সেদিনও শৈলেনদা পোস্ট অফিসের এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করতে করতে হঠাৎ সটিং-এর ওখানে যেতেই একজন সটার ওর হাতে একটা খাম দিয়ে বললেন, দেখতে খোকাবাবু এই ঠিকানাটা পড়তে পারে। কিনা।
চিঠিটার উপর দিয়ে বেশ কয়েকবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে উনি আস্তে আস্তে বললেন, মো-বাবা-দু…
ওর মুখের কথা শেষ হবার আগেই দুজন সটার প্রায় একসঙ্গে বলে উঠল, হা, হা, মোরাবাদীই হোগা।
বাস! এই অপাঠ্য ঠিকানা উদ্ধারের খ্যাতির কৃপায় শৈলেনদাকে বেজেই দু পাঁচটে ঠিকানা পড়ে দিতে হয়। সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই শৈলেনদা সটিং সেক্সনের সবার বিশেষ প্রিয়পাত্র হয়ে উঠলেন। ওঁর দু-এক ঘণ্টা সময় এখানে বেশ কেটে যায়।
দু ইজ দিস বয়?
বিনা মেঘে বজ্রঘাতও এর চাইতে ভাল। স্বয়ং পারিটেনডেন্ট বঅ পোস্ট অফিস লিভিংস্টোন সাহেবের কথা শুনেই সটিং সেক্সনের সবার মুখ শুকিয়ে গেল।
পোস্টমাস্টার কৃপাসিন্ধু চৌধুরী খুব ভালভাবেই জানতেন, পোস্ট অফিসের মধ্যে এবং বিশেষ করে সটিং সেক্সনে ভ্রাতুস্পুত্রের আগমন ঠিক হয়নি। তবু তিনি সাহস সঞ্চয় করে বললেন, স্যার, ও আমার ভাইপো। এ কদিনের মধ্যেই অপাঠ্য ঠিকানা উদ্ধারের একজন এক্সপার্ট হয়ে গেছে।
ইজ ইট! মিঃ লিভিংস্টন হাসতে হাসতে সর্টারদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস কবলেন, টুমাদের মত করে?
সব সর্টাররা এক সঙ্গে ঘাড় কাত করে বলল, জী হুজুর!
ব্যাস! আর এক-মুহূর্ত দেরি না। মিঃ লিভিংস্টোন সঙ্গে সঙ্গে পোষ্টমাষ্টার সাহেবকে বললেন, ভাইপোকে নিয়ে তুমি কলকাতায় মিঃ মুর-এর সঙ্গে দেখা করবে। আমি ওকে আগে থেকে বলে রাখব। হি মাস্ট জয়েন ডি-এল-ও।
সেদিন কৃপাসিন্ধু চৌধুরীর সেকি আনন্দ! উল্লাস! ভ্রাতুষ্পুত্রকে নিয়ে কোয়ার্টার্সে ফিরেই চিৎকার করে গিন্নীকে বললেন, শুনছ! স্বয়ং লিভিংস্টোন সাহেব বাদলের চাকরির ব্যবস্থা করে দিলেন। এই সব সাহেবদের অধীনে চাকরি করেও আনন্দ।
চৌধুরী গিন্নী পান-দোক্তা লাঞ্ছিত দন্ত বিকশিত করে বললেন, বল কি গো!
ওরে বাপু হ্যাঁ! এ হচ্ছে ইংরেজের বাচ্চা! পাকা জহুরী। এরা এক মিনিটে ধরতে পারে কাকে দিয়ে কি হবে। কৃপাসিন্ধুবাবু একটু চাপা হাসি হেসে বললেন, এই ক্ষমতা না থাকলে ওরা পৃথিবী ব্যাপী সাম্রাজ্য চালাচ্ছে কী করে?
