আমার নরম মনের শোলেহ, মনে রেখো সেই দুনিয়ায় তুমি আর আমি থাকব অভিযোগকারীর আসনে। আর ওরা দাঁড়াবে আসামির কাঠগড়ায়। দেখিই না সৃষ্টিকর্তা কী চান। তবে একটাই আর্জি, মৃত্যুর হাত ধরে দীর্ঘ যাত্রা শুরুর প্রাক মুহূর্ত পর্যন্ত তোমায় জড়িয়ে থাকতে চাই, মাগো, তোমাকে যে খুব খুব ভালোবাসি…।”
তবে রেহানার মৃত্যুদণ্ডের কারণ নিয়ে অন্যেরা অন্য মতও পোষণ করেন। তাঁরা বলছেন— ইরানের রেহানা জাব্বারি নামে এক মহিলার মৃত্যুদণ্ড নিয়ে সারা বিশ্বে ব্যাপক অপপ্রচার চলছে। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে ঝড় উঠেছে ওই নারীর পক্ষে, তবে নিতান্তই অসত্যের পক্ষে। প্রকৃত সত্য হল রেহানা ধর্ষণ প্রতিরোধ করতে গিয়ে খুন করেননি। ঘটনাটি ভুলভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। ইরানের বিচার বিভাগ এতটা নারী-বিদ্বেষী নয় যে, অন্যায়ভাবে একজন নারীকে ফাঁসি দেবে। হত্যাকাণ্ডটি পূর্বপরিকল্পিত ছিল। ওই মহিলা তাঁর দোষ স্বীকার করেছেন আদালতে। রেহানা নিজেকে নির্দোষ প্রমাণেও ব্যর্থ হয়েছেন। ঘটনাটি হচ্ছে দুজনের অবৈধ সম্পর্কের জের ধরে এক পর্যায়ে তাঁদের মধ্যে টানাপড়েন সৃষ্টি হয় এবং এই খুনের ঘটনা ঘটে। সে ক্ষেত্রে পুরুষ লোকটি যে ভালোমানুষ ছিলেন তা বলার সুযোগ নেই। টানাপড়েনের একটি পর্যায়ে বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। যার কারণে রেহানা লোকটিকে খুনের সিদ্ধান্ত নেন। খুনের দুই দিন আগে রেহানা নতুন ছুরি কিনেছিলেন এবং তাঁর এক বান্ধবীকে এসএমএস করেছিলেন যে, খুনের ঘটনাটি ঘটতে যাচ্ছে। এই মহিলার সঙ্গে ইরানের আদালতের এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি যে, তাঁকে ফাঁসি দিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় দিয়ে দেবে। অথবা এই মহিলা ইরানের জন্য কোনো হুমকি ছিলেন সে কারণে তার ফাঁসি কার্যকর করা হল। বরং যদি এমন হত যে, খুন হয়নি বরং অবৈধ সম্পর্ক বা ধর্ষণের ঘটনার বিচার হচ্ছে, তাহলে ওই পুরুষ লোকটাও মৃত্যুদণ্ডের মুখে পড়ত। এবং এ ক্ষেত্রেও ইরানের আইন অনুসরণ করা হত। দেখা হত না কে পুরুষ আর কে নারী। যেমনটি দেখা হয়নি রেহানার ক্ষেত্রে। আলোচ্য হত্যাকাণ্ডটি ২০০৭ সালে সংঘটিত হয়। ঘটনাটি সাত বছর ধরে পুঙ্খানুপঙ্খ বিচার বিশ্লেষণ করে তারপর ইরানের আদালত রায় দিয়েছে। এ নিয়ে উচ্চ আদালতে পরে আবার বিচার হয়েছে এবং রায় বহাল রাখে। তারপরও এক মাস দেরি করা হয়েছে যে ভিক্টিম পরিবার যদি মাফ করে দেয় তাহলে ফাঁসিটি কার্যকর করা হবে না। কিন্তু ওই পরিবার মাফ করেনি। ইরানের বিচারব্যবস্থায় খুনের ঘটনায় কারও মৃত্যুদণ্ড হলে ভিক্টিম পরিবার ছাড়া কারও পক্ষে সে রায় উল্টানোর সুযোগ নেই। এমনকি প্রেসিডেন্ট বা সর্বোচ্চ নেতাও পারেন না।
কোনোভাবেই মৃত্যুদণ্ড সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। হত্যা করার অধিকার কারোর থাকতে পারে না। নখের বদলে নখ, দাঁতের বদলে দাঁত, চোখের বদলে চোখ– এ ব্যবস্থা সমাজে কোনো কাজে লাগে না। এটা প্রতিহিংসাপরায়ণতা। অপরাধের বদলে অপরাধ করা।
