি বলে।
অধ্যাপিকা হিসেবে প্রথম দিন খুবই ভাল কাটল মৌ-এর।
.
বাড়ি ফিরতেই রাধা জিজ্ঞেস করে, কলেজ কেমন লাগল?
মাসি, কলেজের পরিবেশ এত ভাল যে কি বলব।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, মাসি।
ছাত্রীদের কেমন লাগল?
খুব ভাল লেগেছে।
ছাত্রীরা নিশ্চয়ই তোমাকে পেয়ে খুশি?
মৌ হাসতে হাসতে বলে, তাইতো মনে হল।
সপ্তাহ দুয়েক পড়াবার পরই ছাত্রীরা বলতে শুরু করল, ম্যাম, আপনার পড়াবার স্টাইল একেবারে আলাদা।
পড়াবার স্টাইল আলাদা হলেই ভাল হবে, তার কোন অর্থ নেই; আসল কথা হচ্ছে, আমার পড়াবার স্টাইল তোমাদের ভাল লাগছে কি না বা ব্যাপারটা বুঝতে সাহায্য করছে কিনা।
হ্যাঁ, ম্যাম, খুব ভাল লাগছে। আমাদের কাছে যা কঠিন মনে হয়, তা আপনি অল্প কথায় খুব সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দেন।
যাক, শুনে ভাল লাগল।
মৌ সঙ্গে সঙ্গে বলে, তোমরাও আমাকে টুকটাক প্রশ্ন করবে।
ওর কথা শেষ হতে না হতেই মনীষা জৈন উঠে দাঁড়িয়ে বলে, ম্যাম হোয়াট ইজ ইনফ্লেশন? মুদ্রাস্ফীতি ব্যাপারটা কী?
জি. ডি. পি অর্থাৎ গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাকশন। সোজা কথায় আমাদের দেশে মোট যা উৎপন্ন হয়, অ্যাম আই ক্লিয়ার?
ইয়েস ম্যাম।
এবার চিন্তা করো দেশে কি কি উৎপন্ন হয়। আমাদের এই কৃষি প্রধান দেশে সব চাইতে বেশি টাকার জিনিষ উৎপন্ন হয় কৃষিতে।
ম্যাম, স্টীল, সিমেন্ট, ফার্টিলাইজার না?
না।
মৌ মুহূর্তের জন্য থেমে বলে, ধান, গম, বজরা, তৈলবীজ, শাকসজি, ফলমূল, তামাক, ডাল, ওষুধ তৈরির গাছপালা ইত্যাদি ইত্যাদি হচ্ছে কৃষিজাত দ্রব্য। আমাদের দেশে সব মিলিয়ে যা উৎপন্ন হয়, তার পঁচাত্তর আশি ভাগ আয়ই আসে কৃষিজাত দ্রব্য থেকে।
দু’চারটি মেয়েকে হাসতে দেখে বলে, তোমরা ভাবতে না পারলেও এটাই সত্যি, এটাই বাস্তব।
ও একটু থেমে বলে, এরপর আছে কুটিরশিল্প, ক্ষুদ্র-মাঝারি-ভারী শিল্প আর সার্ভিস সেক্টর অর্থাৎ ভারতের লোকজন যা কাজ করে এর টোটাল যোগফল প্লাস কৃষিজাত দ্রব্যের টোটাল যোগফল অর্থাৎ সব মিলিয়ে যত টাকার জিনিষ উৎপাদন হয় তাই হল গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাকশন।
অ্যাম আই ক্লিয়ার?
