হিন্দুদর্শনে তৃতীয় লিঙ্গের উল্লেখ পাওয়া যায়। নারী পুরুষের বৈশিষ্ট্য সম্বলিত এই শ্রেণিকে ‘তৃতীয় প্রকৃতি’ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রাচীন হিন্দুশাস্ত্রে এই ধরনের মানুষকে আলাদাভাবে পুরুষ বা নারী হিসাবে বিবেচনা করা হত না। তাদেরকে জন্মসূত্রে তৃতীয় প্রকৃতি হিসেবে গণ্য করা হত। তাদের কাছে সাধারণ নারী-পুরুষের মতো ব্যবহার প্রত্যাশা করা হত না। আরাবানী হিজড়ারা আরাবান দেবতার পুজো করে। অনেক মন্দিরে হিজড়াদের নাচের ব্যবস্থা করা হয়। অনেক হিন্দু বিশ্বাস করেন হিজড়াদের আশীর্বাদ করার এবং অভিশাপ দেওয়ার বিশেষ ক্ষমতা আছে।
হিন্দু সংস্কৃতিতে এই মুহূর্তে তিনজন মহাকাব্যিক চরিত্রের কথা মনে পড়ছে– চিত্রাঙ্গদা, বৃহন্নলা এবং শিখণ্ডী। এঁরা হিজড়া বলেই পরিচিত হয়েছে, যদিও এঁরা কেউই সেই অর্থে হিজড়া নয়। এঁদের কারোরই যৌনাঙ্গের ত্রুটি ছিল না। তবু কেন চিত্রাঙ্গদা, বৃহন্নলা এবং শিখণ্ডীরা ‘হিজড়া’ শব্দের সমর্থক হয়ে উঠল?
চিত্রাঙ্গদা মহাভারত মহাকাব্যের একটি চরিত্র। মণিপুরের রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদা। মণিপুররাজের ভক্তিতে তুষ্ট হয়ে শিব বর দিয়েছিলেন যে তাঁর বংশে কেবল পুত্রই জন্মাবে। তা সত্ত্বেও রাজকুলে যখন চিত্রাঙ্গদা নামে কন্যার জন্ম হল, রাজা তাঁকে পুত্ররূপেই পালন করলেন। সেই সূত্রেই রাজকন্যা পুত্রের বেশে ধনুর্বিদ্যা, যুদ্ধবিদ্যা এবং রাজদণ্ডনীতি অনুশীলন করতে থাকলেন। মণিপুররাজ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, তাঁর কন্যার সঙ্গে কেবলমাত্র মহাবীর অর্জুনের বিবাহ দেবেন। অন্যদিকে ইন্দ্রপ্রস্থে অর্জুন মিলনরত অবস্থায় যুধিষ্ঠির ও দ্রৌপদীকে দেখে ফেললে তাঁর দ্বাদশ বর্ষ বনবাস হয়। অর্জুন দ্বাদশবর্ষ ব্যাপী ব্রহ্মচর্য ব্রত পালনের সময় ভ্রমণ করতে করতে মণিপুর রাজ্যে। সেই সময়ে অর্জুন চিত্রাঙ্গদার প্রেমে পড়েন। চিত্রাঙ্গদাকে বিবাহ করলেন। তাঁদের মিলনের ফলে অর্জুনের ঔরসে চিত্রাঙ্গদার গর্ভে সন্তান আসে। তাঁদের মিলনজাত পুত্রের নাম বজ্ৰবাহন। কিন্তু চিত্রাঙ্গদার মধ্য ক্রমশ দ্বৈতসত্ত্বার দ্বন্দ্ব শুরু হয় এজন্যে যে, অর্জুন তাঁকে বাহ্যিক রূপের কারণে ভালোবাসে সেখানে চিত্রাঙ্গদার প্রকৃত অস্তিত্ব অবহেলিত। এর মধ্যে মণিপুর রাজ্যের বিপদের আভাসে একসময় অর্জুন নারীর মমতায় প্রজাবৎসল, সাহসে-শক্তিতে পুরুষের মতো সবল চিত্রাঙ্গদার কথা লোকমুখে জানতে পারে। রবিঠাকুরের ভাষায় –
“শুনি স্নেহে সে নারী বীর্যে সে পুরুষ,
শুনি সিংহাসনা যেন সে সিংহবাহিনী।”
একজন পুরুষ-মনে একজন রমণীয় সবল নারীকে দেখার উদগ্র বাসনা অর্জুন প্রকাশ করে তাঁর আগ্রহ—
“আগ্রহ মোর অধীর অতি —
কোথা সে রমণী বীর্যবতী,
কোষবিমুক্ত কৃপাণলতা–
দারুণ সে, সুন্দর সে
উদ্যত বজ্রের রুদ্ররসে,
