বৃহন্নলা > বৃহৎ + নল + আ। এর অর্থ দীর্ঘ ভুজা বা দীর্ঘ হাত। মহাভারতে অর্জুন অজ্ঞাতবাসের এক বছর নারীরূপে বিচরণ করেছিলেন। তিনি এসময় নিজের প্রকৃত নাম পরিবর্তন করে ‘বৃহন্নলা’ রাখেন। অর্জুনের দীর্ঘ হাত ছিল বলেই এরূপ নামকরণ অর্জুন যেহেতু স্বনামধন্য যোদ্ধার প্রকৃতির ছিলেন, তাই তিনি অন্য কোনো রূপ ধারণ না করে ‘নারী’ রূপ ধারণ করেন। মহাভারতের অর্জুন অজ্ঞাতবাসের প্রয়োজনে বলেছিলেন– আমি তৃতীয়া প্রকৃতির মধ্যে নিজেকে অন্তরীণ করে রাখব– “তৃতীয়াং প্রকৃতিং গতঃ”। অতএব বৃহন্নলা নামধারী অর্জুনও যৌনত্রুটিগত ‘হিজড়া’ ছিলেন না। শারীরিক ও মানসিকভাবেও সম্পূর্ণ সুস্থ ছিলেন। অর্জুন ছিলেন পূর্ণাঙ্গ পুরুষ, নারী-মনের পুরুষ নয়। সাময়িক কার্যসিদ্ধির জন্য অর্জুন নারীর পোশাক পরে নারীর মতো আচরণ করেছিলেন মাত্র। অতএব বৃহন্নলা কখনোই হিজড়ার সমর্থক হতে পারে না। কোনো পুরুষ কোনো কারণে নারীর সাজপোশাক পরলেই রূপান্তরকামী বলা যায় না। অথবা নারী পুরুষের পোশাক পরলেই রূপান্তরকামী বলা যায় না। মহাভারতের চিত্রাঙ্গদা ও বৃহন্নলা এক ধরনের চরিত্র।
একটা সময় ছিল যখন চলচ্চিত্র, নাটক, যাত্রায় নারীরা সামাজিক অন্তরায় থাকার জন্য অভিনয় করতে আসত না। সে সময় নারীচরিত্রে নারীর পোষাকে পুরুষরা অভিনয় করত। অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি, অমৃতলালবসুর মতো নটরাও প্রয়োজনে নারীচরিত্রে অভিনয় করত। সেই ধারার শেষের দিককার অন্যতম প্রতিনিধি চপল ভাদুড়ী। অভিনয়ের মঞ্চে নারীরা আসতে শুরু করেন ষাটের দশকের শেষের দিকে। তার আগে পর্যন্ত নারীচরিত্রে অভিনয় পুরুষ অভিনেত্রীরাই। অভিনেত্রী’ চপল ভাদুড়ী তাঁদের মধ্যে অন্যতম। চপলবাবুর পারিশ্রমিকও ছিল বেশ চড়া।
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে চপলবাবু বলেন— “১৫ বছর বয়স থেকে নারীচরিত্রে অভিনয় করছি। স্বাভাবিকভাবেই আমার মধ্যে অনেক নারীসুলভ বৈশিষ্ট্য চলে এসেছে। কিন্তু আমি নারীসজ্জা নিয়েছি কেবল মঞ্চে। ঋতুর মতো জনসমক্ষে শাড়ি-গয়না পরে বের হইনি কখনো।” চপল ভাদুড়ী বায়োলজিক্যাল রূপান্তরকামী ছিলেন না। তা সত্ত্বেও তিনি সমকামী অপবাদে অপমানিত হয়েছেন। তাঁর ভাষায় –“সমকামিতার ‘অপরাধে’ দল থেকে বের করে দেওয়া হয়। বঞ্চিত করা হয় প্রাপ্য পারিশ্রমিক থেকেও। আমি অবাক হইনি, সেসময় সমলিঙ্গের মানুষের মধ্যে সম্পর্কের কথা প্রকাশ্যে বলা দূরে থাক, ভাবতও না লোকে।”
সারা পৃথিবী জুড়েই বহুকাল থেকে নারীচরিত্রের ভূমিকায় পুরুষ এবং পুরুষচরিত্রের ভূমিকায় নারীর অভিনয় করার দৃষ্টান্ত আছে। ডাস্টিন হফম্যান ‘টুটসি’ ও রবিন উইলিয়াম ‘মিসেস ডাউটফায়ার’ চলচ্চিত্রে যে চরিত্র করেছেন সেটা তেমনই। কিছু সময়ের জন্য নারী সেজেছেন মাত্র। গল্পের প্রয়োজনেই পুরুষ সেখানে কিছুক্ষণের জন্য নারীর ছদ্মবেশ নিয়েছে। এইরকম ভাবেই “মিসেস ডাউটফায়ার’ অবলম্বনে কমল হাসান করেছিল ‘চাচি ৪২০’। আমির খান, গোবিন্দা ও রীতেশ দেশমুখও এই মুভিতে নারীর ছদ্মবেশ নিয়েছিল। ঠিক যেভাবে ‘মিস প্রিয়ংবদা’ চলচ্চিত্রে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, ঠিক সেভাবেই মহাভারতের অর্জুন বৃহন্নলা।
ওয়ালেস বিরি, ফ্যাটি আরবাকল, অ্যালেক গিনেস প্রমুখ অনেকেই নারীচরিত্রে দাপুটের সঙ্গে অভিনয় করেছেন। পরের দিকে জেরি লিউইস, এডি মারফি, টেরি জোন্সের মতো অনেককে নারীচরিত্রে দেখা গেছে। হেয়ার স্পে’ চলচ্চিত্রে নারীচরিত্র করেই ‘গোল্ডেন গ্লোব’ জিতে নেন অভিনেতা জন ট্রাভোল্টা। হাবিব তনবিরের নির্দেশনায় ‘জিস লাহৌর নহি দেখা ওহ জামিয়া নেহি’ নাটকে নারীচরিত্রে পুরুষের অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়েছেন দর্শকরা।
ডাক্তার মাসুর গুলাটি। আসল নাম সুনীল গ্রোভারের তুলনায় এই নামেই বেশি জনপ্রিয় এই অভিনেতা। কপিল শর্মার অনুষ্ঠানে দীর্ঘদিন ধরে নারীচরিত্রে কমেডিয়ান হিসাবে তাঁর পরিচিতি। জনপ্রিয়তা তুঙ্গে হলেও তাঁর পুরুষসত্ত্বায় কখনো কি আঘাত এনেছে এই চরিত্র? এমন প্রশ্নের উত্তরে তাঁর সাফ কথা– বায়োলজিক্যাল পুরুষ হলেও নারী হতে তাঁর মন্দ লাগে না একফোঁটাও। সুনীল গ্রোভার রূপান্তরকামী নন, উনি একজন পূর্ণাঙ্গ পুরুষ।
ইরানে মেয়েরা ছেলে সেজে স্টেডিয়ামে খেলা দেখেছেন। প্রিয় দলের খেলা দেখতে পুরুষের সাজে স্টেডিয়ামে এসেছিলেন এসব নারীরা। ইরানের স্টেডিয়ামে নারীদের ঢুকতে দেওয়া হয় না। অবিকল ছেলেদের সাজ-পোশাক নিয়ে খেলা দেখেছেন। দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর এই ম্যাচে পেরেসপোলিসের বেশ কিছু নারী সমর্থক নকল দাড়ি আর পরচুলা পরে স্টেডিয়ামে ঢোকেন। নকল এই সাজ-পোশাক এতটাই নিখুঁত ছিল যে, স্টেডিয়ামের নিরাপত্তারক্ষীরা পর্যন্ত ধরতে পারেনি। এই নারীদের রূপান্তরকামী বলা যায় না। উদ্দেশ্য পৃথক হলেও বৃহন্নলা ও চিত্রাঙ্গদাকেও তেমনি রূপান্তরকামী বলা যায় না। তথাকথিত ‘হিজড়া’র প্রতিশব্দও হতে পারে না।
শিখণ্ডী মহাভারতের আর-একটি চরিত্র। দ্রুপদের মেয়ে ও দ্রৌপদীর বড়ো বোন! কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে তাঁর পিতা দ্রুপদ ও ভাই ধৃষ্টদুম্নের সঙ্গে পাণ্ডবদের পক্ষে যুদ্ধ করেছিলেন। এবং ভীষ্মের মৃত্যুর কারণ হয়েছিলেন। তাঁর পুত্রের নাম ক্ষত্রদেব। পূর্বজন্মে শিখণ্ডী ছিলেন কাশীরাজের বড়ো মেয়ে অম্বা। হস্তিনাপুরে রাজা বিচিত্রবীর্যের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার জন্য ভীষ্ম তাঁর দুই বোন সহ তাঁকে স্বয়ংবর সভা থেকে জয় করে নিয়ে যান। কিন্তু তিনি সুবলের রাজা শান্বকে ভালোবাসেন জেনে বিচিত্রবীর্য তাঁকে বিয়ে করেননি। শাল্বও পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে তাঁকে বিয়ে করতে রাজি না হওয়ায় তাঁর দুর্দশার জন্য তিনি ভীষ্মকে দায়ী করেন এবং ভীষ্মের মৃত্যু কামনায় সাধনা করে শিবের বর লাভ করে ‘শিখণ্ডী’ নামে দ্রুপদ রাজার মেয়ে হিসাবে জন্মগ্রহণ করেন।