ঐ ভদ্রলোক পুলিসের গোয়েন্দা ছিলেন।
তাই নাকি?
শৈলেনদা মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ।
ঐ রিটার্ন লেটার অফিসে বসে ভারতীয় ডাক ও তার বিভাগের সেবা করতে দশের ও দেশেরও কত কি জানা যায়।
জান বাচ্চু, প্যাকেট-পার্সেলের মধ্যে বোমা-পিস্তল-পাইপ ছাড়াও আরও কত কি পাওয়া যায়।
কত কি মানে?
খুন করা মানুষের এক টুকরো হাত-পা পর্যন্তও আমরা পেয়েছি।
বলেন কী দাদা?
শৈলেনদা মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ ভাই, সত্যি কথাই বলছি।
আমি তাড়াতাড়ি একটু হেসে বলি, আমি কি বলছি আপনি মিথ্যে কথা বলছেন?
উনি গম্ভীর হয়ে বললেন, নাসিকে এক ব্যবসাদারের মেয়েকে রেপ করে খুন করা হয়। তারপর ঐ খুনী মেয়েটির বডিকে তিরিশ-বত্রিশ টুকরো করে এক একটা টুকরো দেশের এক এক জায়গায় ফলস ঠিকানায় পাঠায়। ইস্!
ইস্ করছে কি! মানুষ কি না পারে?
তা ঠিক। একটু থেমে জিজ্ঞেস করি, লোকটা ধরা পড়েছিল?
হ্যাঁ, ফাঁসীও হয়েছিল।
শৈলেনদার কাছে আর-এল-ও অফিসের গল্প শুনতে শুনতে সত্যি মুগ্ধ হয়ে যাই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ওঁর কথা শুনি। বৌদি খেতে দিয়ে বার বার না ডাকলে আমাদের হুঁশ হত না। একদিন তো শৈলেনদার কথা শুনতে শুনতে ঘড়ি দেখার কথা মনেই পড়েনি। যখন আমাদের বৈঠক শেষ হল, তখন রাত প্রায় একটা। সে কাহিনী আমি কোনদিন ভুলব না।…
ইন্সিওর্ড পার্সেলটা ঠিক ঠিকানাতেই গিয়েছিল কিন্তু মেয়েটির মা পিয়নকে বললেন, না, এ পার্সেল আমার মেয়ে নেবে না।
পিয়ন জিজ্ঞাসা করলেন, তবে কী এই পার্সেল ফেবত পাঠিয়ে দেব?
ভদ্রমহিলা বেশ রাগ করেই বললেন, যা ইচ্ছে করুন, মোট কথা এ পার্সেল আমরা নেব না।
পিয়নের সঙ্গে মাকে এত কথা বলতে দেখে একটি সদ্য বিবাহিত মেয়ে ভদ্রমহিলার পাশে এসে দাঁড়িয়েই জিজ্ঞেস করল, কী ফেরত দিচ্ছ মা?
ভদ্রমহিলা কিছু বলার আগেই পিয়ন ওকে বললেন আপনার নামের এই পার্সেলটা।
মেয়েটি একটু ব্যস্ত, একটু অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করল, কেন মা? এই পার্সেলটা নেবে না কেন মা?
ভদ্রমহিলা বেশ রূঢ় হয়েই বললেন, কোথাকার কে পাঠিয়েছে, তার নেই ঠিক! যে যা পাঠাবে, তাই আমরা নেব নাকি?
মার কথায় মেয়েটি একটু অবাক হয় কিন্তু মুখে কিছু বলে না।
এবার ওর মা প্রায় আনমনেই বলেন, কার মনে কি মতলব আছে, তার কি কোন ঠিকঠিকানা আছে!
পিয়ন আবার প্রশ্ন করেন, তাহলে এটা ফেরত পাঠাব তো?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, ফেরত দিন।
পিয়ন পকেট থেকে কলম বের করে লেখেন, রিফিউজড।
এবার মেয়েটি ওর মাকে জিজ্ঞেস করল, মা, এটা কে পাঠিয়েছেন।
কে এক অরূপ মুখার্জী!
বাপির কোন বন্ধু না তো?
না, না, কোন জন্মেও নাম শুনিনি।
পার্সেলটি ফেরত গিয়েছিল অরূপ মুখার্জীর ঠিকানায়। সেখানে গিয়ে জানা গেল, হা, উনি কদিনের জন্য এই হোটেলে ছিলেন কিন্তু দুতিন দিন আগেই চলে গেছেন।
বাড়ির ঠিকানা?
খাতা খুলে ম্যানেজারবাবু বললেন, শুধু লেখা আছে দার্জিলিং।
পার্সেল কলকাতা থেকে ভুবনেশ্বর ঘুরে গেল দার্জিলিং।
সেখানে কিছুদিন বিশ্রাম নেবার পর পার্সেলটি শেষ পর্যন্ত আর এল-ওতে হাজির।
শৈলেনদা বললেন, পার্সেলটি খুলেই ঘোষদা অবাক!
কেন?
ওর মধ্যে একটা দামী ডায়মণ্ডের নেকলেস, একটা অত্যন্ত পুরনো সিঁদুরের কৌটো আর একটা বিশ-পঁচিশ পাতার চিঠি দেখে ঘোষদা অবাক!
আমি চুপ।
শৈলেনদা বলেন, ঘোষদা চিঠিটা পড়ার পর আমাদের সবাইকে ডেকে চিঠিটা শুনিয়েছিলেন।…
মা অনুরাধা, সবার আগে তুমি আমার প্রাণভরা স্নেহাশিস নাও।
জানি না তোমাকে আমার চিঠি লেখার অধিকার আছে কিনা কিন্তু স্নেহ-ভালবাসা মানুষের এমনই এক রকম সম্পদ যা ন্যায়-অন্যায় উচিত-অনুচিত সময়-অসময় মানতে জানে না। তোমাকে দেখতে, কাছে পেতে, আদর করার জন্য মন অনেক সময়ই ব্যাকুল হয়েছে, কিন্তু মা, তুমি তো জান, এ সংসারে শুধু হৃদয়ের তাগিদে জীবনের জটিল-কুটিল পথে চলা যায় না। সম্ভব নয়। নানা পারিপার্শ্বিক অবস্থার চাপে আমরা সবাই নিজের মনকে উপেক্ষা করি। আমিও করেছি, না করে পারিনি। বাধ্য হয়ে করেছি। তবে বিনিময়ে কখনও বিনিদ্র থেকেছি রাতের পর রাত, কখনও আবার সবার আড়ালে চোখের জল ফেলেছি। সত্যি বলছি মা, মাঝে মাঝে শুধু তোমাকে একটু দেখার জন্য পাগল হয়ে উঠেছি। স্নেহ-ভালবাসার আতিশয্যে তোমার কোন ক্ষতি না হয় ভেবেই পাগলামি করতে গিয়েও থমকে দাঁড়িয়েছি। নিজেকে সংযত করেছি, করতে বাধ্য হয়েছি। তবে রক্ত-মাংসের কোন মানুষই সব সময় সংযত থাকতে পারে না, কিছুতেই পারে না। আমিও পারিনি। কদাচিৎ কখনও ছুটে গেছি তোমার স্কুলের সামনে, কলেজের সামনে। কোনদিন তোমাকে দেখেছি, কোনদিন দেখিনি।
ঠিক পঁচিশ বছর আগে দশই ডিসেম্বর তুমি এই পৃথিবীর আলো প্রথম দেখেছিলে। তাইতো প্রতি বছর ঐ দশই ডিসেম্বর এলেই তোমাকে একটু দেখার জন্য পাগল হয়ে উঠি। একবার আমি কি করেছিলাম জানো?
অনেক টফি আর চকোলেট কিনে সোজা চলে গেলাম তোমাদের স্কুলে। সেদিন কোন কারণে তোমাদের হেডমিস্ট্রেস মিসেস রায় স্কুলে আসেনি। তাই তোমাদের প্রতিমাকে বললাম, আমার নাম অরূপ মুখার্জী। আমি বোম্বে থাকি কিন্তু জরুরী কাজে দুতিন দিনের জন্য কলকাতা এসেছি। আজ আমার মেয়ের জন্মদিন কিন্তু ওকে কাছে পাচ্ছি না বলে
আমি এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলেছিলাম। এবার উনি আমাকে বললেন, আগে আপনি বসুন।