তারপর ঐ কোয়ার্টসগুলোতে খোঁজ নিতেই… উনি আমার দিকে তাকিয়ে মাথা এদিক-ওদিক দুলোতে দুলোতে মুচকি হেসে বললেন, ওহে শ্ৰীমান, এ খবরের কাগজের রিপোর্টারী না যে কিছু একটা লিখে দিলেই হল।
আমি শুধু হাসি।
হঠাৎ শৈলেনদা গম্ভীর হয়ে বললেন, সমস্ত খোঁজখবর নেবার পর ঐ অঞ্চলের একজন সিনিয়র পোস্টাল ইন্সপেক্টরকে সঙ্গে নিয়ে আমি নিজেই মনীষার চিঠি নিয়ে হাজির হলাম দাশুবাবুর আস্তানায়।
মুহূর্তের জন্য একটু থেমে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, সত্যি বলছি বাচ্চু, সেদিনের কথা আমি জীবনেও ভুলব না।…
পাকা তিন-চারতলা বাড়ির কয়েকটি ব্লক। অতীতদিনের কয়েক শ বস্তিবাসীকে এখানে ঠাঁই দিয়ে সরকার মহৎ কাজ করলেও এই আধুনিক নরক দেখে শৈলেনদার মাথা ঘুরে যায়। কচি-কাঁচা থেকে বুড়োবুড়ি মানুষ আর বেড়াল-কুকুর-গরু-ছাগল আর শুয়োরের এমন মিলে-মিশে অবাধ স্বাধীনতাভোগের এমন বিরল দৃশ্য দুনিয়ার আর কোথাও আছে বলে মনে হয় না। এমন স্বর্গরাজ্যে দাশু দাসকে আবিষ্কার করা খুব সহজসাধ্য হয়নি।
জানো বাচ্চু, মাঠের এক পাশে একটা ভাঙা খাঁটিয়ায় বৃদ্ধকে দেখেই বুঝলাম, মৃত্যু ওর সামনে এলে উনি বোধহয় তাকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরবেন।
আমি বললাম, যেসব বুড়োবুড়িকে পরের দয়ায় বেঁচে থাকতে হয়, তাদের সবার অবস্থাই ঐ রকম।
যাইহোক আমি ওকে চিঠিটা পড়ে শোনাতেই উনি হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, আমি জানতাম, আমার চন্দনবাবা আমাকে ভুলে যেতে পারে না, পারে না, পারে না।
আমি কোন কথা বলি না। চুপ করে ওর কথা শুনি। শৈলেনদা আবার বলেন, তারপর ঐ চিঠি আর টাকা হাতে নিয়ে পাগলের মত চিৎকার করে বললেন, ওরে, আমার চন্দনবাবার বউ চিঠি লিখেছে, টাকা পাঠিয়েছে। আমি আর এখানে থাকব না। আমি বোম্বাই চলে যাব। শৈলেনদা আবার একটু থামেন। তারপর বললেন, সত্যি বলছি বাচ্চু, পরশপাথরের ছোঁয়ায় যেমন লোহালঙ্কড়ও সোনা হয়, মনীষার ঐ চিঠিটা পেয়ে ঐ মৃত্যুপথযাত্রী মানুষটাও যেন আনন্দে খুশিতে যৌবনের দিনগুলোতে ফিরে গেল।
আমি একটু হেসে বললাম, ভালবাসার পরশপাথরের ছোঁয়ায় সবকিছুই সম্ভব।
ঠিক বলেছ ভাই।
৫. বাটা কোম্পানীর এক সেলসম্যান
ছোটোবেলায় আমাদের পাড়ায় বাটা কোম্পানীর এক সেলসম্যান থাকতেন। তিনি পথে-ঘাটে হাটে-বাজারে আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব দের বাড়িতে বিয়ের নেমন্তন্ন খেতে গিয়েও সব সময় সবার পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখতেন, কে কি জুতো পরেছেন।
