(ঙ) মিশ্র যৌনগ্রন্থির বিকৃতি (Mixed Gonadal Dysgenesis) : আপাতদৃষ্টিতে এঁদের পুরুষ বলেই মনে হয়। গোঁফ-দাড়িও হয়। শুক্রাশয় থাকে, তবে তা থাকে শরীরের অভ্যন্তরে। এই প্রকার হিজড়াদের শুক্রাশয়ের বিভিন্ন প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতির জন্যই পরিণত শুক্রাণুর জন্ম হয় না। এদের শিশ্ন বা লিঙ্গ বর্তমান থাকে। মূত্রছিদ্র লিঙ্গের স্বাভাবিক স্থানেই থাকে। ব্যতিক্রম যেটা, সেটা হল লিঙ্গ থাকা সত্ত্বেও এদের শরীরে যোনি অর্থাৎ স্ত্রীযোনি, জরায়ু এবং ফেলোপিয়ান টিউব থাকে। কৈশোরের এদের শুক্রাশয় থেকে এন্ড্রোজেন নিঃসৃত হয়, ফলে শরীরে পুরুষালি ভাব বেশ প্রকট হয়ে ওঠে। প্রধানত ক্রোমোজোমের অস্বাভাবিকতা, অ্যাড্রিনাল গ্ল্যান্ডের নানারকম ত্রুটি এবং জননকোশের উৎপত্তি স্থানের নানা সূক্ষ্ম জটিলতার ফলেই এমন যৌনবিকলাঙ্গ মানুষের জন্ম হয়। এইসব মানুষদের দেহকোশে ক্রোমোজোমের সংখ্যা সাধারণত ৪৬ (৪৫ + X) হয়। অবশ্য অনেক সময়েই ৪৭ (৪৫ + XY)ও দেখা যায়।
বস্তুত হিজড়াদের দলে জন্মগত যৌন-প্রতিবন্ধীর সংখ্যা খুবই নগণ্য। সামান্য কিছু ব্যতীত প্রায় সকলেই ছদ্মবেশী হিজড়া। তবে শারীরিক ও মানসিক দিক দিয়ে এঁরা এত বেশি অসুস্থ যে খোশমেজাজে নেচে-গেয়ে হিজড়াদের দলে থেকে এঁদের জীবন কাটিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। নানাবিধ শারীরিক পীড়ায় জর্জরিত এঁরা। আর পাঁচটা অসুস্থ-পঙ্গু মানুষের মতো এরা সংসারের বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। তাই সম্প্রদায়ভুক্ত হিজড়াদের দলে এঁদের ঠাঁই হয় না। এঁদের কাছেও এরা ঝঞ্ঝাট। অন্যভাবে বললে এরা ‘অপ্রকৃত হিজড়া’। প্রসঙ্গত জানাই, যৌন-প্রতিবন্ধী যাঁরা, তাঁদেরকে ‘প্রকৃত হিজড়া’ বলা হয়। প্রকৃত হিজড়াদের সকলকেই পুরোপুরি সারিয়ে তোলা সম্ভব না-হলেও চিকিৎসা বিজ্ঞানের কল্যাণে অনেকেই ত্রুটিমুক্ত হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে। যদিও ক্রোমোজোমের অস্বাভাবিকতা থাকলে তাঁকে স্বাভাবিক অবস্থায় আনা যায় না ঠিকই, কিন্তু হাইপোস্পিডিয়াস থাকলে তাঁকে সার্জারির সাহায্যে ভালো করে তোলা সম্ভব হয়েছে। টানার্স সিনড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও অস্ত্রোপচার সম্ভব হচ্ছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের উন্নতির ফলে আগামীদিনে জন্মগত হিজড়ে অনেক কমে যাবে বলে অনেকে মনে করেন।
(২) ছদ্মবেশী হিজড়া : ছদ্মবেশী হিজড়াদের চারভাগে ভাগ করলে আলোচনার সুবিধা হবে। যেমন–
