নির্দোষ ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড হয়েছে এমন ঘটনা গোটা বিশ্বের সব দেশেই প্রভূত সংখ্যক হয়েছে। বর্ণবিদ্বেষ ও দারিদ্রতার কারণেও বহু নির্দোষের মৃত্যুদণ্ড হয়ে গেছে। আর-একটি হল জনমতের চাপ, যা মিডিয়াগুলি লাগাতার তৈরি করে। চার্লি এল, ব্ল্যাকের গবেষণায় উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। সেখানে বলা হচ্ছে আমেরিকার ফৌজদারি ন্যায় ব্যবস্থাটাই শুধু ভুলপ্রবণই নয়, নেই কোনো নির্দিষ্ট মান। স্বেচ্ছাচারী ও চূড়ান্তভাবে শ্বেতাঙ্গ-ঘেঁষা এবং কৃষ্ণাঙ্গ-বিদ্বেষী। জর্জিয়াতে ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত গবেষণা করে অধ্যাপক ডেভিড বলডাস জানিয়েছেন– একজন শ্বেতাঙ্গকে হত্যা করা শ্বেতাঙ্গের মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার সম্ভাবনার চেয়ে কৃষ্ণাঙ্গ হত্যাকারী শ্বেতাঙ্গের মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার সম্ভাবনা ৮ গুণ কম। শ্বেতাঙ্গ হত্যাকারী কৃষ্ণাঙ্গের সেখানে মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার সম্ভাবনা ৩৩ গুণ বেশি। ভারতের মতো দরিদ্রতম দেশগুলিতে বর্ণ-বৈষম্য কোনো ম্যাটার না করলেও বিচার-বৈষম্য দেখা যায় দরিদ্রদের ক্ষেত্রে। ফৌজদারি মামলা সব ধরনের বৈষম্যের শিকার হয় দরিদ্ররাই– সে অভিযুক্তই হোক বা অভিযোগকারী। আইন আইনের পথে চললেও সেই আইনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত দরিদ্ররা। দারিদ্রতার কারণেই আইনের চোখে সবাই সমান হতে সক্ষম হয় না।
বহুকাল আগে থেকেই চালু থাকলেও বিংশ শতাব্দীতে মৃত্যুদণ্ডের বিপক্ষে ক্রমেই বিভিন্ন দেশে জোরালো যুক্তিতর্ক হচ্ছে। বিশেষত মৃত্যুদণ্ড বিলোপের জন্য বিভিন্ন দেশে প্রভাবশালী কিছু সংগঠন গড়ে ওঠে। যেমন ব্রিটেনে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ইত্যাদি। যাঁদের প্রধান লক্ষ্যই হচ্ছে পৃথিবী থেকে মৃত্যুদণ্ড বিলোপ করা। দেশে দেশে মৃত্যুদণ্ড বিলোপ হওয়ার অন্যতম একটি কারণ হল নির্দোষের মৃত্যুদণ্ড। ভিক্টর হুগো বহুকাল আগে বলেছিলেন, তাঁর কাছে গিলোটিনের নাম Lesurques, একজনের নাম যিনি নির্দোষ ছিলেন। কিন্তু তাঁকে লিয় মেল মামলায় দোষী সাব্যস্ত করে গিলোটিনে হত্যা করা হয়। হুগোর বক্তব্যে এটা অনুধাবন করা যায়– একজন নির্দোষকে দোষী ভেবে হত্যা করাটাই মৃত্যুদণ্ড বিলোপের কারণ হিসাবে যথেষ্ট। কারণ একজন নির্দোষ ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করে দেওয়া মোটেই কঠিন কারণ নয়। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে লাফায়েৎ বলেছিলেন– “Till the infalliability of human judgments shall have been proved to me, I shall demand the abolition of the death penalty.” A. C. Ewing of ‘Second Thoughts in Moral Philosophy’ গ্রন্থে বলেছেন –“নির্দোষকে ফাঁসি দিলে তার প্রভাব সমাজে নানাভাবে পড়ে। প্রথমত, এই ধরনের মৃত্যুদণ্ড সমাজের সুষ্ঠু ন্যায়বিচারের ভিতকে সজোরে নাড়িয়ে দেয়। কারণ শাস্তি তো এমন একটি শরীরের উপরে নির্যাতন, যে অপরাধ করছে বলে সমাজ ও রাষ্ট্র ঠিক করেছে। দ্বিতীয়ত, সবচেয়ে আপত্তির বিষয় এই যে, তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে এই বদনাম চাপিয়ে যে, সে অপরাধী।
