দীপা মেহতার ‘ফায়ার’ বা মধুর ভাণ্ডারকারের ‘পেজ থ্রি’ ছাড়াও সমকালে ভারতীয় সিনেমাতে সমলিঙ্গ প্রেমের প্রচুর উদাহরণ আছে। সদ্যপ্রয়াত ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘চিত্রাঙ্গদা’, কিংবা ‘তিনকন্যা’, মৈনাকের ফ্যামিলি অ্যালবাম’, অপর্ণা সেনের ‘পারমিতার একদিন’ ‘তাসের দেশ’-এর মতো হাল আমলের নানা বাংলা ছবির গল্পও ঘিরেছে সমকামী সম্পর্ক। লক্ষ করা গেছে, আদিকাল থেকে শিল্প-সাহিত্যে মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত অভিলাষ সমকামিতার প্রতিফলন। একদা যেটা লুকিয়ে-চুরিয়ে হত আজ তা প্রকাশ্যে এসেছে। সমসাময়িক সাহিত্য ও চলচ্চিত্রে বারবার জায়গা করে নিয়েছে সমকামী মানুষের গল্প। হেরোডোটাস, প্লেটোর মতো দার্শনিক-চিন্তাবিদদের লেখায় প্রায়ই পাওয়া যায় সমকামী সম্পর্কের কথা।
তবে সমকামী পুরুষ ও সমকামী নারীরা হলিউডে গুরুত্ব পেলেও বলিউডের চলচ্চিত্রে তাঁদের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। আর বড়ো বাজেটের চলচ্চিত্রে একদমই দেখা যায় না তাঁদেরকে। মিডিয়ায় সমকামী পুরুষ, সমকামী নারী, উভকামী এবং হিজড়াদের উপস্থিতি এবং তাঁদের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিষয়াদি পর্যবেক্ষণ করে ‘গ্লাড’। সংগঠনটির মুখপাত্র উইলসন ক্রুজ জানান, মার্কিন সমাজে এসব চরিত্রের গুরুত্ব থাকলেও হলিউডের বড়ো বাজেটের ছবিতে তাঁদের দেখা যাচ্ছে না। এক্ষেত্রে পরিবর্তন জরুরি। সামগ্রিকভাবে হলিউড এবং মার্কিন চলচ্চিত্র তারকারা সমকামীদের অধিকারের দাবিতে সোচ্চার হলেও ছবিতে তার প্রতিফলন নেই। ২০১২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ১০১টি বড় বাজেটের ছবির মধ্যে মাত্র ১৪টি পুরুষ বা নারী সমকামী এবং উভকামীদের চরিত্র ছিল।
ইতিহাস বলছে, প্রাচীন পারস্যে সমকামী সম্পর্কের প্রচলন ছিল। এই ভারতবর্ষেও সমকামিতা ছিল এবং আছে। বহু হিন্দু মন্দিরের দেওয়ালের ভাস্কর্য তো সমকামেরই পরিচয় প্রকট হয়ে আছে। খাজুরাহোর শিল্পকীর্তিতে তো রয়েছে গ্রুপ সেক্সের নিদর্শনও। বাৎসায়নের কামসূত্রেও সমকামিতা নিয়ে আলোচিত হয়েছে, দেখানো হয়েছে যৌন সম্পর্কেরই অন্য এক রূপ। অস্কার ওয়াইল্ডের জীবনী লিখতে গিয়ে প্রখ্যাত এই সমকামী সাহিত্যিকের জীবনের নানা দিক তুলে ধরেছেন রিচার্ড এলম্যান।
সমকামীদের বিষয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে অনেক ভুলভাল ধারণা আছে। যেমন—
(১) সমকামিতা পাশ্চাত্যের সৃষ্টি। পাশ্চাত্যের উদার সমাজব্যবস্থা এবং ভোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গি সমকামিতার জন্য দায়ী।
(২) সমকামিতা এক ধরনের মানসিক বিকৃতি বা অসুস্থতা।
(৩) সমকামীদের সুশিক্ষা এবং চিকিৎসার মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
(৪) সমকামিতা একটা রোগ।
(৫) প্রকৃতিতে অন্য কোনো জীবজন্তু বা গাছপালার মধ্যে সমকামিতা দেখা যায় না।
(৬) সমকামীদের সামাজিকভাবে বয়কট করা উচিত।
(৭) জীবজন্তুরা তো অনেক কিছু করে, তাই বলে সেগুলি মানুষেরও করতে হবে নাকি?
