পিয়নের ঐ কড়া নাড়ার শব্দটি অত্যন্ত পরিচিত। তাই তো
পিয়নের মুখের কথা বেরুতে না বেরুতেই ভদ্রমহিলা ঘর থেকে বেরিয়ে এসেই চিঠিটা হাতে তুলে নেন। কার চিঠি? অমল সান্যাল?
উনি তাড়াতাড়ি এগিয়ে পাশের বাড়ির দরজার সামনে গিয়ে পিয়নের হাতে চিঠিটা ফেরত দিয়ে বললেন, আমাদের বাড়িতে তো অমল সান্যাল বলে কেউ নেই।
পিয়ন ঠিকানাটা আরেকবার দেখে নিয়ে বললেন, কিন্তু ঠিকানা তো আপনাদের বাড়িরই দেখছি।
হ্যা ঠিকানা তো আমাদের বাড়িরই কিন্তু এ বাড়িতে তো শুধু আমরাই থাকি।
পিয়ন চিঠিটি ব্যাগের মধ্যে ভরে রেখে এগুতে এগুতেই বললেন তা তো জানি।
পনের-কুড়ি দিন পরের কথা। পিয়ন খট খট করে কড়া নেড়েই চিঠিটা দরজার সামনে ফেলে না দিয়ে শুধু বললেন, চিঠি!
ভদ্রমহিলা ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই পিয়ন ওর হাতে আগের মতই একটা মোটা খাম দিয়ে বললেন, এ চিঠি কি রাখবেন?
ভদ্রমহিলা চিঠি হাতে নিয়ে প্রায় আপন মনেই বিড়বিড় করে বলেন, অমল ব্যানার্জী? চিঠিটা আবার পিয়নের দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, না ভাই, এখানে অমল বলেও কেউ থাকে না।
কয়েকদিন পরে আবার একটা চিঠি। অশোক মুখার্জী। এবার ভদ্রমহিলা না হেসে পারেন না। বলেন, এ তো ভারী মজার ব্যাপার শুরু হয়েছে। যাদের সঙ্গে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই কোনকালে যাদের নাম শুনিনি, শুধু তাদেরই চিঠি আসতে শুরু করেছে।
এবারও পিয়ন চিঠিটা ফেরত নেন কিন্তু অপর্ণাকে জিজ্ঞেস করেন, এসব চিঠি চৌধুরীবাবুর বন্ধু-বান্ধবের না তো?
অপর্ণা এক গাল হাসি হেসে বলেন, অশেষ তো পাটনার ছেলে, চাকরি করে বোম্বের এক ফার্মে। তাছাড়া ওকে ঘুরে বেড়াতে হয় আসাম-ত্রিপুরা-মণিপুর-নাগাল্যাণ্ডে। পিয়নের মনে খটকা লাগলেও মুখে কিছু বলেন না। অন্য বাড়ির দিকে দুএক পা এগিয়ে উনি আবার পিছিয়ে এসে অপর্ণাকে বলেন, চিঠি তো কয়েকদিন পোস্টাফিসে পড়েই থাকবে, তাই একবার চৌধুরীবাবুকে জিজ্ঞেস করে দেখবেন, যদি চিঠিটা ওঁর বন্ধু-বান্ধবের হয়…
উনি তো কদিন আগেই গোহাটি গেলেন, দশ-বারো দিনের আগে কখনই ফিরবেন না।
সব চিঠিগুলো এসে হাজির হয় রিটার্ন লেটার অফিসে শৈলেনদার টেবিলে। যথারীতি চিঠি খুলেই পত্রদাতার ঠিকানা বের করার চেষ্টা করতে হয় ওঁকে।…
আমার অনেক অনেক আদরের তুমি, দার্জিলিং থেকে লেখা তোমার চিঠিখানা পেয়ে যে কি আনন্দ হল, তা লিখে জানাবার ভাষা আমার জানা নেই। সারাদিনে চার-পাঁচবার চিঠিটা পড়েও মন ভরল না বলে রাত্রে শুয়ে শুয়ে বহুবার চিঠিটা পড়লাম। তুমি যে আমাকে কত গভীর ভাবে ভালোবাসে, তা আবার নতুন করে উপলব্ধি করলাম এই চিঠি পড়ে।