(ক) আকুয়া : হিজড়া দলে এক ধরনের পুরুষ থাকে যাঁরা মেয়ে সাজতে চায়, মেয়ে হতে চায়। মেয়ে হিসাবে নিজেকে জাহির করার মধ্যে এঁরা অসম্ভব রকম মানসিক পরিতৃপ্তি বোধ করে। এঁরা পুরুষ হলেও নারী-বেশ ধারণ করতে পছন্দ করে। স্রেফ এক বিশেষ মানসিক তাড়নায় এঁরা মেয়ে সেজে থাকতে চায়। সদ্য শৈশব পেরিয়ে আসা কিশোরদের মধ্যে এরকম ভাব লক্ষ করা যায়। তবে পরিণত বয়সেও কোনো পুরুষের মধ্যেও এ ধরনের মানসিকতা সৃষ্টি হতে পারে। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এঁদের মানসিকতাকে Transexualism বা লিঙ্গরূপান্তরকামিতা বা যৌন পরিবর্তনকামিতা বলে। নিজেকে পুরোপুরি পালটে মহিলা হিসাবে পরিচিত হতে চায়। যৌন পরিবর্তনকামী মানুষরা নারীত্বের স্বাদ পেতে চায়। পুরুষদের এঁরা প্রেমিকা ভাবে। কৃষ্ণনগর উইমেন্স কলেজের সদ্য নিযুক্ত মানবী বন্দ্যোপাধ্যায় কিছুদিন আগে পর্যন্তও ‘আকুয়া’ সোমনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় হিসাবে পরিচিত ছিলেন। আজ বিজ্ঞানের কল্যাণে ‘পুরুষ’ সোমনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে নারী হিসাবে মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুনর্জন্ম হয়েছে।
এই আকুয়ারা সমবয়সিকে স্রেফ বন্ধু হিসাবে পেতে চায়, যৌনসঙ্গী হিসাবে নয়। কিন্তু পুরুষ হয়েও মেয়েলি স্বভাব ও আচরণের জন্য মেয়েরা তাঁদের মেয়ে হিসাবে মেনে নিতে পারে না। মেয়েলি ভাবের জন্য এঁরা যেমন মেয়েদের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়, তেমনি পুরুষদের কাছ থেকেও প্রত্যাখ্যাত হয়। ফলে এদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবোধ ও অন্তর্মুখীনতা দেখা যায়। দারিদ্র্য, সাংসারিক ও পারিপার্শ্বিক চাপে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠা আকুয়ারা একটা সময় হিজড়াদের দলে এসে ভিড়ে যায়। সবার ভাগ্যে তো আর মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো ঘর ও বর জোটে না!
(খ) জেনানা : জেনানা হল নারীর সাজে সজ্জিত কোনো পুরুষ। তবে এঁদের আকুয়া বলা যাবে না। কারণ জেনানারা কোনো বিশেষ মানসিকতার দ্বারা আক্রান্ত নয়। নারী বেশ ধারণের মধ্য দিয়ে এঁরা কোনো সুখ উপলব্ধি করে না। যৌন-প্রতিবন্ধী হিসাবে পরিচিত হয়ে এঁরা সমাজের কাছ থেকে সর্বপ্রকার বাড়তি সুযোগ-সুবিধা আদায় করতে চায়। কম খেটে অসদুপায়ে বেশি রোজগারের আশায় জেনানা হিজড়াদের এই ধরনের নারীবেশ ধারণ। হিজড়ার জগতে জেনানাদের দাপটই সবচেয়ে জেনানারা আবার দু-ধরনের হয়। যেমন —
(অ) যৌনক্ষমতাহীন জেনানা : হিজড়া দলের এইসব জেনানারা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সমাজের এক্কেবারে পিছিয়ে-পড়া শ্রেণির মানুষ। অস্বাস্থ্যকর ঝুপড়ি বস্তি এলাকা থেকেই এইসব হিজড়ারা সংগৃহীত হয়। এদের কেউ কেউ অনাথ। এঁরা স্বেচ্ছায় হিজড়াদের দলে চলে আসে। দারিদ্র্য, ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা এবং অল্প পরিশ্রমে রোজগারের হাতছানি যৌনক্ষমতাহীন ব্যক্তিদের হিজড়াদের ডেরায় ভিড়ে যায়।