চৌধুরী গিন্নী শৈলেনদার মাথায়-মুখে হাত দিয়ে বললেন, সুখে থাক বাবা! বাবা-মাকে সুখী কর।
এবার কৃপাসিন্ধুবাবু শৈলেনদার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোর মত ভাগ্যবান লাখে একজন হয় না। সাহেবের মান রাখিস বাবা! তা না হলে আমি মুখ দেখাতে পারব না।
২. অতীতের ডি-এল-ও আজকের আর-এল-ও
অতীতের ডি-এল-ও আজকের আর-এল-ও সত্যি এক বিচিত্র অফিস। হাজার-হাজার লাখ-লাখ চিঠিপত্র-পার্শেল-প্যাকেটের ঠিকানা উদ্ধার করতে না পারায় পোস্ট অফিস থেকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় এই দপ্তরে।…রাম লখন সিং, ৫২ লরী, ক্লীব ইসষ্ট্রিট, কলকাতা। হিন্দীতে লেখা এই ঠিকানা দেখে পোস্ট অফিসের সর্টাররা কোন কিছু বুঝতে না পারলেও আর-এল-ও অফিসে নতুন করে ঠিকানা লিখে দেওয়া হয়-রাম লখন সিং, বামার লরী, ক্লাইভ স্ট্রিট ( নেতাজী সুভাষ রোড ), কলকাতা।
ক্রশ স্ট্রীটের ঠিকানার বহু চিঠিতেই লেখা থাকে -X স্ট্রীট। অথবা অনেক ছেলেছোকরার দল বন্ধুবান্ধবকে শুধু নম্বর দিয়ে ঠিকানা লিখে পাঠায়–
নাম-4, 1, 21, 4/20, 15, 16, 14, 15
গ্রাম–2, 1, 18, 11, 21, 1, 1, 15, 10, 15,
পোঃ- 19, 1, 21, 18, 4।
উড়িষ্যা।
আর-এল-ও অফিস চোখের নিমেষে ঠিকানাটি করে লিখে দেয়–
DAUD TONPO
Vill–BARKULA GOJO
P.O.–SARDA
Dist-SUNDARGARH ( ORISSA)
কোন কোন চিঠিতে আবার লেখা থাকে -চাকাই ব্রিস্ট। আর এল-ও লিখে দেয় –চক্র বেড়িয়া… গ্রামগঞ্জ থেকে একটু ইংরেজী জানা অনেকেই লেখে ছাম মার্কেট স্ট্রীট। আসলে ওটা শ্যামবাজার স্ট্রীট।
নানা রকমে গাইড আর কর্মীদের তীব্র সাধারণ জ্ঞানের দ্বারাই অধিকাংশ পথভ্রষ্ট চিঠিপত্তব সঠিক জায়গায় পৌঁছে যায়। তবে সব সময় কখনই নয়।
এই আর-এল-ও অফিস নিয়ে শৈলেনদার সঙ্গে গল্প করতে আমার খুব ভাল লাগে। লাগবে না কেন? আমরা জানি, পোষ্ট কার্ড–ইনল্যাণ্ড খামে চিঠি লিখে আমরা ডাকবাক্সে ফেলি। তারপর? দুদিন আগে বা পরে সে চিঠি পৌঁছে যায় সঠিক ঠিকানায়। প্রয়োজনে উত্তর এসে যায় যথা সময়ে। কার কোন চিঠি হারিয়ে গেল তা নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা কী?
আমাদের মাথাব্যথা না থাকলেও আর-এল-ও অফিসের মানুষদের মাথাব্যথা আছে বৈকি। তা না হলে শক্তি চৌধুরী কী মার অপারেশনের আগে পৌঁছতে পারতেন? যদি ঠিকানা উদ্ধার করতে না পারেন, তাহলে আপনারা কী করেন? আমি শৈলেনদাকে প্রশ্ন করি।
প্রয়োজনে আমরা চিঠি খুলি পড়ি। যদি ঐ চিঠি পড়ে ঠিকানা উদ্ধার করা সম্ভব হয়, তাহলে তো ভালই কিন্তু যদি তা না হয়, তাহলে যিনি চিঠি লিখেছেন, তাকেই ফেরৎ পাঠিয়ে দিই।
যদি তার ঠিকানা থাকে, তবেই তো?
সে তো একশবার।
তার মানে অনেক মানুষের অনেক চিঠিও আপনানের পড়তে হয়?
তা হয় বৈকি!
কথাটা বলেই শৈলেনদা একটু আনমনা হয়ে গেলেন। দূরের আকাশের কত অসংখ্য ছোট-বড় খ্যাত-অখ্যাত তারকা দেখে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, যারা আমাকে চেনে না, জানে না, জীবনে কোনদিন দেখেনি ও দেখবে না, তাদের কতজনেরই কত কি জানলাম!