সাবইন্সপেক্টর একটু থেমে প্রশ্ন করেন, আপনারা অন্য কোথাও না থেকে এই ভাইয়ের কাছে কেন আছেন?
আমার এই ভাই যখন বছরখানেকের, তখন মা খুব অসুস্থ হন। ওকে আমিই খাইয়ে দাইয়ে স্নান করিয়ে দিতাম। ও আমার কাছে ছাড়া কারুর কাছে ঘুমোতেও পারত না।
শীলাদেবী এক নিঃশ্বাসে বলে যান, আমিও যেমন এই ভাইকে ভালোবাসি, এই ভাইও আমাকে প্রায় মায়ের মতোই সম্মান করে, ভালোবাসে।
আপনারাই ভাইয়ের স্ত্রী বলছিলেন, আপনি পেনসনের কিছু টাকা ভাইকে দেন।
আমি পেনসনের পুরো টাকাই ভাইবউকে দিয়ে দিই।
পুরো টাকা মানে কত টাকা?
এখন আমি মাসে মাসে চোদ্দশ পঁয়ত্রিশ টাকা পাই। আগে কম পেতাম।
আপনারা বা আপনার মেয়ের জন্য কিছুই রাখেন না?
আমার স্বামীর গ্র্যাচুইটিপ্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা তো ব্যাঙ্কে জমা আছে। দরকার হলে সেখান থেকে কিছু তুলে নিই।
আপনার মেয়ের পড়াশুনার খরচ?
ওর পড়াশুনার জন্য তো বিশেষ খরচ করতেই হল না। স্কলারশিপের টাকাতেই
আপনার ভাইয়ের কাছে জেনেছি, আপনাব মেয়ে তো ইউ.জি.সি. ফেলোশিপও পেয়েছেন।
হ্যাঁ।
এবার বলুন, আপনার মেয়ে কি কোনো ছেলেকে ভালোবেসে বিয়ে করতে চেয়েছে?
না। ও প্রেমটেম করার মধ্যে নেই।
উনি বিয়ে করবেন না?
করবে না কেন?
আপনারা কি বিয়ের চেষ্টা করেছেন?
শীলাদেবী একটু চুপ করে থাকার পর বলেন, তাহলে আপনাকে খোলাখুলি একটা কথা বলি।
হ্যা বলুন।
আমার ভাইবউয়ের পিসতুতো ভাই দীপু আমার মেয়েকে বিয়ে করার জন্য পাগল। এ ব্যাপারে আমার ভাইবউও খুব উৎসাহী কিন্তু ঐ অশিক্ষিত ভালগার ছেলেটাকে আমার মেয়ে সহ্য করতে পারে না।
এবার সাবইন্সপেক্টর সোজাসুজি প্রশ্ন করেন, ওর হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবার জন্যই কি আপনার মেয়ে এ বাড়ি থেকে চলে গেছেন?
খুব সম্ভব তাই, কিন্তু আমাকে সে কথা বলেনি।
আপনাকে কী বলে গিয়েছেন?
বলেছে, কিছুদিন ঘুরেফিরে বেড়াবে আর তার সঙ্গে সঙ্গে রিসার্চের কাজও করবে। তাছাড়া একটা চাকরিবাকরি জোগাড় করারও চেষ্টা করবে।
উনি মামামামীকে বলে গেলেন না কেন?
ওর মামী আর দীপু কিছুতেই ওকে যেতে দিত না।
আর মামা?
আমার ভাই খুবই শান্তিপ্রিয় মানুষ। ও স্ত্রীর সঙ্গে তর্কঝগড়া করা একেবারেই পছন্দ করে না।
আপনার মেয়ের সঙ্গে টাকাকড়ি আছে তো?
ফেলোশিপের বেশ কয়েক হাজার টাকা ওর কাছে আছে।
আপনার মেয়ের জন্য দুশ্চিন্তা হচ্ছে না?
না। তেমন কিছু না।
কেন?
আমি জানি, আমার মেয়ে কোনো অন্যায় কাজ করবে না।
কিন্তু কোনো বিপদআপদে তো পড়তে পারেন?
বিপদআপদ ঘটার ভয় থাকলে কী মেয়েকে এভাবে লেখাপড়া করাতে পারতাম? বিপদআপদ কী এই কলকাতা শহরে ঘটতে পারে না?
