স্যাফো নারী ও বালিকাদের উদ্দেশ্য করে অনেকগুলি কবিতা রচনা করেছিলেন। ইনি লেসবোস দ্বীপের বাসিন্দা। স্যাফো সম্ভবত ১২,০০০ লাইনের কবিতা লিখেছিলেন নারীদের জন্য। তবে তার মধ্যে মাত্র ৬০০ লাইনেরই সন্ধান পাওয়া গেছে। এই মহিলা কবির লেখার পরতে পরতে ছিল নারী-শরীরের বন্দনা। তাই স্যাফো প্রাচীনকালের নারী-সমকামী কবি হিসাবে পরিচিত। তিনি গ্রিক সমাজে ‘থিয়াসোস’ বা অল্পশিক্ষিতা নারী হিসাবে পরিচিত ছিলেন। সে যুগের সমাজে নারীজাতির মধ্যেও সমকামিতার প্রচলন ছিল। নগররাষ্ট্রের উদ্ভবের পর বিবাহপ্রথা সমাজ ও সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হয়ে ওঠে এবং মেয়েরা গৃহবন্দি হয়ে পড়ে। থিয়াসসাস’-রা হারিয়ে যায়। স্যাফোর জন্মস্থান লেসবস থেকেই তো অভিধানে জায়গা পেয়েছে ‘লেসবিয়ান’ শব্দটি। সামাজিকভাবে নারীর সমকামিতার কোনো স্থান হয়নি। সাধারণভাবে নারীর সমকামিতার ঐতিহাসিক প্রামাণ্য তথ্য বেশি নেই।
সমকামী বিষয়বস্তু সম্পর্কে দীর্ঘকাল নীরব থাকার পর ঐতিহাসিকরা এ বিষয়ে আলোচনা শুরু করেন। এরিক বেথে ১৯০৭ সালে এ বিষয়ে আলোচনা শুরু করেছিলেন। পরে কে, জিডোভারাও গবেষণা চালিয়ে যান। গবেষণায় জানা গেছে, প্রাচীন গ্রিসে সমকামিতার খোলাখুলি প্রচলন ছিল। এমনকি সরকারি অনুমোদনও ছিল। খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দী থেকে রোমান যুগ পর্যন্ত এই অবস্থা চলেছিল। কোনো কোনো গবেষকদের মতে সমকামী সম্পর্ক, বিশেষত পেডেরাস্টির প্রচলন ছিল উচ্চবিত্ত সমাজের মধ্যেই। সাধারণ মানুষের মধ্যে এই প্রথার প্রচলন খুব একটা ছিল না। ব্রুস থর্নটনের মতে, অ্যারিস্টোফেনিসের কৌতুক নাটকগুলিতে গ্রহীতার স্থান গ্রহণকারী সমকামীদের প্রতি উপহাস করার প্রবণতা থেকে বোঝা যায়, পুরুষ সমকামিতাকে সাধারণ মানুষ ভালো চোখে দেখত না। ভিক্টোরিয়া ওল প্রমুখ অন্যান্য ঐতিহাসিকেরা বলেছেন, এথেন্সে সমকামী সম্পর্ক ছিল ‘গণতন্ত্রের যৌন আদর্শ। এটি উচবিত্ত ও সাধারণ মানুষ— উভয় সমাজেই সমাজভাবে প্রচলিত ছিল। হার্মোডিয়াস ও অ্যারিস্টোগেইটন নামে দুই হত্যাকারীর ঘটনা থেকে তা প্রমাণিত হয়। এমনকি যাঁরা বলেন যে, পেডেরাস্টি উচ্চবিত্ত সমাজেই সীমাবদ্ধ ছিল, তাঁরাও মনে করেন যে এটি ছিল ‘নগররাষ্ট্রের সামাজিক কাঠামোর অঙ্গ’।
আধুনিক গ্রিসে এই বিষয়ে বিতর্ক হয়েছে। ২০০২ সালে মহামতি আলেকজান্ডার সম্পর্কিত এক সম্মেলনে তাঁর সমকামিতা নিয়ে বিতর্ক হয়। ২০০৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘আলেকজান্ডার’ চলচ্চিত্রে আলেকজান্ডারকে উভকামী হিসাবে দেখানোর জন্য ২৫ জন গ্রিক আইনজীবী চলচ্চিত্রের নির্মাতাদের বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকি দিয়েছিলেন। তবে ছবির এক আগাম প্রদর্শনীর পর তাঁরা আর মামলা করেননি।
.
সাহিত্য ও সিনেমায় সমকামী
আধুনিক সাহিত্য-সিনেমাতেও বারবার জায়গা করে নিয়েছে সমকামী মানুষের গল্প। অতীত ও বর্তমান কোনোকালেই সমকামিতাকে অস্বীকার করার উপায় না থাকলেও রক্ষণশীল সমাজ ও পরিবারের বাধা তো ছিলই, আজও আছে। তাই সাহিত্যের দিকে তাকালে তার পরিসরের ক্ষেত্রকে খুব সীমাবদ্ধ বলে মনে হয়েছে। তবু, সাহিত্যে যা নিদর্শন পাওয়া যায় সেক্ষেত্রে কোনোমতেই অস্বীকার করা যায় না এর অন্তরালে থাকা মনস্তাত্ত্বিক কিছু প্রবৃত্তিকে। এছাড়া শারীরিক কিছু কারণ তো আছেই। ইংরেজি সাহিত্যে ক্রিস্টোফার মার্লোর ‘Edward the Second’ এবং মহেশ দত্তানির ‘Bravely fought the Queen’ নাটক বর্তমান সমাজেও বহু আলোচিত। জগদীশ গুপ্তের গল্পে সমকামিতার আভাস পাওয়া যায় মাত্র। একটি গল্পে রাণুর স্বামীর বদলিজনিত কারণে অন্যত্র যেতে হবে। যাওয়ার আগে কানুর স্ত্রীর ইন্দিরার সঙ্গে রাণু একরাত্রি কাটাতে চায়। তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে আসে সেই অমোঘ কথাগুলি– “তুই আর আমি এক হয়ে যাই”। এক পুরুষের শরীরে এক নারীর এক হয়ে যাওয়াটাকে যেমন বিষমকামিতা বলা হয়, তেমনি এক নারীর শরীরের সঙ্গে আর-এক নারীর এক হয়ে যাওয়াটাকে সমকামিতা বলা হয়। মুখ্য উদ্দেশ্য হয়ে ওঠে রূপ ছাপিয়ে ইন্দিরার অঙ্গসান্নিধ্যে। রূপ নয়, অরূপের মধ্যে দিয়ে নিজেকে স্বামী আর ইন্দিরাকে স্ত্রী ভেবে মিলনেচ্ছায় রাণু বলেই ফেলে সেই ইচ্ছের কথা। ইন্দিরার মুখে শুনি –“যেন স্বামী আর স্ত্রী, সে আর আমি”। কমলকুমার মজুমদারের মল্লিকা বাহার’ কাহিনিতে সমকামিতার আভাস মেলে। মল্লিকার পুরুষ-সঙ্গের অভাব তাঁর যৌন-তাড়নার অভিমুখ বদলে যায়। তাই শোভনাদির সঙ্গে যখন দেখা হয় তখন থেকেই সম্পর্ক গড়ে ওঠে দুই নারীর। লেখকের ভাষায়– “শোভনার চোখে অন্য আলো এসে পড়েছে, তাঁর চোখে-মুখে দেখা যাবে পুরুষালি দীপ্তি, যে-কোনো রমণী যে সে ঘাটের পথে, বাটের পথে চিকের আড়াল হতে দেখুক, ভালো এ দৃষ্টি লাগবেই… শোভনার স্পর্শের মধ্যে কেমন এক দিব্য উষ্ণতা, এ উষ্ণতা বহুকাল বয়সি বহুজন প্রিয়। মল্লিকার এ উষ্ণতা ভালো লেগেছিল, ভারী ভালো লেগেছিল।” মল্লিকার মন সায় দিয়েছিল, তাই অন্তর থেকে সে স্পর্শসুখকাতরতা অনুভব করেছিল। সেই কাতরতা অনুভব করেছিল বলেই শোভনার সঙ্গে সে তাঁদের বাড়ির ছাদে যায় নিভৃতে কিছুক্ষণ সময় কাটাতে। সেখানে শোভনার আচরণের মধ্যেও পুরুষালি ভাব প্রকট হয়। লেখক বলছেন –“শোভনা আপনার মধ্যে মল্লিকাকে এনেছে, সোহাগ করে মালা পরিয়ে দিয়েছে, সে মালা তাঁর কণ্ঠে বিলম্বিত, চুম্বনে চুম্বনে শোক ভুলিয়ে দিয়েছে।” গল্পের শেষ অংশে পাঠকরা পাচ্ছেন সেইসব সাহসী কথোপকথন। শোভনা বলছে –“কই তুমি আমায় খেলে না? তুমি আমায় ভালোবাসো না?” “বাসি!” মল্লিকা শোভনাকে বিশেষ অপটুতার সঙ্গে গভীরভাবে চুম্বন করলে—