আমি তোমার জন্মদাতা হলেও তোমার পিতৃপরিচয় দেবার সাহস বা অধিকার আমার নেই। সবাই জানেন, তুমি ডাঃ সন্তোষ রায়ের কন্যা। আমিও জানি, তিনি তোমাকে পিতৃত্বের স্নেহ-ভালবাসায় ভরিয়ে দিয়েছেন এবং সেজন্য আমিও তার কাছে আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব।
আমার পরলোকগতা মার ইচ্ছা পূরণের জন্যই এই চিঠি লিখছি। বাবা এই নেকলেসটা আমাকে দিয়ে বলেছিলেন, তোমার প্রথম সন্তান পুত্র হলে, তোমার পুত্রবধূকে এইটি দিও। আর যদি প্রথম সন্তান কন্যা হয়, তাহলে তার বিয়ের সময় এই নেকলেসটা তাকে দিও। মার ইচ্ছা পূরণের জন্যই এই নেকলেসটা তোমাকে পাঠালাম।
আর একটি কথা। এ সংসারে আমার মেয়াদ আর খুব বেশি দিনের নয় বলেই মনে হচ্ছে। তোমাকে দেবার মত আমার বিশেষ কিছুই নেই। তাছাড়া আমার কী অধিকার? তবু বলছি, গ্রাচুইটি প্রফিডেন্ট ফাণ্ডের যা কিছু ইউনিভার্সিটি থেকে পেয়েছি, তার অর্ধেকেরও বেশি চিকিৎসার জন্য ব্যয় করেছি। আগামী সপ্তাহে ভেলোর যাচ্ছি অপারেশনের জন্য। সে জন্যও বেশকিছু ব্যয় হবে। তবু কিছু থাকবে বৈকি। যা থাকবে, তা তোমার সন্তানের জন্য আশীর্বাদ হিসেবে রেখে দেব। স্টেট ব্যাঙ্কের গড়িয়াহাট বাঞ্চে সব নির্দেশ দেওয়া আছে। যদি তোমার ও সুদীপের আপত্তি থাকে তাহলে ব্যাঙ্ক এই টাকা রামকৃষ্ণ মিশনে পাঠিয়ে দেবে।
তোমরা দুজনে আমার প্রাণভরা ভালবাসা নিও।
শৈলেনদা থামলেন।
আমিও চুপ।
কিছুক্ষণ পরে উনি বললেন, এই চিঠিটার কথা আমরা কেউ কোনদিন ভুলব না।
কেন?
উনি একটু ম্লান হাসি হেসে বললেন, যেদিন সকালের কাগজে দেখলাম, ভেলোরে অধ্যাপক অরূপ মুখার্জীর মৃত্যু হয়েছে, সেইদিনই অনুরাধা আর তার স্বামী ঐ পার্সেলটার খোঁজে আমাদের অফিসে এসে হাজির।
বলেন কী?
হ্যাঁ ভাই।
তারপর?
তারপর ঐ পার্সেলটা বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে অনুরাধার কি কান্না।
৭. পুরানো কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করতে
পুরানো কাগজপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে শৈলেনদার শ্রাদ্ধের কার্ডটা হাতে পেয়েই আজ আমার ওঁর কথা মনে পড়ল। উনি বহুকাল আগেই রিটায়ার করেছিলেন এবং সব রিটায়ার্ড লোকজনদের মতই উনিও রিটায়ার করার পরই অফিসের গল্প বেশি করতেন।
বৌদি সারাজীবন ধরে ঐসব গল্প শুনেছেন বলে অনেক সময়ই বিরক্ত হয়ে ওঁকে বলতেন, ঐ অফিসের গল্প ছাড়া কি আর কোন বিষয়ে কথা বলতে পার না?
শৈলেনদা হাসতে হাসতে জবাব দিতেন, ওহে সুন্দরী, এই চিঠি পত্রের মানুষগুলোকে নিয়েই তো জীবন কাটালাম। ওদের নিয়ে ছাড়া আর কাদের নিয়ে গল্প করব?