অপরদিকে মৃত্যুদণ্ডের পক্ষেও মতামত আসতে থাকে, বিশেষত আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে। মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে যে সাধারণ যুক্তি দেওয়া হয়, তা হল— এর ফলে অপরাধের সংখ্যা কমে যায়, এটা পুলিশ ও সরকারি উকিলের সহায়ক হয়। মৃত্যুদণ্ডের ভয়ে অপরাধী তাঁর অপরাধ স্বীকার করে বিনিময়ে জীবন রক্ষার ডিল করতে পারে, দণ্ডিত অপরাধী আর কোনোদিনই যে অপরাধের পুনরাবৃত্তি করতে পারবে না সেটা মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করে। শিশু হত্যা, সিরিয়াল খুন এবং নির্যাতনমূলক হত্যার মতো নৃশংস অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ডই হচ্ছে ন্যায়সংগত শাস্তি।
মৃত্যুদণ্ড বিরোধীরা যুক্তি দেন যে, এসব যুক্তির বিপরীতে যাঁরা হত্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সবাই যে হত্যাকারীর মৃত্যুদণ্ড চান, তা নয়। যেমন ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধির হত্যাকারীকে সোনিয়া গান্ধি মকুব করে দিয়েছিলেন। সাধারণত দেখা যায়, সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের ব্যক্তিরা ও বিত্তশালীরা বিভিন্নভাবে মৃত্যুদণ্ডের হাত থেকে রেহাই পেয়ে যায়। কিন্তু সংখ্যালঘিষ্ঠ ও গরিবরা মৃত্যুদণ্ডের শিকার হয়। মৃত্যুদণ্ড সহিংসতার কালচারকে উৎসাহিত করে। ফলে দেশে সহিংসতা বেড়ে যায়। মৃত্যুদণ্ড মানুষের মৌলিক অধিকার লংঘন করে। কিন্তু দোষী ব্যক্তিকে যদি মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে আজীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়, তাহলে সে তো আর অপরাধ করতে পারছে না। বিরল থেকে বিরলতম’ অপরাধের ক্ষেত্রে যদি অপরাধীকে কঠোরভাবে সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয় আমৃত্যু— তাহলে কেন মৃত্যুদণ্ড? (৩) খুনের শাস্তি আর-একটি ‘খুন’ দিয়ে হতে পারে না। এটাকে কোনোভাবেই ন্যায়বিচার বলা যায় না। প্রতিশোধ বলা যেতে পারে। (৪) সংবিধানের জীবনের অধিকারের কথা বলা হয়েছে। তার সঙ্গে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা মোটেও সংগতিপূর্ণ নয়।
দেখা গেছে, সারা বিশ্বে যত মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়, তার ৯০ শতাংশই হয় এশিয়ায়। এমনকি আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে সুদান, ইরান এবং সৌদি আরবে ১৮ বছরের কম বয়সিকেও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। কী ভয়ংকর! চিনে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ২০১২ খ্রিস্টাব্দে এই সংখ্যা চার হাজারেরও বেশি। প্রাচীন এবং মধ্যযুগে প্রায় সব দেশেই প্রকাশ্যেই ফাঁসি দেওয়ার রীতি থাকলেও বর্তমানে ইরান, সৌদি আরব এবং সোমালিয়া ছাড়া অন্য সব দেশে তা বন্ধ করা হয়েছে।