হ্যাঁ, তারপর বসে বললাম, আমার মেয়ে ক্লাস ফাইভে পড়ে। তাই যদি আপনি দয়া করে অনুমতি দেন তাহলে আপনাদের স্কুলের ক্লাস ফাইভের মেয়েদের আমি একটু টফি-চকোলেট দিতাম।
প্রতিমাদি অবাক হয়ে আমাকে দেখে নিয়ে বললেন, চলুন, আমার সঙ্গে।
সেদিন ওর সঙ্গে তোমাদের ক্লাসে গিয়েছিলাম। তোমার হাতেও টফি-চকোলেট দিয়েছিলাম, মুগ্ধ হয়ে দুচোখ ভরে তোমাকে দেখে ছিলাম কিন্তু মন চাইলেও মুখ দিয়ে একটি শব্দ বের করিনি। তোমার কী সেদিনের কথা মনে আছে?
সেদিন তুমি দশ বছরে পা দিলে! আমার জীবনের সে এক অবিস্মরণীয় দিন!
তুমি যখন কলেজে-ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনা করেছ, তখনও আমি তোমাকে দেখেছি। তবে সব সময়ই দূর থেকে। কখনও কখনও অবশ্য খুব কাছ থেকেই তোমাকে দেখেছি কিন্তু ভয়ে ভয়ে। কিসের ভয়ে জানো? তোমার মার ভয়! সে যদি কোন কারণে আমাকে তোমার কাছাকাছি দেখত, তাহলে নিশ্চয় কিছু অঘটন ঘটত। যাই হোক কফিহাউসে তুমি যখন বন্ধুবান্ধুবদের সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক হাসি-ঠাট্টা করতে তখন তোমাকে দেখে তোমার কথাবার্তা শুনে আমার মন ভরে যেত। ঐ কফিহাউসের আড্ডায় তোমার একটা কথা আমি জীবনেও ভুলব না। বেশ মনে আছে, ওথেলো আর ডেসডিমনার ভালবাসা নিয়ে তোমাদের আলোচনা শুরু হয়েছিল। আলোচনা একটু জমে ওঠার পরই ওথেলো ডেসডিমনা হারিয়ে গেল। প্রেম ভালবাসা নিয়ে তোমাদের তর্ক জমে উঠল। সেদিন সব আলোচনার শেষে তুমি বলেছিলে, যে ভালবাসার দ্বারা প্রিয়জনের কল্যাণ হয় না, তা কখনই ভালবাসা না!
কথাটা শুনে আমি মুগ্ধ হয়ে যাই এবং তোমরা সবাই চলে যাবার পরও আমি ওখানে স্থবিরের মত বসে বসে তোমার কথাটাই ভেবেছি ঘন্টার পর ঘণ্টা।
এই দীর্ঘ পঁচিশ বছরের মধ্যে অনেক সময় ভেবেছি, তোমার কাছে ছুটে যাই, তোমাকে আদর করি, জড়িয়ে ধরি, কোলে তুলে নিই। তুমি একটু বড় হবার পর বহুবার ভেবেছি, তোমাকে আমার চোখের জলের ইতিহাস বলি কিন্তু তা পারিনি। শুধু এই কথা ভেবে নিজেকে সংযত রেখেছি যে যদি আমার আবেগ-ভালবাসার আতিশয্যে তোমার কোন ক্ষতি হয়, তাহলে সে দুঃখ আমি সহ্য করতে পারব না। তুমি যখন এম. এ. পড়ার জন্য ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলে, তখন মনে হয়েছিল, না, না, আর দেরি করব না। এখন তুমি বড় হয়েছ, তোমার বিচার-বুদ্ধি হয়েছে, ভাল-মন্দ ন্যায়-অন্যায় বিচার করতে শিখেছ। সুতরাং আর দেরি করব কেন? না, তখনও পারিনি। তখনো অতি কষ্টে নিজেকে সংযত করেছি কিন্তু মা, আর যে পারছি না। বোধ হয় সময়ও বেশি নেই।