ইয়েস, ইয়েস, ইউ আর ক্লিয়ার।
মনে করো, আমাদের দেশে গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাকশন এর মূল্য হচ্ছে, দশ হাজার কোটি টাকা। এবার যদি কেন্দ্রীয় সরকার মোট দশ হাজার কোটি টাকা বাজারে ছাড়ে, তাহলে কোন ইনফ্লেশন বা মুদ্রাস্ফীতি হয় না।
মৌ একটু থেমেই বলে, দশ হাজার কোটি টাকার যত বেশি টাকা বাজারে ছাড়বে তত বেশি মুদ্রাস্ফীতি হবে অর্থাৎ পাঁচ পার্সেন্ট বেশি টাকা বাজারে ছাড়লে পাঁচ পার্সেন্ট মুদ্রাস্ফীতি…দশ পার্সেন্ট বেশি টাকা ছাড়লে দশ পার্সেন্ট ইনফ্লেশন হবে।
ডরোথী উঠে দাঁড়িয়ে বলে, এবার ব্যাপারটা বেশ পরিষ্কার হল।
.
প্রতিদিন কলেজে শত শত প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরপুর সদ্য যৌবনা মেয়ের মাঝখানে কাটিয়ে মৌ রোজ খুশি মনেই বাড়ি ফেরে। সব ছাত্রীদের হাসি মুখ দেখতে দেখতে মৌ-এর মুখেও হাসি ফিরে আসে, আনন্দ ফিরে আসে।
তবে কলেজের ছুটি হলে মৌ কিছুতেই বাড়ির মধ্যে বন্দিনী হয়ে থাকতে পারে না; বেরিয়ে পড়ে কোথাও না কোথাও। কখনো দার্জিলিং, কখনো পুরী, কখনো শিলং বা কোদাইকানাল, কখনো জৈসালুমের যোধপুর-উদয়পুর-জয়পুর সিমলা-ডালহৌসী।
এইভাবেই কেটে যায় বছরের পর বছর।
.
কলেজ ছুটি হবার দু’চারদিন আগে রাধা মৌ-কে বলে, এবার ছুটিতে কোথায় যাবে ঠিক করেছ?
মাসি, এবার ঠিক করেছি, পুরো ছুটিটাই-হরিদ্বারে কাটাব।
হরিদ্বারে?
হ্যাঁ, হরিদ্বারে।
তুমি তো পুরো ছুটি কখনই এক জায়গায় কাটাও না, তুমি তো চড়ুই পাখির মতো উড়ে বেড়াও নানা জায়গায়।
মৌ একটু হেসে বলে, মাসি, বুড়ি হয়ে গেছি, এই বয়সে আর পাঁচ জায়গায় ঘুরে না বেড়িয়ে হরিদ্বারেই…
তুমি বুড়ি হয়েছ?
তবে কী আমি কচি খুকি?
রাধা একগাল হেসে বলে, তোমাকে দেখে কেউ বলবে না তোমার বয়স পঁচিশ ছাব্বিশের বেশি।
কী পাগলের মতো কথা বলছ?
সত্যি বলছি, তোমাকে দেখে কেউ বলবে না, তোমার তেত্রিশ-চৌত্রিশ বছর বয়স হয়েছে। আজকাল তো বহু মেয়েই এই বয়সে বিয়ে করে।
সে যাইহোক, আমি এবার পুরো ছুটি হরিদ্বারেই কাটাব।
হ্যাঁ, তা কাটাও কিন্তু শরীরের দিকে খেয়াল রেখো।
মৌ শুধু হাসল।
.
রাজধানী এক্সপ্রেসে দিল্লী; তারপর ইন্টারস্টেট বাস টার্মিনাস থেকে শেয়ারের ট্যাক্সিতে ডেরাডুন বাস স্ট্যান্ড। তারপর হরিদ্বারের বাসে উঠতে যাবার মুখেই দু’জনের দেখা।
বিস্মিত হয়ে দু’জনেই একসঙ্গে বলে, তুমি?
দু’জনের মুখেই হাসি।
মৌ একটু হেসে বলে, কলেজের ছুটি, তাই ছুটি কাটাতে হরিদ্বার যাচ্ছি কিন্তু তুমি?
শান্ত একটু হেসে বলে, আমি তো হরিদ্বারেই থাকি।
হরিদ্বারে?
হ্যাঁ, হরিদ্বারে।
তুমি চাকরি করছ না?
না, অনেক দিন ছেড়ে দিয়েছি।
শান্তর হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকা ফুটফুটে সুন্দর মেয়েটিকে দেখিয়ে মৌ জিজ্ঞেস করে, ও কে?
