তৃতীয়ত, সমকামীদের নিয়ে যেই মামলাগুলি হয়েছে, সেখানে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা দাবি করেছিল যে সমকামীরা বিকৃতির শিকার কিংবা রোগী বা কিংবা অসুস্থ। কিন্তু মেডিকেল সায়েন্সে বিপরীতকামীদের সঙ্গে সমকামীদের কোনো পার্থক্য আছে, শারীরিক বা মানসিকভাবে, তার কোনো প্রমাণ নেই। তাহলে সমকামীরা অসুস্থ বা মানসিক বিকৃতির শিকার বা বিকলাঙ্গ তাও বলা যাচ্ছে না।
চতুর্থত, প্রকৃতিতে বিভিন্নভাবে কীভাবে সমকামিতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। প্রকৃতির সৃষ্ট প্রায় প্রতিটি প্রাণী এবং বৃক্ষরাজিতে সমকামিতা বিদ্যমান। বেশিরভাগ জীব এবং গাছপালায় সমকামিতার প্রকাশ আছে।
পঞ্চমত, সমকামীদের কেন সামাজিকভাবে বয়কট করার কথা বলা হবে? তাঁরাও রক্তমাংসের মানুষ। একজন সমকামী পুরুষের নারীর প্রতি প্রাকৃতিকভাবে আকর্ষণ বোধ করে না। কোনো নগ্ন বা অর্ধনগ্ন নারী দেখলে তার লিঙ্গ উত্থিত হয় না। সেই পুরুষের লিঙ্গ উত্থিত হবে কোনো নগ্ন বা অর্ধ নগ্ন পুরুষ দেখলে। একইভাবে নারী সমকামীরও কোনো নগ্ন নারী দেখলে উত্তেজনা আসবে, অপরদিকে পুরুষদের দেখে তাঁকে যৌনসঙ্গী করার কোনো ইচ্ছাই জাগবে না। এই কারণে নিশ্চয়ই একজন মানুষকে একঘরে করে রাখা বা বয়কট করা কোনোমতেই মানবিক আচরণ হতে পারে না। এটা অন্যায্য, ব্যক্তি-স্বাধীনতায় নির্লজ্জ হস্তক্ষেপ।
ষষ্ঠত, জীবজন্তুরা এমন অনেক কাজ করে যেটা সভ্য মানুষের করা উচিত নয়, এটা ঠিক। যেমন ধর্ষণ প্রবৃত্তি জীবকুলে বিদ্যমান, পিতামাতার সঙ্গে যৌনতা প্রাণীকুলে বিদ্যমান। একজন সভ্য মানুষ কখনোই এই ধরনের কাজ করতে বা সমর্থন করতে পারে না। কথা হচ্ছে সমকামিতাও কি একই ধরনের ব্যাপার?
বিরোধীরা বলেন, সমকাম প্রবৃত্তি প্রকৃতিবিরুদ্ধ এবং সৃষ্টিশীল নয়। তাই সেটা আইনসংগত করার কোনো মানে হয় না। সমাজে অবক্ষয় আসবে। সমকামিতা না থাকলে সমাজের কী ক্ষতি হবে? সমকাম সমাজের বা প্রকৃতির কোন্ উপকারে লাগবে? ইত্যাদি।
আমি বলি– কে বলল সমকামিতা প্রকৃতিবিরুদ্ধ? কোন্ যুক্তিতে? সমকামী মানুষরা কি প্রকৃতি ছাড়াই জন্ম নিয়েছে? নারী ও পুরুষদের মতো সমকামীদেরও এই প্রকৃতি থেকেই জন্ম হয়েছে। নারী ও পুরুষদের মতো সমকামী মানুদের শরীরও তৈরি হয়েছে প্রকৃতির উপাদান দিয়েই। আমরা বিপরীতকামীরা যে উপায়ে যৌনতা করি তার সব ইভেন্টই কি সৃষ্টিশীল? একটা বা দুটো সন্তানের পিতামাতা হওয়া কি প্রকৃতিবিরুদ্ধ নয়? তাহলে তো প্রকৃতিবিরুদ্ধতার অভিযোগে জন্মনিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনাটা বাতিল করতে হয়! জন্মনিয়ন্ত্রণ প্রকৃতিবিরুদ্ধতা নয়?
