আর-একটি উপাখ্যান থেকে জানা যায়, তা হল ইলার কাহিনি। এই কাহিনিটি একাধিক হিন্দু ধর্মগ্রন্থে পাওয়া যায়। ইলা ছিলেন এক রাজা। তিনি শিব ও পার্বতীর অভিশাপে এক মাস পুরুষ রূপে এবং পরবর্তী এক মাস নারী রূপে দেহধারণ করে জীবনযাপন করতেন। লিঙ্গ পরিবর্তনের পর ইলা তাঁর পূর্বের লিঙ্গাবস্থার জীবন বিস্মৃত হতেন। এইরকম এক পর্যায়ে ইলা গ্রহদেবতা বুধকে বিয়ে করেন। ইলার লিঙ্গ পরিবর্তনশীলতার কথা বুধ জানতেন। কিন্তু তিনি ‘পুরুষবেশী’ ইলাকে সেটা জানালেন না। ইলাও তাঁর নারীরূপের কথা ভুলে গেলেন। ইলা যখন নারীরূপে থাকতেন, তখনই বুধ ও ইলা স্বামী-স্ত্রী হিসাবে সহবাস করতেন। রামায়ণ অনুসারে বুধের ঔরসে ইলা এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। যদিও মহাভারত অনুসারে ইলাকেই সেই পুত্রের মাতা ও পিতা বলা হয়েছে। পুত্রের জন্মের পর ইলার অভিশাপের নিষ্পত্তি হয়। এরপর ইলা পাকাপাকিভাবে পুরুষে পরিণত হয়। এরপর ইলা তাঁর স্ত্রীর কাছে ফিরে যান এবং একাধিক সন্তানের জন্ম দেন।
কৃষ্ণের পুত্র শাম্ব। শাম্ব নারীর বস্ত্র পরিধান করে মানুষকে উপহাস করতেন এবং বিপথে চালনা করতেন। নারীর বেশ ধারণ করে তিনি সহজেই নারীদের সঙ্গে অবলীলায় পারতেন এবং তাঁদের সঙ্গে সম্ভোগ করতেন। মৌষলপুরাণ গ্রন্থে দেখা যায়, শাম্ব একবার নারীর বেশ ধারণ করে কয়েকজন ঋষিকে নিজের নিজের গর্ভধারণ নিয়ে প্রশ্ন করেন। ঋষিরা তখন তাঁকে অভিশাপ দেন– পুরুষ হওয়া সত্ত্বেও তিনি লৌহমুষল প্রসব করবেন।
সুশ্রুতসংহিতায় দুই ধরনের পুরুষ সমকামিতার কথা উল্লেখ আছে। একটি গোষ্ঠীর নাম ‘কুম্ভীক’, যাঁরা পায়ুসঙ্গমে নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করতেন। অপর গোষ্ঠীর নাম ‘অশ্য’, পায়ুসঙ্গমে যাঁরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করতেন। অগ্নি ও সোম দুজনেই পুরুষ দেবতা। এই দুই পুরুষদেবতার মধ্যে সমকামী সম্পর্ক ছিল বলে জানা যায়। এক কাহিনিতে পাচ্ছি অগ্নিদেবতা সোমের বীর্য মুখে ধারণ করছেন। বৈদিক-দেবতা মিত্র ও বরুণের অযোনিজ কামে লিপ্ত হয়ে সন্তান উৎপাদন করেছিলেন। অতএব এখানেও সমকামী সম্পর্কের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। রামচন্দ্রের পূর্বপুরুষ রাজা দিলীপের দুই স্ত্রীর মধ্যেও সমকামী সম্পর্ক ছিল। গণেশের নানা ধরনের জন্মবৃত্তান্তের কথা জানা যায়। তার মধ্যে একটি হল পার্বতী ও গজানো রাক্ষসী নামের দুই নারীর যৌনমিলনের ফলে গণেশের জন্ম হয়।
