জল্লাদ শাহজাহান বলেন, “যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল তিনি তাঁদের ফাঁসি দিয়েছেন।” তিনি আশা করেছিলেন “শেখের মেয়ে প্রধানমন্ত্রী, সে তাঁর দিকে একটু সুনজর দেবেন। কিন্তু কে রাখে কার খবর? তাঁর কথা কেউ বিবেচনা করেনি।” তিনি বলেন, “নেলসন ম্যান্ডেলা বেশি সময় জেলখানায় কাটিয়ে বিশ্ব রেকর্ড গড়েছিলেন। আর এখন তিনি (শাহজাহান) জীবনের ৩৬টি বছর কারাগারে কাটিয়ে দিলেন। বাইরে মানুষ হত্যা করলে জেল হয়, ফাঁসি হয়। আর এখানে এত মানুষ হত্যা করছি, কিন্তু কিছুই হয় না।”
মেরঠের কাল্লু ও তাঁর ছেলে মামু এবং পশ্চিমবঙ্গের নাটা মল্লিক মারা যাওয়ার পরে বর্ষীয়ান বাবুই আপাতত ভারতের তথা দেশের একমাত্র ফাঁসুড়ে। ইন্দিরা গান্ধির হত্যাকারী সতবন্ত সিংহ ও কেহর সিংহের ফাঁসিও দিয়েছিলেন বাবু ও কাল্প। নাটা মল্লিক শেষবার ২০০৪ সালে ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়কে ফাঁসি দেন। তবে বাবু অসমে ফের ফাঁসি দিতে আসতে রাজি হলেও বাবুর দুই ছেলে বাবার সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ। তাঁরা ফাঁসুড়ের বৃত্তি গ্রহণে রাজি নন।
যেসব রাষ্ট্র হত্যা করবেনই ঠিক করে ফেলেছেন তখন সাধারণ মানুষকে দিয়ে কেন হত্যা করানো হবে, সেই ব্যক্তি যিনি সাজাপ্রাপ্ত? এই হত্যাকাণ্ড বা মৃত্যুদণ্ড সেই রাষ্ট্রের রাষ্ট্রনেতা অথবা প্রধানমন্ত্রী অথবা রাষ্ট্রপতি অথবা দণ্ডদাতা বিচারপতিই কার্যকর করুন না, নিজের হাতে।
এখন প্রশ্ন হল অপরাধের জন্য অপরাধীকে মৃত্যুদণ্ড দিলেই কী আক্রান্ত পরিবারের মানসিক শান্তি মেলে? তাঁর অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়? ঠিক কোন্ ধরনের শান্তিতে আক্রান্ত পরিবার শান্তি পায়, তা পরিমাপ করা কঠিন। তবে এটা দেখা যায় সবরকমের অপরাধেই ভিকটিম অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চায়, অর্থাৎ ফাঁসি। যে-কোনো অপরাধের যে শাস্তিই প্রদান করা হোক না কেন, তা নানা স্তরে বিচারের মাধ্যমে সাক্ষ্য-সাবুদের তুল্যমূল্য বিচারের পর বিচারপতে শাস্তির রায় দেন। সেই রায় মৃত্যুদণ্ডের মতো রায়ও হতে পারে। অর্থাৎ একটা কলমের খোঁচাতেই ব্যক্তির জীবনের শেষ ঘণ্টা বাজিয়ে দিতে সক্ষম আদালত। সত্যিই কি সবক্ষেত্রে তুল্যমূল্য বিচার হয়? অভিযোগকারী ও অভিযুক্তের প্রভাব ও আর্থিক সক্ষমতা কি বিচারের রায় বদলে দেয় না। একপক্ষ অতি দরিদ্র ও এক ধনী হলে কি অতি দরিদ্রের পক্ষে কি সুবিচার পাওয়া সম্ভব? আইনি লড়াই তো বিনামূল্যে হয় না। একটা দক্ষ আইনজীবী নিয়োগ করতে হলে যে আর্থিক সক্ষমতার প্রয়োজন, তা কি একজন দরিদ্র বিচারপ্রার্থীকে সুবিচার থেকে বঞ্চিত করে না? এমন তো অনেক সময়েই দেখা যায় নিম্ন আদালতের রায় উচ্চ আদালতে গিয়ে বদলে যায়। উচ্চ আদালতের রায় সুপ্রিমকোর্টে খুব কম বদলায়। সুপ্রিমকোর্ট বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উচ্চ আদালতের রায় বহাল রাখে। তবে নিম্ন আদালতের রায় উচ্চ আদালতে গিয়ে বদলে যাওয়ার ঘটনা মোটেই বিরল নয়। একটি মামলার কথা মনে পড়ছে। একটি নিম্ন আদালত মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছিল। উচ্চ আদালতে মামলাটি গেলে জানানো হল এই মামলাটি যথেষ্ট