হিজড়াদের ভোটাধিকার
হিজড়ারা আগেও ভোট দিত, এখনও দেয়। তবে হিজড়া হিসাবে ভোট দেওয়া যায় না। যেহেতু এঁরা নারী-বেশ ধারণ করেন এবং স্ত্রীলিঙ্গে নাম ধারণ করে সেইহেতু ভোটের সময় এঁরা স্ত্রী ভোটার হিসাবেই চিহ্নিত হয়। অথচ রহস্যজনকভাবে এঁরাই আবার জনগণনায় পুরুষ হিসাবে নথিভুক্ত হয়। সর্বভারতীয় হিজড়া কল্যাণ সভার সভাপতি শ্রী খৈরাতিলাল ভোলা হিজড়া ‘হিসাবে’ ভোট দেওয়ার আইনি স্বীকৃতি আদায় করার জন্য ‘Election Commisson of India’-র কাছে আবেদন জানিয়েছেন। আবেদনে সাড়া দিয়ে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের সমস্ত মুখ্য নির্বাচনী অফিসারের ভোটার তালিকায় হিজড়াদের ‘হিজড়া’ হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশ পাঠান। সমস্যাটা আর-এক জায়গায়– সমস্ত হিজড়াই নিজেদের ‘স্ত্রীলোক’ হিসাবেই পরিচয় দিতে আগ্রহী। তারা চায় না ভোটার তালিকায় ‘হিজড়া’ হিসাবে নাম থাকুক।
হিজড়াদের সংস্কার
হিজড়া দুনিয়ায় সব সদস্যকেই বেশকিছু নিয়মনীতি মান্য করে চলতে হয়। যেমন –(১) রাস্তায় অপরিচিত কোনো পুরুষের সঙ্গে হালকা চালে কথা বলা এবং অশালীন আচরণ হিজড়াসমাজে গর্হিত অপরাধ। (২) সন্ধ্যার পর হিজড়া মহল্লার সব দরজা বন্ধ হয়ে যায়। অতি পরিচিত কোনো ব্যক্তি ছাড়া ভিতরে প্রবেশ নিযেধ। অবশ্য ঝুপড়িবাসীদের ক্ষেত্রে এই নিয়ম কার্যকর হবে না। (৩) খুব জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বা আমন্ত্রণ না-পেলে কোনো গুরু-মা সাধারণত অপর কোনো গুরু-মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যান না। (৪) কোনো গুরু-মা মাটিতে বসে থাকলে তা চেলা বা শিষ্যরা খাটে বা উঁচু কোনো জায়গায় বসে না। (৫) কিছু কিছু মহল্লায় হিজড়ারা খুব ভোরে উঠে প্রধান দরজার চৌকাঠে ঝাঁটা বা লাঠি দিয়ে আঘাত করে। অনেকে আবার মহল্লার মাথায় ছেঁড়া জুতো বেঁধে রাখে। (৬) হিজড়ারা মনে করে সন্তানসম্ভবা কোনো মহিলার উদর বা পেট যদি কোনো হিজড়া বিশেষভাবে নিরীক্ষণ করে তাহলে গর্ভস্থ সন্তান হিজড়া হয়ে ভূমিষ্ঠ হবে। (৭) হিজড়ারা মনে করে হিজড়াদের লেখা চিঠি যদি কোনো গর্ভবতী মহিলা পাঠ বা স্পর্শ করে তাহলে ভ্রণের ক্ষতি হবে ইত্যাদি। (৮) তাঁরা বিশ্বাস করে, তাঁরা তাঁদের মৃত্যুর কথা আগাম জানতে পারে। (৯) হিজড়ারা মনে করে তাঁদের গুরু-মা দৈব ক্ষমতার ক্ষমতার অধিকারী। | শিষ্যাদের সম্পর্কে সবকিছুই গুরু-মা জানতে পারেন।
হিজড়াদের ঢোল
হিজড়াদের জীবনে ঢোল একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। বাচ্চা নাচাতে ঢোলের বাজনা অত্যাবশ্যক অনুসঙ্গ। কর্মক্ষেত্র ছাড়া অকারণে গুরু-মায়ের সামনে ঢোল বাজালে বা হাতের তালি দিলে শিষ্যদের ক্ষতি হবে বলে বিশ্বাস। হিজড়াদের বিশ্বাস ঢোল পায়ে লাগা পাপ। সকালে, বিকালে ঢোলকে এঁরা প্রণাম করে। কোনো-কোনো মহল্লায় কাজের শেষে ঢোলগুলিকে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে সিঁদুরের ফোঁটা দেওয়া হয়। সকালে কাজে বেরনোর আগে যদি কোনো অ-হিজড়া ঢোল স্পর্শ করে তাহলে ঢোলটি অপবিত্র হয়ে যায়। সেদিনের জন্য ওই ঢোল বাতিল, অন্য ঢোল নিয়ে কাজে বেরতে হয়। হাজারো বিপদের মাঝে নিজের জান দিয়ে হলেও ঢোলকে অক্ষত রাখা হিজড়াদের অসীম কর্তব্য। হিজড়াদের বিশ্বাস, এই ঢোল যদি অন্য কেউ কেড়ে নেয় তাহলে মনে করা হয় বিপদ নিকটেই। এছাড়া মহল্লার গুরু-মায়ের সম্মতি ছাড়া ঢোল ক্রয় করা গর্হিত অপরাধ। সমস্ত হিজড়া মহল্লার ঢোল পুজো হয়। ঢোল পুজো হিজড়াদের একটি বাৎসরিক উৎসব। কালীপুজোর রাতে এঁরা ঢোলের আরাধনায় বসে। এদিন কেউ কাজে বেরন না। নিরামিষ খাবে সবাই। ঢোল পুজোর অনুষ্ঠানে বাইরের কেউ প্রবেশাধিকার পায় না। পুরোনো চামড়ার | ঢোল এই পুজোর বাতিল। যাই হোক, পুজোয় বসেন গুরু-মা। কোনো নির্ধারিত মন্ত্র-টন্ত্র নেই এই পুজোয়। গুরু-মা চোখ বন্ধ করে ধ্যানে বসে, ধ্যান ভাঙলে পুজো শেষ।
হিজড়াদের ধর্মবিশ্বাস
জাতি-ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়নির্বিশেষে সমস্ত রকমের ভেদাভেদ ভুলে এক সম্প্রীতির সমাজ গড়ে তুলেছে হিজড়া সমাজ। যে-কোনো হিজড়া মহল্লায় দেখা মিলবে সব ধর্মের হিজড়া। পারস্পরিক সহযোগিতা, সহানুভূতি, সহমর্মিতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে এরা ধর্মীয় সহিষ্ণুতা গড়ে তুলেছে। ধর্মের ব্যাপারে কোনো বাড়াবাড়ি বা রক্ষণশীলতা এক্কেবারেই নেই। সব ধর্মের দেব-দেবতাই সকল হিজড়াদের ইষ্টদেবতা।
এঁদের অধিকাংশেরই ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান হিন্দু ধর্মের সঙ্গে মেলে। কিন্তু সামাজিক জীবনযাত্রার উপর ইসলামের প্রভাব বিস্তর। হিজড়াদের অধিকাংশ দলপত্নী বা গুরু-মা ইসলাম ধর্মাবলম্বী হন। তামিল লুনার ক্যালেন্ডার মতে নববর্ষের দিন সারা ভারতের হিজড়া সম্প্রদায়ের বার্ষিক অনুষ্ঠান পালিত হয়। মাদ্রাজ থেকে প্রায় ২০০ মাইল দক্ষিণে কোষাগাম গ্রামে তাঁরা একসঙ্গে মিলিত। বাংলাদেশের হিজড়ারাও ভারতে আসেন। তাঁরা মনে করেন ভারতের মানুষের কাছ থেকে হিজড়ারা সম্মান পান। ভারতের মানুষরা হিজড়াদের সমীহ করে।
হিজড়াদের মন ও মনন
নারী না-হয়েও হিজড়ারা নিজেদের নারীরূপে ভেবে থাকে। মহিলাদের পোশাক আশাক, মহিলাদের অলংকার-কসমেটিক-শৃঙ্গার এদের পছন্দ অপ্রতিরোধ্য। ট্রেনে-বাসে লেডিস সিট, লেডিস কম্পার্টমেন্ট, লেডিস ট্রেন, লেডিস বাসে চড়ে বা উঠে যাতায়াত করে। ভুলেও এরা জেনারেল আসন বা কম্পার্টমেন্ট ব্যবহার করে না। শেষ মুহূতে ট্রেনের জেনারেল কম্পার্টমেন্টে উঠে পড়লেও পরের স্টপেজে নেমে লেডিস কম্পার্টমেন্টে ওঠে। পুজোর প্যান্ডেলে বা যাত্রার এঁদের মহিলাদের মধ্যেই দেখা যায়। বস্তুত এঁরা নিজেদেরকে অম্বার জাত বা উত্তরসূরী ভাবে। অম্বা মহাভারতের একটি অভিশপ্ত চরিত্র। গল্পটা একটু বলি; ভাই বিচিত্রবীর্যের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার জন্য স্বয়ংবর সভা থেকে ভীষ্ম অম্বাকে হস্তিনাপুরে নিয়ে এলেন। কিন্তু শারাজার প্রতি অনুরাগের কথা শুনে ভীষ্ম অম্বাকে মুক্তি দেন। অপরদিকে শান্বরাজ অম্বাকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। এহেন ঘটনার অম্বা জোর গলায় ভীষ্মকে অভিযুক্ত করে। এখানেই শেষ নয়, অম্বা ভীষ্মকে ধ্বংস করবে এমন বিধ্বংসী তপস্যায় ব্রতী হলেন। শিব সন্তুষ্ট হয়ে অম্বাকে বর দিলেন। বললেন– এ জন্মে নয়, পরজন্মে নপুংসক ‘শিখণ্ডী’ হয়ে অম্বা জন্মগ্রহণ করবেন এবং ভীষ্মের মৃত্যুর কারণ হবে। হিজড়ারা এই কাহিনি জানে, জানে বলেই তারা নিজেদেরকে অম্বার সঙ্গে গভীর একাত্মতা অনুভব করে। হিজড়ারা বিশ্বাস করে তারা নপুংসক শিখণ্ডী– এ জন্মের আগে তাদেরও ছিল স্বাভাবিক জীবন এবং পরের জন্মে আবার নারীজন্ম ফিরে পাবে।