দিন যায়! আম্রপালী এখন তার বিশাল প্রমোদভবনে অন্তরীণ। কেউ তার সন্দর্শনে যেতে পারে না। রাজাদেশে। কারণ আম্রপালী শত্ৰুপুত্রকে গর্ভে ধারণ। করেছে, বিচারে দোষী সাব্যস্ত হয়েছে। তাই স্বগৃহে অন্তরীণ।
তারপর একদিন।
বৈশালীতে এলো গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ। ভগবান বুদ্ধ চলেছেন কুশীনগর : বৈশালীর উপর দিয়ে। এক রাত্রি তিনি বাস করে যাবেন মহানগরীতে। মহাপরিব্রাজক তখন অতি বৃদ্ধ, সঙ্গে আছেন মহা মৌদগল্ল্যায়ন, সারিপুও এবং আনন্দ। লিচ্ছবিরাজ ধন্য হয়ে গেলেন। রাজপ্রাসাদ, সুসজ্জিত করা হল এই আশায় যে, শাক্যসিংহ সপার্ষদ সেখানেই রাত্রিবাস করবেন।
নগরপ্রান্তে আম্রকাননে উন্মুক্ত আকাশের নিচে বিশ্রাম নিচ্ছেন সপার্ষদ তথাগত। সমস্ত নগরীর নরনারী সে-সন্ধ্যায় সমবেত হয়েছে ঐ আম্রকাননে, পরমকারুণিকের দর্শনে। এমনকি–কী দুঃসাহস–সেই জনারণ্যে অবগুণ্ঠনে মুখ আবৃত করে উপস্থিত হয়েছে ঐ পাপিষ্ঠা! কী অপরিসীম দুঃসাহস! কানীন পুত্রটিকেও নিয়ে গেছে সঙ্গে করে।
দীর্ঘসময় অতিবাহিত হলে লোকুত্তমের ধ্যানভঙ্গ হল। জনতার প্রথম সারি থেকে একযোগে দণ্ডায়মান হলেন লিচ্ছবীরাজ মহানাম, নগরশ্রেষ্ঠী এবং গণপ্রধান। সকলেই চাইছেন সপার্ষদ বুদ্ধদেবকে আমন্ত্রণ করতে। কিন্তু তাঁরা কিছু নিবেদন করার পূর্বেই জনতার লক্ষ্য হল–মহাকারুণিকের করুণাঘন দৃষ্টি নিপতিত হয়েছে জনারণ্যের শেষপ্রান্তে এক অন্তেবাসিনীর উপর।
শাক্যসিংহ সহাস্যে বললেন, আম্রপালিকে! বৈশালী নগরীতে অদ্য রাত্রি অতিবাহিত করতে চাই। তোমার সর্বতোভদ্রে আমাদের ভিক্ষু কয়জনের ঠাঁই হবে?
পরিবর্তে সভাস্থলে বজ্রপাত হলেও জনতা এমন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হত না।
‘সর্বতোভদ্র’! সর্বশ্রেষ্ঠ ভদ্রাসন! ঘৃণিত দেহোপজীবিনীর গণিকালয়!
আম্রপালী উঠে দাঁড়াল। কয়েকপদ অগ্রসর হয়ে এল। কী যেন বলতে গেল। পারল না। ঠোঁট দুটি নড়ে উঠল তার। নতজানু হয়ে বসে পড়ল মহামানবের পদপ্রান্তে।
মহাভিক্ষু সারিপুত্ত বললেন, জীবমাতা! ভগবান বুদ্ধ তোমার আতিথ্য ভিক্ষা করেছেন। তুমি তাকে আমন্ত্রণ করবে না?
না! পারবে না! কিছুতেই পারবে না! সেই পতিতালয়ে গণিকা আম্রপালী কেমন করে আহ্বান জানাবে ‘লোকুত্তম’কে? হতভাগিনী তার অনিন্দ্য-আননটি নীরবে নামিয়ে আনে সহস্রদল পদ্মের মতো যুগলচরণে–আযৌবনের অযুত পরুষ-পুরুষস্পর্শের পুরীষ অশ্রুর বন্যায় ধৌত হয়ে গেল।
লিচ্ছবীরাজ ও গণ-এর পরাজয় ঘটল।
সেই ঘৃণিতা দুর্বিনীতা রাজনটী–যে আশ্রয় দিয়েছিল লিচ্ছবীদের চিরশত্রুকে আপন শয়নকক্ষে, যে সেই মহাপাষণ্ডের বীর্যকে দশ মাস গর্ভে ধারণ করে পাপের পশরা পূর্ণ করেছে–সেই কলঙ্কিনীর হল জয়!