ত্রুটিপূর্ণ। মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার মতো কোনো উপাদান নেই। এখান থেকেই ভাবতে হবে বিষয়টা। সেই অভিযুক্ত যদি উচ্চ আদালতে না যেতেন বা না যেতে সক্ষম হতেন, তাহলে তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়ে যেত। যদিও নিয়ম অনুসারে নিম্ন আদালত কাউকে মৃত্যুদণ্ড দিলে ওই দণ্ড কার্যকর করতে হলে উচ্চ আদালতের অনুমোদন (ডেথ রেফারেন্স) নিতে হয়। নিয়ম অনুযায়ী এই অনুমোদনের জন্য মামলাটি উচ্চ আদালতে আসে। যাই হোক আমাদের সেই বিচার ব্যবস্থা কি ভুল-ত্রুটি বিচ্যুতিমুক্ত? প্রশ্নাতীতভাবে উত্তর হবে– না। কখনোই তা সম্ভব নয়। তাহলে নির্দোষ ব্যক্তির ফাঁসি হয়ে যাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা থেকে যায়। মৃত্যুদণ্ড এমন একটি শাস্তি, যা অন্যান্য শাস্তি থেকে পৃথক। কী গুণগতভাবে, কী মৌলিকগতভাবে। জীবন নিলে আর সেই জীবন ফিরিয়ে দেওয়া যায় না। ভুল হলে ভুলের সেই মাশুল শোধ হবে কোন্ উপায়ে? আমরা দেখেছি বহু অভিযুক্ত ১০ বছর ২০ বছর জেল খাটার পর নিরপরাধ প্রমাণ হয়ে মুক্তি পায়। মৃত্যুদণ্ডের ক্ষেত্রে তো সম্ভব নয়।
ভারতের সুপ্রিমকোর্ট কেহার সিং মামলার একটি রায়ে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছিলেন– “falliability of human judgment (is) undeniable even in the most trained mind, a mind resourced by a harvest of experience.” ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার সুপ্রিমকোর্টও একইভাবে বলেছিল– “In its finality the death penalty may cruelly frustrate justice. Death is the one punishment from which there can be no relief in light of later development in the law or the evidence.”
একটি প্রবন্ধে সাংসদ মুকুন্দলাল আগরওয়াল বহু নজির সহ দেখিয়েছিলেন কীভাবে ভুল তথ্য বা সাক্ষ্য-প্রমাণের বিশ্লেষণের জন্য কত মানুষের ফাঁসি হয়েছে। (Capital punishment abolition move_in_India– Mukundlal Agrawal) আইনজীবী কে. জি. সুব্রহ্মমণিয়ম দেখিয়েছেন– বিচারের একটি মানদণ্ডে মাদ্রাজ হাইকোর্টের ফুল বেঞ্চ ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে আত্থাপ্পা গৌদমকে প্রাণদণ্ড দেয়। দরিদ্র হওয়ার কারণে সে তাঁর পরিবার প্রিভি কাউন্সিলে যেতে পারেননি আপিলের জন্য। তাঁর ফাঁসি কার্যকর হয়ে যায়। প্রায় ১০ বছর বাদে অন্য একটি সমধর্মীয় মামলায় প্রিভি কাউন্সিলে বিষয়টি বিশ্লেষিত হয় ও ফাঁসি দেওয়া ভুল হয়েছিল– একথা বলা হয়। গ্রেট ব্রিটেনে টিমোনি জন ইভান্সকে ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডে ফাঁসি দেওয়া হয়। পরে জানা যায় সে নির্দোষ ছিল। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে ইভান্সকে মরণোত্তর নির্দোষ ঘোষণা করা হয়। খুনের অভিযোগে ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে ডেরেক বেন্টলের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জুলাই আদালত পুনর্বিবেচনা করে বলে বেন্টলের অপরাধী সাব্যস্ত হওয়াটা ছিল ‘unsafe’। নির্দোষ বেন্টলের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার ঘটনা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল।