“আগে কাউকে কখনো এমনভাবে …”
“হ্যাঁ … আচ্ছা আপনি?”
“আমায় তুমি বলো, আমি তোমার কে? বলো?”
“আচ্ছা তুমি?”
“না”, দৃঢ়কণ্ঠে শোভনা বললে। বোধহয় মিথ্যা। হেসে বললে, “আমি তোমার স্বামী, “তুমি”, “বউ”।” লেখক জানাচ্ছেন, “(এই) শুনে শোভনা আবেগে চুম্বন করলে। শোভনার মুখনিঃসৃত লালা মল্লিকার গালে লাগল।”
জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর ‘বুটকি ছুটকি’ গল্পেও খুব সংক্ষিপ্তভাবে শেষদিকে এসেছে দুই বোনের স্পর্শজনিত অনুভবের কথা। মাতৃহীন দুই সমবয়সি বোনের জীবনে জীবনে না আছে কোনো আনন্দের কলরব, না আছে কোনো আশার প্রদীপ। ক্রাচ নিয়ে জীবনোপায় অবলম্বন করা দরিদ্র বাবা প্রতাপের বাড়িতে ইলেকট্রিকের আলো কেটে দিয়েছে। প্রাকৃতিক নিয়মে দুই বোন চোদ্দো পনেরোয় যখন পৌঁছোয়, তখন স্বভাবতই পুরুষের দৃষ্টির আওতার বাইরে থাকে না তাঁরা। “বুটকির কোমরের দিকটা সুন্দর। ছুটকির বুকের দিকটা।” টগবগে যৌবনা দুই নারী, দুই বোন পরস্পরের সহমর্মী হয়ে বেঁচে থাকে বাবার ফিরে আসার প্রতীক্ষায়, অনেক গভীর রাত পর্যন্ত। চরম দারিদ্রতা, তাই পরনের অভাবে নিকষ অন্ধকারে তাঁরা নিরাবরণ হয়ে শোয়। এক বোন আর-এক বোনকে দেখে। দেখে নগ্ন শরীর। এক বোন দেখে, “দিদির ঘাড়ের সুন্দর বাঁক। শাঁখের মতন সরু হয়ে নীচের দিকে গড়িয়ে আসা গলা।” অন্য বোন দেখে, “সবুজ আলোটা বল্লমের মতো খোঁচা মেরে ছুটকির সুন্দর উঁচু বুকের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ছিল, পাতলা জামার ছিদ্র দিয়ে উদ্ধত স্তনের চূড়ায়। একটা চূড়া বেরিয়ে এসেছিল। বিশেষত ছুটকি যখন বলে, “রক্ষা করো বাবা, দরকার নেই রাজার ছেলের, বিনা পণে যদি বুড়ো মদন এসে তুলে নিয়ে যায় বাঁচি”, তখন বোঝাই যায় কামনা-বাসনার প্রতি লোভাতুর হয়ে আছে অসহায় নারী। না-হলে রাত্রের অন্ধকারে নিরাবরণ দুই বোন দুটি শরীরকে আশ্রয় করে উষ্ণতা চাইবে কেন!
তিলোত্তমা মজুমদারের ‘চাঁদের গায়ে চাঁদ’ উপন্যাসে দেবরূপার শ্রেয়সীর প্রতি সমকামিতার প্রকাশ তাঁকে ক্রমশ বিপন্ন করে তোলে –“শ্রুতি হোমাসেক্সয়াল ঘেন্না করে। শ্রুতি হোমোসেক্সয়াল ভয় পায়।” দেবরূপা শ্রেয়সীর প্রতি আসক্ত, যদিও শ্রেয়সী শুভ্ৰশীলের প্রতি প্রণয়াসক্ত। কিন্তু কাহিনি থেকে জানা যায়, দেবরূপা প্রচণ্ডই পুরুষবিদ্বেষী। তাই সে শ্রেয়সীকে শুভ্ৰশীলের কবল থেকে মুক্ত করতে হয়। আর এই সব কিছুর মূলেই যে তীব্র কামচেতনা তা লেখিকা বুঝিয়েছেন– “তোমাদের মধ্যেও দেখো এই দুই বিভাগ। পীড়ক ও আত্মপীড়ক। কিন্তু দুই-ই স্বাভাবিক। দুই-ই কামবোধের প্রকাশ। দুই-ই প্রকৃতির ইচ্ছা। শুধু বৈচিত্র্য ব্যাপ্ত। নারী নারী, পুরুষ পুরুষ সম্পর্কে ভেদ নেই। কারণ শুধুই মানুষে মানুষে টান সমাজের জন্ম দিয়েছিল। মানুষে মানুষে টান গড়নের জন্ম দেয়।”
