শুধু মানুষ নয়, বিজ্ঞানীরা প্রাণিজগতের মধ্যেও রূপান্তরকামিতার উপস্থিতি লক্ষ করেছেন। প্রাণীবিজ্ঞানীরা উত্তর আমেরিকার সমুদ্রোপকূলে আটলান্টিক স্লিপার শেল (Atlantic slipper shell) নামে পরিচিত ক্রিপিডুলা ফরমিক্যাটা (Crepidula_Fornicata) এবং ল্যাবারিডেস ডিমিডিয়াটাস (Laborides dimidiatus), ইউরোপিয়ান ফ্লে অয়েস্টার (European Flay Oyster) ও অস্ট্রা এডুলিস (Ostrea edulis) প্রজাতির ঝিনুকের মধ্যে রূপান্তরকামিতা এবং লিঙ্গ পরিবর্তনের প্রমাণ পেয়েছেন। যৌনতার পরিবর্তন ঘটে মাছি, কেঁচো, মাকড়শা এবং জলজ ফ্রি ডাফনিয়াদের বিভিন্ন প্রজাতিরে মধ্যেও। লিঙ্গ পরিবর্তনকারী মাছের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে প্রবালের খাঁজে বসবাসকারী গ্রুপার মাছ। এ গ্রুপার মাছ প্রথমে স্ত্রী হিসাবে জন্মগ্রহণ করে ও পরিপক্কতা লাভ করে এবং এক বা একাধিকবার প্রজননে অংশ নেয়। এসব স্ত্রী মাছ পরে লিঙ্গ পরিবর্তন করে পুরুষ মাছে রূপান্তরিত হয় এবং সক্রিয় পুরুষ মাছ হিসাবে প্রজননে অংশগ্রহণ করে। ক্লাউনফিশও রূপান্তরকামিতার অন্যতম উদাহরণ—
জন্মগতভাবে সকল ক্লাউনফিশ পুরুষ, কিন্তু দলের সবচেয়ে বড়ো আকারের মাছটি নারী মাছে রূপান্তরিত হয়। ভেটকি বা কোরাল মাছও ওইভাবে লিঙ্গ পরিবর্তন করে বলে জানা যায়।
মানবসভ্যতার বিভিন্ন সমাজব্যবস্থায় লিখিত ইতিহাসের সমগ্র সময়কাল জুড়ে রূপান্তরকামিতার উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। এর মধ্যে আমেরিকার পুরুষ রূপান্তরকামী জর্জ জরগেন্সেনের ক্রিস্টিন জরগেন্সেনের রূপান্তরিত হওয়ার কাহিনি মিডিয়ায় এক সময় আলোড়ন তুলেছিল। এছাড়া জোয়ান অব আর্ক, জীববিজ্ঞানী জোয়ান (জনাথন) রাফগার্ডেন, বাস্কেটবল খেলোয়াড় ডেনিস রডম্যান, চক্ষুচিকিৎসক এবং পেশাদার টেনিস খেলোয়াড় ডঃ রেনি রিচার্ডস, সঙ্গীতজ্ঞ বিলিটিপটন সহ অনেক খ্যাতনামা ব্যক্তির মধ্যে রূপান্তরপ্রবণতার উল্লেখ ইতিহাসে মেলে। ১৯৬০ সালে মনোচিকিৎসক ওয়ালিন্দার রূপান্তরকামীদের উপরে একটি সমীক্ষা চালান। তার এই সমীক্ষা থেকে জানা যায় প্রতি ৩৭ হাজারে একজন পুরুষ রূপান্তরকামীর জন্ম হচ্ছে। অপরদিকে প্রতি ১০৩,০০০-এ একজন স্ত্রী রূপান্তরকামীর জন্ম হচ্ছে। ইংল্যান্ডে এই সমীক্ষাটি চালিয়ে দেখা গেছে যে সেখানে প্রতি ৩৪ হাজারে একজন পুরুষ রূপান্তরকামী ভূমিষ্ট হচ্ছে, অপরদিকে প্রতি ১০৮,০০০-এ একজন জন্ম নিচ্ছে একজন স্ত্রী রূপান্তরকামী। অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে গবেষণা করে দেখা গেছে সেখানে ২৪ হাজারে পুরুষের মধ্যে একজন এবং ১৫০,০০০ নারীর মধ্যে একজন রূপান্তরকামীর জন্ম হয়।
