সক্রেটিসকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন তখনকার আদালত। অভিযোগ– তিনি যুবসমাজকে ধ্বংস করছেন। তাঁর বয়স ছিল তখন ৬৩ বছর। তিনি আরও দীর্ঘ জীবন পেলে পৃথিবী আরও কত কী পেত, সেটা ভাবাই যায় না। মৃত্যুদণ্ডের মাধ্যমে এভাবে কত ক্ষতি হয়ে গেল পৃথিবীর, কে তার হিসাব রাখে? একবিংশ শতাব্দীতে এ ধরনের অপরাধের জন্য আর মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় না ঠিকই, কিন্তু অন্যান্য অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার হার এখনও অনেক বেশি। মূলত হত্যা, নিজ দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, ধর্ষণ, মাদক পাচার এ ধরনের অপরাধের কারণেই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়ে থাকে। সামান্য কিছু চুরি করার। কারণেও ইংল্যান্ডের মতো দেশে বছরে শত শত মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হত একসময়। অষ্টম হেনরির সময় ৭২,০০০ চোরকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল। নিশ্চয়ই সেদিন আর নেই। মানুষ সভ্য হয়েছে বলে দাবি করে। সভ্য হওয়ার নমুনা হিসাবে পৃথিবীর অনেক দেশেই মৃত্যুদণ্ড বিলুপ্ত হচ্ছে একের পর এক। যেসব দেশে এখনও বন্ধ হয়নি, সেখানেও মৃত্যুদণ্ড বন্ধ করার জন্য আন্দোলন চলছে।
বিশ্বব্যাপী প্রায় ৭০ টি মানবাধিকার সংস্থা সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিপক্ষে কাজ করে যাচ্ছে। এর মধ্যে লন্ডন ভিত্তিক মনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল অন্যতম। অ্যামনেস্টির দেওয়া তথ্য মতে –“এখন পর্যন্ত ১৪০টি দেশ মৃত্যুদণ্ড আইনগতভাবে বা প্রথা হিসাবে বাতিল করেছে। যে মাত্র নয়টি দেশ ২০০৯ থেকে ২০১৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রতি বছর ফাঁসি কার্যকর করেছে তার মধ্যে ভারত, বাংলাদেশ অন্যতম।” প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে মৃত্যুদণ্ড এবং কার্যকর বিষয়ে অ্যামনেস্টি বার্ষিক রিপোর্ট প্রকাশ করে। সম্প্রতি প্রকাশিত এক রিপোর্টে দেখা যায়, শাস্তি হিসাবে বিশ্বে ২০১৩ খ্রিস্টাব্দের তুলনায় ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়ার সংখ্যা বেড়েছে। ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে এই সংখ্যাটি ছিল ২ হাজার ৪৬৬ জন, যা আগের বছরের তুলনায় শতকরা হিসাবে ২৮ ভাগ বেশি। মিশর ও নাইজেরিয়ায় গণবিচারে কয়েক শত মানুষকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ায় এই সংখ্যা বেড়েছে। অ্যামনেস্টি বলছে, চিনে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তার কারণে সেখানকার মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের হিসাব পাওয়া যায় না। চিন এই হিসাব প্রকাশ করে না। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল প্রদত্ত বার্ষিক রিপোর্টের পরিসংখ্যান থেকে যায় যে, ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে সারা বিশ্বে মোট ৪২৭২ জন ফাঁসিতে মৃতর মধ্যে ৩৫০০ জন শুধু চিনের। এই তালিকায় এগিয়ে আছে। মুসলিম রাষ্ট্রগুলি। রাশিয়া, ইউক্রেন, ইরান, তুর্কমেনিস্তান, আমেরিকা, পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং ভারতের মতো রাষ্ট্রগুলিতে মাত্র ওই এক বছরে শত শত মানুষকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে গোটা দুনিয়ায় হত্যা করা হয়েছিল ৩২৭০ জনকে। ২০১৩ খ্রিস্টাব্দের মতো ২০১৪ খ্রিস্টাব্দেও ২২টি দেশেই শুধু মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ২০ বছর আগে সংস্থাটি যখন প্রথম প্রতিবেদন প্রকাশ করে তখন মোট ৪২টি দেশে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।
