আগেই উল্লেখ করেছি লঘু পাপে লঘু দণ্ড, গুরু পাপে গুরু দণ্ড। কোন্ অপরাধ লঘু কোন্ অপরাধ গুরু, তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায়। শাস্তির ধরনও বদলে যায়। এ বড়ো আপেক্ষিক ব্যাপার। কোন্ অন্যায়ের কোন্ শাস্তি হবে তা নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট সেই রাষ্ট্রের আইন ব্যবস্থার উপর, যা শাসক দ্বারা নির্দেশিত। লঘু পাপেও যে গুরু দণ্ড দেওয়া হয় এমন উদাহরণ ঝুড়ি ঝুড়ি আছে। প্রাচীন ভারতে ভয়ংকর আঘাতে তাৎক্ষণিক মৃত্যু এবং অন্যান্য গুরুতর অপরাধ –যেমন বাবা-মা-ভাই-বোন-শিক্ষক-গুরু এবং সন্ন্যাসী বা তপস্বীর মৃত্যু ঘটালে আগুনে পুড়িয়ে অথবা জলে ডুবিয়ে অথবা বিষ খাইয়ে মৃত্যুদণ্ড প্রযুক্ত হত। প্রাচীন রোমেও পিতৃহত্যা, স্বজনহত্যা বা রাজহত্যার অপরাধীকে বুনো কুকুর বা বিষধর সাপের সঙ্গে থলির মধ্যে ঢুকিয়ে হত্যা করা হত। ১৭৯৫-৫০ খ্রিস্টপূর্বে হামুরাবির আইন অনুসারে ব্যাবিলনে বিক্রেতা যদি মদ বিক্রিতে মাপে কম দিত তাহলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হত। প্রাচীন ভারতে নরহত্যা ছাড়া যেসব অপরাধে মৃত্যুদণ্ড হত, তার মধ্যে আছে –রাজদ্রোহ, মানী ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিকে অপহরণ– বিশেষত নারীহরণ, উচ্চবর্ণের স্ত্রীর সঙ্গে অবৈধ যৌন সম্পর্ক, রাজাদেশ জাল বা নকল করা, চুরি ও চোরাই মালসহ ধরা পড়া, রাজকোশ থেকে মণিমাণিক্য চুরি, চাষের জন্য তৈরি বাঁধ বা সেতু নষ্ট করা, রাজার হাতি-ঘোড়া-রথ চুরি করা, ঘরবাড়ি বা খেতখামারে আগুন লাগানো, মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত অপরাধীর মৃতদেহ সৎকার করা ইত্যাদি। এখানেই শেষ নয়– বৈদিক ও পরবর্তী যুগে ব্রাহ্মণ ছিল অবধ্য। ব্রাহ্মণগণ প্রাণদণ্ডাই কোনো অপরাধ করলে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে দেশ থেকে নির্বাসন দেওয়া হত। তখনকার সময়ে ‘দেশ’ বলতে ভারত বহির্ভূত বোঝত না, বোঝাত অন্য রাজ্য। অর্থাৎ কাম্পিল্যের নির্বাসিত ব্রাহ্মণ আরামসে মগধে বসবাস করতে কোনো অসুবিধা ছিল না। প্রাচীন গ্রিসেও ‘nobleman’-দের ক্ষেত্রেও মৃত্যুদণ্ডের বদলে নির্বাসন দেওয়া হত। তবে সেই নির্বাসিত ব্যক্তিটি যদি পুনরায় রাষ্ট্রে প্রবেশ করে তাঁর সম্পত্তি হরণ করে প্রাণদণ্ড দেওয়া হত। তবে প্রাচীন ভারতে শূদ্ররাই বেশি শাস্তি ভোগ করত। শূদ্রদের তুলনায় ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের মৃত্যুদণ্ড কমই হত।
শাস্তির নামে মানুষ যে কত নৃশংস হত করে তার নমুনা ইতিহাসের ছত্রে ছত্রে। হত্যার ইতিহাসে রক্তাক্ত হয়ে আছে মানুষের সভ্যতা। ধমকে, দাবিয়ে রাখার সভ্যতা। শুষে খাওয়ার সভ্যতা। ছোটো মাছকে গিলে খাওয়ার সভ্যতা। শাস্তি কেন দেওয়া হত? ‘সবক’ শেখানোর জন্য? বিশ্বাস করি না। মৃত্যুদণ্ড যিনি দেন, মৃত্যুদণ্ড যিনি কার্যকর করেন, মৃত্যুদণ্ডের মতো হত্যাকাণ্ড যে বা যাঁরা সমর্থন করে উল্লসিত হন তাঁরা প্রত্যেকেই হত্যাকারী। হত্যার সপক্ষে যাঁরা বক্তৃতা দেন, আসলে তাঁদের অন্তরের ভিতর হত্যার স্পৃহা জেগে থাকে। হ্যাঁ, অবচেতন মনে। দেশদ্রোহী হলে তাঁর জন্য নির্দিষ্ট হয়ে আছে অবশ্যই মৃত্যুদণ্ড। দেশদ্রোহী এবং দেশপ্রেমী –এই দুটি ভাগে ভাগ হয়ে যায় মানুষ। কেন? কে দেশদ্রোহী? কেই-বা দেশপ্রেমী? যদি কিষাণজি দেশদ্রোহী হন, যদি কাসভ দেশদ্রোহী হন, যদি আফজল গুরু দেশদ্রোহী হন– তবে ব্রিটিশ-ভারতে কাকোরি ষড়যন্ত্র মামলায় ধৃত রাজেন্দ্রপ্রসাদ বিসমিল ও রোশনলাল, লাহোর ষড়যন্ত্র মামলায় ধৃত গণেশ পিংলে ও কর্তার সিং, দিল্লি ষড়যন্ত্র মামলায় ধৃত বসন্ত বিশ্বাস, আলিপুর বোমা মামলায় ধৃত কানাইলাল দত্ত ও সত্যেন বসু, পুনা কালেকটর হত্যার দায়ে ধৃত দামোদর চাপের ও বালকৃষ্ণ হরি চাপের প্রমুখ ব্যক্তিদের দেশদ্রোহী ও সন্ত্রাসবাদীদের কী বলবেন? সময়ের বিচারে তাঁরাও কিন্তু দেশদ্রোহীই। সে সময়কার রেকর্ডে তাঁদের নামের সঙ্গে ‘Terrorist’ উল্লেখ আছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কর্তৃক গঠিত একটি আধাসামরিক বাহিনী। এটি অখণ্ড পাকিস্তানপন্থী বাঙালি এবং উর্দুভাষী অবাঙালি অভিবাসীদের নিয়ে গঠিত হয়। অবরুদ্ধ বাংলাদেশে স্বাধীনতার জন্যে লড়াইরত মুক্তিবাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে খুলনায় প্রথম রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। পাকিস্তানের সংবিধানের প্রতি সত্যিকার আনুগত্য প্রদর্শন করে তাঁরা স্বাধীন বাংলাদেশের কাছে অপরাধী হলেও অখণ্ড পাকিস্তানের কাছে চরম আনুগত্য বইকি! রেজাকার বা রাজাকার মানে স্বেচ্ছাসেবী, এই রাজাকারেরা হলেন গোলাম আজম, আব্বাস আলি খান (জামাতে ইসলামী বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমির), মতিউর রহমান নিজামী, আলি আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ (ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি এবং আলবদর বাহিনীর ঢাকা মহানগরীর প্রধান), মোঃ কামরুজ্জামান (জামাতে ইসলামী বাংলাদেশের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল), দেলোয়ার হোসেন সাঈদি (জামাতে ইসলামীর মজলিসের শুরার সদস্য), আবদুল কাদির মোল্লা (জামাতে ইসলামের প্রচার সম্পাদক), ফজলুল কাদের চৌধুরী, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী– যাঁদের অখণ্ড পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য দেখানোর অভিযোগে অনেককেই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। রেজাকার বা রাজাকার বাহিনী কোরান Šiau xtetet facua, “I shall bear true allegiance to the constitution of Pakistan as framed by law and shall defend Pakistan, if necessary, with my life.” অর্থাৎ, “আমি আইনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের সংবিধানের প্রতি সত্যিকার আনুগত্য প্রদর্শন করব এবং জীবন দিয়ে হলেও পাকিস্তানকে রক্ষা করব।” ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর তারিখের আগে যাঁরা ছিলেন পাকিস্তানের দেশপ্রেমী, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর তারিখের পর থেকে তাঁরাই দেশদ্রোহী হয়ে গেলেন। অসম সাহসিকতার জন্য যাঁদের পুরস্কার পাওয়ার কথা ছিল, তাঁদেরই কপালে জুটল মৃত্যুদণ্ড। অথচ ভাবুন তো, যদি কোনো কারণে মুক্তিযুদ্ধ সফল না হত এই কাদের মোল্লারাই অখণ্ড পাকিস্তানের ঘরে ঘরে দেশপ্রেমী হিসাবে পূজিত হতেন। তাই না?