টুকটাক হোঁচট খেলেও শৈলেনদার সঙ্গে পরিচয় হবার পরই প্রথম বুঝলাম, এই দুনিয়ার মনুষ্য চরিত্র সম্পর্কে আমি কত অনভিজ্ঞ। শুধু মনুষ্য সম্পর্কে কেন, এই বিশ্ব-সংসারে কোথায় কত কি ঘটে, তারই বা কতটুকু খবর রাখি?
পোস্ট অফিস পুলিসের গোয়েন্দা দপ্তর নয়। কোন লুকোচুরির ব্যাপার এখানে নেই। সবকিছুই সবার সামনে হয়। চিঠিপত্র, রেজেষ্ট্রী, পার্সেল, মনি অর্ডার। এমনকি সেভিংস ব্যাঙ্কের কাজ কারবারের মধ্যে কোন রহস্য বা লুকোচুরির ব্যাপার নেই। তবু চোখের সামনের এই কাজকর্মের মধ্যেও কখনো কখনো কত বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে যায়।
আর-এল-ও, রিটার্ন লেটার অফিসে শুধু চিঠিপত্রই আসে না। রেজেস্ট্রী, ইন্সিওরড, চিঠি-প্যাকেট-পার্সেল, মনি অর্ডার ও আরও কত কি আসে কিন্তু তাই বলে প্যাকেট বা পার্সেলের মধ্যে বোমা? না, আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।
অতি সাধারণ একটি ছেলে। বস্তিবাসী। হয়ত কোন কলকারখানায় সামান্য কাজ করে। অথবা আশেপাশে কোন পানবিড়ির দোকান চালায়। বয়স বড় জোর বাইশ-তেইশ কিন্তু স্বাস্থ্য বেশ ভাল। হঠাৎ দেখলে মনে হয় সাতাশ-আঠাশ। বোম্বে মার্কা হিরোদের মত মাথায় লম্বা লম্বা চুল। দাড়ি না থাকলেও গোফ রেখেছে লম্বা-চওড়া এক কথায় হঠাৎ দেখলে মনে হয় গুণ্ডা, মস্তান।
পিয়ন জগদীশ সরকার এ অঞ্চলে চিঠিপত্র-রেজেস্ত্রী-মনি-অর্ডার ইত্যদি বিলি করছেন বিশ-বাইশ বছর কিন্তু মনে পড়ে না ওদের বাড়িতে একটা পোস্টকার্ড এসেছে। তারপর হঠাৎ একদিন ঐ অসীমের নামে রেজেস্ট্রী বুকপোস্টে একটা বইয়ের বাণ্ডিল এসে হাজির। পিয়ন জগদীশবাবু একটু অবাকই হন কিন্তু সেকথা তো প্রকাশ করতে পারেন না! সই করিয়ে প্যাকেট ওর হাতে তুলে দেন। প্যাকেটটা হাতে পেয়ে অসীমের খুশি দেখে জগদীশবাবুর বিস্ময় হয় কিন্তু সে বিস্ময় প্রকাশ করেন না।
জগদীশবাবু অন্যদিকে পা বাড়াতেই অসীম ওকে ডাক দেয়, দাঁড়ান, দাঁড়ান!
উনি পিছন ফিরে তাকাতেই অসীম একটু এগিয়ে তাড়াতাড়ি ওর হাতে পাঁচটা টাকা দেয়। পিয়ন ওর মুখের দিকে একবার তাকিয়ে টাকাটা পকেটে রেখে অন্যদিকে পা বাড়ান।
দিন দশ-পনের পরে আবার একটি প্যাকেট। তবে বুক পোস্টের প্যাকেট নয়, রেজিস্টার্ড পার্সেল। অসীম খুশি হয়ে জগদীশবাবুর হাতে পাঁচ টাকা দেয়।
এর পর থেকে চিঠি না, মনি অর্ডার না, অসীমের নামে নিয়মিত প্যাকেট আর পার্সেল আসে এবং জগদীশবাবুর অদৃষ্টেও কিছু কিছু প্রাপ্তিযোগ ঘটে।
তারপর হঠাৎ একদিন একটা পার্সেল ডেলিভারী দিতে গিয়ে জগদীশবাবু অসীমকে পান না। ঐঘর থেকেই একজন মধ্যবয়সী ভদ্র লোক বেরিয়ে এসে বললেন, অসীম বলে তো এখানে কেউ থাকে না।
গত কয়েক মাস ধরে যে ছেলেটি এখানে থাকত, সেই ছেলেটিই তো অসীম।
ভদ্রলোক হেসে বলেন, কি বলছেন আপনি? যে ছেলেটিকে এখানে রেখে আমি দেশে গিয়েছিলাম, তার নাম তো হৃদয়।
হৃদয়? জগদীশবাবু যেন গাছ থেকে পড়েন।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, হৃদয়। ওর বাবার নাম শ্রীনিবাস। এই শ্রীনিবাস আমার গ্রামের দোকানের দেখাশুনা করে।
জগদীশ একটু ভাবেন। তারপর বলেন, আচ্ছা সেই হৃদয়কে একটু দেখতে পারি?
তাকে তো আমি বাজারে পাঠিয়েছি।
এখুনি আসবে?
না, না, একটু দেরি হবে। এইতো তাকে পাঠালাম।
শেষে জগদীশবাবু বলেন, কাল এই সময় তাকে থাকতে বলবেন।
ভদ্রলোক একটু হেসে বলেন, তা বলব কিন্তু বাড়ির চাকরের নামে বইয়ের বাণ্ডিল বা পার্সেল আসে, তা তো বাপের জম্মে শুনিনি।
পরের দিন হৃদয়কে দেখে জগদীশবাবু অবাক! হা ভগবান! অসীম বলে, এই তো এত কাল সব প্যাকেট পার্সেল নিয়েছে।
হৃদয় ওরফে অসীম ইসারা-টিসারা করেও জগদীশবাবুর কাছ থেকে প্যাকেটটা হস্তগত করতে পারেনি। উনি প্যাকেট ফেরত নিয়ে চলে গেলেন।
প্যাকেটটি নিয়ে মহা সমস্যায় পড়লেন পোস্ট অফিসের বাবুরা। পার্সেলটি রেজেষ্ট্রী করা হয়েছে ধানবাদ হেড পোস্ট অফিস থেকে কিন্তু যিনি এটি পাঠিয়েছেন তার নাম-ঠিকানায় আছে–অবিনাশ, হ্যারিসন রোড, কলকাতা-১। হ্যারিসন রোডে লক্ষ লক্ষ লোকের বাস এবং তার মধ্যে কত শত অবিনাশ রয়েছে, তার কি ঠিকঠিকানা আছে?
শেষ পর্যন্ত অগতির গতি আর-এল-ও।
বুঝলে বাচ্চু, ঐ প্যাকেটের মধ্যে একটা পিস্তল ছিল।
বলেন কি দাদা?
হ্যাঁ ভাই, ঠিককথাই বলছি।
তারপর আপনারা ঐ পিস্তল নিয়ে কি করলেন?
শৈলেনদা একটা সিগারেট ধরিয়ে লম্বা টান দিয়ে বললেন, আমরা আর কি করব? পুলিশকে খবর দেওয়া হল।
যত অনভিজ্ঞই হই, তবু তো রিপোর্টার। তাই কাহিনীর শেষটুকু শুনে স্বস্তি পাই না। জিজ্ঞেস করি, তারপর কি হল, তা কি জানেন?
শৈলেনদা একটু থেমে সিগারেটে আবার একটা টান দিয়ে বললেন, সবকিছু জানতে পারিনি ঠিকই কিন্তু কিছু কিছু জেনেছিলাম বৈকি!
আমাকে আর প্রশ্ন করতে হয় না। উনি নিজেই বলে যান, আমরা শুধু এইটুকু জানতে পারি, ঐ ছেলেটার নাম অসীমও না, হৃদয়ও না। ওর নাম অন্য কি যেন ছিল। তার চাইতে বড় কথা ছেলেটি মোটেও ঐ ভদ্রলোকের চাকর ছিল না।…
বলেন কী?
উনি একটু হেসে বলেন, হ্যাঁ বাচ্চু, ছেলেটি বি. এ. পাস ছিল এবং পলিটিক্স করত।
আচ্ছা! আর ঐ ভদ্রলোক কি ছিলেন জান?
কী?
শৈলেনদা হেসে বললেন, মূৰ্ছা যাবে না তো?
ওঁর কথায় আমিও হাসি। বলি, মূর্ছা যাব কেন?