১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের আগে ভারত কবে ভারতীয়দের ছিল? প্রায় ২০০ বছর ব্রিটিশরা শাসন করেছিল, ব্রিটিশদের ছিল। তার আগে প্রায় ৮০০ বছর মুসলিম শাসকরা শাসন করেছিল, তারও আগে বেদের যুগ পর্যন্ত ভারত বিদেশিদের কর্তৃক শাসিত হয়েছে। এমনকি যে আর্যদের নিয়ে আমাদের অহংকার, সেই আর্যরা কিন্তু ভারতের ভূমিপুত্র নন, ভারত বংশোদ্ভূতও নয়— বিদেশিই। তখন বিপ্লবীরা কোথায় ছিলেন? অত্যাচার কোন শাসক করেননি! তাহলে কার বা কাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদ? দেশদ্রোহিতাই-বা কেন? ব্রিটিশ-ভারতে বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদীদের মৃত্যুদণ্ড যদি অনৈতিক হয়, অন্যদের ক্ষেত্রে সেটা উলটো হবে কেন? অর্থাৎ দেশদ্রোহিতা বা সন্ত্রাসবাদিতা যেহেতু দেশ-কাল বিশেষে আপেক্ষিক, সেই কারণে সেইসব কোনো ব্যক্তিদের মৃত্যুদণ্ডও মেনে নেওয়া যাচ্ছে না।
দেশপ্রেমের প্রসঙ্গে বলব, কারা দেশপ্রেমী? যাঁরা নানা ছলনায় কোটি কোটি টাকার আয়কর ফাঁকি দিয়ে রাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতারণা করেন, তাঁরা দেশপ্রেমী? যেসব নিয়োগ কর্তৃপক্ষ শ্রমিক বা কর্মচারীদের রক্ত শুষে খায়, তাঁরা দেশপ্রেমী? যেসব শ্রমিক বা কর্মচারীরা নানা কায়দায় শ্রম চুরি করে, মালপত্র ঝেড়ে ফাঁক করে দেয়, তাঁরা দেশপ্রেমী? যে সব মাননীয় নাগরিকরা কালো টাকার পাহাড় জমান, তাঁরা দেশপ্রেমী? যেসব মাননীয় নাগরিকরা আয় বহির্ভূত প্রচুর অর্থ সুইস ব্যাঙ্কে জমা রেখে আসেন, তাঁরা দেশপ্রেমী? আয়কর দপ্তরের যেসব অসৎ অফিসারেরা অসৎ ব্যবসায়ীদের কোটি কোটি টাকার আয়কর ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ করে দিয়ে নিজে ‘লাল’ হয়ে সরকারকে দিনের পর দিন ‘কালো’ করে চলেছেন, তাঁরা দেশপ্রেমী? যেসব নির্লজ্জ নাগরিকরা দেশের যত্রতত্র দাঁড়িয়ে পেচ্ছাব ছিটিয়ে দেশের সর্বত্র কলুষিত করেন, তাঁরা দেশপ্রেমী?
একদা মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত অপরাধীকে জনসমক্ষে প্রকাশ্যে দণ্ড কার্যকর করা হত। সেক্ষেত্রে দণ্ড প্রয়োগের স্থান-সময় আগেভাগে জানিয়ে দেওয়া হত, যাতে সাধারণ মানুষ যত বেশি সংখ্যক উপস্থিত থাকতে পারে। উদ্দেশ্য : যাতে সুস্থ স্বাভাবিক মানুষেরা অপরাধীর দণ্ড নিজের চোখে দেখে অপরাধ বিষয়ে তাঁর একটা বিরূপ মানসিক প্রতিক্রিয়া হয় এবং তাতে সামাজিক সুফল মিলবে। না, মৃত্যুদণ্ড দিয়ে এক ইঞ্চিও সামাজিক সুফল মেলেনি। হাজার হাজার বছর ধরে এত নৃশংস কঠোর শাস্তি দিয়েও পৃথিবীকে অপরাধমুক্ত করা যায়নি। অপরাধ হয়েই চলেছে এবং তা হাজারবার মৃত্যুদণ্ড দিয়েও অবস্থার পরিবর্তন করা যাবে না। কারণ প্রায় সব অপরাধের পিছনে থাকে আর্থ-সামাজিক সংকট এবং মানসিক বৈকল্য, যার দায় কোনো রাষ্ট্র এড়াতে পারে না।
মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধির হত্যাকাণ্ড উপমহাদেশের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। গান্ধির হত্যাকারী ছিলেন তাঁর মতোই একজন উচ্চশ্রেণির ব্রাহ্মণ। তার নাম নাথুরাম গডসে। গান্ধি হত্যাকাণ্ডে গডসের যে যুক্তি ছিল তা তাঁর একার ছিল না। হিন্দুদের একটি বিরাট অংশ গডসের যুক্তি সঠিক বলে মনে করে। ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দের জুলাই থেকে ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট ছয়বার গান্ধিকে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়। নাথুরাম গডসে ১৯৪৬ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথমবার গান্ধিকে হত্যার চেষ্টা করেন। ব্যর্থ হয়ে তিনি আবার ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ২০ জানুয়ারি একই চেষ্টা চালান। পরপর দু-বার ব্যর্থ হয়ে তৃতীয়বার ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে ৩০ জানুয়ারি তিনি সফল হন। তিনি মনে করতেন, অষ্টাদশ শতাব্দীতে মোগলদের বিরুদ্ধে মারাঠা দস্যু শিবাজি, রাজা রাবণের বিরুদ্ধে হিন্দু বীরদের সহিংস লড়াইয়ের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে অহিংস পথ অবলম্বন করে গান্ধি হিন্দুধর্ম ত্যাগ করেছেন। তাই তাঁকে হত্যা করা পুণ্যের কাজ। গডসে এ সিদ্ধান্তে আসেন যে, জাগতিক বিচারে তাঁর পরিণাম যাই হোক, পরজন্মে তিনি মুক্তি পাবেন। শুধু তাই নয়, গান্ধি হত্যাকাণ্ড সফল হলে তাঁর স্বধর্মের অনুসারী ভারতের ৩০ কোটি হিন্দুও অবিচারের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবে। গান্ধি হত্যাকাণ্ডে এগুলোই ছিল নাথুরাম গডসের যুক্তি। তিনি মনে করতেন— শিবাজি, রানা প্রতাপ ও গুরু গোবিন্দের মতো ঐতিহাসিক বীর যোদ্ধাদের বিপথগামী দেশপ্রেমিক হিসাবে নিন্দা করে গান্ধিজি নিজের আত্মম্ভরিতা প্রকাশ করেছেন। গান্ধিজি অহিংস ও সত্যাগ্রহ নীতির নামে দেশে অবর্ণনীয় দুর্দশা ডেকে এনেছেন। পক্ষান্তরে, রানা প্রতাপ, শিবাজি ও গুরুগোবিন্দ তাঁদের জাতিকে যে মুক্তি এনে দিয়েছিলেন সেজন্য তাঁরা জাতির হৃদয়ে চিরজাগরুক হয়ে থাকবেন। এই হল নাথুরাম গডসে।
মেরঠে নাথুরাম গডসের মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হবে বলা হয়েছিল অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভার পক্ষ থেকে। হিন্দু মহাসভার সভাপতি শুধু জানিয়েছেন, মন্দিরে নাথুরাম গডসের সঙ্গে থাকবেন অখণ্ড ভারতমাতা। হিন্দু মহাসভার তরফে চন্দ্ৰপ্ৰকাশ কৌশিক বলেছেন, “মহাত্মা গান্ধির সঙ্গে নাথুরাম গডসের কোনো ব্যক্তিগত দুশমনি ছিল না। তবুও তিনি গান্ধিজিকে খুন করেছিলেন। কেন সেই ঘটনা ঘটেছিল, তার তদন্তও হয়নি। কেন হয়নি, সেটা একটা প্রশ্ন। যদি আকবর রোড, হুমায়ুন রোড, ঔরঙ্গজেব রোড থাকে, তা হলে গডসের নামে কেন রাস্তা থাকবে না? কেন তাঁর একটি মূর্তি তৈরি হবে না।” অর্থাৎ, আপনার কাছে যে টেররিস্ট, আমার কাছে সে বিপ্লবী শহিদ। আপনার কাছে যে গড, আমার কাছে সে গডসে –এরকম ব্যাপার আর কি! মহাত্মা গান্ধির ঘাতক নাথুরাম গডসেকে ‘দেশপ্রেমিক’ বলেছিলেন বিজেপি সাংসদ সাক্ষী মহারাজ। সাক্ষী মহারাজ বলেন, “নাথুরাম গডসে একজন জাতীয়তাবাদী ছিলেন। মহাত্মা গান্ধি যতটা করেছেন দেশের জন্য, গডসের অবদানও ততটা।” পরে অবশ্য চাপে পড়ে সাক্ষী মহারাজ বলেন, “যদি ভুল করে কিছু বলে থাকি, তা হলে কথা ফিরিয়ে নিচ্ছি। নাথুরাম গডসে দেশপ্রেমিক নয়। কখনও ছিল না।” চাপে পড়ে ভুল স্বীকার করা আর শ্রদ্ধা থেকে সরে আসা এক ব্যাপার নয়। গডসের ফাঁসি হয়েছে একথা ঠিক। তবে তিনি যে চিন্তায় আলোড়িত হতেন সে চিন্তার মৃত্যু আজও হয়নি। এখনও ভারতের কট্টরপন্থী এবং উগ্রবাদী হিন্দু গডসের চিন্তা ও চেতনায় আলোড়িত হয়। তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে।