(১) প্রকৃত হিজড়া (True Hermaphrolite),
(২) পুরুষ অপ্রকৃত হিজড়া (Male Pseudo Hermaphrodite),
(৩) স্ত্রী অপ্রকৃত হিজড়া (Female Pseudo Hermaphrodite) এবং
(৪) ফ্ৰিমার্টিন সিনড্রোম (Freemartin Syndrome)।
প্রকৃত হিজড়াদের ক্ষেত্রে একই দেহে শুক্রাশয় ও ডিম্বাশয়ের অবস্থান লক্ষ করা যায়। পুরুষ অপ্রকৃত হিজড়াদের শরীরের আপাত বাহ্যিক গঠন মেয়েলি হলেও শুক্রাশয় বর্তমান। স্ত্রী অপ্রকৃত হিজড়াদের দৈহিক গঠনের সঙ্গে সুস্থ পুরুষের আপাত সাদৃশ্য থাকলেও এরকম হিজড়ার দেহে ডিম্বাশয় থাকে।
হিজড়াদের মূলত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়– (১) জন্মগত হিজড়ে এবং (২) ছদ্মবেশী হিজড়া।
(১) জন্মগত হিজড়ে : আমরা আমাদের চারপাশে যেসব হিজড়া দেখি তাঁদের অনেকেই জন্মগত যৌন প্রতিবন্ধী। এঁদের যৌন জনন বৈকল্য বা প্রতিবন্ধকতা একরকম নয়। কারোর যৌনাঙ্গ অপুষ্ট বা অপূর্ণাঙ্গ। কারোর-বা শরীরে নারী ও পুরুষ অপরিপূর্ণ উভয় যৌনাঙ্গের অবস্থান লক্ষ করা যায়। এখন প্রশ্ন কেন প্রতিবন্ধকতা?
নারী-পুরুষ লিঙ্গ নির্ধারণ হয় দুই ধরনের আলাদা আলাদা ক্রোমোজোমের উপস্থিতিতে। সাধারণত প্রতি কোশে এক জোড়া ক্রোমোজোম দেখা যায়, যারা বস্তুত লিঙ্গ নির্ধারক। এই ক্রোমোজোমগুলিই হল Sex Chromosome বা যৌন ক্রোমোজোম। যৌন ক্রোমোজোম দুটিকে X এবং Y দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। বাকি ক্রোমোজোমগুলি জীবের অন্যান্য বৈশিষ্ঠ্যের ধারক। এঁরা। Autosome বা অযৌন ক্রোমোজোম। স্বাভাবিক ক্ষেত্রে মানুষের দেহকোশের ক্রোমোজোমের সংখ্যা ৪৬ বা ২৩ জোড়া। এই ২৩ জোড়া ক্রোমোজোমের মধ্যে এক জোড়া ক্রোমোজোম নির্ধারক। অর্থাৎ বাকি ২২ জোড়া অটোজোম। Y ক্রোমোজোমের আকৃতি ও আয়তনে X ক্রোমোজোমের তুলনায় ক্ষুদ্র। স্ত্রী দেহকোশে দুটি X ক্রোমোজোম থাকে। অপরদিকে, পুরুষ দেহকোশে একটি x এবং একটি Y ক্রোমোজোম থাকে। প্রতিটি কন্যা সন্তান মাতাপিতার কাছ থেকে ২২ জোড়া অযৌন ক্রোমোজোম পেয়ে থাকে। এর মধ্যে মায়ের কাছ থেকে একটি X ক্রমোজোম এবং বাবার কাছ থেকে একটি Y ক্রোমোজোম, অর্থাৎ দুটি XX যৌন ক্রোমোজোম পেয়ে থাকে। অপরদিকে পুত্র সন্তানটি ২২ জোড়া অযৌন ক্রোমোজোমের সঙ্গে মায়ের কাছ থেকে একটি x এবং বাবার কাছ থেকে একটি Y ক্রোমোজোম লাভ করে। এটাই স্বাভাবিক হলেও সবসময় তা হয় না। অনেক সময় যৌন ক্রোমোজোমের ত্রুটির ফলে কোনো সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। অর্থাৎ সন্তানটি ছেলে না মেয়ে, সেটা বলা নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না। তখন সে তৃতীয় সেক্সের দলে পড়ে, অর্থাৎ হিজড়া। ক্রোমোজোম ও বাবডির ত্রুটির হিসাবে হিজড়াদের ছয় ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন–