উত্তরে বলি— প্রথমত, সমকামিতা মোটেই পাশ্চাত্যের সৃষ্টি নয়। এটা অত্যন্ত ভুল ধারণা। সমকাম কোনো ফ্যাশন নয় যে, ওখান-এখান থেকে মানুষ গ্রহণ করবে। সমকাম একটি জৈবিক বিষয়, যা শরীর অনুমোদন করে দেশ-কাল নারী-পুরুষ নির্বিশেষে। প্রথমত, আদিমকাল থেকেই সমকামিতা আছে। ইতিহাসের বিভিন্ন অংশে সমকামিতার দৃষ্টান্ত আছে। সমকামিতা কোনো ফ্যাশান নয়, এটি একটি যৌন-সংকট বলা যায়। প্রাচীন বিভিন্ন মহাকাব্য সমকামিতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আছে। মধ্যপ্রাচ্যে সমকামিতার ব্যাপক প্রচলন ছিল এক সময়ে। আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেট, সক্রেটিস সমকামী ছিলেন। কামসূত্রে সমকামিতার প্রচুর উদাহরণ আছে। অতএব সমকাম কোনো পাশ্চাত্যের তৈরি করা বিষয় নয়। দ্বিতীয়ত, প্রাণীকুলে সমকামিতার ব্যাপক বিস্তার দেখতে পাওয়া যায়। প্রাণীকুল পাশ্চাত্যের উদার জীবনব্যবস্থা থেকে শিক্ষা নিয়েছে এটা যাঁরা ভাবে তাঁদের সম্পর্কে বলার কিছু নেই।
দ্বিতীয়ত, সমকামিতা কোনোভাবেই মানসিক বিকৃতি নয়। জীববিজ্ঞানী এবং মনোবিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন যে, সমকাম কোনো মানসিক বিকার নয়। এটা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক প্রাকৃতিক বিষয়। প্রত্যেক জীবের মধ্যে কিছু অংশ অবশ্যই সমকামী হয়ে জন্ম নেবে। তারা বেড়ে উঠবে সমকামী হয়ে, তাদের চালচলনে সমকামী ভাব ফুটে উঠবে। একটা রক্ষণশীল সমাজে সমকামীরা বেঁচে থাকে গোপনে, তাদের যৌনপ্রবৃত্তি তারা উপভোগ করে গোপনে, অনেক ক্ষেত্রে অপরাধের মাধ্যমে, আর-একটা মুক্তসমাজে সেটা হয় প্রকাশ্যে। প্রকাশ্যে হওয়ার কারণে অপরাধের মাত্রা কমে যায়। মাদ্রাসার শিক্ষকদের বিরুদ্ধেও সমকামিতার অভিযোগ শোনা যায়। মাদ্রাসার শিক্ষকরা যাঁরা সমকামী, তাঁরা তাঁদের যৌন আকাঙ্ক্ষা মেটায় অপরাধের মাধ্যমে শিশু ছাত্রদের সঙ্গে। হয়তো তাঁরা একজন নারীর সঙ্গে বিবাহত জীবন পালন করছে, কিন্তু তৃপ্তির অভাবে তাঁরা প্রতিনিয়ত সুযোগ খোঁজে তাঁদের অবদমিত কামনা পুরণের। যার শিকার সব সময় আমাদের দেশের বালক-তরুণরা হয়। অন্যান্য বিদ্যালয়ের সমকামী | শিক্ষক-শিক্ষিকারও যৌনক্ষুধা মিটিয়ে নেয় ছাত্রছাত্রীদের মধ্য দিয়ে। ব্যাপারটা বেশ গোপনেই চলে। উন্নত বিশ্বে সমকামীরা প্রকাশ্যে বলে যে তাঁরা সমকামী। যার ফলে চিনতে পারা সহজ হয় এবং সমলিঙ্গের Straight মানুষরা সবসময় সতর্ক থাকতে পারে। তার উপর সমকামীরা সমকামী সঙ্গী বেছে নিয়ে স্বাভাবিক বিবাহিত এবং যৌন জীবনযাপন করলে তাঁরা অপরাধের মাধ্যমে তাঁদের যৌনাকাঙ্ক্ষা পূরণ করার প্রয়োজন পড়ে না।