১৮৩৬ সালে মুর্শিদাবাদের এক প্রাসাদে ৬৩ জন খোজার অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছিল। এই খোজারা শুধু আজ্ঞাবাহী ভৃত্য হিসাবে নিয়োজিত ছিল না, তাঁরা সম্রাট এবং নবাবের প্রিয়পাত্র হিসাবে কোনো কোনো সময় শাসনকার্যে প্রভাব বিস্তার করত। ইতিহাসে এ রকম একটি ঘটনার কথা জানা যায়, ঘটনাটি ঘটেছিল তুর্কি হারেমে। তুর্কিমহলের খোজা প্রধানকে বলা হত কিসলার আগা। কিসলার আগা উপাধিধারী খোজা শুধু মহলের কুমারীদের প্রধান রক্ষী হিসাবে নিয়োজিত হত। সে নিজে দাস হলে তার অধীনে থাকত চারশো গোলাম-বাঁদি। তার নামে ঘোড়াশালে আলাদা করে রেখে দেয়া হত তিনশো ঘোড়া। পুরুষত্বহীন একজন মানুষের এই বিপুল ক্ষমতা একজন খোজার শুধু অটোমান সাম্রাজ্যেই দেখা যায়নি, ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় মোগল আমলে অযোধ্যার একজন জনপ্রিয় আঞ্চলিক শাসক ছিল খোজা। স্পষ্টত মুসলিম বিশ্বে প্রেরিত কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসদের সব বা অতি উচ্চ অংশকে খোজা করা হয়েছিল, যার কারণে এসব অঞ্চলে তারা উল্লেখযোগ্য বংশধর (ডায়াসপোরা’) রেখে যেতে ব্যর্থ হয়। ইসলামি ক্রীতদাসত্বের নিদারুণ লৌহশৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে পড়া ইউরোপীয়, ভারতীয়, মধ্য-এশীয় ও মধ্যপ্রাচ্যের লক্ষ লক্ষ বিধর্মীর ভাগ্যও অনেকটা একইরকম ছিল। ১২৮০-র দশকে মার্কোপোলো ও ১৫০০-র দশকে দুয়ার্ত বার্বোসা স্বচক্ষে ভারতে বিপুল সংখ্যায় খোজাকরণ প্রত্যক্ষ করেছেন। একই প্রক্রিয়া চলে সম্রাট আকবর (মৃত্যু ১৬০৫), জাহাঙ্গীর (মৃত্যু ১৬২৮) ও আওরঙ্গজেবের (মৃত্যু ১৭০৭) শাসনামলে। সুতরাং, ভারতে গোটা মুসলিম শাসনামলে খোজাকরণ ছিল একটা প্রচলিত নিয়ম। সম্ভবত এটা ইতিপূর্বে উল্লেখিত ভারতের জনসংখ্যা ১০০০ খ্রিস্টাব্দে প্রায় ২০ কোটি থেকে ১৫০০ খ্রিস্টাব্দে ১৭ কোটিতে হ্রাসকরণে একটা বড়ো অবদান রেখেছিল।
খোজাদের মধ্যে বুদ্ধিমান এবং স্মৃতিশক্তিধর হিসাবে যাঁদের পাওয়া যেত সুলতান এবং সম্রাটেরা তাঁদের রাজকার্যে নিয়োজিত করতেন। তবে বুদ্ধিমান খোজার সংখ্যা ছিল খুবই কম। খোজাদের নিয়ে গবেষণায় দেখা গেছে অধিকাংশ খোজাই বদমেজাজি, বালসুলভ, প্রতিশোধপরায়ণ, নিষ্ঠুর এবং উদ্ধত। অবশ্য এর বিপরীত স্বভাবের খোজাও রয়েছে। এঁরা সরল, নিরীহ, আমোদপ্রিয় উদার। অবশ্য খোজাদের মেজাজ মর্জি এই বৈপরীত্যের কারণ তাঁদের খোজাকরণের বয়সের উপর নির্ভর করত। কম বয়সে খোজা করার পর ওই খোজা কারও উপর ক্রোধান্বিত হলে এবং সুযোগ পেলে তাঁকে হত্যা করতেও দ্বিধা করত না।
জে. রিচার্ড লিখিত ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রক্ষিত একটি পাণ্ডুলিপি থেকে জানা যায়, সাধারণভাবে খোজা বা পুরোপুরি অক্ষম এই কথাটা ব্যাপকভাবে প্রচলিত থাকলেও খোজারা কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যৌন-অক্ষম নয়। রিচার্ড একজন বিবাহিত খোজার স্ত্রীর সংগে আলাপের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, স্ত্রীলোকটির কথায় মনে হচ্ছিল ওরা পুরোপুরি তৃপ্ত এবং সুখী। চিয়েন লুঙের আমলে একটি ঘটনা থেকে জানা যায়, পিকিংয়ের হারেমের এক খোজা পুরোহিতের কাছে ঔদ্ধত্ব প্রকাশ করে বলেছিল, খোজার উপর পুরোহিতের কোনো এক্তিয়ার নেই। পুরোহিত খোজাকে হেকিমের কাছে নিয়ে গেলেন। পরীক্ষা করে দেখা গেল তাঁর পৌরুষত্ব ফিরে এসেছে। আসলে সে ছিল এক নকল খোজা।
প্রাচীন চিনে শাসক বা রাজারা রক্ষিতা রাখার ব্যাপারে অনেকটা এগিয়ে ছিল। বিস্তৃত চিনের অবস্থা ছিল যে, যাঁর যত বেশি রক্ষিত নারী আছে সমাজে তাঁর স্ট্যাটাস তত উঁচুতে। সম্রাটদের ক্ষেত্রেও রক্ষিতা রাখার প্রচলন ছিল। কোনো কোনো সম্রাটের হারেমে হাজার হাজার রক্ষিতা থাকত। মিঙ রাজবংশ এই দিক থেকে বিখ্যাত। মিঙ শাসনামলে তাঁদের হারেমে ২০ হাজার ছিল। যেন পালিয়ে না যায় বা ভিতরে কোনো ঝামেলা না করে সে কারণে পাহারাদার রাখা হত। তবে পাহারাদাররা অবশ্যই পুরুষ ছিল। পাছে রক্ষিতাদের সঙ্গে যৌন সম্পর্কগড়ে তোলে, তাই সেইসব যৌনক্ষমতা নষ্ট করে দেওয়া হত খোজাকরণের মাধ্যমে। ইংরেজি Eunuch শব্দের প্রতিশব্দ হল খোজা। ইউনাক শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ Eunoukhos থেকে, যার অর্থ শয়নকক্ষের পাহারাদার।
খোজাকরণ মূলত তিনটি পদ্ধতিতে করা হত। যেমন– (১) পুরুষাঙ্গ বা লিঙ্গ সমূলে কর্তন করা, (২) অণ্ডকোশ বা শুক্রথলি কর্তন করা এবং (৩) পুরুষাঙ্গ ও অণ্ডকোশ উভয়ই কর্তন করা।
প্রাচীন চিনে এই তিনপ্রকার কর্তনই প্রচলন ছিল। এই প্রক্রিয়ায় খুব ধারালো ছুরির সাহায্যে পুরুষাঙ্গ ও অণ্ডকোশ উভয়ই কেটে ফেলা হত। চিনে খ্রিস্টপূর্ব ১৬০০ অব্দ থেকে শুরু করে পরবর্তী কয়েক হাজার বছর পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া প্রচলিত ছিল। তবে এই প্রক্রিয়ায় ঝুঁকি অনেক বেশি। এই প্রক্রিয়ায় অসংখ্য পুরুষের মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুহার কমানোর জন্য অবশেষে পুরুষাঙ্গ রেখে শুক্রথলি কেটে খোজা বানানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়। পরবর্তীতে চিনের খোজাকরণ প্রক্রিয়া আরও উন্নত করা হয়। এর সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুহারও কমতে শুরু করে। এই কাজে এতটাই পারদর্শী হয়ে ওঠে যে মৃত্যুহার শূন্য হয়ে যায়। প্রাচীন চৈনিক সাম্রাজ্যে খোজাকরণের কাজটি করা হত মূল প্রাসাদের বাইরে বিচ্ছিন্ন কোনো জায়গায়। রাজপ্রাসাদের চারদিকে দেয়াল-ঘেরা সীমানা থাকত। এই সীমানার কোনো স্থানে ব্যবহৃত হয় না এমন একটি পাহারাকক্ষ ব্যবহার করা হত খোজাকরণের অপারেশনের কক্ষ হিসাবে।