আমার মেয়ে।
তোমার মেয়ে?
হ্যাঁ, আমার মেয়ে।
শান্ত মেয়েটির মুখ আলতো করে তুলে ধরে বলে, মাগো, আমি তোমার বাবা না?
হ্যাঁ, তুমি আমার বাবা।
মৌ বলে, তুমি বিয়ে করলে কবে?
শান্ত একগাল হেসে বলে, বিয়ে তো বহুকাল আগেই করেছি।
তোমার বউ কোথায়? হরিদ্বারে?
সে আমার সঙ্গে থাকে না।
কেন?
শান্ত আবার একটু হেসে বলে, সে প্রায় বছর দশেক আগেকার কথা। একদিন একটু মতবিরোধ হল বলে এক রবিবার খুব ভোরে আমাকে কিছু না বলেই…
এবার মেয়েটি বলে, বাবা ইনি কে?
মাগো, ইনি তোমার মা; তুমি মাকে প্রণাম করো।
পার্বতী প্রণাম করতেই মৌ দু’হাত দিয়ে ওকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে ওর কপালে স্নেহচুম্বন দেয়।
মৌ শান্তকে জিজ্ঞেস করে, এমন সোনার টুকরো মেয়েকে পেলে কোথায়?
দেবতাত্মা হিমালয় জুটিয়ে দিয়েছেন বলেই তো ওর নাম রেখেছি পার্বতী।
প্লীজ বল না, কী করে ওকে পেলে।
.
শান্ত একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, চাকরি ছেড়ে বেশ মোটা টাকা পেলাম; তাছাড়া বাবা মায়ের জন্য যে ইন্সিওরেন্স করেছিলেন, তার টাকা ব্যাঙ্কেই পড়েছিল বহুদিন। এই সব টাকা পাবার পর হরিদ্বারে এসেই গঙ্গার ধারের একটা কমপ্লেক্সে একটা সুন্দর দু’কামরার ফ্ল্যাট কিনলাম।
তারপর?
প্রথম দু’এক মাস বেশ কাটল, তারপর আর একলা থাকতে ভাল লাগছিল না বলে রোজই এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়াতাম।
শান্ত একটু হেসে বলে, সেদিন হৃষিকেশে গঙ্গার ধারে চুপচাপ বসেছিলাম। হঠাৎ পাঁচ-ছ’ বছরের একটা ফুটফুটে সুন্দর মেয়ে এসে বলল, বাবা, বড্ড খিদে লেগেছে; আমাকে কিছু খেতে দেবে?
তারপর?
ওকে খাইয়ে আবার ওকে নিয়ে গঙ্গার ধারে বসে ওর মা-বাবার কথা জিজ্ঞেস করি।
ও কী বলল?
বলল, গত কুম্ভমেলার সময় ও মা-বাবার সঙ্গে হরিদ্বারে এসেছিল। চার-পাঁচ দিন পরই ওর বাবা হাসপাতালে ভর্তি হয় ও দু’তিন দিন পরই মারা যায়।
ওর বাবার কী হয়েছিল?
বোধহয় কলেরা।
তারপর?
ওর মা কান্নাকাটি করতে করতে ছুটে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গেল।
বেরিয়ে কোথায় গেল?
তারপর ও আর মায়ের দেখা পায়নি।
শান্ত চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, বেচারা বছর দুয়েক কান্নাকাটি করে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছে আর কোনমতে ভিক্ষা করে বেচে থেকেছে।
তারপর তোমার সঙ্গে দেখা?
হ্যাঁ।
শান্ত সঙ্গে সঙ্গে বলে, দুটো কাগজে ওর ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপন দিলাম, তারপর কোর্ট-কাছারি করে ওকে আমি আডপ্ট করলাম আর নাম দিলাম পার্বতী।
এই কাহিনী শুনে খুশিতে মন ভরে যায় মৌ-এর। একটু থেমেই বলে, তোমরা ডেরাডুনে এসেছ কেন?
