সভ্যতার একেবারে গোড়ার দিকে, অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব ৮১১ থেকে ৮০৮ অব্দের আসিবিয়ার রানিমাতা সামুরামাত নিজ হাতে তার এক ক্রীতদাসকে ‘খোজা’ করেছিলেন। একটি উপকথায় তাঁকে সেমিরা মিস বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আসিবিয়ার রানিমাতা কেন তাঁর ক্রীতদাসকে ‘খোজা’ করেছিলেন ইতিহাসে তার বিবরণ না-থাকলেও অনেক গবেষক মনে করেন রানির বিকৃত যৌন-লালসা নিবৃত্ত করার জন্য হতভাগ্য ক্রীতদাসকে বিকলাঙ্গ করা হয়েছিল।
এরপর বিভিন্ন দেশে ‘খোজা’ করা হয়েছে। আর এই নিষ্ঠুরতা সংঘটিত হয়েছে শাসক, অভিজাত শ্রেনি এবং ধনাঢ্য ব্যক্তিদের মহলেও। শুধু যে রাজা-বাদশা বা অভিজাত শ্রেণির মহলে খোজা তৈরি হত তা কিন্তু নয়, ধর্মীয় কারণে অনেকেই খোজাকরণ বরণ করেছে, ইতিহাসে এর প্রমাণও আছে। ওল্ড টেস্টামেন্টে খোজার উল্লেখ আছে। ম্যাথুর প্রবচনে আছে— ‘একদল পুরুষত্বহীন মানুষ আছে যারা মাতৃগর্ভ থেকেই অসম্পূর্ণ অবস্থাতে ভূমিষ্ট হয়েছে। আর একদল আছে যাদের অন্য মানুষ খোজা করেছে। তৃতীয় দলের খোজা যাঁরা তাঁরা স্বর্গের কামনায় স্বেচ্ছায় পুরুষহীন হয়েছে। এই কথার পরিপ্রেক্ষিতেই বোধহয় একজন খ্রিস্টান ধর্মযাজক ঘোষণা করেছিলেন— একমাত্র কামনাশূন্য খোজার কাছেই স্বর্গের দুয়ার খোলা রয়েছে। কামনা-বাসনা শূন্য হওয়ার জন্য অনেক ধর্মপ্রচারক খোজাদের স্বপক্ষে তাঁদের অভিমত ব্যক্ত করেছেন। কামনাশূন্য সাধনা করার জন্য বিগত খ্রিস্টান সাধু ওরিজেন তার পুরুষত্ব বিসর্জন দিয়েছিলেন। ১৭৭২ সালে রাশিয়ায় একটি গোপন ধর্মীয় গোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটেছিল, যাঁরা স্বেচ্ছায় খোজাকরণ বরণ করে নিতেন। এঁদের বিশ্বাস ছিল মানুষের দেহে আদম এবং ইড থেকে যে নিষিদ্ধ ফল যৌন-তাড়না করে বেড়াচ্ছে, খোজাকরণের মাধ্যমে তার অবসান ঘটানো সম্ভব। মানব এবং মানবীর জনক এবং জননী হওয়ার যোগ্যতা এই নিষিদ্ধ অদৃশ্য ফল থেকেই আসে, আর লিঙ্গ ও যোনির ব্যবহারে আর একটি মাত্র সন্তানের জন্ম হয়। এ কারণেই রাশিয়ার ওই গোপন সংগঠনের পুরুষ সদস্যরা স্বেচ্ছায় খোজা এবং নারীরা তাঁদের স্তন কেটে কামনাশূন্য হতে চেয়েছিল।
খ্রিস্টানদের মধ্যে স্বর্গ প্রাপ্তির আশায় শুধু খোজাকরণ বরণ করত, তা কিন্তু নয়। গির্জায় প্রার্থনা সংগীত গাওয়ার জন্য খোজাদের কদর করা হত। সিসটান চ্যাপেলে প্রার্থনা সংগীত গাওয়ার জন্য স্বয়ং পোপ তাঁদের আহ্বান করতেন। খোজাদের আহ্বান করার পিছনে যুক্তি ছিল খোজাদের কণ্ঠস্বর সমান তেজি, সমান গভীর এবং সমান নিখাদ। খ্রিস্ট সম্প্রদায় এই সংগীত আগ্রহভরে শ্রবণ করত, তাঁদের বিশ্বাস ছিল ঈশ্বরকে মুগ্ধ করার জন্য খোজা কণ্ঠের সংগীত অবশ্যই গীত হওয়া প্রয়োজন। এই ধারণা থেকে ইতালির অনেক বিখ্যাত গায়ক স্বেচ্ছায় খোজা হয়ে গিয়েছিলেন।
এখানেই শেষ নয়, হারেমের প্রহরী হিসাবেও খোজারা নির্ভরযোগ্য ছিল। খোজাদের এই বিশ্বস্ততা প্রথম লক্ষ করেন সাইরাস। তিনি খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৮ অব্দে ব্যাবিলন দখল করার পর আবিষ্কার করলেন খোজাদের মতো নির্ভরযোগ্য পুরুষ সত্যিই দুর্লভ। তার এই আবিষ্কারের পিছনে যুক্তি ছিল খোজাদের যেহেতু কোনো সংসার নেই, তাই যে তাকে প্রতিপালন করবে খোজারা সুখ-দুঃখে তারই পাশে থাকবে। সাইরাস এও লক্ষ করেছিলেন যে, খোজারা পুরুষত্বহীন বলে কিন্তু তারা হীনবল নয়। সাইরাস এই বিশ্বাস থেকেই রাজ অন্তঃপুরে খোজা প্রহরী নিয়োগ করেছিলেন। এরপর বিভিন্ন দেশের হারেমে খোজা প্রহরীদের নিয়োগের হিড়িক পড়ে যায়।
হেরোডোটাসের বর্ণনা থেকে জানা যায়, পারস্যের মানুষরা আইনিয়ানদের দলে দলে বন্দি করে তাঁদের পুরুষত্বের বিনাশ করত এবং এঁদের সুন্দর পোশাক-আশাক পরিয়ে বিভিন্ন দেশের রাজাদের কাছে বিক্রি করে দিত। হেরোডেটাস বলেছেন– সম্রাট জারেজেসের প্রিয় খোজা-পুরুষ ছিলেন হারমোটিয়াস নামে এক ব্যক্তি। শিশুকালে তাঁকে অপহরণ করে দাস বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। এরপর দাস-বিক্রেতারা ভালো দাম পেয়ে তাঁকে পানিওনিয়াস নামে এক ধনী ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে দেয়। সে ছিল খোজাকরণে দক্ষ। পানিওনিয়াসই বালক হারমোটিয়াসকে খোজা করে বাজারে নিয়ে আসে। এরপর আর-এক ব্যবসায়ীর হাতে তুলে দেওয়া হয়। এইভাবে হাতবদল হতে হতে হারমোটিয়াস একদিন জারকজেসের দরবারে পৌঁছে যায়।
পারসিকরাই মুসলিম শাসিত রাজ্যে প্রথম খোজার আমদানি করেছিল। তুর্কিরা তো খোজার খোঁজই রাখতেন না। অবশ্য পঞ্চদশ শতাব্দীতে খোজার সন্ধান পান তুর্কি শাসকরা। এই আশ্চর্য বিশ্বস্ত এবং শক্তিমান না-নারী না-পুরুষ প্রাণীটি পেয়ে তুর্কিদের মধ্যে এই চেতনার উদয় হল যে, ইচ্ছে করলে তা তাঁরা নিজেরাই খোজা তৈরি করতে পারে।
তুর্কি সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগে অসংখ্য যুদ্ধবন্দির মাঝখান থেকে রূপবান এবং শক্তিমান পুরুষদের বেছে বেছে খোজা তৈরির মহরত শুরু করেন সুলতান প্রথম মাহমুদ এবং দ্বিতীয় মুরাদ। খোজাদের প্রথমদিকে বাদশাহ বা সুলতানের মহিষী এবং রক্ষিতাদের পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হলেও পরবর্তী সময় সুলতানের হেঁসেল থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের বিভিন্ন কাজে তাঁদের নিয়োগ করা হত।