বদলেছে মানুষের মানসিকতা, বদলেছে মানুষের প্রান্তিক ধ্যান-ধারণা। তাই পুরস্কৃত হয় স্বপ্নময় চক্রবর্তীর ‘হলদে গোলাপ’। নর-নারীর যৌন সম্পর্ক, সমকামীদের আকাঙ্ক্ষা-যন্ত্রণা, তৃতীয় লিঙ্গ সম্প্রদায়ের বিস্তৃত বিবরণ উপন্যাসটিকে একটি বৈপ্লবিক মাত্রা সংযোজন। সংযোজন বলাটা ভুল হল বোধহয়, আসলে তৃতীয় লিঙ্গ সম্প্রদায়ের কাহিনিই এতে যোজিত হয়েছে। ‘হলদে গোলাপ’ প্রসঙ্গে মনে পড়ে বিচারপতি কে. এস. রাধাকৃষ্ণণের উক্তি : “তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতি কোনো সামাজিক বা চিকিৎসা সংক্রান্ত ইস্যু নয়, মানবাধিকারের প্রশ্ন বলেই বিবেচ্য।” এই উপন্যাসে অনিকেত একজন বেতারকর্মী— যিনি সমকামী, লিঙ্গান্তরকামী কিছু মানুষের কথা তুলে ধরেছেন, বিস্তৃতভাবে বর্ণনা করেছেন হিজড়ে সম্প্রদায়ের অন্ধকারময় জীবনের কথা– যৌনতার বিকৃতিজনিত কিছু অসুস্থতার কথা, যাঁদের বর্তমানে এলজিবিটি বলে চিহ্নিত করা হয় তাঁদের জীবনচিত্র। কিন্সের তত্ত্ব দিয়ে প্রকাশ করেছেন, “প্রত্যেক মানুষের মধ্যে পুরুষ সত্ত্বা ও নারী সত্ত্বা একসঙ্গে থাকে। সব পুরুষের কম-বেশি সমলিঙ্গের প্রতি যৌন আকর্ষণ আছে।” তবে শুধু পুরুষরা নয়, নারীরাও সমলিঙ্গে আকর্ষণ বোধ করে। বরং বেশিই। লেখক স্বপ্নময় চক্রবর্তী যুক্তি দিয়ে দেখিয়েছেন– বিষমকাম যেমন স্বাভাবিক একটা ব্যাপার, সমকামও তেমনই। তবে মানুষের হরমোনাল একটা ‘স্কেল থাকে। তার তারতম্যেই আসে ‘এলজিবিটি তত্ত্বটি। সুধীর চক্রবর্তী গ্রন্থটির আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছেন– “আনকমনদের বেদনার্ত আখ্যান”।
তৌহিদুর রহমানের লেখা ‘নীল যমুনার জলে’ উপন্যাস নিয়ে তোলপাড় হয়েছিল। বইমেলায় প্রকাশিত এই উপন্যাসটি নিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল বিভিন্ন গোষ্ঠী তাঁদের মতামত– বইটি নিষিদ্ধ করতে হবে। নীল যমুনার জলে’-র কেন্দ্রীয় চরিত্র সোমা। যিনি একজন কলেজ ছাত্রী। আর-একটি চরিত্র রেহানা। তিনি একজন কলেজের শিক্ষিকা। এই দুই চরিত্র ঘিরেই এগিয়েছে উপন্যাসের কাহিনি। এতে দেখানো হয়েছে দুজন একই প্রকৃতির। তাঁদের দুজনেরই পুরুষের কোনো আকর্ষণ নেই। কোনো পুরুষের প্রতি আকর্ষণ না থাকাটাই স্বাভাবিক। তার মানে যৌনতা নেই, তা কিন্তু নয়। সোমা ও রেহানা উভয় উভয়ের মধ্যে আকর্ষণ খুঁজে পায়। সেই আকর্ষণে থাকে তীব্রতা। কেউ একে অপরকে ছেড়ে থাকতে পারে না। ধীরে ধীরে একসময় দুজন দুজনকে ভালোবেসে ফেলে। দুজনে চলার পথে একসময় বুঝতে পারে আর দশটা মানুষের মতো ওদের জীবন নয়। তাই সিদ্ধান্ত নেয় তাঁরা সারাজীবন একসঙ্গে থাকবে। তবে সামাজিক কারণে ওরা একসঙ্গে থাকতে পারে না। একদিন দুজনেই মালাবদল করে গোপনে বিয়ে করে নিলেন। সে বিয়ের কথা কেউ জানতে পারল না। ওরা কারোকে জানাতেও পারে না। এভাবেই বয়ে চলে দুটি জীবন। লেখক বিশ্বাস করেন, “বাংলাদেশে অনেক সমকামী পুরুষ আছেন। আর থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে রক্ষণশীল সমাজব্যবস্থার কারণে সমকামী নারী পুরুষরা এখানে নিজেদের আড়ালে রাখেন। সমকামিতা কোনো প্রকৃতিবিরুদ্ধ আচরণ নয়, বরং খুব স্বাভাবিক।”