এ চিঠি এখানেই শেষ কিন্তু এর নিচে নাম আছে–ইতি নন্দ।
দুটি চিঠির কোনটিতেই পত্ৰপ্রেরকের ঠিকানা ছিল না এবং থাকলেও এ চিঠি আর-এল-ও অফিস থেকে পত্রপ্রেরকের কাছে পাঠানো হতো না।
শৈলেনদা আপনমনে কথা বলতে বলতে একটু থামতেই আমি জিজ্ঞেস করি, চিঠি দুটো আপনাদের অফিসে এল কেন?
উনি একটু হেসে বললেন, আসলে সন্তুর নামের নিচে বিকাশের ঠিকানা লেখা ছিল।
আবার বিকাশের নামের নিচে বুঝি সন্তুর ঠিকানা লিখেছিল।
হ্যাঁ।
যাই হোক, তারপর কী হল?
চিঠি দুটো সঙ্গে সঙ্গে আমরা লালবাজারের গোয়েন্দা বিভাগে পাঠিয়ে দিলাম।
শৈলেনদা এবার একটা সিগারেট ধরিয়ে দুএকটা টান দেবার পর বললেন, আর দুটো দিন দেরি হলেই সর্বনাশ হয়ে যেত।
আসল ব্যাপারটা কী ছিল?
কী আর ব্যাপার? গুণ্ডা-বদমাইসা যা করে আর কি! নাম ঠিকানা ঠিক থাকলে ঐ ধ্রুব বেচারী প্রাণ হারাত আর শিউলিকে নিয়ে নন্দ ব্যাঙ্গালোর চলে যেত।
তাই নাকি?
তবে কী?
ধ্রুব কী অপরাধ করেছিল যে…
আমার কথার মাঝখানেই উনি বলেন, নন্দ বিখ্যাত গুণ্ডা ও বদমাইস ছিল। ও নেপাল থেকে আফিঙ স্মাগলিং করে এনে বিদেশে পাচার করত। এই কাজের জন্য ও একদল মেয়েকে রেখেছিল। শৈলেনদা একটু হেসে বললেন নন্দ এই মেয়েগুলোর সঙ্গে স্ফুর্তিও করত।
কিন্তু ধ্রুব?
বলছি, বলছি।
আমি আর প্রশ্ন করি না! শৈলেনদা আবার বলে যান, আমি চুপ করে শুনি।
নন্দর এইসব কাজ-কারবারের জন্য পাড়ার লোকজন অত্যন্ত বিরক্ত বোধ করলেও প্রকাশ্যে ওর বিরুদ্ধে কিছু বলতে সাহস করতেন না কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর সহ্য না করতে পেরে বেচুবাবু একদিন নিজে গিয়ে পুলিশকে খবর দিয়ে তুলকালাম কাণ্ড করে দিলেন।
তিন বছর প্রেসিডেন্সী জেলে কাটিয়ে আসার কিছুদিন পরই নন্দ হঠাৎ একদিন শিউলিকে দেখেই পাগল হয়ে উঠল। ব্যস! পরদিন ও বেচুবাবুকে গিয়ে বলল আপনার শিউলির সঙ্গে আমার বিয়ে দিন।
ঐ লম্বা চওড়া বেচুবাবু সঙ্গে সঙ্গে ওর গালে ঠাস করে একটা চড় মেরে বললেন, জবাব পেয়েছ?
নন্দ মাথা ঘুরে পড়ে যেতে যেতে নিজেকে কোন মতে সামলে নিয়ে শুধু বলল, সুদে-আসলে এর জবাব দেব।
তোমার মত পুচকে গুণ্ডাকে বেচু সরকার ভয় করে না।
সত্যি বেচু সরকার ওকে ভয় করতেন না। শিউলির বিয়ের দিন নন্দ দুজন সাগরেদকে সঙ্গে নিয়ে হামলা করতে এসে এমন শিক্ষা পেয়েছিল যে তা সে জীবনে ভুলতে পারবে না।
শৈলেনদা এক নিঃশ্বাসে সব বলে যান।
আমি জানতে চাই, নন্দ কি বেচুবাবুর মেয়ে-জামাইকে খুন করার প্লান করেছিল?
