–কী হল? জবাব দিলেন না যে? আপনি লাইনে আছেন তো?
বৃদ্ধ গম্ভীরভাবে বললেন, আছি। মন খুলে তোমাকে একটা কথা বলতে চাই, মস্তান। হয়তো তুমি আমার ছেলের বয়সী। তাই কথাটা না বলে থাকতে পারছি না। তুমি আমাকে এই নোংরা কাজটা করতে বাধ্য কর না, মস্তান। এতে তোমার ভাল হবে না!
টেলিফোনে ভেসে এল উদ্ধত যুবকের অট্টহাস্য। বললে, ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমার নরকযন্ত্রণার কথা আপনাকে ভাবতে হবে না। আপনি শুধু নিজের ভালমন্দর কথা চিন্তা করুন। আপনাকে বরং একটা শেষ কথা বলে নিই, স্যার;
পুলিসে খবর দিলে কিন্তু খেল খতম! কলেজে কেমিস্ট্রি লেকচার থিয়েটার ক্লাসের মধ্যেই আপনার লাশ ফেলে দেব। আমার সঙ্গে বেইমানি করে কেউ কখনো পার পায়নি, স্যার। তিনটে ডাকাতি, পাঁচটা রেপ-কেস আর দু-দুটো খুনের মামলা আমার মাথায় ঝুলছে, বুয়েছেন? তার ভিতর একটা আবার পুলিস–এক শালা পুলিস। কেদ্দানি দেখাতে গিয়ে আনফরচুনেটলি আমার গুলিতেই ফৌত হয়েছিল। তবু দেখুন, আমি জামিনে ছাড়া! পুলিস আজও কোনও ‘আই-উইটনেস্’ যোগাড় করতে পারেনি। পারবে কোথা থেকে? সাক্ষী দিতে রাজি হলেই সে শালা হাফিজ! তাই পুলিস ডিপার্টমেন্টে আমি-শালা অচ্ছুৎ! বুয়েছেন?
বৃদ্ধ অধ্যাপক গম্ভীর হয়ে বললেন, তুমি কি আমাকে ভয় দেখাতে চাইছ মস্তান?
–আজ্ঞে না! কলেজে আপনার খুব সুনাম শুনি কিনা। সবাই বলে আর. কে. টি. খুব সৎ আর প্রচণ্ড সাহসী। তাঁর নাকি দারুণ বুদ্ধি! তাই আপনাকে একটু সাবধান করে দিচ্ছি, এই আর কি। ও-সব থানা-পুলিসের ন্যাকড়াবাজিতে যাবেন না। জানে মারা যাবেন? আর যদি ‘পোলিটিকাল দাদা-টাদা’ থাকেন–ঐ যাঁরা হাতে মাথা কেটে থাকেন, তাঁদের কাছেও নয়। জানেনই তো, পাঁচটি বছর হাতে মাথা কাটার পর ওঁরা ভিক্ষাপাত্র হাতে পথে নামেন–দেশসেবা করবার আর্জি নিয়ে –আপনার ভোটটা আমাকে কাইভলি দেবেন, স্যার?’ সেই দেশসেবকদের টিকি বাঁধা থাকে আমাদের কাছে।
নিঃশব্দে রিসিভারে টেলিফোনটা নামিয়ে রাখলেন।
বুঝতে পারেন : ও মিথ্যে ভয় দেখাচ্ছে না। মৃত্যু ওকে টানছে! তাই সগর্বে ও ঘোষণা করেছে ওর কীর্তিকাহিনী! এটাই এখন স্বাধীন ভারতবর্ষের ট্র্যাজেডি।
ইংরেজের অপশাসনের হাত থেকে দেশটাকে স্বাধীন করতে যারা প্রাণপাত করেছিলেন, কালের ধর্মে তাঁরা ধীরে ধীরে অপসৃত হচ্ছেন ইতিহাসের নেপথ্যে। এখন এগিয়ে আসছে আর এক জাতের অপশাসক। স্বার্থান্ধ, স্বজনপোষক, মিথ্যাচারী! দেশশাসনের নামে দেশশোষণ করতে তারা হিটলারী পদ্ধতিতে পোষে নিজ নিজ দলের গেস্টাপো বাহিনী : গুণ্ডা, মস্তান, মাসম্যান, প্রফেশনাল খুনী! পলিটিকস্ আজকের দিনে সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা। শ্রদ্ধায় মাথা নোয়াতে ইচ্ছে করে এমন দেশসেবক আজও ক্কচিৎ দেখা যায়–তাঁরা অব্যতিক্রম দেশের নির্বাচনে প্রার্থী হন না। হয় গান্ধীবাদী, নয় সুভাষবাদী অথবা অগ্নিযুগের শেষ অবশেষ। তারা ক্লান্ত! তাঁরা বিভ্রান্ত। তাঁরা খবরের কাগজও পড়েন না। ভোট দিতেও যান না। কাকে দেবেন?
দেশের ভালমন্দ নির্ধারণ করেন, দেশশাসন তথা দেশশোষণ করেন, আপনার আমার নির্বাচিত প্রতিনিধির দল।
পাছে আমরা নির্বাচনে ভুল করে বসি, তাই দেশসেবক জনপ্রতিনিধিরা নানান ব্যবস্থা করে রেখেছেন। শাসকদলের মতাদর্শের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললে ওঁরা সে কণ্ঠকে নীরব করিয়ে দেন। লেলিয়ে দেন পোষা গুণ্ডা। গৌরবে তাদের বলা হয়– পার্টি ক্যাডার।
দিল্লী শহরের পথে-ঘাটে নাটক করে বেড়াতে একটি প্রাণবন্ত তরুণ। সস্ত্রীক। মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়স তার। জন্মসূত্রে মুসলমান। মুশকিল এই : আহাম্মকটা সাম্যবাদী। বোঝ বখেড়া। কী দরকার তোর এই চূড়ান্ত অ-সাম্যের দেশে সাম্যবাদ নিয়ে আমড়াগাছি করার? মিলমালিক কী-কায়দায় মজদুরকে শোষণ করে, বড় জোতদার কীভাবে বর্গাদারকে ভূমিহীন মজুর চাষীতে রূপান্তরিত করে, ডাইনাস্টিক রুলে দেশশাসক কীভাবে দেশশোষক হয়ে যায়, তা নেচে-কুঁদে দেখালে কি তোর চারটে হাত গজাবে? পার্টি-মস্তান গোপনে হুমকি দিলেন : ‘বন্ধ কর য়্যে নটুঙ্গীখেল’! মূর্খটা শুনলো না। পড়িলিখি ইনসান! ‘Right to Perform’ নামে একখানা কিতাব লিখেছে অংরেজিতে-–পড়ে দেখ–কী দারুণ বিদ্যে! পোষ মানলে বকরি নোকরি-ছুকরি সবই পার্টি থেকে দেওয়া হতো। লেকিন, শুনল না। অগত্যা! একদিন পথ-নাটকের মাঝখানে ট্রাকে চেপে হামলা করল গেস্টাপো বাহিনী। ঝাঁপিয়ে পড়ল নাটকের কুশীলবদের উপর। ওর ঔরৎটা জানে বেঁচে গেল, ও জান বাঁচাতে সেকলো না! ক্যা আপসোস্ কি বাত! শত শত দর্শকের সামনে লুটিয়ে পড়ল নাট্যকার! কলিজার খুনে ভেসে গেল দিল্লীর রাজপথ!
আদালতে মামলা উঠল! পার্টি-পেপার ব্যতীত সমগ্র ভারতের সংবাদপত্র এই নৃশংস বর্বর হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ জানালো। মায়, সারা-ভারত টি. ভি. স্ক্রীনে দেখল চলচ্চিত্র উৎসবে শাবানা আজমি প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠল–শাসকদলের বেইজ্জতির চূড়ান্ত। এমনকি দেশের প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত প্রকাশ্যে স্টেটমেন্ট দিলেন, ‘হামে কদম উঠানা চাহিয়ে কি য়্যে গুণ্ডোলোগোঁ কি বদমাসি বন্ধ কিয়া যায়…’
‘কদম’ কতটা উঠেছিল প্রফেসর তালুকদার জানেন না, তবে ‘কর্দম’ উঠেছিল। অনেকটাই। আদালতে যখন মামলা উঠল তখন সহস্র দর্শকের ভিতর একটিও প্রতক্ষ্যদর্শীকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।