হিজড়া দক্ষিণ এশিয়ায় ব্যবহৃত একটি পরিভাষা— বিশেষ করে ভারতের ট্রান্সসেক্সয়াল বা ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিকে বুঝিয়ে থাকে।চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় ক্রোমোজোমের ত্রুটির কারণে জন্মগত যৌনপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি, যাদের জন্ম-পরবর্তী লিঙ্গ নির্ধারণে জটিলতা দেখা দেয়, মূলত তাঁরাই হিজড়া। হিজড়া শব্দের অপর অর্থ হচ্ছে ‘ট্রান্সজেন্ডার’, ট্রান্সজেন্ডার বলতে এমন এক লৈঙ্গিক অবস্থাকে বোঝায় যা দৈহিক বা জেনেটিক কারণে মেয়ে বা ছেলে কোনো শ্রেণিতে পড়ে না। প্রকৃতিতে কিছু মানুষ নারী এবং পুরুষের যৌথ বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। বাংলা ভাষায় এই ধরনের মানুষগুলো হিজড়া নামে পরিচিত। সমার্থক শব্দে শিখণ্ডী, বৃহন্নলা, তৃতীয় লিঙ্গ, উভলিঙ্গ, নপুংসক, ট্রান্সজেন্ডার (ইংরেজি), ইনুখ (হিব্রু), মুখান্নাতুন (আরবি), মাসি, বৌদি, চাচা, তাউ, ওস্তাদ, মাংলিমুখী, কুলিমাদর, ভিলাইমাদর, মামা, পিসি, অজনিকা ষণ্ড, অজনক, সুবিদ, কঞ্চুকী, মহল্লক, ছিন্নমুষ্ক, আক্তা, পুংস্তহীন ইত্যাদি। হরিদ্বারে হিজড়াদের সকলে তাওজি বা পণ্ডিতজি বলে পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্মে হিজড়াদের সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
হিজড়া, সমকামী, উভকামী, রূপান্তরকামী– এঁরা না-নারী না-পুরুষদের দলে অন্তর্ভুক্ত হলে এঁদের সূক্ষ্ম মূলগত পার্থক্য আছে। সবাইকে পাইকারি দরে এক পংক্তিতে ফেলা যাবে না। প্রথমে আসি হিজড়া প্রসঙ্গে।
হিজড়া : লিঙ্গ ও অণ্ডকোশ কর্তন করে যাঁরা বাচ্চা নিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে তাঁরা হিজড়া বলে পরিচিত। বা যাঁরা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া সত্ত্বেও অপরিণত বা ত্রুটিপূর্ণ যৌনাঙ্গ নিয়ে জন্মগ্রহণ করে তাঁদেরও হিজড়া বলা হয়। এঁরা সমকামী হতে পারে আবার নাও হতে পারে। এঁরা সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
সমকামী : সমকামিতা (Homosexuality) বলতে বোঝায় সমলিঙ্গ ব্যক্তির প্রতি আকর্ষণ ও দুর্বলতা বোধ করে। যৌনতা করতে মন চায়। অর্থাৎ যাবতীয় রোম্যান্টিক আকর্ষণ, যৌন আকর্ষণ ও যৌন আচরণকে বোঝায়। যৌন অভিমুখিতা হিসাবে। সমলিঙ্গ বলতে শারীরিকভাবে পুরুষ শরীরের অধিকারী হয়েও পুরুষ শরীরের প্রতি যৌন আকর্ষণ এবং শারীরিকভাবে নারী শরীরের অধিকারী হয়েও নারী শরীরের প্রতি যৌন আকর্ষণ বোঝায়। এঁরা সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
উভকামী : এঁরাও সমকামী। তবে এঁরা বিপরীত লিঙ্গের ব্যক্তিদের সঙ্গে যৌনানন্দ উপভোগ করে। এঁরা বিপরীত লিঙ্গের ব্যক্তিদের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেও সমলিঙ্গের বন্ধু খুঁজে নিয়ে তাঁর সঙ্গে যৌন সম্পর্কে লিপ্ত হয়ে যায়। এঁরা সমাজের মূলস্রোতেই থাকে।