তাছাড়া আজ তুমি বিবাহিতা। যে সহপাঠীকে তুমি জীবনসঙ্গী হিসাবে গ্রহণ করেছ, সেই সুদীপও অত্যন্ত আদর্শবান ও বুদ্ধিমান ছেলে। আজ তুমি শুধু তোমার বাবা-মার সন্তান না, তুমি সুদীপের স্ত্রী। তাইতো আজ তুমি এই পৃথিবীর, এই সংসার ও মানুষজন সম্পর্কে নিজস্ব মতামত গ্রহণ করার অধিকারিণী এবং সেই সাহসেই আজ তোমাকে প্রথম চিঠি লিখছি।
মাগো, এত দীর্ঘ ভূমিকার জন্য তুমি আমাকে ক্ষমা কর। তবে শুধু এইটুকু মনে রেখ, আমি দুঃখী, চির দুঃখী। আমি সারাজীবন শুধু চোখের জলই ফেললাম। এই পৃথিবীর কারুর বিরুদ্ধে আমার অভিযোগ নেই। এই পৃথিবী, এই সংসারের জন্য আমরা সবাই কি উপযুক্ত? না, তা হতে পারে না। আজ আমি মনে মনে বিশ্বাস করি, আমি শুধু হতভাগ্য না, আমি একটি ব্যর্থ, অপদার্থ জীব মাত্র।
দীর্ঘ চিঠির শেষের দিকে উনি লিখেছিলেন, ধনীর ঘরে জন্মে সুখ পেলেও শান্তি পাইনি। আনন্দময় হয়নি আমার শৈশব-কৈশোরের দিনগুলি। ছোটবেলায় মাতৃহীন হলে কি কোন শিশু বা কিশোরের জীবন মধুর হতে পারে? তবু জীবন এগিয়ে চলল। তারপর একদিন সরকার জমিদারী-প্রথা বিলোপ করলেন ও সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞাতিদের শত্রুতাও চরমে উঠল। বাবা সবকিছু হারিয়েও নির্বিবাদে সেক্সপিয়ার চর্চা নিয়ে মেতে রইলেন। তারপর একদিন শুধু ফার্স্ট ডিভিশান না, তিনটে লেটার পকেটে করে প্রেসিডেন্সী কলেজে ভর্তি হলাম। দেখতে দেখতে প্রেসিডেন্সী কলেজের দিনগুলোও কেটে গেল। বাবা জোর করেই বিলেত পাঠালেন। বাবাকে শুধু বৃদ্ধা বিধবা পিসীর ভরসায় রেখে সাত সমুদ্র পাড়ি দেবার একটুও ইচ্ছা ছিল না কিন্তু বাবার ইচ্ছাকে অগ্রাহ্য করতে না পেরে সত্যি সত্যি একদিন বোম্বে থেকে পি. অ্যাণ্ড ও লাইনের জাহাজে চড়লাম। বিলেত বাসের মেয়াদ শেষ করে কলিকাতায় ফিরে দেখি, বাবা মৃত্যুশয্যায়। বোধ হয় আমার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন।
জানো মা, বাবার মৃত্যুর দিন পনেরো পর আবিষ্কার করলাম, তিনি আমার পাত্রীই শুধু নির্বাচন করেননি, বিয়ের দিনও পাকা করে গেছেন। না, ঐ দিনই আমার বিয়ে হয়নি কিন্তু ঐ পাত্রীর সঙ্গেই আমার বিয়ে হল। সেটা সাতাশ বছর আগেকার কথা। যাকে আমি বিয়ে করি তিনি শুধু সুন্দরী ছিলেন না, উচ্চশিক্ষিতাও ছিলেন এবং ওর বাবা আমার বাবার বিশেষ বন্ধু ছিলেন।
অত্যন্ত দুঃখের কথা আমার বিবাহিত জীবন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। বিয়ে করলেই কি ভালবাসা হয়? ছন্দপতনের সঠিক কারণটা আজো আমি জানি না। শুধু এইটুকু জানি, আমার স্ত্রীকে আমি সুখী করতে পারিনি এবং তিনি যেদিন আমার বন্ধন থেকে মুক্তি চেয়েছিলেন, সেদিন আমি নীরবে সম্মতি জানিয়েছিলাম। তারপর একদিন আমার স্ত্রী তার শিশুকন্যাকে কোলে নিয়ে চলে গেলেন। মাগো, সেদিনের সেই শিশুকন্যাটি আর কেউ নয়, তুমি!