…স্নেহের খোকা, আমি জানি এই চিঠি পেয়ে তুই অবাক হয়ে যাবি। কোনদিন কাউকে চিঠিপত্র লিখি না, দরকারও হয় না। যার বাপের বাড়ি, শ্বশুর বাড়ি পাশাপাশি গ্রামে, যার ভাইবোনের। পর্যন্ত আশেপাশের গ্রামেই থাকে, সে কাকে চিঠি লিখবে? এর আগে কবে কাকে চিঠি লিখেছি, তা মনেও পড়েনা। তবু তোকে চিঠিলিখছি। লিখতে বাধ্য হচ্ছি। না লিখে উপায় নেই। বেশ কিছুদিন ধরেই ভাবছি তোকে চিঠি লিখব কিন্তু নানা কারণে তা সম্ভব হয়নি। সারা দিনরাত্তির সংসারের হাজার কাজ নিয়ে এত ব্যস্ত থাকি যে সত্যি সময় পাই না! তাছাড়া তোর অফিসের নাম-ধাম-ঠিকানা কিছুই জানা ছিল না। সবাইকে বলতেও পারি না। শেষ পর্যন্ত অনেক কষ্ট করে তোর অফিসের নাম জেনে এই চিঠি লিখছি। আশা করি দুএকদিন দেরী হলেও এ চিঠি তোর হাতে পৌঁছবে।
আজ তিন বছর তুই দেশ ছাড়া। এর মধ্যে একদিনের জন্যও দেশে আসিসনি। কোনদিন আসবি কিনা তাও জানি না। মাঝে মাঝে মনে হয়, তুই জীবনে এদিকে না এলেই ভাল হয় কিন্তু তোকে আর দেখতে পাব না ভাবলেও আমার মাথা ঘুরে যায়, চোখে জল আসে। তোকে একবার দেখার জন্য মন বড়ই আকুলি-বিকুলি করে কিন্তু তা কী করে সম্ভব? কে আমাকে নিয়ে যাবে? বা যেতে দেবে? আমি যে দাসী, কপর্দক শূন্য। সর্বোপরি আমি যে বাল্যবিধবা। এ সংসারে যার স্বামী-পুত্র নেই, অর্থ নেই, যাকে শ্বশুর-ভাসুরের দাসীবৃত্তি করে এক টুকরো কাপড় আর দুমুঠো অন্নের সংস্থান করতে হয় তার আবার ব্যক্তিগত ইচ্ছা।
এইত কদিন আগেকার কথা। হঠাৎ শ্বশুরমশাই আমাকে বললেন, হ্যাঁগো ছোট বৌমা, তোমার একটা গরদের কাপড় আছে না?
হ্যাঁ, খোকা মাস্টারী করে আমাকে যে গরদের কাপড়টা দিয়েছিল…
আছে কিনা তাই বল। খোকা-খুকীর কথা তো আমি জানতে চাইনি।
বারান্দায় বসে পান-দোক্তা চিবুতে চিবুতে শাশুড়ী-ঠাকরুণ বাঁকা চোখে একবার ছোট বৌকে দেখে নিয়ে স্বামীকে বললেন, আঃ! তুমি চটছ কেন? খোকা ছাড়া ছোট বউয়ের আপনজন কে আছে?
এবার উনি একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, যার জন্য আমরা গ্রামে মুখ দেখাতে পারি না, সেই খোকার কথা আমাদের শুনতেই হবে।
শ্বশুরমশাই গিন্নীর কথার কোন জবাব না দিয়ে শুধু বললেন, তুমি তো ঐ কাপড়টা ব্যবহার কর না। তাই বলছিলাম, এবার থেকে ঐ কাপড়টা পরে আমি নারায়ণ পূজা করবো।
যক্ষের ধনের মত আমি ঐ কাপড়টা রোজ রাত্তিরে একবার বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে মনে করতাম, তোকেই যেন জড়িয়ে ধরেছি। যাই হোক কাপড়টা দেবার পর আমি আর কিছুতেই চোখের জল আট কাতে পারলাম না। ব্যস! ঐ চোখের জল দেখেই শাশুড়ী দপ করে জ্বলে উঠলেন, ওরে বাপু গ্রামের লোক এমনি এমনি বদনাম দেয় না। নিজের পেটের ছেলে না হলে এত দরদ আসে কোথা থেকে।
খোকা, সত্যি বলছি ঐ কয়েক ফেঁটা চোখের জল ফেলার জন্য আমাকে যে কি অপমান সহ্য করতে হয়েছিল, তা শুধু ভগবানই জানেন। মনের দুঃখে আমি পুরো দুটো দিন মুখে একটা দানা পর্যন্ত দিইনি, দিতে প্রবৃত্তি হয়নি। পরে মেজ পিসী আমাকে টেনে নিয়ে জোর করে খাইয়ে দিয়ে বলল, ওরে হতভাগী, না খেয়ে থাকবি কোন্ দুঃখে রে? এ বাড়ির জমিজমায় কী তোর স্বামীর ভাগ ছিল না? দশটা না, পাঁচটা না, তোর একটা পেটের খাবারও কী সে ভাগ থেকে হয় না?
ঐ মেজ পিসীর জন্য আমি এখনও বেঁচে আছি কিন্তু আজ তোকে আমি জানতে বাধ্য হচ্ছি, মেজ ভাসুরের যা মতিগতি তাতে আমি কতদিন বেঁচে থাকতে পারব, তা ঠিক বলতে পারি না। তোকে আমি পেটে ধরিনি ঠিকই কিন্তু তোর মা তোর জন্মের পর পরই ধনুষ্টঙ্কারে মারা যাবার পর তাকে কোলে তুলে নিয়েই আমি সদ্য বৈধব্যের যন্ত্রণ। ভুলেছিলাম। এ বিশ্ব-সংসারে তুই-ই আমার একমাত্র আপনজন। শুধু তোর কাছেই আমার সব দুঃখের কথা বলতে পারি বলেই জানাচ্ছি, মেজ ভাসুর বিপত্নীক হবার পর থেকেই আমার সম্পর্কে বড় বেশি আগ্রহী হয়ে উঠেছেন কিন্তু ওর ঐ অহেতুক আগ্রহ দেখে আমার ভীষণ ভয় হয়। হাজার হোক তুই আমার প্রাণপ্রিয় সন্তান। তাছাড়া তুই বড় হয়েছিস। তোকে বেশি কি আর লিখব। শুধু জেনে রাখ, আমি জীবনে কোন অন্যায় করিনি এবং করব না। আমার পরম শ্রদ্ধেয় মেজ ভাসুর মশাই যদি সম্মান ও সৌজন্যের সীমা লঙ্ঘন করেন, তাহলে আমি তা নীরবে মেনে নিতে পারব না। শুধু এইটুকু জেনে রাখ, তোর মা কোন কলঙ্ক নিয়ে এ পৃথিবীতে একদিনের জন্য ও বাঁচবে না।…
শৈলেনদা অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর বললেন, চিঠিটা পড়ে মাথা ঘুরে গেল কিন্তু কিভাবে ঐ ভদ্রমহিলার খোকার কাছে চিঠিটা পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করব, তা ভেবে পেলাম না।
কেন? ঠিকানা ছিল না?
ঠিকানা ঠিক থাকলে কী চিঠি আমাদের কাছে আসে? মনে মনে বলি, তাইত।
উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তবুও আমরা অনেকে মিলে অনেক চেষ্টা করেও ওকে চিঠিটা পোঁছে দিতে পারলাম না।
চিঠিটা কী ফেরত পাঠালেন?
না, সে ঠিকানাও চিঠিতে ছিল না। চিঠিটা জিয়াগঞ্জে পোস্ট করা হয়েছিল কিন্তু আর কিছু জানা গেল না।
আমি চুপ করে থাকি কিন্তু চোখের সামনে এক অসহায় বিধবার বেদনার্ত মুখের ছবি ফুটে ওঠে।
অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর শৈলেনদা বললেন, দশ-পনর দিন পর হঠাৎ খবরের কাগজে দেখি, জিয়াগঞ্জের কাছেই গঙ্গার জলে এক মধ্যবয়সী বিধবার মৃতদেহ পাওয়া গেছে।