হিজড়াদের মৃত্যু ও সৎকার
সাধারণ মানুষের কাছে এ এক রহস্যজনক অধ্যায়। কোনো রহস্য নেই, সবটাই উন্মোচিত। আমাদের অজ্ঞানতাই এসব জানতে পারি না। এঁদের প্রতি আমাদের চরম অবহেলা আর উদাসীনতাই রহস্য ঘনীভূত হয়েছে। হিজড়াদের মৃতদেহ কেউ দেখেছে কি না এ প্রশ্ন অনেকসময় শুনতে হয়। উত্তর সবার কাছে নেই, তাই ভ্যাবাচাকা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া তেমন কিছু করারও নেই। বস্তুত হিজড়াদেরও মৃত্যু হয়, মৃতদেহও হয়, মৃতদেহের সৎকারও হয়। মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে হিজড়াদের শবযাত্রাও হয়। তবে তা নিঃশব্দে গভীর রাতে। শ্মশান বা গোরস্থানের কিছুটা আগে মৃতদেহকে দাঁড় করানো হয়। এরপর চতুর্দিক থেকে মৃতদেহকে ঘিরে থাকে হিজড়ারা। তারপর মৃতদেহকে কিছুক্ষণ হাঁটানো হয়। মৃতদেহকে কি হাঁটানো সম্ভব? মোট্টেও সম্ভব নয়। অগত্যা টেনে হিছড়ে নিয়ে আসা হয়। শ্মশান বা গোরস্থানে এসে নির্দিষ্ট জায়গায় শুইয়ে দিয়ে মৃতদেহকে উপর্যুপরি লাথি মারা হয়। লাঠিপেটাও করা হয়। মৃতব্যক্তি যত বড়ো প্রিয় মানুষ হন না-কেন এই আচরণে অন্য হিজড়াদের একদম কাঁদা চলবে না। নিয়ম নেই। হিন্দু হলে নগ্ন করে চিতার উপর শোয়ানো হয়, মুসলমান হলে মাটি দেওয়ার আগে মৃতদেহকে সম্পূর্ণ নগ্ন করে স্নান করানোর রীতি আছে। তবে পাঞ্জাবের বেশ কিছু জেলায় মৃত্যুর পর বাড়ির ছাত সরিয়ে হিজড়াদের বাইরে বের করে আনা হয়। যাতে ভোলা ছাতের মধ্য দিয়ে মৃতব্যক্তির আত্মা চিরতরে আকাশে বিলীন হয়ে যায়। মৃতব্যক্তি যদি গুরু-মা হন, তবে হিন্দুদের ক্ষেত্রে তাঁর বড় মেয়ে বা শিষ্য বা চেলা মুখাগ্নি করবে। মুসলমান হলে বড়ো মেয়ে বা শিষ্য বা চেলাই পারলৌকিক সমস্ত ক্রিয়াকর্মের সম্পাদনের মূল দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়। এরপর কোথাও দীর্ঘ এক মাস কোথাও-বা ৩৯ দিন ধরে চলে অশৌচ পর্ব। অন্য হিজড়া মহল্লার হিজড়ারও অশৌচ পালন করে, তবে সেটা চারদিনের মাত্র। হয় শ্রাদ্ধানুষ্ঠানও, নিমন্ত্রণ রক্ষা করে হিজড়ারাই।
হিজড়া আর সমকামী কি সমার্থক?
