(আ) যৌনক্ষমতাসম্পন্ন জেনানা : এঁরা শরীরিক ও মানসিক দিক দিয়ে পরিপূর্ণ সুস্থ পুরুষ-মানুষ। এঁরা ধান্দাবাজ, ধুরন্ধর। এঁদের অনেকেরই স্ত্রী-সন্তান পরিবার থাকে। কোনো জেনানা যদি হিজড়েদের দলের প্রধান হয় তাহলে তাঁর পক্ষে তাঁর পরিবারের সঙ্গে থাকা সম্ভব হয় না। দল পরিচালনার জন্যে তাঁকে হিজড়া-মহল্লাতেই থাকতে হয়। তাই বলে পরিবারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নষ্ট হয় না। সেই কারণেই এদেরকে রোজ ভোর হতে না-হতেই ছুটতে হয় হিজড়েদের দুনিয়াতে।
(গ) ছিবড়ি : শুধু পুরুষরাই নয়, হিজড়াদের দলে কিছু মহিলাদেরও দেখা যায়। এইসব হিজড়াদের ছিবড়ি বলা হয়। এঁরা যৌনাঙ্গের ত্রুটিযুক্ত মহিলা নয়, সুস্থ সবল মানুষ এঁরা। নিতান্তই অর্থনৈতিক কারণেই এঁরা হিজড়ের দলে এসে যোগ দেয়। চরমতম আর্থিক সংকটের মধ্যেই দিন গুজরান করে। রুটিরুজির ধান্দায় এঁরা হিজড়াদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়। হিজড়াদের সঙ্গে থাকার কারণে হিজড়াদের আদব-কায়দাও শিখে নেয়। রপ্ত করে নেয় হিজড়া সমাজের রীতিনীতি। এঁরা বেশিরভাই বিবাহিতা এবং স্বামী পরিত্যক্তা হন।
(ঘ) ছিন্নি : যে সমস্ত পুরুষ মানুষ লিঙ্গ কর্তন করে ‘খোজা হয়, তাঁদেরকেই ‘ছিন্নি’ বলে। হিজড়াদের গরিষ্ঠাংশই ছিন্নি। আকুয়া থেকে অনেকে হিজরাই স্বেচ্ছায় ছিন্নিতে রূপান্তরিত হয়। যৌন পরির্তনকামী হিজড়ারা নিজেদের পুরুষাঙ্গ কেটে ফেলে। শরীর থেকে পুরুষাঙ্গ কর্তন করে পরিপূর্ণ নারী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকে। আধুনিক বা অগ্রসর দেশগুলিতে অত্যাধুনিক প্ল্যাস্টিক সার্জারি করে যৌন পরিবর্তনকামীরা তাঁদের লিঙ্গ পরিবর্তন করার সুযোগ পেতে পারে। এই জাতীয় অস্ত্রোপচার অত্যন্ত ব্যয়বহুল, তাই অনেকেরই এই স্বপ্ন অধুরাই থেকে যায়। তবে যাঁরা অসম্ভব রকমের মানসিক টানাপোড়েনকে উপেক্ষা করতে পারেন না, তাঁরা হাতুড়ে চিকিৎসক দিয়ে লিঙ্গ কর্তন করিয়ে নেয়। অবশ্য যৌন পরিবর্তনকামী আকুয়ারা ছাড়াও যৌনক্ষমতাহীন জেনানারাও অনেক সময় তাঁদের লিঙ্গ কর্তন করায়। এছাড়া দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দালাল মারফত পুরুষ-শিশু, কিশোর এবং যুবকদের হিজড়াদের গোষ্ঠীপতিরা সংগ্রহ করে। এরপর ওদের লিঙ্গ কর্তন খোজা করে ‘পাকা হিজড়া’ বানিয়ে তাঁদের বিভিন্ন রকম রোজগারের কাজে নামানো হয়।
