কীভাবে খোজা করা হত? প্রথমে ব্যক্তিটিকে ওই কক্ষে নিয়ে গিয়ে একটি কাঠের পাটাতনে শুইয়ে দেওয়া হত। এরপর হালকা গরম জলে যৌনাঙ্গ ও যৌনাঙ্গের আশেপাশে ধুয়ে নেওয়া হত। তারপর ওই স্থানটুকু অবশ করতে পারে এমন উপাদানের প্রলেপ দিয়ে যৌনাঙ্গকে অবশ করে নেওয়া হত। তখনকার সময়ে অবশকারী উপাদান হিসাবে প্রচণ্ড ঝালযুক্ত লঙ্কা বাটা ব্যবহার করা হত। যিনি খোজাকর্মটি করবেন তিনি হচ্ছেন অপারেশন প্রধান। প্রধানের পাশাপাশি কয়েকজনের সহকারীও থাকত। পুরুষাঙ্গ অবশ করার পর সহযোগীরা পুরুষটিকে কাঠের পাটাতনের সঙ্গে শক্ত করে বেঁধে ফেলত। এরপর দুজন সহকারী তাঁর দুই পা ফাঁক করে ধরে থাকত, যেন পুরুষাঙ্গ কর্তনের সময় পায়ের দ্বারা কোনো বাধার সৃষ্টি না হয়। দুইজন সহকারী দুই পা শক্ত করে ধরে রাখতই, তার উপর আরও দুজন কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে একজন হাতদুটি বেঁধে চেপে ধরে রাখত। কর্তক ব্যক্তি সুবিধামতো পুরুষটির দুই পায়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে অণ্ডকোশ ও পুরুষাঙ্গ একসঙ্গে মুঠোর ভিতর ধরে নিত। মুঠোর মধ্যে শায়িত পুরুষটির কাছ থেকে সম্মতি (অসম্মতির কোনো প্রশ্নই নেই, এটা ছিল প্রোটোকল) নেওয়া হত যে, তিনি স্বেচ্ছায় খোজাকরণ করতে দিচ্ছেন। সম্মতি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চোখের পলকেই ধারালো ছুরি দিয়ে একসঙ্গে কর্তন করে দিত পুরুষাঙ্গ ও অণ্ডকোশ। পুরুষটি তীব্র যন্ত্রণায় আর্ত চিৎকার করে উঠত। কর্তন প্রক্রিয়া শেষ হলে মূত্রনালিতে একটি প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হত, যাতে মূত্রত্যাগ করতে পারে। নলটি ছিল অনেকটা আজকের যুগের স্যালাইনের পাইপের মতো। আজ রাজা-সম্রাটদের হারেমে হাজার হাজার নারী রাখার প্রথা বিলুপ্ত হয়েছে। পাশাপাশি বিলুপ্ত হয়েছে খোজাকরণের মতো চরম নিষ্ঠুর এটি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা। তবে রাজার আমল না থাকলেও হিজড়াসমাজে আজও খোজাকরণ হয়ে থাকে।
রাজা-সুলতান-বাদশাহদের হারেমের জন্য খোজার প্রয়োজনীয়তার যে কারণগুলি পাওয়া যায়, তা হল –
(১) হারেম ও অন্দরমহলে থাকত হাজার হাজার পত্নী ও উপপত্নী, স্বামীর সঙ্গে যৌনমিলনের সুযোগ কম পেত। ফলে সেসব নারীর অধিকাংশের যৌনাকাঙ্ক্ষা অতৃপ্ত থেকে যেত। সেই সঙ্গে তাঁদের স্বামীদের বহু নারীর সঙ্গে যৌনসংসর্গে লিপ্ত থাকাটা মেনে নিতে বাধ্য হত। এর ফলে ঈর্ষা ও আক্রোশের জন্ম নিত। এ অবস্থায় হারেমে বা অন্দরমহলে পুরুষ ক্রীতদাস রাখা স্বামীর জন্য ছিল উদ্বেগের বিষয়। কারণ যৌন অতৃপ্ত ও ঈর্ষাপূর্ণ ওসব নারীরা পুরুষ ক্রীতদাসদের সঙ্গে সহজেই যৌনমিলনে প্রলুব্ধ হতে পারত। অন্য পুরুষের প্রতি হারেমের নারীদের আকর্ষণ বোধ করা তো আর অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়।
(২) পরিবার বা সন্তান-সন্ততি-পরিবারহীন এসব খোজা পুরুষ মানুষরা অসহায় বৃদ্ধ বয়সে দেখাশোনার জন্য সামান্য সান্নিধ্যের আশায় মালিকের প্রতি চরম আনুগত্য প্রদর্শন করে নিজেদেরকে উৎসর্গ করে দিত। উপরন্তু যৌন তাড়নাবিহীন খোজাকৃত দাসরা সাধারণ যৌন উন্মাদনাযুক্ত ইসলামি সংস্কৃতিতে সহজেই একাগ্রভাবে কাজে মনসংযোগ করতে পারত।
(৩) খোজা ক্রীতদাসদের অত্যধিক চাহিদার আর-এক অন্যতম কারণ –শাসক, সেনাধ্যক্ষ ও সম্ভ্রান্তদের সমকামিতার প্রতি মোহাচ্ছন্নতা। ইন্দ্রিয়গত আকাক্ষা চরিতার্থ করার জন্য রাখা হত খোজাদের। সেইসব খোজাদের বলা হত ‘গেলেমান’ বা ‘গিলমান’। তাঁরা উৎকৃষ্ট ও আকর্ষণীয় পোশাকে সজ্জিত থাকত এবং নারীদের মতো তাঁদের শরীরকে সুন্দর করে রাখত। সুগন্ধী সহ প্রসাধনী করত।
.
