.
ইসলাম ধর্মে হিজড়া
হজরত ইব্রাহিমের বংশধরদের মাধ্যমে পৃথিবীর বুকে প্রচারিত ধর্মগুলোকে একসঙ্গে বলা হয় ইব্রাহিমীয় ধর্ম ইসলাম, খ্রিস্টধর্ম, ইহুদি ধর্ম— এগুলো সবই ইব্রাহিমীয় ধর্ম। প্রতিটি ইব্রাহিমীয় ধর্ম পুরুষ এবং নারী সৃষ্টির ব্যাপারে আদম এবং হাওয়া (ইভ)-এর গল্প বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ প্রথমে মাটি থেকে তৈরি করেন আদমকে। আদমের বুকের পাঁজর দিয়ে তৈরি করেন বিবি হাওয়াকে। তাহলে আল্লাহ তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ কিভাবে তৈরি করেন? নারী ও পুরুষের পাশাপাশি তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ বা হিজড়া কীভাবে সৃষ্টি করা হল, এই বিষয়ে পৃথিবীর কোনো ধর্মেই আলোচনা করা হয়নি।
ইসলামে তৃতীয় লিঙ্গ বা হিজড়াদের মুখান্নাতুন হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। আরবি ভাষায় ‘মুখান্নাতুন’ বলতে মেয়েদের মত আচরণকারী পুরুষদেরকে বোঝানো হয়। এক্ষেত্রে যেহেতু শুধুমাত্র মেল টু ফিমেল ট্রান্সসেক্সয়ালদের বোঝানো হয়, তাই আরবি ‘মুখান্নাতুন’ হিব্রু সারিস বা ইংরেজি ‘ইউনুখ’-এর সমার্থক শব্দ নয়। কোরানে কোথাও মুখান্নাতুন সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। কিন্তু হাদিসে ‘মুখান্নাতুন’-এর উল্লেখ পাওয়া যায়।
নবি বর্ণিত হাদিস থেকে জানা যায়, একজন মুখান্নাতুন’ হচ্ছে সেই পুরুষ, যাঁর চলাফেরায়, চেহারায় এবং কথাবার্তায় নারী আচরণ বহন করে। তাঁরা দু-প্রকারের— প্রথম প্রকারের হচ্ছে তাঁরাই যাঁরা এই ধরনের আচরণ ইচ্ছাকৃতভাবে করে না এবং তাঁদের এই ব্যবহারে কোনো দোষ নেই, কোনো অভিযোগ নেই, কোনো লজ্জা নেই যতক্ষণ পর্যন্ত তাঁরা কোনো অবৈধ কাজ না করে এবং গণিকাবৃত্তিতে না জড়িয়ে পড়ে। দ্বিতীয় শ্রেণির ব্যক্তি হচ্ছে তাঁরাই যাঁরা অনৈতিক উদ্দেশ্যে মেয়েলি আচরণ করে।
হজরত ইবনে আব্বাস বলেছেন– হিজড়ারা জিনদের সন্তান। এক ব্যক্তি আব্বাসকে প্রশ্ন করেছিলেন– এটা কেমন করে হতে পারে? জবাবে তিনি বলেছিলেন– “আল্লাহ ও রসুল নিযেধ করেছেন যে মানুষ যেন তাঁর স্ত্রীর পিরিয়ড বা মাসিক স্রাব চলাকালে যৌনমিলন না করে”। সুতরাং কোনো মহিলার সঙ্গে তাঁর ঋতুস্রাব হলে শয়তান তাঁর আগে থাকে এবং সেই শয়তান দ্বারা ওই মহিলা গর্ভবতী হয় এবং হিজড়া সন্তান (খুন্নাস) প্রসব করে (সুরা বাণী ইস্রাইল –আর রাহমান-৫৪, ইবনে আবি হাতিম, হাকিম তিরমিজি)।
