শুধু গল্প-উপন্যাসেই নয়, সমকাম ধরা দিয়েছে কবিতাতেও। এই সময়ের কবি অনুপম মুখোপাধ্যায় লিখছেন –
“আমার খবর জবাব নেই। কুসুমের কাছে
বাগান আমাকে এখানে। এই। নোটিশ দিয়েছে।
বোঁটা জানে, ডাল জানে। মালি নই আমি
বেতন দিয়েছে। শুধু। পরাগ দিল না।
হায়ের বয়স কত। কেউ কি তা জানে
এতদিন। ছায়া সে তো রোদেই ফেলেছে।
ধুলোর অনেক কাছে। রেণু। রাখা ছিল
আমার এলার্জি। তার। ঠিকানা পেল না।
সুগন্ধ এভাবে। বেশ। কেটেই চলেছে
অপর সুগন্ধী। সেই। মনে পড়ে গেল।
কিছু নেই। খুব জানি। কিছুই তো নেই।”
কবি চৈতালী চট্টোপাধ্যায় ‘বান্ধবীবিহার’ কবিতাটিতে লিখছেন –
“ব্যত্যয় নেই কোনও! আমি
জানি, তোকে ভালবাসি, তাই এ-জগত
মধুময় লাগে। আয়োজনে, যদি কিছু
বিরোধিতা জাগে! খুনি বোমা বেঁধে
চলে, কোকিল লুকিয়ে কাঁদে
বসন্তগোড়ায়, দুধে-বিষে মিশে গেলে,
তখন সমাজ, খোলা বাথরুম হয়ে, যায়! … দরোজা দিয়েছি, জানলাও,
আমাদের ঘরে মধুঘুম নামবে, বল
সখি, মম সঙ্গে লিভ-ইন করবে কি।”
কিছুদিন আগে নিজেকে সমকামী দাবি করে একটি গানও লিখেছেন দুই বাংলার জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী কবীর সুমন।
“পুরুষ হও বা নারী, তুমিই আমার সখা”– ঋগ্বেদের এই উক্তিকে পুঁজি করেই ১৪ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল সমকামিতার উপর প্রথম বাংলা চলচ্চিত্র ‘১০ জুলাই’। এর আগে বিভিন্ন বাংলা চলচ্চিত্রে সমকামিতার আভাস থাকলেও সমকামীদের নিয়ে পূর্ণাঙ্গ কোনো চলচ্চিত্র এটাই প্রথম। সারা দেশে সমকামী প্রেম যেখানে নিষিদ্ধ, সেখানে পরিচালক রাতুল গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্মিত এই ছবির রিলিজ নিয়ে হইচই তো হবেই। ভারতীয় চলচ্চিত্রে বিভিন্ন সময়ে বিষয়বস্তু হিসাবে উঠে এসেছে সমকামিতা। বলিউডে সমকামিতা বিষয়ক কিছু ছবি নিয়ে জি নিউজে একটি প্রতিবেদনে প্রকাশ করেছিল। বম গে’ (১৯৯৬) সমকামিতার উপর তৈরি ভারতের প্রথম ডকুফ্লিম। যদিও ভারতে মুক্তি পায়নি এই ছবি। কবি আর, রাজ রাওয়ের লেখার উপর, মুম্বাইয়ের গে সংস্কৃতি নিয়ে গে পরিচালক রিয়াদ ভিঞ্চি ওয়াদিয়ার ছবিতে অভিনয় করেছিলেন রাহুল বসু। ‘ফায়ার’ (১৯৯৭) ভারতে সমকামী চলচ্চিত্র তৈরির পথপ্রদর্শক দিপা মেহতা। তাঁর ট্রিলজির প্রথম ছবি ‘ফায়ার’। বৈবাহিক জীবনের সমস্যায় জর্জরিত দুই মহিলার শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার কাহিনি নিয়ে ফায়ার’ ভারত রক্ষণশীল সমাজে আগুন জ্বেলেছিল। বক্স অফিসে মুক্তি রক্ষণশীল সমাজের ভ্রুকুটি এড়াতে পারেনি। এর ছয় বছর পর ‘ম্যাঙ্গো সুফলে’ (২০০২) চলচ্চিত্রটি বানিয়েছিলেন সাহিত্য একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত মহেশ দত্তানি। একাকিত্বে ভোগা গে ফ্যাশন ডিজাইনারের গল্প ব্যঙ্গাত্মক মোড়কে উপস্থাপন করেছিলেন মহেশ। ফায়ারের মতো রক্ষণশীলদের প্রতিবাদের মুখে পড়তে না-হলেও চুপিচুপি মুক্তি পেয়ে চুপিচুপিই প্রেক্ষাগৃহ থেকে চলে গিয়েছিল ম্যাঙ্গো সুফলে।