রূপান্তরকামী : রূপান্তরকামিতা (Transsexualism) বলতে বিশেষ একটি প্রবণতা বোঝায় যখন জৈব লিঙ্গ ব্যক্তির জেন্ডারের সঙ্গে প্রভেদ তৈরি করে। রূপান্তরকামী ব্যক্তিরা এমন একটি যৌন পরিচয়ের অভিজ্ঞতা লাভ করেন, যা ঐতিহ্যগতভাবে তাঁদের নির্ধারিত যৌনতার সঙ্গে স্থিতিশীল নয় এবং | নিজেদেরকে স্থায়ীভাবে সেই লিঙ্গে পরিবর্তন করতে চান। রূপান্তরকামী। মানুষেরা পুরুষ হয়ে (বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যে) জন্মানো সত্ত্বেও মন-মানসিকতায় নিজেকে নারী ভাবেন এবং নারী হিসাবে জন্মানোর পরও মানসিক জগতে থাকেন পুরুষসুলভ। এঁদের কেউ কেউ বিপরীত লিঙ্গের পোশাক পরিধান করেন, এই ব্যাপারটিকে বলা হয় ট্রান্সভেস্টিজম বা ক্রসড্রেস। আবার কেউ সেক্স রিঅ্যাসাইনমেন্ট সার্জারির মাধ্যমে রূপান্তরিত মানবে (Transexual) পরিণত হন। যেমন সোমনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে মানবী বন্দ্যোপাধ্যায় হয়ে যাওয়া। এঁরা সকলেই রূপান্তরিত লিঙ্গ নামক বৃহৎ রূপান্তরপ্রবণ সম্প্রদায়ের (Transgender) অংশ হিসেবে বিবেচিত।
মানবসভ্যতার বিভিন্ন সমাজব্যবস্থায় লিখিত ইতিহাসের সমগ্র সময়কাল জুড়ে রূপান্তরকামিতার উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। এর মধ্যে আমেরিকার পুরুষ রূপান্তরকামী জর্জ জরগেন্সেনের ক্রিস্টিন জরগেন্সেনের রূপান্তরিত হওয়ার কাহিনি মিডিয়ায় একসময় আলোড়ন তুলেছিলো। এ ছাড়া জোয়ান অব আর্ক, জীববিজ্ঞানী জোয়ান (জনাথন) রাফগার্ডেন, বাস্কেটবল খেলোয়াড় ডেনিস রডম্যান, চক্ষুচিকিৎসক এবং পেশাদার টেনিস খেলোয়াড় ডঃ রেনি রিচার্ডস, সঙ্গিতজ্ঞ বিলিটিপটন সহ অনেক খ্যাতনামা ব্যক্তির মধ্যে রূপান্তর প্রবণতার উল্লেখযোগ্য ইতিহাসে পাওয়া যায়। ১৯৬০ সালে মনোচিকিৎসক ওয়ালিন্দার রূপান্তরকামীদের উপরে একটি সমীক্ষা চালান। তাঁর এই সমীক্ষা থেকে জানা যায়, প্রতি ৩৭,০০০ জনের মধ্যে একজন পুরুষ রূপান্তরকামীর জন্ম হচ্ছে, অন্যদিকে প্রতি ১০৩,০০০ জনের মধ্যে একজন স্ত্রী রূপান্তরকামীর জন্ম হচ্ছে। ইংল্যান্ডে এই সমীক্ষাটি চালিয়ে দেখা গেছে যে, সেখানে প্রতি ৩৪,০০০ জনের মধ্যে একজন পুরুষ রূপান্তরকামী ভূমিষ্ট হচ্ছে, আর অন্যদিকে প্রতি ১০৮,০০০ জনের মধ্যে একজন জন্ম নিচ্ছে একজন স্ত্রী রূপান্তরকামী। অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ডে গবেষণা চালিয়ে দেখা গেছে, সেখানে ২৪,০০০ পুরুষের মধ্যে একজন এবং ১৫০,০০০ নারীর মধ্যে একজন রূপান্তরকামীর জন্ম হয়। এ বিষয়ে আরও পরে বিস্তারিত লিখব।
ধর্মবেত্তারা হিজড়াদের নিয়ে বিপুল শ্রম খরচ করে ভয়ানক ভ্রম সৃষ্টি করে রেখেছেন। ঘৃণা আর অবজ্ঞা ছড়িয়ে রেখেছেন। তা সত্ত্বেও হিজড়ারা কেউ নাস্তিক নয়। তথাকথিত ‘ঈশ্বরের এই বিধান ও ধর্মীয় অনুশাসনকে মাথায় পেতে নিয়ে নিজেদেরকে ‘অভিশপ্ত’ বলেই গোটা জীবন কাটিয়ে দেন। আসুন দেখি, ধর্মগ্রন্থগুলি কী বলছে জেনে নেওয়া যাক।