কেবল সমকামীই নয়, রূপান্তরকামিতারও কিছু উল্লেখ পাই। মহাভারতের কাহিনিতে আমরা অর্জুনের এক স্নান করার কথা জেনেছি, সেখানে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে পবিত্র সরোবরে স্নান করতে বলেছিলেন। অর্জুন সেই পবিত্র সরোবরে যেই-না স্নান করলেন, অমনি অপরূপা সুন্দরী এক নারীতে পরিণত হলেন। অর্থাৎ পুরুষ থেকে নারীতে রূপান্তর। সেই রূপান্তরিত নারীর সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের কামকেলির আখ্যান পাওয়া যায়। কেলি শেষে পুনরায় সরোবরে স্নান সেরে অর্জুন পুরুষজীবনে ফিরে আসে। রূপান্তরকামিতার আরও একটি কাহিনিতে পাচ্ছি রাজা ভগ্নাস্বনকে। রাজা ভগ্নাসন সরোবরে স্নান করে পুরুষ থেকে নারীত্ব লাভ করেন এবং তাপসের স্ত্রী হয়ে পুত্রসন্তানও উৎপাদন করেন। পুরাণগুলিতে রূপান্তরকামীরা সন্তান উৎপাদন করলেও বাস্তবে সেটা সম্ভব নয়। এখন পর্যন্ত চিকিৎসা বিজ্ঞান যতটা এগিয়েছে, তাতে কোনো রূপান্তরিত মানুষ গর্ভবতী হতে পারবে ন বা জন্ম দিতে পারবে না। অর্থাৎ কোনো পুরুষ নারীতে রূপান্তরিত হয়ে যেমন গর্ভবতী হতে পারবে না, তেমনি কোনো নারী পুরুষে রূপান্তরিত হয়ে কোনো নারীকে মা করতে সক্ষম হবে না।
হিন্দুসমাজে তথাকথিত হিজড়ারা ব্রাত্য, ঘৃণ্য, প্রান্তিক। তাঁদের সম্মানের চোখে দেখা হয় না। এঁদের নিয়ে খিল্লি করা যায়, ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করা যায়। এঁরা হাসির খোরাক। তাই এঁরা সমাজের মূল্যস্রোতকে এড়িয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকে নিজস্ব কমিউনিটিতে। পুরুষদের উৎপাত এড়াতে এঁরা ট্রেনের লেডিস কম্পার্টমেন্টে রেলভ্রমণ করেন। অবশ্য এঁরা নিজেদের মহিলা ভাবেন বলেই স্বভাবত লেডিস কম্পার্টমেন্ট, লেডিস টয়লেট ব্যবহার করেন। তবে যেসব মহিলারা নিজেদেরকে পুরুষ সত্ত্বার (নারী হিজড়া) অধিকারী ভাবেন, তাঁদের কখনো জেন্টস টয়লেট ব্যবহার করতে দেখা যায় না।
হিন্দুসমাজের অনেকেই মনে করে হিজড়াদের প্রথম মুখদর্শন অশুভ, অমঙ্গলের। হিজড়াদের জন্ম অভিশাপের জন্ম বলে মনে করা হয়। বাচ্চা নাচানো হিজড়ারাও তাঁদের গানে ‘আমাদের জীবন অভিশাপের’ বলেন। এই অভিশাপের সূত্রপাত সম্ভবত মহাভারতে। যেখানে উর্বশীর অভিশাপে অর্জুন এক ‘ক্লীব’ বা তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিতে হয়েছেন। কৃষ্ণ অর্জুনকে বলেন যে, পাণ্ডবদের বর্ষব্যাপী অজ্ঞাতবাসের ক্ষেত্রে এই অসুখ ফলপ্রসূ হবে। আবার অনেক ব্যবসায়ীরা মনে করেন সকাল খুলেই হিজড়া প্রথম কাস্টমার হলেই সেদিন ব্যাবসা ভালো হবে।
.
খ্রিস্টান ধর্মে হিজড়া
গ্রিক Eunochos থেকে Eunuchs শব্দটি এসেছে। খ্রিস্টধর্মের নিউ টেস্টামেন্টে স্পষ্ট করে তৃতীয় লিঙ্গ ব্যক্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে। যদিও এখানে Eunuchs বলতে নপুংসক ব্যক্তি বোঝানো হয়েছে। বিবাহ এবং বিচ্ছেদ সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় জিশু বলেন, কিছু মানুষ জন্ম থেকেই Eunuchs, আবার কিছু মানুষ অন্যদের দ্বারা Eunuchs–এ পরিণত হয় এবং আরও কিছু মানুষ আছে যারা স্বর্গরাজ্যের জন্য নিজদেরকে Eunuchs-এ রূপান্তরিত করে।