সে যাই হোক, প্রসঙ্গে আসি। লিঙ্গচ্ছেদনের পর ওই ব্যক্তিকে চিৎ করে শুইয়ে তাঁর ক্ষতস্থানের নীচে একটি পাত্র রাখা হয়। ক্ষতস্থান থেকে বেরিয়ে আসা রক্ত ওই পাত্রে রাখা হয়। কর্তিত লিঙ্গটিও রাখা হয় ওই পাত্রটিতেই। পরদিন সকালে পাত্রটিকে ফুল দিয়ে সাজানো একটি ঝুড়ির মধ্যে নিয়ে হিজড়ারা মিছিল করে চলে কাছেপিঠের কোনো জলাশয়ে। সেখানেই ঝুড়িটি ভাসিয়ে দেওয়া হয়। ছেদনকার্যের পর নতুন হিজড়াকে ৪৮ ঘণ্টা ঘুমোতে দেওয়া হয় না। ক্ষতস্থান রক্ত বন্ধ করার জন্য ঘুঁটে পোড়া ছাই খয়ের ভিজিয়ে পুরু করে ওই ক্ষতস্থানের ছাইয়ের উপর লাগিয়ে দেওয়া হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই জায়গাটি প্লাস্টারের মতো শক্ত হয়ে যায়। নির্মাণ হয় এক লিঙ্গ-কবন্ধ হিজড়া।
লিঙ্গ কর্তনের পর আর-একটি প্রধান কাজ হল স্তন-দুটিকে পুষ্ট করা। এটি হিজড়াসমাজের অত্যন্ত গোপনে হয়, যাকে বলে ট্রেড সিক্রেট। লিঙ্গ কর্তনের কয়েকদিন পর নতুন হিজড়া একটু সুস্থ হয়ে উঠলে মহল্লার দলপতি তাকে Lyndiol (চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এই ট্যাবলেট খাওয়া অনুচিত) নামে এক ধরনের জন্ম নিরোধক ট্যাবলেট খাওয়ায়। বেশ কয়েক মাস ধরে এই ট্যাবলেট সেবন করানো হয় রোজ, নিয়মিত। এই ট্যাবলেটে ইথিলিন অস্ট্রাডাইওলের পরিমাণ একটু বেশি থাকে। ফলে শরীরে ইস্ট্রোজেন হরমোনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। হরমোনের কু-প্রভাবে স্তনগ্রন্থিতে স্নেহজাতীয় পদার্থ সঞ্চিত হতে থাকে এবং ধীরে ধীরে পুরুষ-বক্ষ থেকে নারী-স্তনের মতো স্ফীত ও পরিপুষ্ট হতে থাকে। নারীদের মতোই স্তনবৃন্তও ফুলে ওঠে।তবে যাদের আর্থিক সামর্থ্য থাকে তারা প্ল্যাস্টিক সার্জারির মাধ্যমে স্তন প্রতিস্থাপন বা সিলিকন ব্রেস্ট করিয়ে নেয়। খুবই ব্যয়সাপেক্ষ এই পদ্ধতি আমাদের দেশের মতো তৃতীয় বিশ্বে প্রায় অসম্ভব হলেও ধনতান্ত্রিক দেশগুলির হিজড়ারা সিলিকন ব্রেস্ট বানিয়ে নেয়। তবে তারা কিন্তু সকলেই লিঙ্গ কর্তন করে না। নীল ছবির দুনিয়ায় এদের বেশ কদর আছে। এরা ‘shemale’ বা ‘Ladyboy’। তবে সোমনাথ ওরফে মানবী মনে করেন, “মেয়ে হিজড়ে ছেলে হিজড়ে বলে কিছুই নেই। সকলেই সমান হিজড়ে। হিজড়ে দলে দু-রকম মানুষ –আকুয়া আর নির্বাণ। আকুয়ারা পেনিস টেসটিস এখনো কেটে ফেলে দেয়নি, আর নির্বাণ হল তাঁরাই যাঁরা কেটে ফেলে দিয়েছে”।
.
হিজরাদের দেবতা
বহুচেরা মাতা হলেন হিজড়াদের দেবতা। হিন্দু হিজড়াদের এই দেবতার জনপ্রিয় মূর্তিটিতে দেখা যায়, তিনি একটি মোরগের পিঠে বসে আছেন এবং হাতে ধরে আছেন একটি তরবারি, ত্রিশূল ও একটি বই। বহুচারা সংক্রান্ত কাহিনিগুলিতে পুরুষাঙ্গ কর্তন ও শারীরিক যৌন বৈশিষ্ট্যের অন্যান্য পরিবর্তনের বেশ কিছু উদাহরণ পাওয়া যায়। এই জন্যে তাঁকে পুরুষের প্রতি অভিশাপদাত্রীর দেবী মনে করা হয়। কথিত আছে, বহুচারা ছিলেন এক নশ্বর নারী। তিনি শহিদ হন। একটি কাহিনিতে দেখা যায়, একদল দস্যু বহুচারাকে ধর্ষণ করার জন্য আক্রমণ করেছিল। সে সময় বহুচারা নিজের তরবারিতেই নিজেরই স্তন দুটি কর্তন করে ফেলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মৃত্যু হয়। অন্য একটি কাহিনিতে জানা যায়, বহুচারার স্বামী যখন একটি উপবনে সমকামী রতিক্রিয়ায় লিপ্ত ছিলেন, তখন বহুচারা তাঁকে হাতেনাতে ধরে ফেলে। তখন স্বামীর পুরুষাঙ্গ খসে পড়ে এবং তিনি নারীর বেশ ধারণ করতে বাধ্য হন।