পাড়ার সবাই ওকে নিয়ে ঠাট্টা করতেন। কেউ বলতেন, শম্ভুদা নিশ্চয়ই শুভদৃষ্টির সময় বোদির মুখের দিকে না তাকিয়ে পায়ের দিকে তাকিয়েছিলেন।
সঙ্গে সঙ্গে আরেকজন ফোঁড়ন কেটে বলতেন, তার চাইতেও বড় কথা বৌদিকে খালি পায়ে দেখেই উনি বুঝেছিলেন, পাঁচ নম্বর লাগবে।
শম্ভুদা শুভদৃষ্টির সময় সত্যি সত্যি বৌদির পায়ের দিকে তাকিয়ে ছিলেন কিনা অথবা তাকে খালি পায়ে দেখে দুঃখ পেয়েছিলেন কিনা, তা আমি জানি না। তবে তার দৃষ্টি যে সর্বত্র সব সময় নিম্নগামী ছিল, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
তখন শম্ভুদাকে দেখে অবাক হতাম। মনে হত উনি কি অদ্ভুত মানুষ।
এখন জেনেছি, এই বিশ্ব-সংসারের অধিকাংশ মানুষই শম্ভুদা! কেউ পায়ের জুতো দেখেন, কেউ বা অন্যকিছু।
আমাদের মনোরঞ্জনবাবু মাস্টারমশাই সব সময় বলতেন, আমাদের দেশে মাস্টারদের সম্মান নেই বলেই তো দেশের এই দুর্গতি! ওরে বাপু, মাষ্টারমশাইরাই তো জাতিকে সত্যিকার উন্নত করতে পারেন। জজ-ম্যাজিস্ট্রেট বা ব্যবসাদার দিয়ে কী দেশের সত্যিকার উন্নতি হয়?
দারোগাবাবুরা চব্বিশ ঘণ্টাই চোর-ডাকাত খুন-জখম-রাহাজানি লুঠপাট-বলাৎকার নিয়ে ব্যস্ত ও বিব্রত থাকেন বলে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষকে বিশেষ খুঁজে পান না। ডাক্তারবাবুদের ধারণা, সবাই কোন না কোন রোগে ভুগছেন। উকিলবাবুরা ভাবতেই পারেন না, কোর্ট কাছারি না করেও সংসারে থাকা যায়। ডেনটিস্টদের একটাই দুঃখ, দেশের লোকজন দাঁতের যত্ন নিতে শিখল না। অর্থাৎ আমরা সবাই এক একজন শম্ভুদা! অনন্ত বৈচিত্র্যময় বিশ্ব-সংসারের মানুষও কম বৈচিত্র্যে ভরা নয় কিন্তু আমরা কজন সেই অজানা জগতের খবর রাখি?
একদিন কথায় কথায় শৈলেনদা বললেন, চাকরি পাবার পর প্রথম দিকে খুবই মন খারাপ লাগত।
কেন?
উনি একটু হেসে বললেন, এই মাটির পৃথিবীর উপর দিয়ে হাঁটা চলা করার সময় কি আমরা স্বপ্নেও ভাবতে পারি, আমাদের পায়ের নিচের মাটিতেই সোনা রুপো হিরে ছড়িয়ে আছে?
আমি মাথা নেড়ে বলি, ঠিক বলেছেন।
নানা রকম হাতের লেখা পড়তে আমার ভাল লাগলেও প্রথম প্রথম এই একঘেয়েমির কথা ভেবেই বিরক্তবোধ করতাম।
উনি আরও কি বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু আমি ওঁকে বাধা দিয়ে বললাম, কিছুদিন পরে বুঝি বুঝলেন, ঐ অসংখ্য চিঠিপত্রের জঙ্গলের মধ্যেই বহু সম্পদ ছড়িয়ে আছে?
ঠিক বলেছ ভাই। উনি মুহূর্তের জন্য আনমনা হয়ে কি যেন একটু ভাবেন। তারপর বলেন, এই চিঠিপত্র ঘাটাঘাটি করতে করতে কত মানুষের কত ভাল-মন্দ সুখ-দুঃখের কথা যে জানলাম তার হিসেব করতে গেলেও মাথা ঘুরে যায়।
তা তো বটেই। পিয়ন খটখট্ কড়া নেড়েই দরজার সামনে একটা চিঠি ফেলে দয়েই একটু জোর গলাই বললেন, চিঠি!