- বইয়ের নামঃ বাঙালী-টোলা
- লেখকের নামঃ নিমাই ভট্টাচার্য
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. টিকিট কালেক্টরের হাতে টিকিট দিয়ে
টিকিট কালেক্টরের হাতে টিকিট দিয়ে সুবোধবাবু এক পা এগুতে না এগুতেই প্রায় শতখানেক রিকশাওয়ালা ওঁকে ছেঁকে ধরল। কেউ কেউ হাত ধরে বলে, আইয়ে বাবুজি, চলিয়ে বাবুজি। কেউ কেউ আবার ওঁর হাতের ছোট সুটকেসটা নিয়ে টানাটানি করতে করতে জিজ্ঞেস করল, কাঁহা যানা সাব?
শুধু ওঁকে না, সব প্যাসেঞ্জারকেই ওরা ঘিরে ধরছে। কী করবে ওরা? এ শহরে কোন রিকশাওয়ালাই দিন-রাত্তির খেটে দশ-বারো টাকার বেশি কামাই করতে পারে না। মালিকের পাওনা মিটিয়ে বিবি-বাচ্চার পেট চালানোই দায়। যা দিনকাল পড়েছে!
সারা দিনরাত্তিরে দশ-বারোটা ট্রেন আসে ঠিকই কিন্তু ভোরবেলার এই গাড়িতেই সব চাইতে বেশি প্যাসেঞ্জারের আসা-যাওয়া হয়। তাইতো এই গাড়ির প্যাসেঞ্জার ধরতে না পারলে রিকশাওয়ালাদের সারা সকালটাই মাটি হয়ে যাবে। কিন্তু এত রিকশার প্যাসেঞ্জার কি আছে?
সুবোধবাবু খানিকটা এগিয়ে শেষ পর্যন্ত একজন বয়স্ক রিকশাওয়ালার কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হলেন। কী করবেন? কতজনের টানাটানি কতক্ষণ সহ্য করা যায়?
শিকার ধরার মহানন্দে রিকশা ওয়ালা এক লাফে সীটে উঠেই একটু পিছন ফিরে জিজ্ঞেস করল, কাঁহা যানা সাব?
বাঙালীটোলা।
ডান পা দিয়ে প্যাডেলে জোরে একটা চাপ দিয়েই আবার প্রশ্ন করে, কিসকা ঘর যানা সাব?
রাজাবাবু কা কোঠি। সুবোধবাবু একটু থেমেই বললেন, উকিল মহেন্দ্রবাবুর বাড়ি। চেনো তো?
ট্রেনের প্যাসেঞ্জার নিয়ে অনেকগুলো রিক্শা এক সঙ্গে বেরিয়েছে বলে রাস্তায় বেশ ভিড়। ক্রীং ক্রীং করে বেল বাজিয়ে, চিৎকার করে এরই মধ্যে সুবোধবাবুর রিকশাওয়ালা একটু এগিয়ে বলে, সব পুরানা বাঙালীবাবুদের কোঠি আমি চিনি। আর রাজাবাবুর ছোট ছেলের কোচোয়ান ছিল তো আমার বড় চাচা।
সুবোধবাবু সিগারেট ধরিয়েই বলেন, তাই নাকি?
আমি নিজেও তো ঝন্টুবাবুর কাছে কাজ করেছি।
আচ্ছা!
আচ্ছা বললেও সুবোধবাবু কিন্তু ঝন্টুবাবুকে চেনেন না। নামও শোনেননি কোনদিন। এই রাজাবাবুর পরিবারের বিষয়ে উনি কোন কিছুই জানেন না। ওঁদের কাউকে চেনেনও না। শুধু মহেন্দ্রবাবুর সঙ্গেই মাত্র মাস কয়েক আগে মেজ মাসীমার ওখানে আলাপ হয়েছে। তাও নেহাতই হঠাৎ।
সুবোধবাবুকে ওঁর মা অনেকদিন ধরেই বলছিলেন, হ্যাঁরে আদু, তুই হরদম হিল্লী-দিল্লী ঘুরছিস আর যাতায়াতের পথে একবার রাচীতে নেমে মেজদিকে একটু দেখতে পারিস না? উনি একটু থেমে বললেন, এই মেজ মাসী কি তোদের জন্য কম করেছে?