আদিম যুগে যে সময় বিবাহ প্রথা ছিল না, যখন মানুষ প্রাণীদের মতোই ভোলা আকাশের নীচে যৌনমিলন করেছে, প্রকৃতির কোলে জন্ম নিয়েছে ও মরেছে, সেটা কী প্রকৃতিবিরুদ্ধ ছিল? নাকি বিবাহ প্রথাটাই প্রকৃতিবিরুদ্ধ? যেসব নারী বা যেসব পুরুষ বন্ধ্যা হওয়ার কারণে সন্তানের জন্মদানে অক্ষম, তাঁদের যৌনজীবন কি প্রকৃতিবিরুদ্ধ?
বস্তুত সমকামিতা সমকামীরা নিজে নির্ধারণ করে না। প্রকৃতি তাঁদের ভিতরে সমকামিতার বীজ বপন করে রেখেছে। একজন ধর্ষক ধর্ষণ না-করেও সুস্থ যৌনতার মাধ্যমে নিজের যৌনাকাঙ্ক্ষা পুরণ করতে পারে। একজন ইনসেস্টার বা অজাচারিতা ইনসেস্ট বা অজাচার সম্পর্ক না-করেও সুস্থ যৌনজীবন যাপন করতে পারে। সমকামীরা কীভাবে যৌনজীবন যাপন করবে? এই প্রশ্নটাই মূলত বিপরীতকামীদের মাথার ব্যথার কারণ। যেভাবেই করুক, সেটা তাঁদের ব্যক্তিগত পরিসরেই করে। সমকামীরা কেন তাঁদের রুচিমতো যৌনতা উপভোগ করতে পারবে না? কেন পারবে না?
হিজড়ে এবং সমকামীরা কি একই সমগোত্রীয়? রূপান্তরকামী সোমনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘অন্তহীন অন্তরীণ প্রোষিতভর্তৃকা’ গ্রন্থে বিষয়টা পরিষ্কার করেছেন। তিনি হিজরানী শ্যামলী-মায়ের মুখ দিয়ে বলিয়েছেন– “এতদিনে মানুষের ধারণা ছিল হিজড়ে বুঝি জন্ম থেকেই হয়। ছোটোবেলাতেই হিজড়ে সন্তান জন্মালে মা-বাবা তাকে হিজড়ে ডেরায় দিয়ে আসে। কেন– এমন গল্প শুনিসনি, হিজড়ে বাচ্ছাকে মা-বাবা আটকে রেখেছিল, পাড়ায় হিজড়েরা তালি দিচ্ছিল, আর সেই তালি শুনে ঘর থেকে বাচ্ছা হিজড়ে তালি দিল। আর সেই তালি শুনে হিজড়েরা বাচ্ছাটাকে নিজেদের সঙ্গে নিয়ে চলে গেল!”
হিজড়া হতে হলে লিকস্ (লিঙ্গ) ছিবড়াতে (কর্তন) হয়। অণ্ডকোশ সমেত পুরুষাঙ্গ কেটে ফেললে তবেই ‘নির্বাণ’ বা প্রকৃত সন্মানিত হিজড়া হওয়া যায়। অবশ্য পুরুষাঙ্গ কর্তন করতেই হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। পুরুষাঙ্গ নিয়ে যে ধুরানি (বেশ্যা বা যৌনকর্মী) হিজড়া বৃত্তি করবে, তাকে হিজড়ারা ‘আকুয়া’ (বিপরীত সাজসজ্জাকামী ও যৌনপরিবর্তনকামী) বলে।
ওরা ঢোল বাজিয়ের দল, ওরা হিজড়া। ওরা নবজাতকের খোঁজে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ায়, ওরা হিজড়া। ওরা এক শ্রেণির অবাঞ্ছিত, অপাঙক্তেয় মানবগোষ্ঠী, ওরা হিজড়া। ওরা যৌন বিকলাঙ্গ– এক প্রতিবন্ধী মানুষ, ওরা হিজড়া। মনুষ্য সমাজে এক অন্তঃসলিলা প্রবাহ, যাঁরা প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে চলে আসছে সমাজের উন্থানপতন ও বিবর্তনের মধ্য দিয়ে, ওরা হিজড়াই। প্রাণীজগতে আমরা চার প্রকারের ‘হিজড়া’ দেখতে পাই।