সারা জীবন ওদের নিয়েই গল্প করে। বৌদি দু পেয়ালা চা আমাদের সামনে রেখে ফিরে যাবার সময় একবার আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলেন, এমন শ্রোতা বহুকাল পাও না, তাই বলে যাও।
শৈলেনদার সামনে বৌদি যাই বলুন, আমাকে একলা পেলেই উনি বলতেন, সত্যি বলছি বাচ্চু, তোমার দাদার কাছে এইসব ঘটনা না শুনলে ভাবতেই পারতাম না, সংসারে এত ঘটনা ঘটে।
তা তো বটেই।
এ সব অনেক দিন আগেকার ঘটনা। তারপর এই বিশ্বসংসারে কত কি দেখলাম, শুনলাম! তবু শৈলেনদার কাছে শোনা সব কাহিনী মনে না থাকলেও অনেক কাহিনীই ভুলিনি। বোধহয় কোনদিনই ভুলব না।
জানো বাচ্চু, হঠাৎ একদিন এক অত্যন্ত সৌখীন ভদ্রলোক আমাদের অফিসে এসে এক কুখ্যাত বেশ্যাপল্লীর একটা ঠিকানা বলে খোঁজ করলেন, প্রমোদ রায়চৌধুরীর নামের কোন চিঠি ফেরত এসেছে কি?
চিঠিপত্রের খোঁজে লোকজনও কি আপনাদের অফিসে হাজির হয়?
এখনকার কথা বলতে পারি না কিন্তু তখন মাঝে মাঝে কিছু লোক আসতেন।
আচ্ছা তারপর কি হল?
ও নাম-ধাম, কোথা থেকে চিঠি আসবে ইত্যাদি জানার পর জিজ্ঞেস করা হল, আপনি যখন ঐখানেই আছেন, তখন চিঠি ফেরত এল কেন?
উনি জবাব দিলেন?
উনি একটু মুচকি হেসে বললেন, ও-পাড়ার সবাই আমাকে মেজ কর্তাবাবু বলে জানে। আসল নাম কেউই জানে না। তাই বোধহয় কেউ বলেছে, আমি ওখানে নেই।
যাই হোক দু তিনদিন খোঁজাখুঁজির পর প্রমোদ রায়চৌধুরীর নামের একটা চিঠি পাওয়া গেল ও উনি আবার এলে ওর হাতে দেওয়া হল। চিঠিটা পড়েই উনি পাগলের মত চিৎকার করে উঠলেন, আপনারা সবাই জেনে রাখুন, আমি মলিনার ছেলে, অঘোর রায়চৌধুরীর বিবাহিতা স্ত্রীর ছেলে না!
শৈলেনদা ও তার সহকর্মীরা সবাই ওর কাণ্ড দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কি ব্যাপার? আপনি পাগলের মত চিৎকার করছেন কেন?
আমি চিৎকার করব না? পাটনা হাইকোর্ট জাজমেন্ট দিয়েছে, আমি মলিনার ছেলে!
আর মানে?
তাহলে শুনুন!
অতীত দিনের বিহারের বিখ্যাত জমিদার কুমুদকান্তি রায়চৌধুরীর ছেলে জমিদার হবার পর পরই সরকার জমিদারী তুলে দিলেন কিন্তু কুমুদকান্তির নাতি অঘোরকান্তি রায়চৌধুরী চাষবাস ব্যবসা-বাণিজ্য করে আবার কোটিপতি হয়েছেন। এই অঘোরকান্তির তিন পুত্র। প্রমোদবাবুই বড় ছেলে। প্রমোদবাবুর জন্মের প্রায় পনের বছর পর ওর মেজভাইয়ের জন্ম। এর বছর তিনেক পরে ছোট ভাইয়ের জন্ম। বহু ধনদৌলত ভূ-সম্পত্তি রেখে অঘোরবাবু পরিণত বয়সেই মারা গেলেন এবং ওর মৃত্যুর পরই শুরু ভ্রাতৃবিরোধ। তারপর যথারীতি কোর্ট-কাছারি। শেষ পর্যন্ত পাটনা হাইকোর্ট।
দুজন মহামান্য বিচারপতি এক মত হয়ে রায় দিয়েছেন, সন্দেহা তীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে মলিনা শুধু দাসী ছিল না, সে একজন বারবনিতাও ছিল এবং অর্থ বা অলঙ্কারের বিনিময়ে সে বহুজনকেই নিজের দেহ দান করত। এই কথাও প্রমাণিত হয়েছে যে মলিনার সঙ্গে কোন পুরুষের কোনদিনই আনুষ্ঠানিক বিয়ে হয়নি। তবে সেই সঙ্গে আমরা মুক্ত কণ্ঠে স্বীকার করব যে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষা ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার দ্বারা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়েছে, প্রমোদের জন্ম মলিনার গর্ভে ও অঘোরকান্তিই তার জন্মদাতা।…