শৈশবে শিখণ্ডী রাজপ্রাসাদের ফটকে রাখা একটা মালা গলায় পরে দ্রুপদের কাছে এলে দ্রুপদ বুঝতে পারেন, শিখণ্ডীই অম্বা। কারণ কার্তিকের প্রদত্ত চিরসবুজ পদ্মের মালাটি শুধু অম্বাই পরতে পারে। তখন রাজা ভীষ্মের আক্রমণ এড়ানোর জন্য শিখণ্ডীকে বনে রাখার ব্যবস্থা করেন। সেখানে শিখণ্ডী সাধনা করে স্থণাকর্ণ নামে এক যক্ষের কাছ থেকে পুরুষত্ব লাভ করে। মহাভারতের যুগে সফল ট্রান্সজেন্ডার! অথচ একবিংশ শতাব্দীর গোড়ায় সোমনাথ থেকে মানবী হতে কত কসরৎই-না করতে হল। যাই হোক, এরপর শিখণ্ডী বন থেকে রাজপ্রাসাদে ফিরে আসে এবং বিয়ে করে সংসারী হন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পুরুষ-যোদ্ধা হিসাবেই অংশগ্রহণ করেছিলেন।
ভীষ্মের সঙ্গে যুদ্ধের সময় ভীষ্ম তাঁকে দ্রুপদের মেয়ে হিসাবে জানতে পেরে অস্ত্র পরিত্যাগ করে শরাক্রান্ত হয়ে শরশয্যায় শায়িত হন এবং মৃত্যুবরণ করেন। যুদ্ধের অষ্টাদশ দিনে অশ্বত্থামার সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে শিখণ্ডী মৃত্যুবরণ করেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে শিখণ্ডীর জন্মরহস্য জানতেন বলে ভীষ্ম দুর্যোধনকে আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, শিখণ্ডীর বিরুদ্ধে তিনি অস্ত্র ধারণ করবেন না পাণ্ডবরাও তা জানতেন। শিখণ্ডী নিজেও ভালো যোদ্ধা ছিলেন না। তাই শিখণ্ডীকে সামনে রেখে অর্জুন ভীষ্মকে বাণহত করে শরশয্যায় শুইয়েছিলেন। এক্ষেত্রে একমাত্র শিখণ্ডীর ক্ষেত্রেই বলা যায়, নারীশরীর থেকে পুরুষত্ব প্রাপ্ত হয়েছিলেন। শিখণ্ডীকে অবশ্যই রূপান্তরকামী বলা যায়।
হিন্দু পুরাণে এলজিবিটির বিষয়বস্তু বিভিন্নভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। কয়েকজন দেবদেবী ও যোদ্ধাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বা আচরণে স্ত্রী সমকামিতা, পুরুষ সমকামিতা, উভকামিতা বা রূপান্তকামিতা (এককথায় এলজিবিটি) অর্থাৎ বৈশিষ্ট্য ও আচরণে পরিদৃষ্ট হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁদের চরিত্রে লিঙ্গ পার্থক্য ও অ-বিষমকামী যৌনপ্রবৃত্তিরও আভাস মেলে। ঐতিহ্যগতভাবে হিন্দু সাহিত্যে সরাসরি সমকামিতার কথা উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু বেদ, রামায়ণ, মহাভারত ও অন্যান্য পুরাণগুলিতে এবং লোকসাহিত্যে লিঙ্গ পরিবর্তন, সমকামোদ্দীপক (হোমো ইরোটিক) ঘটনা এবং আন্তঃলিঙ্গ ও তৃতীয় লিঙ্গ চরিত্রের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়।
হিন্দু পুরাণে দেখা যায় দেবদেবীরা লিঙ্গ পরিবর্তন করছেন বা বিভিন্ন সময়ে বিপরীত লিঙ্গের রূপ ধারণ করছে, অথবা একজন দেবতা ও একজন দেবী মিলিত হয়ে একই শরীরে উভলিঙ্গ রূপ ধারণ করেছে। যৌনমিলনের সুবিধার্থে দেবতাদের বিপরীত লিঙ্গের অবতার রূপে অবতীর্ণও দেখা যায়।