বহুচারার উপাখ্যানগুলিতে তাঁর দৈবসত্ত্বা পাওয়ার পর লিঙ্গ পার্থক্যের বিষয়টি লক্ষিত হয়। একটি কিংবদন্তী অনুসারে, এক রাজা বহুচারার কাছে পুত্রসন্তান কামনা করেছিলেন। বহুচারা তাঁর প্রার্থনা মঞ্জুর করেন। কিন্তু বড়ো হয়ে রাজকুমার সন্তান উৎপাদনে অক্ষম হন। এক রাতে বহুচারা রাজকুমারকে স্বপ্নে দেখা দেন এবং আদেশ করেন যাতে সে পুরুষাঙ্গ কর্তন করে নারীর বেশ ধারণ করেন এবং তাঁর দাসত্ব করেন। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে, বহুচারা এরপরও পুরুষত্বহীন পুরুষদের চিহ্নিত করে লিঙ্গ কর্তন করতে আদেশ দিতে থাকেন। যাঁরা সেটা করতে অস্বীকার করে তিনি তাঁদের শাস্তি দেন। ফলে তাঁরা পরবর্তী সাত জন্ম পুরুষত্বহীন হয়ে থাকে। এই কাহিনিটিই বহুচারা কাল্টের উৎস। বহুচারা ভক্তদের নিজেদের পুরুষাঙ্গ কর্তন করে আজীবন “ব্রহ্মচারী’ থাকতে হয়।
বহুচারা মন্দিরে ‘কমলিয়া’ নামে এক বিশেষ হিজড়া সম্প্রদায় আছে। এরা পুরুষ। এরা একই সঙ্গে নিজেদের নারী ও পুরুষ হিসাবে কল্পনা করে। তাই লম্বালম্বিভাবে দেহের এক অংশে পুরুষের পোশাক এবং অপর অংশে নারীর বেশ ধারণ করে। এই ‘কমলিয়া’ ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে।
.
রূপান্তরকামী
রূপান্তরকামীর উদাহরণ হিসাবে হাতের সামনে জ্বলজ্বল করছে সোমনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামটি। যিনি আধুনিক বিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে পুরুষ শরীর ত্যাগ করে নারী শরীর গ্রহণ করেছেন। সন্তানধারণ করার ক্ষমতা ছাড়া তিনি আজ পূর্ণাঙ্গ নারীতে রূপান্তরিত। তাঁর বর্মান নাম মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়। ঈশ্বর তাঁকে এক পুরুষের শরীর দিয়ে এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে মনকেই জিতিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। ২০০৩ সালে একটি লিঙ্গ পুনর্নির্মাণ সার্জারি করিয়েছিলেন তিনি, তাঁর মনের সঙ্গে শরীরেও বসত করতে লাগল এক মানবী’। এরপর সমাজের বুকে নিজের অস্তিত্বই শুধু টিকিয়ে রাখা নয়, মানুষের মধ্যে রীতিমতো চর্চিত হতে শুরু করেন মানবী। এরপর ২০০৫ সালে বাংলা সাহিত্যে পিএইডি অর্জনকারী দেশের প্রথম রূপান্তরকামী হলেন এই মানবী। এরপর ২০১৫ সালে তিনি প্রথম রূপান্তরকামী অধ্যক্ষ হিসাবে নিযুক্ত হন কৃষ্ণনগর ওম্যানস কলেজে। বর্তমানে তিনি ঢোসা মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষের দায়ভার সামলাচ্ছেন। একটি সর্বভারতীয় সংবাদ মাধ্যমকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে মানবী বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন যে, তাঁর এই মেয়ে জীবনকে তাঁর বাবা কখনোই মেনে নিতে পারেননি। তাঁকে বরাবরই তিরস্কার সহ্য করতে হয়েছে, কিন্তু জীবনের লড়াইয়ে পিছিয়ে যাননি মানবী। দীর্ঘদিনের সংগ্রাম আজ তিনি অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছেন।
রূপান্তরকামিতা (Transsexualism) বলতে বিশেষ একটি প্রবণতা বোঝায়, যখন সেক্স বা ‘জৈব লিঙ্গ’ ব্যক্তির জেন্ডার বা ‘সাংস্কৃতিক লিঙ্গ’-এর সঙ্গে সংঘর্ষ তৈরি করে। রূপান্তরকামী মানুষরা এমন একটি যৌন-পরিচয়ের (Sex Identity) অভিজ্ঞতা লাভ করেন যা ঐতিহ্যগতভাবে তাঁদের নির্ধারিত যৌনতার সঙ্গে সমঝতা করতে সক্ষম নয় এবং স্থিতিশীলও নয়। অতএব নিজেদেরকে স্থায়ীভাবে সেই লিঙ্গে পরিবর্তন করতে চান। রূপান্তরকামী মানুষেরা পুরুষ হয়ে (বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যে) জন্মানো সত্ত্বেও মনমানসিকতায় নিজেকে নারী ভাবেন, পুরুষের প্রতি যৌনাকৃষ্ট হন। অপরদিকে নারী হয়ে জন্মানোর পরও মানসিক জগতে নিজেকে পুরুষ বলে মনে করেন, নারীর প্রতি যৌনাকৃষ্ট হন। এঁদের কেউ কেউ বিপরীত লিঙ্গের পোশাক পরিধান করেন, এই ব্যাপারটিকে বলা হয় (ট্রান্সভেস্টিজম বা ক্রসড্রেস)। আবার কেউ সেক্স রিঅ্যাসাইনমেন্ট সার্জারির মাধ্যমে রূপান্তরিত মানবে (Transexual) পরিণত হন। এরা সকলেই রূপান্তরিত লিঙ্গ নামক বৃহৎ রূপান্তরপ্রবণ সম্প্রদায়ের (Transgender) অংশ হিসেবে বিবেচিত।