অ্যামনেস্টির ‘ডিরেক্টর অফ গ্লোবাল ইস্যুজ’ অড্রে গাউঘ্রান বলেন, “মৃত্যুদণ্ড কোনো সুবিচার নয়।” মিশর এবং নাইজেরিয়ার পরিস্থিতি নিয়ে অ্যামনেস্টি ভীষণ উদ্বিগ্ন। ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে নাইজেরিয়ায় ৬৫৯ জন এবং মিশরে কমপক্ষে ৫০৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। দু-দেশেই বৃদ্ধির হার উদ্বেগজনক। ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে ১৪১ জনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল নাইজেরীয় সরকার। মিশরে সে বছর ১০০-র মতো লোককে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।
আমি মৃত্যুদণ্ড বিরোধী। আমি মনে করি রত্নাকররা বাল্মীকি হতে পারলে ধনঞ্জয়রাও অন্য কিছু হতে পারত। সেদিন যদি রত্নাকরকে জঘন্য খুনের অপরাধের কারণে ক্ষমা না-করে হত্যা করা হত, “রামায়ণ” কোথায় পেতাম? মহাকবি কোথায় পেতাম? রত্নাকরকে বাঁচিয়ে সমাজের কি খুব ক্ষতি হয়ে গেছে? মৃত্যুদণ্ড কোনো রাষ্ট্রের স্বৈরচারিতারই নামান্তর। না, রাষ্ট্রের এহেন স্বৈরাচারিতা মেনে নেওয়া যায় না। আমি মনে করি, প্রতিটি মানুষের বাঁচার অধিকার আছে। একজন ভুল করে একটা অপরাধ করে ফেললে রাষ্ট্র কেন পরিকল্পিতভাবে একজনের জীবন কেড়ে নেবে? মৃত্যুদণ্ডের বদলে অন্য যে-কোনো শাস্তি তাঁরা পেতে পারে। আমৃত্যু যাবজ্জীবন তো পেতেই পারে? নয় কেন? পরে যদি দেখা যায় দণ্ডপ্রাপ্ত সেই ব্যক্তি সম্পূর্ণ নির্দোষ ছিল, তাহলে তো তাঁকে মুক্তি দিয়ে স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে যেতে পারে। হত্যা করে দিলে তো সেটা কখনোই সম্ভব নয়। বস্তুত যাবজ্জীবনেও আপত্তি করি। জেলখানা ব্যাপারটাকেই পছন্দ করি না। জেলখানাগুলি হতে পারে সংশোধনী কেন্দ্র। যতদিন মাথার ভিতর থাকা দুষ্টু কীটগুলি মরে যাচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত অপরাধীরা থাকবে ওই কেন্দ্রে। কে যেন একজন বলেছিলেন, “জেলখানার ঘরগুলি হতে পারে এক-একটা ক্লাসরুম, আর জেলখানাগুলো এক-একটা বিশ্ববিদ্যালয়”। কিছুদিন আগে সুইডেনের কিছু জেলখানা বন্ধ করে দিতে হয়েছে। কারণ জেলে মোটেও লোক নেই। অপরাধের সংখ্যা কম, তাই আসামীর সংখ্যাও কম। সমাজটাকে বৈষম্যহীন যত করা যাবে, যত সমতা আনা যাবে মানুষে-মানুষে, অপরাধ তত কমে যাবে। কোনো প্রাণীই বা কোনো মানুষই অপরাধী বা সন্ত্রাসী হয়ে জন্ম নেয় না। একটি শিশুকে যদি সুস্থ সুন্দর শিক্ষিত বৈষম্যহীন পরিবেশ দেওয়া না-হয়, একটি শিশুর গড়ে ওঠার সময় যদি তার মস্তিষ্কে ক্রমাগত আবর্জনা ঢালা হতে থাকে, তবে এই শিশুরাই বড়ো হয়ে অপরাধ আর সন্ত্রাসে নিজেদের জড়িয়ে ফেলে। এ কি ওদের দোষ? নাকি যাঁরা আবর্জনা ঢালে, আবর্জনা ঢালার যে প্রথা যাঁরা চালু রাখছে সমাজে, তাঁদের দোষ! একই সমাজে বাস করে আমি মৌলবাদ-বিরোধী, কেউ মৌলবাদী, কেউ খুনী, ধর্ষক, চোর, আবার কেউ সৎ, সজ্জন। সমাজ এক হলেও শিক্ষা ভিন্ন বলেই এমন হয়। একদল লোক বিজ্ঞান শিক্ষা পাচ্ছে, মানবাধিকার সম্পর্কে জ্ঞানলাভ করছে, আলোকিত হচ্ছে। আর-এক দলকে ধর্মান্ধ, মূর্খ, কূপমণ্ডুক আর বর্বর বানানো হচ্ছে। ফেলে রাখা হচ্ছে ঘোর অন্ধকারে। শিক্ষার ব্যবস্থাটা সবার জন্য সমান হলে, শিক্ষাটা সুস্থ শিক্ষা হলে, সমানাধিকারের শিক্ষা হলে, মানুষেরা মন্দ না-হয়ে ভালো হত। ছোটখাটো অভদ্রতা, অসভ্যতা, অপরাধ থাকলেও সমাজ এমনভাবে নষ্টদের দখলে চলে যেত না, এত লক্ষ লক্ষ লোক খুনের পিপাসা নিয়ে রাজপথে তাণ্ডব করত না। যে দেশে সবার জন্য খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান-শিক্ষা স্বাস্থ্য নেই, সেই দেশে অরাজকতা থাকবেই। অন্য সব ব্যবস্থার মতোই বিচারব্যবস্থাতেও আছে পাহাড়প্রমাণ গলদ। বিদ্যাসাগর লিখেছিলেন, “অপরাধীর যথার্থ দণ্ড না হইলে সমাজের অমঙ্গল”। কিন্তু দণ্ডের যথার্থতাই যদি প্রশ্নের মুখে এসে দাঁড়ায়? আইএসআইয়ের ফলিত রাশিবিজ্ঞানের দুই অধ্যাপকের গবেষণা প্রশ্ন তুলেছে এক দশকেরও বেশি আগের ধনঞ্জয়ের ‘বিরলতম’ অপরাধের তদন্ত প্রক্রিয়াকে নিয়েই। প্রশ্ন তুলেছে, বহুচর্চিত আরুষি মামলার মতো হেতাল পারেখ হত্যাকাণ্ড ‘অনার কিলিং’ নয় তো? তারাশঙ্করের ভাষায় –“কলঙ্কিনী রাধার দণ্ড না দিলে মান থাকে কোথা?” গবেষকদের বিলম্বিত গবেষণা ভিত্তিহীন হতেই পারে। কিন্তু সর্বনাশা সংশয়টা অন্যত্র। যে তদন্তের শাস্তি হিসাবে রাষ্ট্র কেড়ে নিয়েছে জলজ্যান্ত একটা প্রাণ, সে তদন্ত ঘিরে আদৌ কোনো প্রশ্নের অবকাশ থাকবে কেন? কেন থাকবে এক শতাংশ সন্দেহের জায়গাও? “জাজমেন্ট অফ এরর” হলে আর ফেরানো যাবে না মৃত্যুদণ্ডে ঝোলানো দণ্ডিতকে! সে কারণেই অপরাধ করলে কী কারণে অপরাধ করেছে, কোথায় ভুল ছিল এসব না ভেবে, ভুলগুলি শোধরানোর চেষ্টা না-করে অপরাধীকে জেলে ভরা হয়, অথবা হত্যা বা খুন করা হয়। আসলে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে অনেক সমস্যার চটজলদি সমাধান করতে চায় রাষ্ট্রগুলি। কিন্তু একে সমস্যার সত্যিকারের সমাধান হয় না। অপরাধ বন্ধ হওয়া তো দূরের কথা, এক চিলতেও কমে না। মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকলে সেই ভয়ে অপরাধ প্রবণতা কমে যাবে বলে যাঁরা এরকম ধারণার পক্ষপাতী, তাঁদের মৃত্যুদণ্ডবিরোধীরা বলেন– যেহেতু অনেক খুনের ঘটনায় অপরাধী ধরা পড়ে না, দীর্ঘসূত্রী বিচারপদ্ধতি, জুরিদের মতপার্থক্য এবং মৃত্যুদণ্ড প্রদান বিরলতম (rarest of the rare) হওয়ার ফলে নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না যে অপরাধ কমবে। যদি কমত তাহলে মৃত্যুদণ্ড চলছে হাজার হাজার বছর ধরে, এতদিনে অপরাধমুক্ত একটা পৃথিবীতে বাস করতাম আমরা। এখন বসে মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে আর্টিকেল লিখতে হত না। তা ছাড়া এমন কোনো পরিসংখ্যান আমাদের জানা নেই, যার দ্বারা প্রমাণ করা যায় যে, মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকায় অপরাধ কমেছে বা বন্ধ হয়ে গেছে। এমন কোনো প্রমাণ নেই যে, যে দেশগুলি থেকে মৃত্যুদণ্ড বিলুপ্ত হয়ে গেছে চিরতরে, সে দেশে বিশৃঙ্খলা আর অরাজকতায় ভরে গেছে। বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন এক স্ত্রী হত্যার অভিযোগে স্বামীর মৃত্যুদণ্ড দিতে গিয়ে বলেছেন –“এত কঠোর সাজার পরেও কি স্ত্রী হত্যাকাণ্ড বন্ধ হয়েছে? হয়নি। সুতরাং সাজা দিলেই যে দুধের মধ্যে ভালতে থাকবে এমন ধারণা ভুল। আর ফাঁসির দণ্ডও সমাজকে রক্ষা করে না।”