খোজার কথা যখন উঠলই তখন আমরা জেনে নিতে পারি খোজার ইতিহাস। কীভাবে খোজা’ (ক্যাসট্রেশন) করা হয় তাও জানব। খোজাদের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় মানুষের হাতে গড়া খোজাদের আবির্ভাব হয়েছিল মেসোপটেমিয়ায়। খোজা প্রাচীন ও মধ্যযুগে রাজকীয় হারেমে বা জেনানামহলে কর্মী ও কর্মকর্তা হিসাবে নিযুক্ত খোজাকৃত পুরুষ। বিশেষ উদ্দেশ্যে পুরুষদের খোজা করার প্রথা খ্রিস্টপূর্ব আট শতকের গোড়ার দিকেও প্রচলিত ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রাচীন ও মধ্যযুগে খোজারা রাজকীয় হারেমের ভৃত্য বা প্রহরী হিসাবে, খেতাবধারী বা বৃত্তিভোগী রানি এবং সরকারের যোদ্ধা ও মন্ত্রীদের পরামর্শদাতা হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। এ প্রথা বা ব্যবস্থাটি ভারতে প্রবর্তিত হয় সম্ভবত সুলতানি আমলের গোড়ার দিকে। খোজাদের প্রধানত সুলতানদের প্রাসাদে হারেম প্রহরার জন্য নিযুক্ত করা হলেও চিনা খোজাদের মতো সুলতানি আমলের খোজারা গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও সামরিক ভূমিকা পালন করে। সুলতান আলাউদ্দিন খলজির (১২৯৬-১৩১৬) অন্যতম বিখ্যাত সেনাপতি ও ওয়াজির মালিক কাফুর একজন খোজা ছিলেন। দিল্লির খোজাদের মতো বাংলার অভিজাতবর্গের খোজারাও প্রশাসনে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে। বাংলায় হাবশি শাসনামলে (১৪৮৭-১৪৯৩) বস্তত শাসকদের ক্ষমতার উত্থান-পতনে তাদের অংশগ্রহণ ছিল গুরুত্বপূর্ণ। শাহজাদা ওরফে বারবক নামে এক খোজা ১৪৮৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলার মসনদ দখল করেন। পণ্ডিতদের বিশ্বাস, হাবসি সুলতান শামসউদ্দিন মুজাফফর শাহ (১৪৯০-১৪৯৩) খোজা ছিলেন। সমসাময়িক বাংলায় পর্তুগিজ পরিব্রাজক দুয়ার্তে বারবোসার বিবরণ অনুসারে বাংলার শাসক ও অভিজাতবর্গের হারেমগুলিতে দেশীয় ও বিদেশি বংশোদ্ভূত খোজারা প্রহরায় নিয়োজিত থাকত। কথিত আছে, নওয়াব শুজাউদ্দিন খানের (১৭১৭-১৭৩৯) হারেম প্রহরায় নিয়োজিত ছিল উত্তর-পশ্চিম ভারত থেকে সংগৃহীত খোজারা।
ঐতিহাসিক ও নৃতাত্ত্বিক নানা গবেষণা থেকে জানা যায় যে, বহুবিবাহ, উপপত্নী (বাঁদি) ও হারেম ব্যবস্থা গড়ে ওঠার কারণে খোজা ব্যবস্থারও উদ্ভব ঘটে। হারেমের নারীদের উপর নজর রাখার জন্য খোজাকৃত পুরুষ প্রহরী নিয়োগ করা হত। পুরুষদের খোজা করে দেওয়া হত এই কারণে যে, যাতে এই পুরুষ-প্রহরীরা হারেমের নারীদের সঙ্গে যৌনমিলন না করতে পারে। সাধারণত রণাঙ্গণে বন্দি তরুণ সৈনিকদের খোজা করা হত। এছাড়া দাস-বিক্রেতারা সাধারণত দাস বাজার থেকে ক্রয় করে স্বাস্থ্যবান ও তরুণ বালকদেরও খোজা করত। এরপর শাসক ও অভিজাতবর্গের হারেমে বিক্রি করে দিত। ভারতের প্রাচীন শাসকরা তাঁদের হারেম পাহারা দেওয়ার জন্য হিজড়াদের নিয়োগ করতেন, কখনো তাঁরা খোজা করা কোনো পুরুষকে নিয়োগ করতেন না। অতএব খোজা প্রথা এদেশে প্রবর্তিত হয় বিদেশিদের দ্বারাই।