(ক) ক্লাইনেফেলটার সিনড্রোম (Klinefelter Syndrome): এদের স্ফীত স্তন দেখা যায়। এদের শিশ্ন বা পুংলিঙ্গ থাকে বটে, তবে তা অত্যন্ত ক্ষুদ্র। শুক্রাশয়ও খুব ছোটো হয়। বগল (বাহুমূল) চুল বা কেশ থাকে না। এঁদের তলপেটের নীচে, অর্থাৎ যৌনাঙ্গের চারপাশে চুল কম হয়। মুখে দাড়ি-গোঁফ কম হয়। এঁরা সাধারণত উচ্চতায় লম্বা ধরনের হয়ে থাকে। মানসিক জড়তাও থাকতে পারে। এই সমস্ত ব্যক্তিদের দেহকোশে ২২ জোড়া অটোজোম, ২টি x ক্রোমোজোম এবং একটি Y ক্রোমোজোম— মোট ৪৭টি ক্রোমোজোম থাকে। সাধারণ অবস্থায় পুরুষের শরীরে যৌন ক্রোমোজোম থাকে xY এবং মোট ক্রোমোজোমের সংখ্যা হয় ৪৬টি। অতিরিক্ত স্ত্রী যৌন ক্রোমোজোম, অর্থাৎ X এর উপস্থিতির ফলেই ব্যক্তির শরীরে স্ত্রী-বৈশিষ্ট্য প্রকট হয়।
(খ) XXX পুরুষ (xxY Male) : এঁদের শরীরের গঠন পুরুষদের মতো হলেও এঁরা পুরোপুরি পুরুষ নয়। এরা স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক বেশি লম্বা হয়। এঁদের বুদ্ধিবৃত্তি কম। এঁদের মধ্যে অনেক সময়েই হিংসাত্মক সমাজবিরোধী আচরণের প্রকাশ ঘটে। পুরুষদের মতো লিঙ্গ থাকে। তবে লিঙ্গ থাকলেও মূত্রছিদ্রটি লিঙ্গের স্বাভাবিক স্থানে থাকে না। এঁদের অণ্ডকোশও স্বাভাবিক স্থানে না। থাকে শরীরের অভ্যন্তরে। এঁদের শরীরে ক্রোমোজোমের সংখ্যা ৪৭। ৪৪ টি অটোজোম এবং ৩ টি যৌন ক্রোমোজোম। যৌন ক্রোমোজোমের মধ্যে একটি x এবং দুটি Y ক্রোমোজোম থাকে।
(গ) XX পুরুষ (xx Male syndrome) : XX-পুরুষদের সঙ্গে ক্লাইনেফেলটার সিনড্রোমের অনেক মিল আছে। এদের অনেকেরই স্তন থাকে। তবে তা কখনোই সুডৌল এবং স্ফীত নয়। শুক্রাশয় থাকে, তবে তা খুবই ক্ষুদ্র। তবে শুক্রাশয় থাকলেও সেখানে শুক্রাণু উৎপন্ন হয় না। পুরুষাঙ্গ আকৃতিতে স্বাভাবিক, অথবা স্বাভাবিকের তুলনায় ছোটোও হতে পারে। লিঙ্গের যে স্থানে মূত্রছিদ্রটি থাকার কথা সেখানে থাকে না। XX পুরুষরা উচ্চতায় বেঁটে প্রকৃতির হয়। এই ধরনের XX পুরুষের শরীরে ক্রোমোজোমের মোট সংখ্যা ৪৮। অটোজোম ৪৬ টি এবং দুটি সেক্স ক্রোমোজোম থাকে। XX সেক্স ক্রোমোজোমের উপস্থিতি থাকলেও ক্রোমোজোমের গঠনের অস্বাভাবিকতার জন্য এঁরা পরিপূর্ণ নারী হয়ে উঠতে পারে না। বিভিন্ন রকম পুরুষালি ভাব প্রকট হয়।
(ঘ) টার্নার সিনড্রোম (Turner Syndrome) : এঁদের ক্রোমোজোমের গঠন ক্লাইনেফেলটার সিনড্রোম ও XX-পুরুষ হিজড়াদের অনুরূপ নয়। আপাতদৃষ্টিতে এঁদের নারী মনে হলেও এরা কিন্তু পুরোপুরি নারী নন। কারণ এদের প্রধান যৌনাঙ্গ এবং অন্যান্য গৌণ যৌনাঙ্গ ত্রুটিযুক্ত। এদের যৌনাঙ্গের সঙ্গে নারীর যৌনাঙ্গের আপাত সাদৃশ্য থাকে। যোনিকেশ খুবই কম দেখা যায়। ডিম্বাশয় থাকে না এবং অপূর্ণাঙ্গ ফেলোপিয়ান টিউব ও জরায়ুর গঠন। এর ফলে রজঃস্বলা বা পিরিয়ড হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এদের বুকের ছাতি পুরুষদের মতো প্রশস্ত। তবে এঁদের প্রশস্ত ছাতিতে কৈশোর থেকে স্তনগ্রন্থির প্রকাশ ঘটে। এঁরা অস্বাভাবিক খর্বাকৃতি হয়। গায়ের চামড়া টানলে অনেকটা ঝুলে পড়ে। হাত-পায়ের অত্যন্ত খসখসে হয়। বৌদ্ধিক ক্ষমতা সাধারণের চাইতে কম। এঁদের কোশের ক্রোমোজোমের সংখ্যা ৪৫ (অটোজোম ৪৪ + x)। বার্বোডি থাকে না। ক্রোমোজোমের এই অস্বাভাবিকতার জন্যেই এঁদের যৌনাঙ্গ ইত্যাদি ত্রুটিযুক্ত হয়। Y ক্রোমোজোমের অনুপস্থিতি যেমন শরীরে পুরুষালি ভাব প্রকাশের অন্তরায় হয়ে শরীরকে নারীসুলভ করে তোলে, ঠিক তেমনই বার্বোডি না-থাকায় নারী শরীরের স্বাভাবিক বহিঃপ্রকাশ ঘটে না। দেহের গঠন আংশিক পুরুষের মতো হয়ে থাকে।