সেই প্রশ্নটাই আবার ঘুরে ফিরে এল। হিজড়া আর সমকামী কি সমার্থক? বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে বোঝার চেষ্টা করতে হবে। আদিকাল থেকে সমকাল পর্যন্ত শিল্প-সাহিত্যেও মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত অভিলাষ সমকামিতার প্রতিফলন। অথচ ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আদালতের রায়ে সহস্রাব্দ প্রাচীন সমকাম আজ ‘বিকৃত’ সমকামিতা অপরাধ। গ্রিক সভ্যতা থেকে প্রাচীন ভারত। সমকামিতার উদাহরণ যুগে যুগে। প্রাচীন নাগরিক সমাজ, ব্যক্তির স্বাধীনতা, আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ধারণা যেখানে জন্ম নিয়েছিল গ্রিসে। সেই গ্রিস, যে কখনও নাগরিকের যৌন স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেনি। সমলিঙ্গ যৌন সংসর্গের বৈধতা নিয়ে কোনও প্রশ্ন ছিল না সেখানে। হেরোডেটাস, প্লেটোর মতো দার্শনিক-চিন্তাবিদদের লেখায় প্রায়ই পাওয়া যায় সমকামী সম্পর্কের কথা। আনুমানিক খ্রিস্ট পূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে গ্রিসের লেসবস দ্বীপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন স্যাফো। এই মহিলা কবির লেখার প্রতিটি পরতে পরতে নারী শরীরের বন্দনা। স্যাফোর জন্মস্থান লেসবস থেকেই তো অভিধানে জায়গা পেয়েছে লেসবিয়ান শব্দটি। পাশ্চাত্য থেকে এবার আসা যাক প্রাচ্যে। ইতিহাস বলছে, প্রাচীন পারস্যে সমকামী সম্পর্কের প্রচলন ছিল। যেমনটা ছিল, এই ভারতবর্ষেও। বহু হিন্দু মন্দিরের দেওয়ালের ভাস্কর্য তো সমকামেরই অভিজ্ঞান। পুরাণে বিষ্ণুর মোহিনী রূপ আর অর্ধনারীশ্বর শিব, মহাকাব্য- পুরাণের পাতায় পাতায় যেন তৃতীয় লিঙ্গের সদর্প উপস্থিতি। এমনকী, বাৎসায়নের কামসূত্রও বলছে সমকামিতা যৌন সম্পর্কেরই অন্য রূপ।
সমকামিতা বলতে আমরা সাধারণ অর্থে বুঝি পুরুষের সঙ্গে পুরুষের বা নারীর সঙ্গে নারীর যৌন সম্পর্ক। সমকামিতা কিন্তু যৌন সম্পর্কের উপর নির্ভর করে না, এটা নির্ভর করে যৌন আকর্ষণের উপরে। একটি ছেলে কোনোদিন যৌন সম্পর্ক করেনি, কিন্তু করলে সে একটি মেয়েকেই বেছে নেবে। সে মেয়েদের প্রতি তীব্র আকর্ষণ বোধ করে বা প্রেমে পড়ে। ছেলেটি যদি ঠিক তেমন আকর্ষণ একটি ছেলের প্রতি অনুভব করে বা ছেলে হয়ে ছেলের প্রেমে পড়ে তখন সে সমকামী। যৌন সম্পর্ক হোক বা না-হোক। মোদ্দা কথা হল— সমকামিতা একটা পছন্দ, কাজ নয়। স্বাভাবিক যৌন আকর্ষণ সম্পন্ন ব্যক্তিকে, অর্থাৎ একজন নারী একজন পুরুষকে অথবা একজন পুরুষ একজন নারীর প্রতি যৌন-আকর্যণ বোধ করলে, তাকে স্ট্রেইট (Straight) বলা হয়। সমকামিতা কিন্তু বিভিন্ন ধরনের ধারণা আছে। এ সংক্ষেপে শ্রেণিবিভাগগুলি আলোচনা করে নিতে পারি বোঝার জন্য। এই শ্রেণিবিভাগ করে হয়েছে একজন নিজেকে কী মনে করে ও কী পছন্দ করে তার উপর ভিত্তি করে।
(১) গে (Gay) : একজন পুরুষ নিজেকে পুরুষ মনে করে। পুরুষের পোশাক পরে এবং একজন পুরুষের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে। এই ধরনের দুইজন পুরুষ বিয়ে করলে এদের মধ্যে স্বামীকে ‘টপ’ এবং স্ত্রীকে ‘বটম’ বলে।
(২) লেসবিয়ান (Lesbian) : একজন মেয়ে নিজেকে মেয়ে মনে করে। মেয়েদের পোশাক পরে এবং একজন মেয়ের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে। এই ধরনের দুইজন মেয়ে বিয়ে করলে এরা পুরুষালি পোশাকে ও আচরণে একজন স্বামীর ভুমিকা পালন করে।