শীলাদেবীর কথা শুনে সাবইন্সপেক্টর ব্যানার্জী একটু খুশির হাসি হেসে বলেন, আপনার মেয়ে কোথায় গিয়েছেন বলে আপনার মনে হয়?
ঠিক বলতে পারব না; তবে আমার ধারণা, ও উদয়পুরে গিয়ে প্রফেসর চ্যাটার্জীর সঙ্গে দেখা করার পর হয়তো রাজস্থানেই ঘুরে ফিরে বেড়াবে।
প্রফেসর চ্যাটার্জীর কাছে কেন যেতে পারেন?
প্রেসিডেন্সিতে প্রফেসর চ্যাটার্জীর কাছে ও পড়েছে। আমার মেয়েকে উনি নিজের মেয়ের মতোই স্নেহ করেন আর আমার মেয়েও ওকে পিতৃতুল্য শ্রদ্ধা করে।
প্রফেসর চ্যাটার্জী এখন উদয়পুরে আছেন?
হ্যাঁ, উনি ওখানে ডীন।
ও!
সাবইন্সপেক্টর ব্যানার্জী মুহূর্তের জন্য একটু ভেবে জিজ্ঞেস করেন, আপনার মেয়ে কী আর কারুর সঙ্গে গিয়েছেন।
না, বাবা, তা বলতে পারব না। মাথার ঘোমটা আবার একটু টেনে নিয়ে বলেন, আমি কোনো ব্যাপারেই মেয়ের কাছে খুব বেশি কিছু জানতে চাই না।
কেন? সাবইন্সপেক্টর একটু অবাক হয়েই জানতে চান।
উনি সঙ্গে সঙ্গে জবাব দেন, যেটুকু আমার জানার প্রয়োজন, তা সে নিজেই জানিয়ে দেয়। এবার একটু থেমে বলেন, হাজার হোক মেয়ে বড় হয়েছে, লেখাপড় শিখেছে; তার ব্যক্তিগত ব্যাপার সম্পর্কে কী আমার খুব বেশি কৌতূহল থাকা উচিত
সাবইন্সপেক্টর কলম বন্ধ করে পকেটে রেখেই কাগজপত্র গুছিয়ে নেবার পর বলেন আপনাকে অনেক কষ্ট দিলাম। মাফ করবেন।
না, বাবা, কী আর কষ্ট! বরং আমার মেয়ের জন্য আপনাকেই কষ্ট করে আসতে হল
এ তো আমাদের দৈনন্দিন কাজ।
সাবইন্সপেক্টর দুহাত জোড় করে নমস্কার করার পর দরজার বাইরে পা দিযে বললেন, আপনার ভাইকে বলবেন, আপনার মেয়ের কয়েকটা ছবি নিয়ে আমার সঙ্গে এক যোগাযোগ করতে।
হ্যাঁ, বলব কিন্তু আমার মেয়ের তো বিশেষ ছবিটবি নেই।
যে ছবি আছে, তাই পাঠাবেন।
***
বিনয়বাবু পরের দিন অফিস থেকে ফেরার পথে থানায় গিয়ে সাবইন্সপেক্টর সুদী ব্যানার্জীর টেবিলের সামনে দাঁড়াতেই উনি জিজ্ঞেস করলেন, ছবি এনেছেন?
বিনয়বাবু সামনের চেয়ারে বসে ব্রীফকে খুলতে খুলতেই বলেন, ইদানীংকালে তে ওর কোনো ছবি তোলা হয় নি, তাই যা ছিল, তাই নিয়ে এসেছি।
কই, দেখি।
বিনয়বাবু ওর হাতে দুটি ছবি দিতেই উনি এক ঝলক দেখেই বলেন, এ ছবি তো অনেক দিন আগের।
হ্যাঁ, ও তখন স্কুলের সেভেনএইটে পড়ে।
এ ছবি দেখে তো ওকে এখন আইডেনটিফাই করা যাবে না।
কিন্তু আমাদের বাড়িতে তো ওর আর কোনো ছবি নেই।
বন্ধুবান্ধব বা আপনাদের সঙ্গে তোলা কোনো গ্রুপ ফটোও নেই?
বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে ছবিটবি তুলেছে কিনা তা তো বলতে পারবো না; তবে আমাদের কাছে ওর কোনো ছবি নেই।
সাবইন্সপেক্টর ব্যানার্জী একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রায় আপনমনেই বলেন, তাহলে তো মুশকিল হলো।