সুবোধবাবু একজন প্রবীণ অধ্যাপক। ওঁর বহু ছাত্র নানা জায়গায় ছড়িয়ে রয়েছেন। তাদের অনেকেই সুপ্রতিষ্ঠিত। কেউ কেউ খ্যাতিমানও। তাইতো তাদের অনুরোধে বা চাপে সুবোধবাবুকে নানা কারণে ছুটতে হয় এখানে-ওখানে। প্রায় সারা দেশেই বলা যায় কিন্তু সত্যি রাঁচী যাবার অবকাশ বা সুযোগ হয় না। উনি ওঁর মাকে বললেন, দেখি, যদি সম্ভব হয় সামনের বার নাগপুর থেকে ফেরার সময় টাটায় নেমে রাঁচী ঘুরে আসিব।
ঐ মেজ মাসীর ওখানে গিয়েই হঠাৎ মহেন্দ্রবাবুর সঙ্গে আলাপ। পরিচয় ও ঠিক নয়। একথা-সেকথার পর মেজ মাসী ওঁকে জিজ্ঞেস করলেন, হারে আদু, ছেলের বিয়ে দিবি না?
সুবোধবাবু একটু হেসে বললেন, মা তো নাতির বিয়ে দেবার জন্য পাগল হয়ে উঠেছেন কিন্তু কোন মেয়েকেই মা বা তার নাতির পছন্দ হচ্ছে না।
মেজ মাসী সঙ্গে সঙ্গে মহেন্দ্রবাবুর দিকে তাকিয়ে এক গাল হাসি হেসে বললেন, কি মহিম, ঘটকালী করব নাকি?
মহেন্দ্রবাবু একটু সকৃতজ্ঞ হাসি হেসে বললেন, যদি ওঁরা দয়া করে আমাদের পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক করতে চান
ওঁকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই মেজ মাসী বেশ আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে বলেন, তোদের পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক করা তো ভাগ্যের ব্যাপার। হাজার হোক তোরা রাজা অবলাকান্তের নাতি!
কথাটা শুনে অর্থনীতির যশস্বী অধ্যাপক সুবোধবাবু মুগ্ধ হতে পারেন না। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে এই বিংশ শতাব্দীর গোড়া পর্যন্ত বাংলা-বিহার-উত্তরপ্রদেশে যেসব বাঙালী পরিবার খ্যাতি অর্জন করেছে, তাঁদের কজন উত্তরপুরুষ সেই খ্যাতি, গৌরব অম্লান রাখতে পেরেছেন? তবে উনি মুখে কিছু বললেন না। চুপ করে থাকেন।
পারিবারিক গৌরবের ইঙ্গিত পেয়েও সুবোধবাবুর মধ্যে বিন্দুমাত্র কোন প্রতিক্রিয়া না দেখে মহেন্দ্রবাবু মনে মনে একটু ব্যথা অনুভব করেন। কিন্তু হাজার হোক উকিল তো! মনের ভাব মনের মধ্যেই লুকিয়ে একটু গদ্গদ হয়ে বললেন, আমার কন্যাটিকে যদি দয়া করে ওঁরা পছন্দ করেন…
এবার ও মেজ মাসী মাঝপথে কথা বলেন, তোদের বংশে কি কুচ্ছিত ছেলেমেয়ে জন্মেছে?
এবার সুবোধবাবু মনে মনে সত্যি একটু বিরক্ত হন।
মেজ মাসী বলে যান, তাছাড়া মহিম, তোর মেয়ে তো সাক্ষাৎ রাজকন্যা? ও ছুঁড়ীর মত রূপসী তো চোখে পড়ে না।
এত বাড়াবাড়িতে বোধ হয় মহেন্দ্রবাবুও একটু কুণ্ঠিত না হয়ে পারেন না। বলেন, না, না, পিসী, অত বলবেন না। তবে হ্যাঁ, আমার মেয়েটি মোটামুটি সুন্দরী। দেখলে হয়তো অপছন্দ হবে না।
এতক্ষণ পর বোধ হয় মেজ মাসীর হুঁশ হয়েছে, শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের দিকে একটু বেশী ঝোল টেনেছেন। তাই উনি এবার মহেন্দ্রবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, বুঝলি মহিম, আমার বাবা তো আমাদের কোন বোনকেই আজেবাজে পরিবারে বা পাত্রের হাতে দেননি।