হিন্দু পুরাণগুলিতে আমরা বিষ্ণু ও শিবকে নারীরূপে পাই। হিন্দুধর্মে ও ভারতীয় পুরাণে একাধিক দেবদেবীকে বিভিন্ন সময়ে ও বিভিন্ন রূপে পুরুষ ও নারী উভয় সত্ত্বা ধারণ করতে দেখা যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আবার একজন দেবতা ও একজন দেবী একই সময়ে একই মূর্তিতে একাধারে পুরুষ ও নারী রূপে প্রকাশিত হয়েছেন। এইরকম একটি মূর্তি আমরা পাই শিবের অর্ধনারীশ্বর রূপ। এই রূপ শিব ও পার্বতীর সম্মিলিত রূপ। শিবের এই মূর্তিটি দ্বৈতসত্ত্বার উৰ্বেস্থিত সামগ্রিকতার প্রতীক। এই মূর্তি নশ্বর জীব ও অমর দেবদেবীর এবং পুরুষ ও নারীসত্ত্বার যোগসূত্র। এই প্রসঙ্গে অ্যালাই ড্যানিলোর মতে– “উভলিঙ্গ, সমকামী ও রূপান্তকামিতার একটি প্রতীকী মূল্য আছে এবং এঁদের সম্মানীয় সত্ত্বা অর্ধনারীশ্বর মূর্তি মনে করা হয়। আর-একটি অনুরূপ মূর্তি হল লক্ষ্মী-নারায়ণ। এই মূর্তিটি সৌন্দর্য ও সম্পদের দেবী লক্ষ্মী ও তাঁর স্বামী বিষ্ণুর যুগল উভলিঙ্গ মূর্তি।
ভাগবত পুরাণে পাওয়া যায় বিষ্ণু অসুরদের অমৃতের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্য ছলনাকারিণী মোহিনী রূপ গ্রহণ করেছিলেন। শিব মোহিনীকে দেখে আকৃষ্ট হন এবং এর ফলে তাঁর বীর্যস্খলন হয়ে যায়। সেই বীর্য পাথরের উপর পড়ে সোনায় পরিণত হয়। ব্রহ্মাণ্ড পুরাণ গ্রন্থে দেখা যায়, শিবের পত্নী পার্বতী তাঁর স্বামীকে মোহিনীর প্রতি আকৃষ্ট হতে দেখে লজ্জায় মাথা নত করে ফেলেন। কোনো কোনো উপাখ্যানে দেখা যায়, শিব পুনরায় বিষ্ণুকে মোহিনী রূপ ধারণ করতে বলেন, যাতে তিনি প্রকৃত রূপান্তরটি স্বচক্ষে দেখতে পারেন। যেসব উপাখ্যানে শিব মোহিনীর সত্য প্রকৃতিটি জানতেন, সেই উপাখ্যানগুলিকে যৌন-আকর্ষণে লিঙ্গের অনিশ্চয়তার পরিচায়ক হিসাবে ব্যাখ্যা করা হয়। মোহিনীর নারীসত্ত্বা হল সত্যের জাগতিক দিক। শিবকে আকর্ষিত করার যে চেষ্টা মোহিনী করেছিলেন, তা শুধুমাত্র শিবকে জাগতিক বিষয়ে আগ্রহী করে তোলার জন্যেই। পট্টনায়ক একটি উপাখ্যানের উদাহরণ দেখিয়ে বলেছেন যে, কেবলমাত্র বিষ্ণুরই শিবকে ‘মোহিত’ করার ক্ষমতা ছিল।
এক অসুর নারীমূর্তি নারীমূর্তি ধারণ করে শিবকে হত্যা করতে যায় বলে একটি আখ্যান পাওয়া যায়। সে তাঁর নারীমূর্তির যোনিতে তীক্ষ্ণ দাঁত স্থাপন করেছিল। শিব তাঁর ছলনা ধরে ফেলেন এবং নিজের পুরুষত্ব’-এ একটি ‘বজ’ স্থাপন করে ‘রতিক্রিয়া’-র সময় সেই অসুরকে হত্যা করেন। মহাভারত মহাকাব্যের তামিল সংস্করণ অনুসারে বিষ্ণুর অবতার কৃষ্ণ মোহিনীমূর্তি ধারণ করে ইরাবানকে বিয়ে করেছিলেন। ইরাবান আত্মবলিদানের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেন। মৃত্যুর পূর্বে তাঁকে প্রেমের স্পর্শ দান করার জন্য কৃষ্ণ তাঁকে বিয়ে করেন। ইরাবানের মৃত্যুর পর কৃষ্ণ মোহিনীমূর্তিতেই তাঁর জন্য বিলাপ করতে থাকেন। বার্ষিক তালি অনুষ্ঠানে ইরাবানের বিয়ে ও মৃত্যুর ঘটনাকে স্মরণ করা হয়। এই অনুষ্ঠানের হিজড়ারা কৃষ্ণ-মোহিনীর ভূমিকায় অভিনয় করে একটি গণবিবাহ অনুষ্ঠানে ইরাবানকে বিয়ে করেন। এই উৎসব ১৮ দিন ধরে চলে। উৎসব শেষ হয় ইরাবানের আনুষ্ঠানের সমাধিদানের মধ্য দিয়ে। এইসময় হিজড়ারা তামিল প্রথা অনুসারে নৃত্য করতে করতে বুক চাপড়ায়, হাতের চুরি ভেঙে ফেলে এবং বৈধব্যের শ্বেতবস্ত্র পরিধান করে। পদ্মপুরাণ অনুসারে কৃষ্ণের রাসনৃত্যে কেবলমাত্র নারীরই প্রবেশাধিকার ছিল। সেই রাসনৃত্যে অংশগ্রহণের অনুরোধ জানালে অর্জুন শারীরিকভাবেই নারীতে পরিণত হয়েছিলেন বলে ভিত্তিহীন গল্প ফাঁদা হয়েছে।