“তিনিই মহান সত্ত্বা, মাতৃগর্ভে যেভাবে ইচ্ছে তোমাদের আকৃতি গঠন করেন। তিনি প্রবল পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।” (সুরা আলে ইমরান ৬) ইসলামীদের মতে তিনি মানবজাতির কারোকে পুরুষ, কারোকে নারী, আবার তাঁর কুদরতের বহিঃপ্রকাশ স্বরূপ কারোকে বানিয়েছেন একটু ভিন্ন করে। যেন বান্দা তাঁর একচ্ছত্র ক্ষমতা সম্পর্কে জানতে পারে যে তিনি সব বিষয়ে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তিনি যেমন স্বাভাবিক সুন্দর সৃষ্টি করতে সক্ষম, তেমনি এর ব্যতিক্রম সৃষ্টি করতেও সক্ষম। আর এমনই এক বৈচিত্র্যময় সৃষ্টি হল লিঙ্গ প্রতিবন্ধী বা হিজড়া। এঁরা পূর্ণাঙ্গদের মতো সমান মর্যাদার অধিকারী মানবগোষ্ঠী।
ইসলামের দৃষ্টিতে হিজড়া, বিকলাঙ্গ বা পূর্ণাঙ্গ হওয়া মর্যাদা-অমর্যাদার মাপকাঠি নয়। বরং তাকওয়াই হল মানমর্যাদা আর শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি। “আল্লাহতাআলা তোমাদের বাহ্যিক আকার-প্রকৃতি এবং সহায়-সম্পত্তির প্রতি লক্ষ করেন না। বরং তিনি লক্ষ করেন তোমাদের অন্তর এবং আমলের প্রতি।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস নম্বর ৬৭০৮) অতএব ইসলামি মূল্যবোধ ও সুমহান আদর্শের আলোকে এটাই প্রমাণিত হয়, লিঙ্গ প্রতিবন্ধীদের এ পরিমাণ সম্মান ও মর্যাদা আছে, যে পরিমাণ মর্যাদা ও সম্মান আছেএকজন সুস্থ-সবল সাধারণ মুসলিমের। এমনকি ইসলামি শরিয়তে একজন মুমিন-মুত্তাকি, পরহেজগার হিজড়া, শত-সহস্র কাফের-ফাসেক ও মুত্তাকি নয় এমন নরনারী থেকে উত্তম। শরিয়তের পরিভাষায় তাঁকেই হিজড়া বলা হয়, যাঁর পুংলিঙ্গ স্ত্রীলিঙ্গ উভয়ই আছে। অথবা কোনোটিই নেই, শুধু মূত্রত্যাগের জন্য একটিমাত্র ছিদ্রপথ আছে। সংক্ষেপে একই শরীরে স্ত্রী ও পুরুষচিহ্ন যুক্ত অথবা উভয় চিহ্নবিযুক্ত মানুষই হল লিঙ্গ প্রতিবন্ধী বা হিজড়া (কামুসুল ফিকহ ৩/৩৭৭)। ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা মনে করেন, কোনো পুরুষ বা নারী নিজ ইচ্ছায় নারী ও পুরুষ হয়নি। তেমনি হিজড়া হওয়ার পিছনেও তাঁদের নিজের ইচ্ছার কোনো ভূমিকা নেই। এটা শুধুমাত্র আল্লাহতালার কুদরতের বহিঃপ্রকাশ। তিনি নিজের ইচ্ছায় বানিয়েছেন উভলিঙ্গ বা হিজড়া। কোরানের আলোকে বোঝা যায়, এর পিছনে আল্লাহর মহান হেকমত ও নিগূঢ় রহস্য বিরাজমান। ইসলামী দেশগুলির মধ্যে ইরানে সবচেয়ে বেশি রুপান্তরকামী অপারেশন করা হয়। তারা তৃতীয় লিঙ্গের ব্যক্তিকে যে-কোনো এক লিঙ্গে রুপান্তর হওয়ার সুযোগ দেয়।
.
হিন্দু ধর্মে হিজড়া
দক্ষিণ এশিয়ায় তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদেরকে সাধারণত হিজড়া নামে অভিহিত করা হয়। কিন্তু অঞ্চলভেদে ভাষাভেদে হিজড়াকে বিভিন্ন নামে ডাকা হয়। এই অঞ্চলে হিজড়াদেরকে সামাজিক ভাবে মূল্যায়িত করা হয়। তারা সমাজ থেকে দূরে বাস করতে বাধ্য হয়। দূরপাল্লা ট্রেনে বা বাজারে ভিক্ষাবৃত্তি, পতিতাবৃত্তিই তাদের প্রধান পেশা।