স্বাভাবিক কর্মজীবনে হিজড়াদের ভূমিকা
হিজড়াদের সেই পরিচিত কর্মের বাইরে মূলস্রোতে কর্মরত অবস্থাতেও দেখা যাচ্ছে। কিছু খ্রিস্টান সংঘ হিজড়াদের সদস্য হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করেন। ইউনিটারিয়ান একটি উদার ধর্মমত। তাদের মূল খ্রিস্টান ধর্মের সঙ্গে যুক্ত। ১৯৭৯ সালে তারাই সর্বপ্রথম হিজড়াদের পূর্ণ সদস্য হিসাবে গ্রহণ করে। and the first to open an Office of Bisexual, Gay, Lesbian, and Transgender Concerns in 1973. ১৯৮৮ সালে উইনিটারিয়ান উইনিভার্সালিস্ট অ্যাসোসিয়েশান প্রথম একজন হিজড়া ব্যক্তিকে মনোনীত করে। ২০০২ সালে শ্যন ডেন্নিসন প্রথম হিজড়া ব্যক্তি যিনি ইউনিটারিয়ান ইউনিভার্সালিস্ট মন্ত্রনালয়ে ডাক পান। ২০০৩ সালে ইউনাইটেড চার্চ অফ খ্রিস্ট সকল হিজড়া ব্যক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষে মত দেয়। ২০০৫ সালে ট্রান্সজেন্ডার সারাহ জোনস চার্চ অফ ইংল্যান্ডের ধর্মযাজক হিসাবে নিয়োগ পান। ২০০৮ সালে ইউনাইটেড মেথোডিস্ট চার্চ জুডিশিয়াল কাউন্সিল রায় দেন যে ট্রান্সজেন্ডার ড্রিউ ফনিক্স তাঁর পদে বহাল থাকতে পারবেন। ওই একই বছরে মেথোডিস্টদের একটি সাধারণ বৈঠকে একাধিক হিজড়া ক্লারজির বিরুদ্ধে পিটিশন খারিজ করে দেওয়া হয়। ভারতের বিহারে ‘কালী হিজড়া’ পশ্চিম পাটনা কেন্দ্র থেকে ‘জুডিসিয়াল রিফর্মস’ পার্টির প্রার্থী হিসাবে দাঁড়িয়েছিলেন। ১৯৯৫ সালে পশ্চিমবাংলার টিটাগড় পৌরভোটে ১৪ নং ওয়ার্ড থেকে ‘হিজড়া’ বৈজয়ন্তীমালা মিশ্র ভোটপ্রার্থী হয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালের লোকসভায় মহারাষ্ট্রের জালনা কেন্দ্র থেকে নির্দল হিজড়া প্রার্থী রমেশ ওরফে মালা ভোটপ্রার্থী হয়েছিলেন।
উত্তর চব্বিশ পরগণার নৈহাটির কারখানা শ্রমিক বাবার মধ্যবিত্ত পরিবারে ছেলে হিসেবে জন্ম হয় সোমনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করে কলকাতার একটি কলেজ থেকে বাংলায় স্নাতক সম্পন্ন করেন তিনি। পড়াশোনা শেষে পশ্চিমবঙ্গের মাওবাদী (ঝাড়গ্রাম) অধ্যুষিত অঞ্চলের এক কলেজে বাংলার শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন তিনি। এ সময়েই নারী ও তৃতীয় লিঙ্গের অধিকারের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে লেখালেখি ও সামাজিক আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। পরে ২০০৩ সালে জটিল এক অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে নিজেকে নারীতে রূপান্তরিত করেন সোমনাথ, এখন তিনিই মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়। ৫১ বছর বয়সি মানবী বন্দ্যোপাধ্যায় এখন পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগর মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ। ২০১৫ সালের ৯ জুন থেকে তিনি নতুন দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন। ভারতে প্রথমবারের মতো তৃতীয় লিঙ্গের (হিজড়া) একজনকে কলেজের অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ করা হয়েছে। এটা তৃতীয় লিঙ্গদের জন্য একটা গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।সম্প্রতি অনেকে নিশ্চয় লক্ষ করেছেন যে, ভারত সরকারের একটি ট্র্যাফিক সংক্রান্ত বিজ্ঞাপন হিজড়াদের দিয়ে করানো হয়েছে। তবে বাংলাদেশে হাসিনা সরকার হিজড়াদেরকে ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণের কাজে লাগানো যায় কি না ভাবছেন।