হিজড়াসমাজে খোজাকরণ
হিজড়াসমাজে সাধারণত দু-রকমভাবে খোজা করা হয়। একটি হল— (১) Castration (Removal of the testicles), অপরটি (২) Penectomy (Penis Removal)। ক্যাসট্রেশন (Castration) হল আসলে পুরুষের ভাসডিফারেন্স বা শুক্রনালীকে কেটে দেওয়া হয়। এই শুক্রনালী শুক্রাণু বহন করে। কাজেই শুক্রাণু বীর্যে আসতে পারে না। কাজেই এই পুরুষের পক্ষে নারীর গর্ভসঞ্চার করানো হয় না। এটি পুরুষের স্থায়ী জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, যা ভেসেকটমি বলে পরিচিত। ভেসেকটমি অপারেশনের পর সেই পুরুষের যৌন-ইচ্ছা, যৌনক্ষমতা, যৌন-আবেদন কোনোটাই হ্রাস পায় না। হারেমের খোজাদের বেশিরভাগেরই এই পদ্ধতিই অবলম্বন করা হত। তবে Penectomy খোজা হল পুরুষের লিঙ্গটাকে কেটে শরীর থেকে আলাদা করে ফেলা। বাৎসায়নের আগেই কৌটিল্য তাঁর ‘অর্থশাস্ত্র’-এ এক বিশেষ ধরনের পুরুষের কথা উল্লেখ করেছেন। এরা নপুংসক’। পুরুষাঙ্গ ছেদন করে এদের নপুংসক করা হত। এরা ছিল রাজ-অন্তঃপুরের পাহারাদার। শুধু মহিলারক্ষীদের এই করানো বেশ কঠিন ছিল। আবার পুরুষরক্ষীবাহিনীকে বিশ্বাস করা যেত না। এদের দ্বারা অতঃপুরবাসিনীর শ্লীলতাহানি হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। কিছু পুরুষকে লিঙ্গ কেটে খোজা করে দেওয়া হয়। রাজ-অন্তঃপুরের বা হারেমের মহিলারা এইসব খোজাদের দিয়ে বিকৃতভাবে তাঁদের যৌনক্ষুধা মেটাতো। রাজা বা বাদশাও যাবে কেন? এঁদের অনেকেই পুরুষসঙ্গমে তৃপ্ত হতেন। লিঙ্গ কেটে ফেললে যৌনমিলন একেবারেই অসম্ভব।
হিজড়া-মহলে কীভাবে লিঙ্গ কর্তন খোজা (Penectomy) করা হয় সেটা এবার জানা যেতে পারে। বীভৎস নারকীয় এবং অবৈজ্ঞানিক উপায়ে লিঙ্গ শরীর থেকে কেটে ফেলা হয়। হিজড়া বানানোর জন্য নিয়ে আসা ব্যক্তিকে একটি নির্দিষ্ট ঘরে অন্তরীণ অবস্থায় ১১ দিন থাকতে হয়। সূর্যের আলো পর্যন্ত দর্শন করতে পারবে না সে। প্রথম প্রথম মহল্লার হিজড়ারা এর সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করে। চলে আদর আর যত্ন। লিঙ্গচ্ছেদনের জন্য হবু হিজড়ার সম্পত্তি আদায় করে নেয়। যৌন পরিবর্তনকামীরা মত দিলেও অন্যরা মত দিতে রাজি হয় না। রাজি না-হলে চলে দৈহিক আর মানসিক নির্যাতন। এই সময়ে হবু হিজড়াকে প্রচুর পরিমাণে মাদক সেবন করানো হয়। অমানবিক অত্যাচার ও মাদকের প্রভাবে তার স্বাভাবিক চেতনা লুপ্ত হয়। ঠিক ১১ দিন পর অনেক রাতে মহল্লার দলপতি তার অনুগত কয়েকজনকে হিজড়াকে নিয়ে ওই ঘরে ঢোকে। নেশায় আচ্ছন্ন হবু হিজড়াকে উলঙ্গ করে হাত-পা বেঁধে দেয়ালের সঙ্গে চেপে ধরা হয়। যাতে চিৎকার করতে না-পারে সেজন্য মুখের ভিতর কাপড় জাতীয় কিছু খুঁজে দেওয়া হয়। এরপর কালো ফিতে দিয়ে লিঙ্গ ও অণ্ডকোশ একসঙ্গে সজোরে বেঁধে দু-দিক থেকে টেনে ধরা হয়। মাথা একদিকে হেলিয়ে কয়েকজন হিজড়া তাকে চেপে ধরে রাখে। এরপর দলপতি অত্যন্ত ধারালো ছুরি বা ক্ষুর দিয়ে ঘ্যাচাং করে লিঙ্গটি কেটে ফেলে। তখন প্রচুর পরিমাণে রক্ত নিঃসরণ হতে থাকে। হিজড়াদের ধারণা এই রক্তপাতের মধ্য দিয়ে শরীরের সমস্ত পুরুষ-রক্ত বেরিয়ে যায় এবং ধীরে ধীরে শরীরে নারী-রক্তের জন্ম হয়। একে ওরা ‘নির্বাণ বলে। নির্বাণের মধ্য দিয়ে হিজড়ার জন্ম হয়।