সমাজ, ধর্ম ও রাজনীতি বিষয়ে ভিন্নমত প্রকাশ লেখকদের জন্য সবসময় ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। আছে এবং হয়তো-বা থাকবে। ভিন্ন মতাবলম্বী লেখকের উপর যে-কোনো সময়ে রাষ্ট্রের খড়গহস্ত নেমে আসতে পারে। গ্রেফতার হতে পারেন লেখক, লেখক নির্বাসিত হতে পারেন, এবং মৃত্যুদণ্ড পেতে পারেন। শুধু রাষ্ট্রই নয় –বিভিন্ন ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সামাজিক এবং ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর সংঘবদ্ধ আক্রমণের শিকার হতে পারে লেখক। সেই লেখক যদি সরকারের অপ্রিয়ভাজন হন তাহলে রাষ্ট্র সেই সুযোগ নিয়ে সেই একই পদ্ধতি প্রয়োগ। হতে পারে।
ধর্ম এবং বিজ্ঞান বিষয়ে নতুন চিন্তাধারা প্রকাশ করেছিলেন ইটালিয়ান দার্শনিক ও বিজ্ঞানী জিওর্ডানো ব্রুনো তাঁর রচনাসমূহে। সাত বছর বাপী মামলার পরে ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে আগুনে পুড়িয়ে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে আয়ারল্যান্ডের কবি ও শিক্ষক প্যাট্রিক হেনরি পিয়ার্স তাঁর সহবিপ্লবীদের নিয়ে ব্রিটিশদের ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি ধরা পড়েন এবং তাঁকে ফায়ারিং স্কোয়াডের গুলিতে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। স্পেনের সুবিখ্যাত লেখক ও নাট্যকার ফেডারিকো গার্সিয়া লোরকাকে স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধের প্রথমদিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল ন্যাশনালিস্ট সিভিল গভর্নর। জেনারেল ফ্রাঙ্কোর সেনাবাহিনী তাঁকে প্রথমে অকথ্য অত্যাচার করে এবং পরে তাঁকে হত্যা করা হয়। তাঁর কবর খুঁজে পর্যন্ত যায়নি।
সমাজ, রাষ্ট্র ও ধর্ম বিষয়ে এখন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি অনেক বদলে গিয়েছে। এমনকি যাঁরা ধর্মপরায়ণ ব্যক্তি তাঁদের মধ্যেও নিজেদের ধর্ম বিষয়ে নতুন চিন্তাভাবনা এসেছে। এর কারণ হচ্ছে মানুষ চেয়েছে ধর্মের আওতায় থেকেও পরিবর্তিত যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে। আর তার ফলে মৃত্যুদণ্ডসহ বিভিন্ন ইসুতে ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গিয়েছে।
বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ ‘পঞ্চশিলা’-তে বলা হয়েছে –“প্রত্যেকেই শাস্তিকে ভয় পায়। প্রত্যেকেই মৃত্যুকে ভয় পায়। ঠিক তোমারই মতো। সুতরাং তুমি কাউকে হত্যা করবে না, অথবা এমন কিছু করবে না যার ফলে কেউ নিহত হতে পারে।” বলা হয়েছে –“তাকেই আমি ব্রাহ্মণ বলব যে অস্ত্র ছেড়ে দিয়েছে এবং সকল প্রাণীর বিরুদ্ধে সহিংসতা ছেড়ে দিয়েছে। সে কাউকে হত্যা করে না। সে অন্য কোনো ব্যক্তিকে হত্যায় সাহায্য করে না। অনেক বৌদ্ধগণ মনে করেন কোনো আইনগত পদ্ধতিতে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার বিরোধী তাঁদের ধর্ম। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী দেশগুলোর মধ্যে বেশির ভাগ দেশে কিছু অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ৮১৮ খ্রিস্টাব্দে জাপানের সম্রাট সাগা মৃত্যুদণ্ড বন্ধ করেছিলেন। তা সত্ত্বেও কিছু জমিদার তাদের এলাকায় মৃত্যুদণ্ড চালু রেখেছিলেন। ১১৬৫ খ্রিস্টাব্দে জাপানে আবার মৃত্যুদণ্ড চালু হয়। এখনো তাই। অবশ্য সম্প্রতি জাপানের কিছু বিচারক মৃত্যুদণ্ড সই করতে রাজি হননি। এ ক্ষেত্রে যুক্তিস্বরূপ তাঁরা নিজেদের ধর্মবিশ্বাসের উল্লেখ করেছেন। অন্যান্য বৌদ্ধপ্রধান দেশগুলোর মধ্যে ভুটান ও মঙ্গোলিয়া মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ করেছে। শ্রীলংকা একসময়ে মৃত্যুদণ্ড বন্ধ করলেও আবার সেটা চালু করেছে। থাইল্যান্ডে মৃত্যুদণ্ড বরাবরই চালু ছিল এবং আছে। তবে থাইল্যান্ডের বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারকদের মধ্যে এ বিষয়ে মতভিন্নতা আছে। বুদ্ধ তার বাণী দিয়ে খুনি এবং অপরাধীদের যে সংশোধিত করেছিলেন সে বিষয়ে বৌদ্ধ পুরাণে অনেক কাহিনি আছে। যেমন, আঙ্গুলিশালা ৯৯৯ জনকে হত্যার পর নিজের মা এবং বুদ্ধকে হত্যার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বুদ্ধের প্রভাবে তিনি অনুতপ্ত হন এবং বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। সব পশুপ্রাণী হত্যা সম্রাট অশোক নিষিদ্ধ করেছিলেন এবং তিনি চেয়েছিলেন মানুষ হত্যার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে। মৃত্যুদণ্ড বিষয়ে ক্যাথলিক খ্রিস্টান ধর্মে বহু রকমের মতামত আছে। কেউ মনে করেন, জিশু যে ক্ষমার বাণী প্রচার করেছিলেন তার সম্পূর্ণ বিরোধী মৃত্যুদণ্ড, কারণ এটি প্রতিহিংসার বাস্তবায়ন। সুতরাং এটি সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ হওয়া উচিত। আবার কেউ মনে করেন, ওল্ড টেস্টামেন্ট আইন অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ড দেওয়া উচিত। মৃত্যুদণ্ড-বিরোধীরা মনে করিয়ে দেন, জিশু বলেছিলেন, এক গালে চড় খেলে আর-এক গাল বাড়িয়ে দিতে। তাঁরা মনে করিয়ে দেন, পরকীয়া প্রেমে অভিযুক্ত ও মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত এক নারীকে যখন পাথর ছুঁড়ে মারা হচ্ছিল তখন জিশু সেটা বন্ধ করেন। মৃত্যুদণ্ড-বিরোধীরা বলেন, এই ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয়, শারীরিকভাবে প্রতিশোধ নেওয়ার বিপক্ষে ছিলেন যিশু। কিন্তু মৃত্যুদণ্ডের পক্ষেও ক্যাথলিক খ্রিস্টানরা আছেন। আমেরিকায় সকল ধরনের মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতা যাঁরা সবচেয়ে আগে করেছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন প্রটেস্টান্ট খ্রিস্টানদের একটি শাখা, দি রিলিজিয়াস সোসাইটি অফ ফ্রেন্ডস বা কোয়েকার চার্চ। সাদার্ন ব্যাপটিস্টরা খুন ও দেশদ্রোহিতার দায়ে দণ্ডিতদের