শান্ত একটু হেসে বলে, মা জননীকে এখানকার একটা খুব ভাল স্কুলে ভর্তি করেছি। ও থাকে হস্টেলেই। তবে শনি-রবিবার ছুটি বলে শুক্রবার বিকেলে আমি ওকে নিয়ে যাই আবার সোমবার ভোরের বাস ধরে ওকে হস্টেলে পৌঁছে দিই।
এতক্ষণ চুপ করে থাকার পর পার্বতী একগাল হেসে বলে, জানো মা, শনি-রবিবার আমি আর বাবা যে কি আনন্দ করি, তা তুমি ভাবতে পারবে না।
পার্বতী, মা, তুমি কোন ক্লাসে পড়ছ?
এবার আমি ক্লাস টেন-এ উঠেছি।
বাঃ! খুব ভাল।
শান্ত বলে, জানো মৌ, পার্বতী সত্যি ভাল ছাত্রী। ও কোন সাবজেক্টে আশির কম নম্বর পায় না।
সঙ্গে সঙ্গে পার্বতী বলে, জানো মা, বাবার কোচিং এত ভাল যে কি বলব! বাবার কোচিং ঠিক মতো ফলো করলে আমার রেজাল্ট আরো ভাল হওয়া উচিত।
তোমার বাবা তো খুব ভাল ছাত্র ছিলেন; সে তো ভাল কোচিং করবেই।
মৌ না থেমেই বলে, রাজধানী এক্সপ্রেসে ব্রেকফাস্ট করার পর আর কিছু খাইনি; আমার বেশ খিদে লেগেছে।
বাবা, চল আমরা ‘কোয়ালিটি’তে যাই।
হ্যাঁ, চল।
শান্ত সঙ্গে সঙ্গে বলে, মৌ, একটু হাঁটতে পারবে তো?
খুব বেশি দূর না তো?
না, না খুব বেশি দূর না।
তাহলে চল, কথাবার্তা বলতে বলতে হেঁটে যাই।
হাঁটতে হাঁটতেই পার্বতী বলে, বাবা, মা আমাদের কাছে থাকে না কেন?
তোমার মা যে কলকাতার কলেজে পড়ায়।
পার্বতী হাসতে হাসতে বলে, বাবা, মাকে দেখে তো মনে হয়, সী ইজ এ কলেজ স্টুডেন্ট!
মৌ একটু হেসে বলে, এই বাঁদর মেয়ে এই বুড়ীকে দেখে তোমার কলেজ স্টুডেন্ট মনে হচ্ছে?
সত্যি বলছি মা, তোমাকে দেখতে এত সুন্দর, এত ইয়াং যে তোমাকে কলেজ স্টুডেন্টই মনে হয়।
মৌ হাসতে হাসতে বলে, পার্বতী, এবার তোমাকে আমি পিটুনি লাগাব।
তুমি যে কি পিটুনি লাগাবে, তা আমার জানা আছে।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর পার্বতী বলে, মা, তুমি কী আমাদের ছেড়ে কলকাতা চলে যাবে?
আমি তো তোমাকে ছেড়ে যেতে চাই না কিন্তু তোমার বাবা কী আমাকে থাকতে দেবে?
মা, তুমি ভাল করেই জানো বাবা হ্যাঁজ এ গোল্ডেন হার্ট!
পার্বতী না থেমেই বলে, তুমি কাছে থাকো না বলে বাবা তো তোমার ছবি দিয়ে সারা বাড়ি সাজিয়ে রেখেছে।
রিয়েলী?
হ্যাঁ, মা, সত্যিই তাই। তিনজনেই হাঁটছে; হাঁটতে হাঁটতে পার্বতী ওদের থেকে একটু এগিয়ে যায়।
.
শান্ত মৌ-এর কাছে এসে চাপা গলায় বলে; তোমাকে দেখেই তো আমার মনে ঝড় উঠেছে; কার জন্য যৌবন ধরে রেখেছ?
আমার ডাকাত বরের জন্য।
মৌ ওর চোখের পর চোখ রেখে হাসতে হাসতে বলে।