মেয়েকে না, শুধু জামাইকে খতম করার প্ল্যান করেছিল। জামাইকে শেষ করে মেয়েকে নিয়ে উধাও হবার মতলব ছিল।
পুলিস ধরে ফেলেছিল নিশ্চয়ই?
ধরেছিল মানে? রাবণের গুষ্টিকে ধরেছিল। তারপর তো কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরুল।
তার মানে?
দেখা গেল, নন্দ সন্তুকে দিয়ে আগে আরও দুটো মার্ডার করিয়েছে। তাছাড়া কলকাতা পোর্টে আসার সময় কিছু বিদেশী জাহাজ ডায়মণ্ডহারবারের ওদিকে গঙ্গার জলে বাক্স ভর্তি রিভলবার ফেলে দেয় ও বিকাশ সেসব নিয়ে ব্যবসা করে।
আমি একটু হেসে বললাম, ঐ রিভলবারকেই বুঝি চিঠিতে গঙ্গার ইলিশ বলেছে?
শৈলেনদা একটু হেসে বললেন, হ্যাঁ, আর দশ দিস্তা নতুন কাগজ মানে নতুন দশ হাজার টাকার বাণ্ডিল।
কয়েক বছর ধরে এই মামলা চলেছিল। দায়রা জজের রায়ের বিরুদ্ধে ওর। হাইকোর্টে আপিল করেছিল কিন্তু কিছু লাভ হয়নি। সন্তু অর নন্দ যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে এখনও প্রেসিডেন্সী জেলে রয়েছে।
শৈলেনদা এই মামলার অন্যতম সাক্ষী ছিলেন। দায়রা জজ ও হাইকোর্টের মহামান্য বিচারপতি ওঁর ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। বিচারপতিদের প্রশংসার জন্য কিছু মাইনেও বেড়েছিল!
আর?
শৈলেনদা এখন বেচুবাবুর পরমাত্মীয়। আর শিউলি তো কাকু বলতে অজ্ঞান।
এ সংসারে কখন কোথায় যে অঘটন ঘটবে, তা কেউ জানে না, জানতে পারে না।
৪. আমরা চিঠি লিখি, ডাকবাক্সে ফেলি
আমরা চিঠি লিখি, ডাকবাক্সে ফেলি। কিছু কিছু চিঠি ঠিক সময়ে ঠিক মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। কিছু চিঠি নানা ডাকখানার মোহরে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে কয়েক দিন পর যথাস্থানে হাজির হয়। কিছু কিছু চিঠিপত্র আরও কিছুদিন ডাক বিভাগের আদর-আপ্যায়ন উপভোগ করার সৌভাগ্য লাভ করে। এসব চিঠিপত্রের ঠিকানায় লাল-কালো কালি দিয়ে কাটাকুটি থাকে কিন্তু কে বা কারা এই কাটাকুটি করে ঠিকানা সংশোধন করার দায়িত্ব বহন করেন, সে খবর আমরা রাখি না। রাখার প্রয়োজনও অনুভব করি না।
শীতের রাতে যেসব রেলযাত্রী লেপ মুড়ি দিয়ে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করেন, তারা কী গার্ডসাহেব বা ড্রাইভারের রাত্রি যাপনের কাহিনী জানেন! নাকি জানতে চান? আমরা নিজেদের কাজটুকু হলেই খুশী কিন্তু কে বা কারা এই কাজ সম্পন্ন করল, তা জানতে, বুঝতে চাই না।
দুর্ঘটনাক্রমে শৈলেনদার সঙ্গে আমার আলাপ-পরিচয় না হলে হয়তো আমিও জানতে পারতাম না, আর-এল-ও অফিসের অন্দরমহলে কে বা কারা নীরবে কত হারিয়ে যাওয়া মানুষকে আবার আমাদের কাছে এনে দিচ্ছেন। খামের উপর ঠিকানা ছিল শ্রীদাশু দাস, গগন ডাক্তারের বাগান, পাইকপাড়া, কলকাতা। না, পাইকপাড়া পোস্ট অফিসের কেউই গগন ডাক্তারের বাগান কোথায় তা খুঁজে পেল না। আশেপাশের কয়েকটি পোস্ট-অফিসেও চিঠিটা পাঠানো হল, ওদের ওখানেও গগন ডাক্তারের বাগানের হদিস পাওয়া গেল না।