মৃত্যুদণ্ড সমর্থন করলেও তারা বলেন, সেখানে যেন কোনো ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা অথবা রাষ্ট্রীয় বৈষম্য না থাকে। ইউনাইটেড মেথডিস্ট চার্চ এবং অন্যান্য মেথডিস্ট চার্চও মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী। তাঁরা বলেন, সামাজিক প্রতিশোধ নিতে কোনো মানুষকে মেরে ফেলা উচিত নয়। মেথডিস্ট চার্চ আরও বলে, মৃত্যুদণ্ডের শিকার হয় অসমভাবে গরিব, অশিক্ষিত, সংখ্যালঘু এবং মানসিক রোগাক্রান্ত অথবা আবেগপ্রবণ মানুষরা। হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন গ্রন্থে মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে এবং বিপক্ষে বলা হয়েছে। হিন্দু ধর্মে অহিংসার বাণী প্রচারিত হয়েছে যেখানে দাবি করা হয়েছে “আত্মা অবিনশ্বর … মৃত্যু কেবল দৈহিকভাবে হতে পারে।” কিন্তু ধর্মশাস্ত্রে বলা হয়েছে, খুনের কারণে এবং ন্যায়সঙ্গত যুদ্ধের সময়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যেতে পারে। মৃত্যুদণ্ড বিষয়ে ইসলামী জ্ঞানীজনদের মধ্যে কিছু বিতর্ক আছে। প্রায় সব ইসলামি দেশে মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছে। তবে সেটা কার্যকরের পন্থা হয় ভিন্ন। কিছু ইসলামী দেশে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে বাঁচতে পারেন। বর্তমান যুগে অধিকাংশ খ্রিস্টানরা যেমন মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী অবস্থান নিয়েছেন তেমনটা মুসলিমরা করেননি। তদুপরি কিছু মুসলিম দেশে প্রকাশ্যে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করায় এবং সেই ছবি পত্রিকা ও ইন্টারনেটে প্রকাশ করায় মুসলিমরা সাধারণত চিত্রিত হয়েছেন মৃত্যুদণ্ডের পক্ষপাতী এবং প্রাচীনপন্থী রূপে। ইহুদি ধর্মে নীতিগতভাবে মৃত্যুদণ্ডকে সমর্থন করা হয়। তবে সেই দণ্ড দেওয়ার আগে সুষ্ঠু বিচার ব্যবস্থা ও প্রয়োজনীয় সকল সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একটি নির্দেশে বলা হয়েছে, মৃত্যুদণ্ডের মামলায় তিনজন নয়, অন্ততপক্ষে ২৩ জন বিচারককে থাকতে হবে। দ্বাদশ শতাব্দীর ইহুদি জ্ঞানী ব্যক্তি মুসা ইবনে মায়মুন বলেন, একজন নিরপরাধের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার চাইতে এক হাজার অপরাধীকে ছেড়ে দেওয়া শ্রেয়। মুসা বিন মায়মুন যুক্তি দেন, সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত না হয়ে একজন অভিযুক্তকে মেরে ফেললে আমরা একটা পিচ্ছিল পথে পড়ে যাব এবং শেষপর্যন্ত বিচারকের অভিরুচি মোতাবেক দণ্ড হবে। “It is better and more satisfactory to acquit a thousand guilty persons than to put a single innocent one to death… that executing a defendant on anything less than absolute certainly would lead to a slippery slope of decreasing burdens of proof, until we would be convicting merely, according to the judge’s caprice.”