নহে সে ভোগীর লোচনলোভা,
ক্ষত্রিয়বাহুর ভীষণ শোভা।”
এমতাবস্থায় চিত্রাঙ্গদা নিজেকে অর্জুনের কাছে প্রকাশ করে এভাবে—
“আমি চিত্রাঙ্গদা, আমি রাজেন্দ্ৰনন্দিনী
নহি দেবী, নহি সামান্যা নারী।
পূজা করি মোরে রাখিবে ঊর্ধ্বে
সে নহি নহি,
হেলা করি মোরে রাখিবে পিছে
সে নহি নহি।
যদি পার্শ্বে রাখ মোরে
সংকটে সম্পদে,
সম্মতি দাও যদি কঠিত ব্ৰতে
সহায় হতে,
পাবে তবে তুমি চিনিতে মোরে।
পরিশেষে এটা উপলব্ধি হয় যে, বাহ্যিক রূপের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান মানুষের চারিত্রিক শক্তি এবং এতেই প্রকৃতপক্ষে আত্মার স্থায়ী পরিচয়।
অতএব চিত্রাঙ্গদা যৌনত্রুটি ঘটিত হিজড়া বা রূপান্তরকামী ব্যক্তি ছিলেন না। তিনি পূর্ণাঙ্গ নারী এবং নিজেকে নারী হিসাবেই পরিচয় দিতেন। নারী হয়েও পুরুষের পোশাক পরতেন ঠিকই এবং পুরুষদের মতো শিক্ষাগ্রহণও করেছিলেন। সেটা করেছিলেন পিতার ইচ্ছাপূরণ করতে। তাঁর শারীরিক প্রতিবন্ধকতা যেমন ছিল না, তেমন মানসিক বৈকল্যও ছিল না। কেন যে ‘চিত্রাঙ্গদা’ চলচ্চিত্রের পরিচালক ও অভিনেতা (অভিনেত্রী?) ঋতুপর্ণ ঘোষ বলেন –“পৌরুষের বদলে রূপলাবণ্য পাওয়ার বাসনাই ঘুরপাক খেয়েছে এই চলচ্চিত্রে।” চিত্রাঙ্গদার ভিতর লৈঙ্গিক বিষয়টা যে অনেক বড়ো আছে, তা নাকি আগে বুঝতে পারেননি ঋতুপর্ণ। চলচ্চিত্র যদি ভাষার মতো হবে, তাহলে সেই ভাষার পথ ধরে ঋতুপর্ণের অবচেতনের ঘরে কে বসত করত, তা সহজেই অনুমেয়। সেই বসতকারী পৌরুষ বিসর্জন দেওয়ার জন্য উদগ্রীব, নারীসুলভ লাবণ্য ঋতুপর্ণের কাম্য। চিত্রাঙ্গদায় ঋতুপর্ণ দেখিয়েছেন, শুদ্ধ বললে ভুল হবে, কারণ তিনি অভিনয়ও করেছেন এক রক্ষণশীল, বিত্তবান পরিবারের নারীসুলভ ছেলের চরিত্রে। যাঁকে প্রায় বাধ্য করা হয় পুরুষ হয়ে উঠতে। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি ঋতুপর্ণ ঘোষ নিজেই রূপান্তকামী ব্যক্তিত্ব ছিল। তিনি পুরুষ হয়েও মেয়েদের পোশাক পরতেন, মেয়েদের মতো রূপচর্চাও করতেন। অবশেষে চিকিৎসা বিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে রূপান্তর হতে গিয়েই নাকি তাঁর অকালমৃত্যু হয়। প্রকৃত ঘটনা হল ১০ বছর ধরে উনি ডায়াবেটিস (ডায়াবেটিস মেটিলাস, টাইপ ২) অসুখে ভুগছিলেন। ৫ বছর ধরে প্যানক্রিটিটিস অসুখে ভুগছিলেন। এছাড়াও তাঁর অনিদ্রার সমস্যা ছিল। ফলে তিনি নিয়মিত ঘুমের ওষুধ খেতেন। চিকিৎসকদের রিপোর্ট অনুযায়ী, অ্যাবডোমিনোপ্ল্যাস্টি ও ব্রেস্ট ইমপ্ল্যান্টের পর প্রয়োজনীয় হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি করাতে গিয়ে তাঁর শারীরিক অসুস্থতা বেড়ে যায়। আরেকটি প্রেমের গল্প’ চলচ্চিত্রে এক সমকামী চিত্রপরিচালকের ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য তাঁকে এগুলি করাতে হয়েছিল বলে শোনা যায়।