মা মারা যাবার পর পরই দাদু-দিদা আমাকে ওদের কাছে নিয়ে এলেন। তখন ঠিক ছিল, আমি একটু বড় হয়ে বাবার কাছে ফিরে যাব কিন্তু মা মারা যাবার বছর খানেকের মধ্যেই বাবা আবার বিয়ে করায় আমাকে আর উনি নিজের কাছে নিয়ে যেতে পারলেন না। তাছাড়া দাদু-দিদাও আমাকে ছাড়লেন না। দাদু-দিদার কাছে খুবই আদর-যত্নে মানুষ হয়েছি কিন্তু তবুও কোথায় যেন একটা শূন্যতার বেদনা-জ্বালা অনুভব করতাম। আমি দাদু-দিদার চোখের মণি ছিলাম ঠিকই কিন্তু তবু মাঝে মাঝে মা-বাবা ভাই-বোনের সান্নিধ্য ভালবাসার জন্য মন বড় ব্যাকুল হয়ে উঠত। পাঁচজনের সংসারে মানুষ হইনি বলে আমি কোনদিনই বিশেষ কারুর সঙ্গে মেলামেশা করতে পারতাম না। স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে আমার কোন বন্ধু ছিল না বললেই হয়। তবু পড়াশুনা আর দাদু-দিদার সঙ্গে হাসিঠাট্টা গল্পগুজব করে দিন বেশ কাটত। এম. এ পরীক্ষার রেজাল্ট বেরুবার কদিন আগেই দাদু মারা গেলেন। দাদুর শরীর বরাবরই খারাপ ছিল তবু কখনও ওঁর শরীর একটু বেশি খারাপ হলেই দিদা খুবই অস্থির হয়ে উঠতে ও আমাদের ফ্যামিলী ফিজিসিয়ান ডাঃ বসুকে ডেকে পাঠাতেন ডাঃ বসুকে ঘরে ঢুকতে দেখলেই দাদু একটু হেসে বলতেন, আপনি আবার কষ্ট করে এলেন কেন? এরকম শরীর খারাপ তো আমার প্রায়ই হয়। আবার দাদু একবার আড় চোখে আমাকে ও দিদাকে দেখে নিয়ে বলতেন, আমার বুড়ী বউ কিছুতেই বিশ্বাস করে না আমার যুবতী স্ত্রী এম. এ. পাস না করা পর্যন্ত আমার কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়। সত্যি, দাদু কথার খেলাপ করেননি।
যাইহোক দাদুর মৃত্যুর পর আমি জীবনে প্রথম অনুভব করলাম, কাউকে ভাল না বেসে ভুল করেছি কিন্তু ভালবাসার মানুষ কী চাইলেই পাওয়া যায়?
শুনেছি, জন্ম-মৃত্যু-বিয়ের ব্যাপারে কেউ আগে থেকে কিছু বলতে পারে না। এভাবে হঠাৎ যে আমার বিয়ে হবে, তা আমি স্বপ্নে ভাবিনি। তোমাকে দিদার এত ভাল লেগেছে যে কি বলব। তাছাড়া দিদা বার বার আমাকে একটা কথা বলেছেন, দ্যাখ দিদিভাই, তোর মত অমল ভাইও বাপ-মায়ের আদর পায়নি জ্যেঠা-খুড়োর কাছে মানুষ হয়েছে। তাইতো বলছি, ও তোকে ভালবাসায় ভরিয়ে দেবে। দিদিভাই, তুইও ওর জীবনের সব দুঃখ ঘুচিয়ে দিস।
বিয়ের পর যে কদিনের জন্য আমরা একসঙ্গে থেকেছি, তার মধ্যেই আমি বুঝেছি, দিদা ঠিকই বলেছেন। সত্যি ঐ কটা দিন তুমি এমন আদর-ভালবাসায় আমাকে ভরিয়ে দিয়েছ যে তার স্বাদ, মধুর স্মৃতি আমি জীবনে কোন দিন ভুলতে পারব না।
তোমার কলকাতার কাজ কবে শেষ হবে? জানি, কাজ শেষ হবার পর এক মুহূর্তও তুমি ওখানে থাকবে না। তুমি আমার কাছে ছুটে আসবে। খাওয়া-দাওয়া ঠিক মত করছ তো? আর হ্যাঁ, দিদার পরামর্শ মত উকিল দাদু দুটি ব্যাঙ্ককেই জানিয়ে দিয়েছেন, তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে। ব্যাঙ্ক ও নানা জায়গায় তোমার আমার নতুন করে সই করতে হবে। তুমি এলেই সেসব কাজ সেরে ফেলতে হবে।