‘কাল হো না হো’ (২০০৩) চলচ্চিত্র মুম্বাইয়ের মেনস্ট্রিম ধারার সমকামিতাকে ব্যঙ্গাত্মক রূপ দিয়েছিলেন করণ জোহর। তবে শুধু সমকামিতা নয়, সমকামিতার প্রতি সাধারণ মানুষের ভুরু কোঁচকানোও করণ তুলে এনেছিলেন এই চলচ্চিত্রে। শাহরুখ খান ও সইফ আলি খানের গে সম্পর্ক দেখে চমকে ওঠেন ছবির চরিত্র কান্তা বেন। গার্লফ্রেন্ড’ (২০০৪) আর-একটি চলচ্চিত্র। গে সম্পর্ক নিয়ে চলচ্চিত্র বেশ কিছু চলচ্চিত্র তৈরি হলেও লেসবিয়ান সম্পর্ক নিয়ে চলচ্চিত্র ফায়ারের পর হয়েছে গার্লফ্রেন্ড। দুই বন্ধুর মধ্যে একজন লেসবিয়ান, অন্যজন বাই-সেক্সচুয়াল। বন্ধুর সঙ্গে সমকামিতার সম্পর্ক ছাড়াও তাঁর জীবনে ছিল প্রেমও। সমকামিতার সম্পর্ক ও বিষমকামিতা (Heterosexuality) সম্পর্কের দ্বন্দ্ব, বয়ফ্রেন্ড ও বন্ধুর মধ্যে যৌনহিংসা নিয়ে এগিয়েছে গার্লফ্রেন্ডের গল্প। মাই ব্রাদার নিখিল’ (২০০৫) গে পরিচালক ওনির প্রথম চলচ্চিত্রেই গে সমকামিতাকে দারুণ সফলভাবে নিয়ে এসেছিলেন। ভারতের মতো দেশ থেকে সমকামিতার কারণে একঘরে হয়ে যাওয়া থেকে এইডস নিয়ে বাঁধাধরা ধারণা, সর্বোপরি পরিবারের পাশে দাঁড়ানো সবকিছুই ওনির তুলে ধরেছিলেন। পরে ‘আই অ্যাম’ চলচ্চিত্রেও। হানিমুন ট্রাভেলস প্রাইভেট লিমিটেড’ (২০০৭) চলচ্চিত্রে ছয়জন সদ্যবিবাহিত জুটির হনিমুনের গল্প। এই ছয় জোড়ার মধ্যেই ছিলেন একজন বিবাহিত সমকামী পুরুষ। কীভাবে সেখান থেকেই অন্য সমকামী পুরুষের প্রতি আকর্ষণ ও বৈবাহিক সম্পর্কেও নিজেদের নিজেদের পছন্দের জায়গা বেছে নেন তাঁরা। ফ্যাশন’ চলচ্চিত্রে সমকামিতার অন্য দিক তুলে ধরেন মধুর ভাণ্ডারকর। সমাজের সামনে নিজের সমকামিতা লুকিয়ে রাখতে বন্ধু মুগ্ধা গডসেকে বিয়ে করেন গে ডিজাইনার সমীর সোনি। পাঁচ বছর পর আবার একই বিষয়ে ‘দোস্তানা’ চলচ্চিত্রটি রুপোলি পর্দায় নিয়ে আসেন। করণ জোহর। অভিষেক বচ্চন ও জন আব্রাহামের গে সম্পর্ক বক্স অফিসে প্রথমবারের জন্য কিছুটা হলেও দর্শকদের আনুকূল্য পেয়েছিল। পরে ‘বম্বে টকিজ’ চলচ্চিত্রেও সমকামিতা দেখিয়েছেন করণ জোহর। বস্তুত করণ জোহর নিজেও একজন সমকামী ব্যক্তিত্ব। সেই কারণে সুযোগ পেলেই উনি সমকামিতা বিষয়টাকে তাঁর চলচ্চিত্রে টেনে আনেন। ‘ডোন্ট নো হোয়াই না জানে কিউ’ (২০১০) চলচ্চিত্রকেও সেন্সর বোর্ডের চোখ-রাঙানিতে পড়তে হয় সমকামিতা প্রদর্শনের জন্য। এমনকি সমকামিতার দৃশ্যে অভিনয় করার অভিনেতা যুবরাজ পরাশরকে ত্যাজ্য করেছিল তাঁর পরিবার।