তবে দৈনিক প্রথম আলোর একটি সংখ্যায় ছাপা হয়েছে, বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি ক্ষুদ্র অংশ হিজড়া। হিজড়াদের দেওয়া তথ্যমতে বাংলাদেশে এঁদের সংখ্যা প্রায় ১,৫০,০০০। শুধু ঢাকাতেই বসবাস করে ১৫,০০০ হিজড়া। তবে বেশিরভাগই অন্য জেলা থেকে এসেছে রাজধানীতে রুজি-রোজগারের আশায়। তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, হিজড়াদের নিয়ে সরকারের কোনো কার্যক্রম নেই। তবে সরকার অপরাপর জনগোষ্ঠীর তথ্য সংগ্রহ করেন। ২০১১ সালের আদমসুমারির রিপোর্টে দেখানো হয়েছে যে, বাংলাদেশে ২৭টি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী আছে। তাঁদের মোট সংখ্যা ১৫,৮৬,১৪১ এবং প্রতিবন্ধী জনসংখ্যা ২০,১৬,৬১২, যা মোট জনসংখ্যার ১.৪ ভাগ। দৈনিক যুগান্তরে এ বিষয়ে রিপোর্ট করা হয়েছে, সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কাছে হাজারের নীচে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর হিসাব আছে, তেমনি আছে প্রতিবন্ধীদেরও আলাদা আলাদা হিসাব। তবে হিজড়াদের কোনো পরিসংখ্যান সরকারের কোনো বিভাগ সংরক্ষণ করে না। ২০০৮ সালে লিঙ্গ নির্ধারণ না করেই প্রথমবারের মতো ভোটাধিকার পায়। তবে ভোটার আইডি কার্ডে লিঙ্গ-পরিচয় না-থাকায় তাঁদের বিড়ম্বনার অন্ত ছিল না। জাতীয় আদমসুমারি ২০১১ সালের মধ্যেও হিজড়াদের গণনা করা হয়নি, এমন অভিযোগ করেছে বাংলাদেশের ‘বাঁধন হিজড়া সংঘ’ এএফপিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে। বাংলাদেশে নারীর তুলনায় পুরুষের সংখ্যা বেশি হওয়ায় আদমসুমারিতে এঁদের অধিকাংশকেই দেখানো হয় পুরুষ হিজড়া হিসাবে। ফলে এঁদের নিয়ে প্রায় সর্বক্ষেত্রেই বেশ বিড়ম্বনায় পড়তে হয়। কারণ এঁদেরকে টিক চিহ্ন দিতে হয় পুরুষ কিংবা নারীর ঘরে। দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন সংগঠন এই স্বীকৃতির দাবি জানিয়ে আসছিল।
অবশেষে ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী পরিষদে উত্থাপিত হিজড়াদের নারী-পুরুষের পাশাপাশি আলদা লিঙ্গ বা তৃতীয় লিঙ্গ হিসাবে স্বীকৃতির বিলটি পাস হয়েছে। স্বীকৃতি পরবর্তী নির্দেশ জারি করা হয় যে, সার্টিফিকেট, ভিসা, বিমা, ব্যাংক সর্বক্ষেত্রে লিঙ্গ নির্ণয়ে তৃতীয় লিঙ্গের অপশন রাখতে হবে এবং তাঁদের পরিচয়ে হিজড়াই লিখতে হবে, অন্য কোনো শব্দ নয়। এ স্বীকৃতি হিজড়াদের জন্যে অবশ্যই মন্দের ভালো। কিন্তু সুপারিশমালায় পরিসংখ্যানে জানানো হয়েছে এঁদের সংখ্যা ১০ হাজার। হিজড়াদের সংগঠন ‘বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি সূত্রে জানা যাহ, সারা দেশে হিজড়ার সংখ্যা ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার। বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার দাবি, সারা দেশে ৫০ হাজার হিজড়া আছে। ডেমোগ্রাফি সূত্র অনুযায়ী শুধু ঢাকার মধ্যে হিজড়ার সংখ্যা ২৫ হাজারেরও বেশি।