সমাজবিজ্ঞানী অ্যান ওকলের মতে, জৈবিক লিঙ্গ শারীরিক বৈশিষ্ট্য বহন করে। আর মানসিক লিঙ্গ’ একটি নির্দিষ্ট সমাজে সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে নির্ধারিত বিশিষ্টতা নির্দেশ করে। একজন নারী ও পুরুষের কার কী রকম পোশাক-পরিচ্ছদ হবে; কে কী রকম আচার-আচরণ করবে; আশা-আকাঙ্ক্ষা, প্রত্যাশা কার কী রকম হবে; সমাজের নানা ধরনের কাজে একজন নারী বা একজন পুরুষের ভূমিকা কী হবে এই বিষয়গুলো নির্ধারণ করে জেন্ডার বা লিঙ্গ। অর্থাৎ, ‘জৈবিক লিঙ্গ’ বিষয়টি পুরোপুরি শরীরের উপর নির্ভরশীল, কিন্তু মানসিক লিঙ্গ নির্ভরশীল সমাজের উপর। যেহেতু নারী বা পুরুষের দায়িত্ব, কাজ ও আচরণ মোটামুটি সমাজ কর্তৃক নির্ধারিত হয়। তাই সমাজ পরিবর্তন বা সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জেন্ডারের ধারণা বদলে যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, আমরা যখন কাউকে ‘নারী’ বা ‘পুরুষ’ হিসাবে চিহ্নিত করি, তখন সেখানে ‘জৈবিক লিঙ্গ’ নির্দেশ করাটাই মূল উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু ‘মেয়েলি’ বা ‘পুরুষালি ইত্যাদি শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে জেন্ডার প্রপঞ্চকে যুক্ত করা হয়, যেখানে নারী বা পুরুষের লৈঙ্গিক বৈশিষ্ট্যকে ছাপিয়ে স্বভাব আচরণগত ইত্যাদি বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়। আর এই কারণে সেক্সকে জৈবলিঙ্গ এবং জেন্ডারকে সামাজিক বা ‘সাংস্কৃতিক লিঙ্গ’ বলে অনেকে অভিহিত করেন। বস্তুত জৈব বৈশিষ্ট্যের বলয় অতিক্রম করে সাংস্কৃতিক বলয়ে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার বাসনার কারণেই মানব সমাজে রূপান্তরকামিতার অস্তিত্ব আছে বলে মনে করা হয়।
অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে লিঙ্গ পরিবর্তন বা সেক্সচেঞ্জ একটি খুব জটিল প্লাস্টিক সার্জারি অপারেশন। এই অপারেশনে যাঁরা নতুন দিগন্তের সন্ধান দিয়েছেন তাঁদের মধ্যে আছেন হ্যারি বেঞ্জামিন, স্টিক, আব্রাহাম, জন মানি প্রমুখ। রূপান্তরকামী এবং উভলিঙ্গ মানুষদের চাহিদাকে মূল্য দিয়ে ডাক্তাররা সার্জারির মাধ্যমে সেক্সচেঞ্জ অপারেশন করে থাকেন। যে সকল রূপান্তরকামী একে অসুখ মনে করেন না, তাঁদের ঔষধ প্রয়োগ করে উক্ত মানসিকতাকে বদলে ফেলা সম্ভব হয় না। এঁদের অনেকেই সেক্সচেঞ্জ অপারেশনের মধ্য দিয়ে মানসিক পরিতৃপ্তি পেয়ে থাকেন। পুরুষ রূপান্তরকামী অর্থাৎ যাঁরা পুরুষ থেকে নারীতে রূপান্তরিত হতে চায়, তাঁদের জন্য এক ধরনের অপারেশন। আর নারী রূপান্তরকামীদের জন্য ভিন্ন অপারেশন রয়েছে। মুলত শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে চামড়া ও টিস্যু নিয়ে গ্রাফটিংয়ের মাধ্যমে যৌনাঙ্গ গঠন করা হয়, হরমোন থেরাপির সাহায্যে স্তন গ্রন্থির হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটানো হয়, সিলিকন টেস্টিকেলের সাহায্যে অণ্ডকোশ তৈরি করা হয়।