ভগবান বুদ্ধ সশিষ্য অতিথি হলেন নটীর প্রমোদভবনে।
পিটককার বলেননি –আহা, কেন বলেননি– সেই অবাক-রাত্রিতে মহাকারুণিক কী উপদেশ দিয়েছিলেন রুদ্ধদ্বার কক্ষে–ঐ হতভাগিনী কানীনপুত্রের জননীকে! বস্তুত আদৌ কোন উপদেশ যে তিনি দিয়েছিলেন তারও উল্লেখ নেই, ইঙ্গিত নেই। বোধকরি সেরাত্রে আম্রপালীর অন্তরে মুক্তির জন্য এমন একটি ঐকান্তিক আকুতি তিনি লক্ষ্য করেছিলেন যার জন্য মৌখিক উপদেশ ছিল বাহুল্য।
১৫. ভবানীপুরের পদ্মপুকুরে
১৫.
রবিবার ছুটির দিন। তবু সকাল সকাল দুটি খেয়ে নিয়ে বেলা দেড়টা নাগাদ বাড়ি থেকে বার হবার জন্য প্রস্তুত হলেন। হাতে ছাতা, কাঁধে ঝোলা ব্যাগ। তার ভিতর স্টীলের সেই ক্যাশবাক্স ছাড়াও ছিল একটা স্ট্যাম্প-প্যাড আর এক খণ্ড কাগজে সেই স্বীকৃতি “পত্রবাহকের নিকট ব্ল্যাকমেলিং বাবদ প্রথম ও শেষ কিস্তি হিসাবে পঁচিশ হাজার টাকা দশ ও বিশ টাকার নোটে বুঝিয়া পাইলাম।” গোটা-গোটা হরফে রসিদটা লিখতে লিখতে প্রফেসর তালুকদারের মনে হয়েছিল, তিনি বোধহয় ব্ল্যাকমেলিঙের ক্রিমিনোলজির ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব নজির সৃষ্টি করে গেলেন : রসিদ নিয়ে ব্ল্যাকমেলিঙের প্রথম ও শেষ কিস্তি মেটানো। নিজের গাড়ি গ্যারেজ থেকে বার করলেন না। সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে, মায় জুতোর ফিতেটা বেঁধে রামুকে বললেন, একটা ট্যাক্সি ডেকে আনতে–ভবানীপুরের পদ্মপুকুরে যাবেন।
ট্যাক্সি এসে দাঁড়াল দরজায়। ডানে-বাঁয়ে দেখে নিয়ে সাবধানী প্রৌঢ় মানুষটি ছাতা বগলে, ব্যাগ কাঁধে ট্যাক্সিতে উঠে বসলেন।
দুপুরের ফাঁকা রাস্তা। গোলপার্ক, সাদার্ন অ্যাভিন, শরৎ বসু রোড ধরে চক্রবেড়িয়ার মোড়ে পৌঁছাতে সময় লাগল বাইশ মিনিট। শরৎ বসু আর চক্রবেড়িয়ার মোড়ে, ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার বিপরীতে ট্যাক্সিটাকে থামালেন। তখন দুটো দশ। এখনো কুড়ি মিনিট সময় হাতে আছে। যথেষ্ট সময়। এটুকু পথ উনি হেঁটেই যেতে চান। ট্যাক্সি-ড্রাইভারটাকেই বা বেহুদ্দো সাক্ষী রাখেন কেন? ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে ছাতাটা খুলে উনি গুটি গুটি জাস্টিস্ চন্দ্রমাধব রোড ধরে পশ্চিমমুখো চলতে থাকেন। কাঁধে ব্যাগ।
পথ এই মধ্যদিনে প্রায় নির্জন। দু-একটা গাড়ি যাচ্ছে হুস-হাস করে। রিকশার ঠুন-ঠুন। বাঁ-দিকে গুজরাতিদের একটা মেটার্নিটি হোম। তার পাশেই এক ভাজিওয়ালার দোকান। বিপরীত ফুটপাতে ‘দক্ষিণাকালী মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’। ঘড়িটা দেখলেন আবার : দুটো কুড়ি। এখনো দশ মিনিট বাকি।